আশিক আকবরের গল্পিকা
প্রকাশিত : অক্টোবর ১৮, ২০১৯
এক.
সে ভাবিলো তাহার হৈয়া গিয়াছে। বুকের ভিতর হাত দিয়া সে হৃপিণ্ডটা বাহির করিয়া আনিলো। এবং কচকচ করিয়া চিবাইয়া খাইতে লাগিলো।
একটু দূরে বসিয়া মেয়েটি অঝোর ধারায় কাঁদিতে ছিল। সে যুবকটিকে ভালোবাসিত। তখনও পৃথিবীতে শ্রেণি বৈষম্য বিরাজিত ছিল। এইসব ঘটনা তখন অহরহই ঘটিত।
দুই.
পাখির মাংস খাবার তার ইচ্ছা হইছিল। বন্দুক নিয়া ঘুইরা ফিইরা যখন পাখি মিললো না, দুই একটা ঠুস ঠাসও যখন ব্যর্থ হইলো, তখন সে নিজের ভিতরের পাখিটাকে বের করে গুলি করে দিলো। আমরা যখন তাকে কবর দিয়ে ফিরে আসছিলাম, তখন দেখলাম তার বালক ছেলেটি কাঁদছে। আর তার ভেতরে পাখির মাংস খাওয়া লোকটার পাখি হাসছে। তার রঙ মোলায়েম হলুদ। আমরা লোকটার হলুদ পাখিটাকে দেখতে পেয়ে ছিলাম। নিজেদের পাখিকে দেখতে পাইনি। তখন দুই চোখে অনেক কিছুই দেখা যেত না।
তিন.
পৃথিবীর সর্বশেষ জন নামের মানুষটির দরজায় কে যেন নক করল! জন কেঁপে উঠে বললো, কে?
দরজার ওপাশ থেকে উত্তর এলো, আমি জন স্টুয়াল মিল।
নিজেকে দেখবার জন্য মৃদু হেসে জন রিমোট টিপলো। দরজাটি খুলে গেল। খোলা দরজার সামনে দাঁড়ানো দেখা গেল হাস্যরত একজনকে। যার নাম ফ্রেডরিক ব্রাউন।
চার.
সে তখনো বসে ছিল। মেয়েটি আসেনি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় হয়। বুকল ফুলের মালা নিয়া কন্যাশিশুটি ঘ্যানঘ্যান করছিল।
ন্যান ভাই, একটা ন্যান।
ন্যান স্যার, একটা ন্যান।
ছয়-সাত বছরের ফুটপাতিনী হঠাৎ আলতো করে তার গা ঘেঁষে দিল ছেলেটির গাতে। চমকে উঠলো প্রেমিকা না আসার বিচ্ছেদে থাকা প্রেমিক পুরুষটি। এ কিসের নতুন ঘোর তার শরীরে। বকুল বেচনি ওয়ালিনীর স্পর্শে। সে তাকালো, লাল হাফ প্যান্ট, ফিতা বাঁধা। খালি গা। ঝাকড়া চুল। বুকের মাছিতে উড়ার কোনো আভাসই নেই। গালে ঠোঁটে পায়ে ময়লার আস্তরণ। চোখে মুখে সব বোঝার ইঙ্গিত। আবার চমকালো সে। চারপাশে ব্যস্ত শহর। পার্কে উপচানো ভিড়।
কি করি,
কি করি,
ভাবলো সে।
নিবেন না, নিবেন না? ন্যান, ন্যান।
বলছে মেয়েটি। তার হাতের মধ্যে বকুল ফুলের মালা গুলা দুলছে ফাঁসের মতো। মুখে তার সব জানা, সব দেয়া হাসি।
শিউরে উঠলো প্রেমিক পোলাটি। প্রেমিকা আসেনি তার । কিন্তু সে বুঝলো নিজের মধ্যে অন্য এক উত্থান। ঝট্ করে পকেটে হাত দিয়া সবগুলা মালা নিলো ছেলেটি। হাতের ভেতর কাঁপন তার। শিশুকন্যার মাতা নত। চোখ মাটিতে। যেন বা সে আর পৃথিবীর কাউকে দেখাতে চায় না তার লজ্জাবৃত মুখ।
পাপ। পাপ।
ততোক্ষণে বাজলো প্রেমিকার কল। কল না রিসিভ করে, সে একটা গাছের গোড়ালিতে যেয়ে, অমানবিক দৈত্যের মতো মালাগুলা ছিঁড়তে লাগলো। পা দিয়া পাগলের মতো মারাতে থাকলো। তার চোখ তখন ভেজা। শরীরে সিংহের বিকার। প্রেমিকা আসছে। ফুটপাতের বকুল কন্যার চোখে আগুন। ইস! একটা মালা বানাতে কি যে কষ্ট! আর দ্যাখো, কি চমৎকার গন্ধই না বাতাসে মৌ মৌ করছে।
পাঁচ.
লোকটি কোথাও ছিল না। হঠাৎ তাকে পেলাম। বললাম, এখন তোমার নুনু খাড়ায়?
লোকটি জ্যোস্না রাইত কাঁপায়ে হাসতে লাগলো। মনে হলো পাশের গোরস্থান থেকে মুর্দারা জেগে উঠবে। ওর হাসিতে একটু ভয়ই লেগে গেলো। কব্বর থেকে উইঠা আইলো নাকি লোকটা?
আমিও কি মৃত? এমন প্রশ্ন কি কেউ কাউকে অসভ্য দুনিআত করে?
লোকটা হাসি থামিয়ে গড় গড় করে বললো, ধুর, আগের বউ ঝগড়া ঝাটি কইরা, লাঞ্ছনা গঞ্ছনা দিআ, বায়না টায়না কইরা... মনটা এমন কইরা রাখতো যে, ঐটারে একশ রহম আদর করলেও খাড়াইত না।
লোকটা একটু থামে। হেলে থাকা বাঁশ পাতা ধইরা টাইনা ছিঁড়ে। খচমচ একটা শব্দ হয়। আত্মহত্যাকারিনী লোকটার বউয়ের কবর এখানেই। গোরস্তানে মোল্লারা তাকে তার বউয়ের কবর দিতে দেয়নি। জানিনা এই হাদিস অরা কই পাইছে। ফল যা অইছে, লোকটার বউ আত্মহত্যার পরেও তারে জ্বালাইতাছে। লোকটা কয় একটু নিজেকে জ্যোস্নার মতো ম্লান করে।
বউ মরছে। বিয়া করছি। বাচ্চা হৈছে। এই বউ তো একটু তাকাইলেই তো টং কইরা খাড়াইআ যায়। আসলে ঐ মাগী আমারে এমুন অত্যাচার করছিলো যে, আমি পুরুষ অইআ দেহাই দিছি। দেখ মাগী দেখ, পুরুষ কি জিনিষ! না খাড়াইআও কেমন চোদন যায়। লোকটা আত্মহত্যাকারিনী বৌয়ের কবরের দিকে তাকাইয়া বলতে থাকে।
আমি লোকটারে কই, চলেন তো, চা এর দোকানে যাইআ দুধ খাই।
চলেন। খাড়া খাড়ি থাক।
ছয়.
ভালোবাসার নিয়মে ওরা আলাদা হয়ে যাচ্ছিলো। নাবিকের লাল টুপিটা নাড়তে নাড়তে সমুদ্র পাড়ের কন্যা বললো, তোমার বুকে লবণের স্বাদ কেন? আমরা যে সমুদ্রে ছিলাম। তোমাতেই লবণের নদী আছে। এই যে এখানে, এখানে। বলে বলে দুই ঊরুর ফাঁকে মুখ নামালো ছেলেটি।
হাসিতে সমুদ্র কাঁপাতে কাঁপাতে মেয়াটি বললো, থেকে যাও, থেকে যাও নাবিক। ঘর বাঁধি।
আর ওর ঝাকড়া পাকড়া চুল টেনে ধরে ওর মুখ তুলালো। এবং নিবিড় ভাবে টানলো বুকে।
দুজনে জলে ভাসা এমিবা বা প্রথম প্রাণে পরিণত হলো।
ঢেউ শুধু ঢেউ।
মেয়েটির পিঠে চুমু খেয়ে নাবিক বললো, যাই।
নাবিকের পিঠে পান করা লবণ থেকে মুখ তুলতে তুলতে সমুদ্র পাড়ের কন্যা বললো, যাও।
উঠে দাড়ানো নাবিকের মাথায় নিজের লাল টুপিটা পরিয়ে দিতে দিতে,
আমার কথা মনে হলে সমুদ্রে লাল টুপি ভাসিয়ে দিও। ও দেখলেই বুঝতে পারবো তুমি আছো। আসছো ।
আর আমি তো প্রতি প্লাবনে সমুদ্রে লাল ফুল ভাসাই। কারো না কারোর জন্য। এসো।
ততোক্ষণে সমুদ্র আছড়ে পরা থামিয়ে হাসতে শুরু করেছে। বিদায় এতো আনন্দের।
সাত.
সে তিনকোনা জালি নিয়া জলায় নাইম্মা ছিলো। দারকিনা, কুচো চিংড়ি, চাডা, হঠাৎ হঠাৎ ছোটো টাকি, গু খাওরা রাগগা মাছ পাচ্ছিলো। তার কোমরে লটকানো খালুই পানি ছুয়ে ছুয়ে দুল ছিলো। আকাশে চমক দিলো একটা বিজলি। চমকে উঠা তার চোখ পরলো সোনা রঙ পোনা মাছের দিকে। এক ঝাক সোনালী পোনা পানিতে উপর নিচ করছে। খেলছে। সোল মাছের পোনার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো সে। কী সৌন্দর্য! কী সৌন্দর্য! কাঁচা সোনা। কাঁচা সোনা। জীবন্ত। জীবন্ত। সাট্ করে তিনকোনা জালি সে নামিয়ে দিলো জলে।
উঠে আসলো পোনা মাছগুলো। মা শোলটা লাফ দিয়া ছিটকে পড়লো। ঝটপট্ খালুইতে পোনা তুললো লোকটা। এবং হাটা দিলো বাড়ির দিকে। বৌ এর হাতে মাছগুলা দিয়া সে গেল গোসলে।
ততোক্ষণে বিজলির ঝলকে নেমে আসা সোনালী মাছগুলা স্বর্ণে পরিণত হয়ে গেছে। বৌ এইসব দলা দলা মাছ মূর্তির সোনা দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, জামাই রে জামাই, গেলি কই, আজ তোরে মাছ খাওয়ামু, বলতে বলতে ছাইগাদায় ছুড়ে মারলো দলা দলা মাছ আকৃতির সোনার টুকরাগুলা। চাডা, পুডি না পাওয়ার দুঃখে ম্যাও ম্যাও করে উঠলো ওদের বিড়াল।
রাতে খেতে বসে লোকটা বেগুন পুড়া দিআ খেতে খেতে কিছু বললো না। একবার শুধু ব্যাথিত নয়নে বৌ এর মুখের দিকে তাকালো। আর এতেই বৌ এর কান্না উথলে উঠলো। আর উথলানো কান্নায় তড়িতাহত স্বামী, স্ত্রীর চোখে রাখতে গেল চোখ। আর তখন পৃথিবীর রমণী কান্না ঠেকানো জলের ধারা বহাতে বহাতে বলছে,
সোনা দিয়া তুমি আমারে আবার বাঁধবা? শিকল বানাবা? মাটি আনতা গয়না বানাতাম। পাখি বানাতাম। মৃদু একটা লুকানো হাসির আভা তার মুখে তখন।