ইগো

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২১, ২০১৯

পহেলা বৈশাখ, নব্বই দশকের পহেলা বৈশাখ। তখনও মানুষের চলা কথাবলা চিন্তা চেতনা সব চলতো আরও ধীর গতিতে। মানুষ মন দিয়ে গান শুনতো, ক্যাসেট কিনতো, টিভিতে সাপ্তাহিক নাটক কিংবা ঈদের আনন্দমেলা দেখার জন্য ঈদের দিন-রাত আটটার পরে আর বের হতো না। জীবন কিছুটা স্লথ গতির ছিল। এত প্রতিযোগিতা তখন ছিল না।

নাহার ফেরদৌস, মগবাজার স্কুলে পড়ান, বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। জীবন সম্পর্কে সুন্দর একটা বোধ আছে ওনার, খুব পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি। ঘর সাজানোর বাতিক আজোবধি যায় নাই তাই যেখানে যা পান, এনে ঘরে সাজিয়ে রাখেন। গতকাল গিয়েছিলেন বৈশাখী মেলাতে, হাইকোর্টের সামনে অর্থাৎ কার্জন হলের সামনে ফুটপাতে এক পশরা বসে মাটির বানানো জিনিসপত্রের। ওনার একটা ফুলদানি খুব পছন্দ হয়ে যায় কিন্তু অনেক কিছু কেনার পর আর পয়সা ছিল না বিধায় কেনা হয় নাই। সেকারণেই আজ পহেলা বৈশাখে ওখানে আবার যাওয়ার প্ল্যান করেন। বিকেলের দিকে রওনা দেন যাতে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ফিরতে পারেন।

নাহার ফেরদৌস থাকেন দয়াগঞ্জ পুলের কাছে। বাসা থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নেন। রিক্সা কার্জন হল পর্যন্ত যেতে বেশ লম্বা একটা সময় লাগিয়ে দেয়, বাসে যেতে হলে অনেক ঝক্কি, বাস নিয়ে প্রথমে গুলিস্থান যেতে হবে, তারপর আরেকটা বাসে হাইকোর্ট। বিকেলের মৃদুমন্দ বাতাসে নাহার ফেরদৌসের রিক্সাওয়ালা ধীর গতিতে রিক্সা টানতে থাকে, বেচারা বুড়া মানুষ তাই টানতে কষ্ট হয়। তবু পেট বুড়া মানে না, ক্ষুধা লাগতেই থাকে এবং রিক্সা চালাতেই হয়।

বিকেল থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু ঝুম বৃষ্টিটা নামছে না। মেঘ দেখে মনে হচ্ছে, এখনি যেন সব অভিমানের বাধ ভেঙে কেঁদে উঠবে আকাশ। রিক্সাওয়ালা হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির কাছে এসে পাশের ফুটপাথে রিক্সা থামায়, নাহার ফেরদৌসকে নামতে বলে রিক্সা থেকে, নাহার নেমে দাঁড়ান। রিক্সাওয়ালা সিটটা উঠিয়ে পরদা বের করে এবং সিটটা আবার আগের জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে নাহার ফেরদৌসের হাতে পরদাটা দিয়ে আবার রিক্সায় উঠতে বলে। নাহার উঠে বসেন, গায়ের ওপর আলতো করে পর্দাটা দিয়ে দেন, রিক্সা আবার স্লথ গতিতে চলতে থাকে। খুব হালকা টিপটিপ দু’এক ফোঁটা পড়ে, যার জন্য পর্দার দরকার নাই তবুও সাবধানের মাইর নাই বলেই রিক্সাওয়ালা বের করে দেয় পর্দাটা। রিক্সা অভিসারের সামনে দিয়ে ইত্তেফাকের মোড়ে গিয়ে বাঁয়ে ঘুরে গণভবনকে ডানে রেখে গুলিস্থানের সামনে দিয়ে সেক্রেটারিয়েটকে হাতের ডানে রেখে চালিয়ে যেতে থাকে এবং একসময় পৌঁছে যায় কার্জন হলের সামনে। নাহার ফেরদৌস ভাড়া চুকিয়ে রাস্তার ওপারে হাইকোর্টের ফুটপাতে বসা সেই দোকানটায় যান যেখানে দেখেছিলেন ফুলদানিটা। কিনে ফেলেন ফুলদানিটা, বিশ টাকা নেয় দাম। নাহার ফেরদৌস আরেকটু ঘোরাফেরা করেন ওখানে। এরই মধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, মেঘ আরও প্রবল শব্দে গর্জন শুরু করে দেয়। উনি আর দেরি না করে মনে মনে ভাবেন বেবিট্যাক্সিতে ফেরার কথা। যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে এবং বৃষ্টি এলো বলে। রিক্সায় গেলে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাই বেবিট্যাক্সিটা সেফ বেশি।

দাঁড়িয়ে থাকেন বেবিট্যাক্সির আশায় কিন্তু এই সাঝবেলায় বৃষ্টি আসার আগমুহূর্তে বেবি পাওয়া খুব ঝামেলা। আর পেলেও কেউ যেতে চায় না দয়াগঞ্জ। বেবিওয়ালাদের যুক্তি, ওদিকে গেলে ফেরার সময় খ্যাপ পাওয়া যায় না। যাই হোক, অনেক চেষ্টার পর একটা বেবি পাওয়া গেল। এই বেবিটা অবশ্য ঠিক ওনার সামনে এসেই দাঁড়ালো, ডাকতে হলো না। নাহার ফেরদৌস জিজ্ঞাসা করলেন, এই বেবি, যাবা দয়াগঞ্জ?

দশাসই বেবিট্যাক্সি ড্রাইভার, মোটাসোটা, গাত্রবর্ণ কালো এবং মুখে বসন্তের দাগ, খুব রাশভারি। মুখে কোনো কথা না বলে ইশারায় উঠতে বললো। নাহার ফেরদৌস হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যাই হোক, আর কোনো ভয় নাই বৃষ্টি যতই আসুক। নাহার ফেরদৌস উঠে বসলেন বেবিট্যাক্সিতে। রাশভারি বেবিট্যাক্সিওয়ালা ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে পিছনের ওঠার জায়গার গুটানো ফিতাওয়ালা পরদা দুটো নামিয়ে দুই সাইডে ফিতা টাইট করে বেঁধে দেয় এবং সামনে নিজের ড্রাইভিং শীতে গিয়ে বসে। হাইকোর্ট থেকে রওনা দিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে সেগুনবাগিচার কাছে আসতেই শুরু হয়ে যায় ঝুম বৃষ্টি, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বজ্র নিনাদ জানান দিয়ে দেয় চরম অভিমানের কথা এবং সঙ্গে নেমে আসে পুঞ্জিভূত অভিমানের অশ্রুধারা। বেবিট্যাক্সিওয়ালা ধীরে ধীরে চালাতে থাকে, বৃষ্টির তোড়ে সামনের কিছুই দেখা যায় না। বেবিওয়ালা বারবার ম্যানুয়াল ওয়াইপার হাত দিয়ে ঘুরাতে থাকে বৃষ্টি সরানোর জন্য। তখনও মটরচালিত ওয়াইপারওয়ালা বেবিট্যাক্সির আমদানি হয় নাই। তখনকার বেবিট্যাক্সিগুলির পটপট করে ভীষণ শব্দও হতো চলার সময়।

বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে সমস্ত ধরা। রাস্তাঘাটে একটা কাকপক্ষীর দেখাও মেলে না। বৃষ্টির আভাসে সবাই আগেভাগে বাসা ফিরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে চুলায় চড়ানো খিচুড়ি এবং তার সাথে সরিষার তেল দিয়ে পেঁয়াজ মরিচ মাখানো ভর্তা দিয়ে রাতের খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে। রাস্তায় রিক্সাও দেখা যায় না। এত বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যে রিক্সাও চলতে চায় না বিধায় রিক্সাওয়ালা রাস্তার পাশে রিক্সা রেখে ভেজা কাকের মতো দোকানের রকে কিংবা কারো বাড়ির দরজার বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে বৃষ্টি কমার আশায়। নাহার ফেরদৌসের বেবিট্যাক্সি গুলিস্থান হল পেরিয়ে বাঁয়ে গিয়ে বিক্রমপুর হাউজের সামনে দিয়ে গিয়ে ইত্তেফাকের মোড়ে ডানে ঘুরে অভিসারের সামনে দিয়ে যেতে থাকে। দয়াগঞ্জ যেতে হলে স্বামীবাগের মোড়কে বাঁয়ে রেখে রাস্তার ওপার দিয়ে ডানে ঘুরে ভিতরে ঢুকতে হয়, ওটাও স্বামীবাগ রোড। ওখান দিয়ে ঢুকে দয়াগঞ্জের পুলের কাছে যাওয়া যায় এবং ওটা শটকাট। বেবিট্যাক্সিওয়ালা স্বামীবাগের কাছে এসে ডানে না ঘুরে বাঁয়ে মিতালি স্কুলের গলিতে ঢুকে যায়। নাহার ফেরদৌস বিষয়টা খেয়াল করে বলে ওঠেন, এই বেবিট্যাক্সিওয়ালা, এদিকে কোন দিকে যাও? যাবাতো তুমি ডানে।

বেবিট্যাক্সিওয়ালা কোনো কথা বলেনা, চালিয়ে যেতে থাকে। আবার নাহার ফেরদৌস বলে ওঠেন, কি কানে শোনো না? তুমিতো যাবা ডানে, বাঁয়ে ঢুকলা কেন?

বেবিট্যাক্সিওয়ালা কোনো কথা না বলে চালিয়ে যেতে থাকে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বৃষ্টির কারণে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়েছে। ঝম ঝম করে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর কোথাও বাজ পড়ার আওয়াজ। স্বামীবাগের গলিটা জনশূন্য, কেউ নাই রাস্তায়। পাড়ার দোকানটাও বন্ধ করে মুদিওয়ালা ঘুমে কাতর। রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে একটা বেবিট্যাক্সির পিছনের সিটে নাহার ফেরদৌস আর সামনে দশাসই বেবিট্যাঁক্সিওয়ালা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। ট্যাক্সিওয়ালা মিতালি স্কুলকে বাঁয়ে রেখে সোজা চলে যায় গলির শেষ মাথায়। এরই মধ্যে নাহার ফেরদৌস চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু এত বৃষ্টি, বজ্রপাত আর বেবিট্যাক্সির আওয়াজে ওনার গলার আওয়াজ বেবিট্যাক্সি থেকে বের হয়ে কোথাও যাচ্ছে না। ওনার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, উনি ইচ্ছামতো গালাগালি শুরু করে দিয়েছেন, বেবিওয়ালার তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নাই। ওই গলিটার ওদিকে আর কোনো পথ নাই বের হওয়ার, যাকে বলে কিনা কানাগলি। ওদিকটায় দুইচারটা একতলা টিনচালা পাকা বাড়ি আছে। গলিটা ক্রমেই সরু হয়ে গিয়েছে গলির শেষের দিকে। একেবারে শেষ মাথায় সামনে একটা দেয়াল এবং আর কোনো বাসা নাই ওখানে। বেবিট্যাক্সিওয়ালা এসে ঠিক ঐখানটায় বেবিটা স্টার্ট দেয়া অবস্থায় গিয়ার নিউট্রালে রেখে দাড় করায় এবং বিদ্যুৎ গতিতে পিছনের পর্দার ফিতা খুলে উঠে পড়ে পিছনের সিটে। উঠে ও আর দেরি করে না, জড়িয়ে ধরে নাহার ফেরদৌসকে এবং যত্রতত্র হাত চালাতে থাকে। নাহার ফেরদৌস সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে থাকেন কিন্তু কোনো লাভ হয় না। বেবিট্যাক্সিওয়ালা আরও মরিয়া হয়ে উঠে, নাহার ফেরদৌস চড়থাপ্পড় যা পারেন, দিতে থাকেন। একপর্যায়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে আরও হিংস্র হতে দেখে ঘাবড়ে যান এবং লাথি দিয়ে ওনার ডান পাশের পর্দাটা ছিঁড়ে ফেলেন এবং সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে হাতের ফুলদানিটা দিয়ে ওর গায়ে একটা বাড়ি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে যান প্রচণ্ড বৃষ্টিভেজা কাদা আর পানিভরা চপচপে রাস্তায়। উনি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকেন কিন্তু কেউ শুনতে পায় না ওনার আর্তনাদ। কোনো রকমে উঠে পিছনের দিকে দৌড় দেন কোনো একটা বাসার জালনা খেয়াল করার জন্য। সামনে একটা একতলা বাসা পড়ে, উনি ওনার হাতের ফুলদানিটা দিয়ে একটা বাড়ি দেন কাচের জানালায়, কাচ ভেঙে যায়। বাড়ির ভিতর থেকে লোকজন চিৎকার করে ওঠা এবং বেরিয়ে আসে বাইরে। উনি চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন এবং সমস্ত বিষয়টা ওদের জানান। ওদিকে ঠিক একশো গজ দূরে দুঃসাহসী ট্যাক্সিওয়ালা ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে ওই বাসার সামনে আসে এবং ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়ায় ওই বৃষ্টির মধ্যে। লোকজন এগিয়ে যায় ওকে ধরার জন্য। ও চিৎকার করে উঠে, ইনি আমারে এইদিকে সেইদিকে ঘুরাইয়া এই গলিতে আইনা পয়সা না দিয়া ভাগনের তাল করতেছিল।  আমি প্রতিবাদ করছি দেইখা উনি আমারেও ঝাড়ি লইতেছিল। এখন আবার লোক ডাইকা চাপা মারতেছে আর আপানারা আমারে ঝাড়ি মারতেছেন। ওর কথাবার্তা আর সাহস দেখে নাহার ফেরদৌস একেবারে থ হয়ে যান। ওই লোকগুলি আরও কিছু প্রশ্ন করার জন্য ওকে বেবিট্যাক্সি বন্ধ করতে বলে। ও কোনো কথা না বলে হঠাৎ করে বেবিতে উঠে জোরে টান দিয়ে চলে যায়, সবাই ধর ধর করে চিৎকার ওঠে কিন্তু ওই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আওয়াজ বেশি দূর যায় না। ওই বাসার মহিলা এসে নাহার ফেরদৌসকে বাসার ভিতরে নিয়ে যান। নাহার ফেরদৌস ভয়ে লজ্জায় অপমানে থর থর করে কাঁপতে থাকে, মুখ দিয়ে একটাও টু শব্দও করতে পারে না।

অন্ধকার স্বামীবাগের রাস্তা ধুয়ে যেতে থাকে বৃষ্টি ধারায়। নাহার ফেরদৌসের মন ভিজে যায় অপমানের ঘেন্নায়। ওনার শুধু একটাই কথা বারবার মনে আসে, এই বয়সে এধরনের অপমান মনের কোন জায়গাটায় গিয়ে লাগে, তা কাউকে বলা যায় না। অনেক বয়স হয়েছে নাহার ফেরদৌসের। আজও মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই পহেলা বৈশাখ আর সেই বেবিট্যাক্সিওয়ালা। বীভৎস স্মৃতিটা এখনও ওনাকে কুরে কুরে খায়, এখনও মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ঐ শয়তানটাকে জবাই করে ফেলতে। কিছু মানুষের জীবনে এধরনের কিছু শয়তানের দেখা মেলে যেগুলি সে কোনোদিনও কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারে না, একা একা মনের কোনায় ডুকরে ডুকরে কেদে ফিরতে থাকে অসহ্য স্মৃতিটা।