আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন ও দূরভিসন্ধিমূলক তৎপরতা
কাজী নাসির মামুনপ্রকাশিত : আগস্ট ২৬, ২০২৪
অমুসলিমদের বন্ধু হিসেবে নেওয়া যাবে কিনা, এ বিষয়ে আহমাদুল্লাহ হুজুরের একটা বয়ান কেউ কেউ শেয়ার দিচ্ছেন। আমরা জানি, আহমাদুল্লাহ সাহেবের নেতৃত্বেই আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণে এই প্রতিষ্ঠানের অভূতপূর্ব সাফল্যও জনমানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। এসময়ে ওই ভিডিওটি যারা সামনে আনছেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এখন কথা হলো, শরিয়াহ`র প্রসঙ্গ আসলে তো আহমাদুল্লাহ সাহেবকে ধর্মীয় সত্যই বলতে হবে। ধর্মের অনেক বিষয়ই আছে যা স্যাকুলার আইডিওলজি দ্বারা বিবেচনা করা যাবে না। অন্যান্য ধর্মেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের যবন, ম্লেচ্ছ বা এমন কিছু বলার প্রমাণ বা নির্দেশনা আছে।
কিন্তু সেটা কেবলি ধর্মীয় প্রেক্ষাপট। ওসব থাকা সত্ত্বেও সমাজে মানুষ পরস্পর মিলেমিশে আছে। এবং এটাই সভ্যতা। নইলে স্বভাবতই মূর্তিপূজা ইসলামে শিরক হিসেবে বিবেচিত। আর শিরক হচ্ছে মহাপাপ। ধর্মীয়ভাবে দেখলে যে-শিরক করছে এবং যে করছে না, তাদের মধ্যে আন্তরিক বন্ধুত্ব তো হবারই কথা নয়। এটা হচ্ছে ধর্মীয় আইডিওলজির বেলায়। সমাজতন্ত্রেও তো পূঁজিপতিদের শ্রেণিশত্রু হিসেবে দেখে। এই শত্রুতা ধর্মীয় না হলেও আইডিওলজিক্যাল তো বটেই। ফলে শ্রেণিশত্রুর সঙ্গে আন্তরিক বন্ধুত্ব হবে না, এরকমই তো সমাজতন্ত্রীরা বলবেন। আমি যেটা বলতে চাইতেছি, আইডিওলজির কোর জায়গায় বন্ধু ও শত্রুর এই বয়ান-বৈপরীত্ব সমাজে এগজিস্ট করে। তবে মনে রাখতে হবে, কোর আইডিওলজির ব্যাপারগুলো মূলত textual এবং টেক্সটের আক্ষরিকতা সমাজ বাস্তবতার নিরিখে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দাবি করে এবং সেভাবেই সমাজের সঙ্গে খাপ খায়। তাই কোনো রাষ্ট্রের সারফেস লেভেলে একটা বিপরীত-ঐক্য বজায় থাকে। ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ ও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সেই বিপরীত-ঐক্যের মধ্যেই নির্বিরোধ সামাজিক চর্চায় অভ্যস্ত হয়। ওইটাই রাষ্ট্রের প্রাণ। রাষ্ট্র মূলত ওইটা দিয়াই চলে। আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশনে মন্দির কর্তৃপক্ষ যে-টাকা দান করছেন সেটা সেই ঐক্যের ফলাফল। আবার মসজিদে যে বন্যা-কবলিত সনাতনধর্মীরা আশ্রয় নিয়েছেন সেটাও রাষ্ট্রের মানবিক ঐক্যের সাক্ষ্য দেয়।
আহমাদুল্লাহ হুজুরের ভিডিওটি আরও আগের। তার বয়ান নিয়ে কারো কারো মনে বিতর্কের উদ্রেক হতেই পারে। কিন্তু সেটার জন্য আলাদা একটা পরিসর প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। একটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে কে কাকে কতটা আন্তরিক বন্ধু হিসেবে নেবেন, সেটার মধ্যেও একটা ইনসাফ কায়েম থাকা দরকার। আন্তরিক বন্ধুত্বের বেইজ হিসেবে যেমন ইনসাফ প্রয়োজন আবার ইনসাফ কায়েমের স্বার্থে প্রয়োজন হলো রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা। আহমাদুল্লাহ হুজুর যে সময়ে এই ভিডিও করেছেন তখন নিরেট ধর্মীয় জায়গা থেকে আক্ষরিক বয়ান হাজির করেছেন। এতসব বিবেচনা করেননি। কিন্তু এটাকে ইস্যু করে তর্কে লিপ্ত হলে বিরোধ তৈরি করা ছাড়া অন্য কোনো ফায়দা হাসিল হবে না। তর্কটা অন্য সময়ে হোক।
মোদ্দা কথা হলো, কোর ধর্মীয় জায়গা থেকে আহমাদুল্লাহ সাহেব ভিডিওতে যা বলেছেন সেটাকে সামনে এনে কেউ কেউ আমাদের রাষ্ট্রের মানবিক ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছেন। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সেটা অনুচিত। যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দিকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে আমরা আশাবাদী হয়ে উঠছি, সেখানে রাহুগ্রাস নিয়ে আগাবেন না, প্লিজ। আহমাদুল্লাহ সাহেবের নেতৃত্বে আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন অলাভজনক সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চরম জনপ্রিয়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বন্যাদুর্গতদের ত্রাণ সংগ্রহে একদিনেই ১৫/২০ কোটি টাকার রেকর্ড অসামান্য ব্যাপার বলেই মনে হয়। এর কারণ হলো, গণমানুষের আস্থা, ত্রাণ বিতরণে তাদের চমৎকার সুব্যবস্থাপনা, নিঃস্বার্থ ও উদার জনবল এবং সর্বোপরি সেবার মাধ্যমে পরকালীন মুক্তির প্রবল আকাঙ্ক্ষা। কাজেই আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশনের এই সাফল্যকে একটা ভিডিওর মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ না করে একে ওন করতে শিখুন।
যদিও `প্রথম আলো` আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশনের এই সাফল্যকে চেপে গেছে, ধিকৃত হয়েছে সেজন্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, `আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন` সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এরই মধ্যেই তাদের সততা ও স্বচ্ছতার প্রমাণ দিয়ে জনমানুষের ভালোবাসায় পৌঁছে গেছে। এটি এখন সবার প্রতিষ্ঠান। কাজেই আহমাদুল্লাহ হুজুরের ধর্মীয় বয়ান সামনে এনে এই প্রতিষ্ঠানের সেবাদান প্রক্রিয়ার যেমন ক্ষতি করা যাবে না, তেমনি `প্রথম আলো` বা এরকম কোনো পত্রিকা এই সেবা প্রতিষ্ঠানের খবর না দিলেও কিছু আসে যাবে না। মানুষের ভালোবাসাই টিকিয়ে রাখবে আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশনকে।
এই বন্যাকবলিত সময়ে আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশনকে তাদের কাজ করতে দিন। দূরভিসন্ধিমূলক তৎপরতা না দেখিয়ে আসুন সবাই মানুষের পাশে দাঁড়াই। সাম্প্রদায়িক বিভেদ ঠেকিয়ে দেই।
লেখক: কবি