আশিকুজ্জামান টুলুর গল্প ‘মুক্তিযুদ্ধ’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : মার্চ ২৯, ২০১৯

জহুর সাহেবের কথামতো আমরা সবাই ইট পাটকেল নিয়ে ছাদে বসে থাকলাম। আমি ছোট হওয়ায় আমাকে বেশি কিছু করতে হলো না, শুধু ওদের পিছে পিছে ঘুরতে থাকলাম। লিয়াকতদের বারান্দার সামনের জালি দিয়ে রাস্তা দেখতে থাকলাম। কারফিউ। রাস্তা খালি। মাঝে মাঝে দুয়েকটা আর্মির জিপ যাচ্ছে। জহুর সাহেব ওনার বন্দুক আর জিক্কু ওদের বন্দুকটা নিয়ে ছাদের সব চাইতে উপরের স্তরে শুয়ে আছে বন্দুক রাস্তার দিকে তাক করে। কী অদ্ভুত একটা অবস্থা! ওই বয়সে এরকম দেখতে পারার সৌভাগ্য সবার হয় না। জানি না ওটাকে সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য বলবো। মনে ভীষণ সাহস লাগলো। আমরা এতগুলি মানুষ এক হয়ে গেছি, আমাদের নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা হবে না। আমাদের সাথে কেউ পারবে না। সবাইকে আমরা উড়ায় দিবো।

ওইদিন আসলেই কিছু হয় নাই। পরেরদিন চোরের মতো আমাদের পিছনের দেয়াল টপকিয়ে আমরা সবাই খুব সাবধানে আমাদের পাড়া থেকে বের হয়ে গেলাম এবং মেইন রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলাম। জানি না কত ঘণ্টা হেঁটেছিলাম। দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম হাতিরপুলে শামসুল ভাইয়ের বাসা। উনি খুব সমাদর করলেন। শামসুল ভাই আমার আব্বার ছাত্র। ওনার বাসায় দুইদিন থাকলাম আমরা। এর মধ্যে আব্বা খবর নিলেন কোনো লঞ্চ গোয়ালন্দ যাচ্ছে কিনা। খবর পাওয়া গেল। মাঝে মধ্যে গোয়ালন্দ যাচ্ছে দুয়েকটা লঞ্চ। আমরা সদরঘাট রওনা দিলাম। লঞ্চে করে অনেক কষ্টে গোয়ালন্দ পৌঁছলাম। গোয়ালন্দ পৌঁছে শুরু হলো আরেক কষ্ট। ওখান থেকে হেটে, গরুর গাড়িতে বিভিন্ন ভাবে পৌঁছলাম মধুখালী। গোয়ালন্দ থেকে মধুখালী বহুদূর। ওখানে হামিদ চাচার বাসায় উঠলাম এবং ওখানে আমরা একদিন থাকলাম। চাচিআম্মা আমাদের জন্য ভাত, আলু ভর্তা, ডাল আর ওনার পোষা মুরগি রান্না করলেন। আমরা প্রাণ ভরে খেলাম। খেয়েদেয়ে আমার চাচাতো ভাই কামুর সাথে বাজারে গেলাম। গ্রামের বাজার, ভীষণ ভালো লাগলো। ওখানেও সবাই বসে বসে রেডিও শুনছে। অনেক মানুষ দেখলাম দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে ভিটামাটি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

পরেরদিন আমরাও সবার সাথে হেঁটে রওনা দিলাম। হামিদ চাচাকে আব্বা বললেন, চল আমাদের সাথে। হামিদ চাচা গেলেন না। আমরা দীর্ঘ পথ ধরে হাঁটতে থাকলাম। বেশি রাত করা যাবে না। কামারখালি পৌঁছতে হবে। বেশি রাত হলে আবার নৌকায় ডাকাতি হতে পারে। হাঁটতে থাকলাম। মেঠো পথ, মাথার ওপর সুর্য। মাঝে মাঝে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। কোনো গাছের নিচে বসছি, রেস্ট নিচ্ছি, আবার যাত্রা শুরু করছি। আমি মোটেই খেয়াল করিনি যে, আমাদের সাথে আরও ৫-৬টা ফ্যামিলি ঠিক আমাদের মতোই হাঁটছে। আমাদের মতোই ওরাও রেস্ট নিচ্ছে। ভালো লাগলো আর বুকে সাহস পেলাম।

কামারখালির ওদিকটায় আর্মি চলে এসেছে শোনা গেল। আমরা কামারখালি না গিয়ে চলে গেলাম গোপালদি। গোপালদি যাওয়ার সময় কিছুটা পথ গরুর গাড়িতে করে গেলাম। খুব ভালো লাগলো গরুর গাড়ি, কেমন যেন একটা মচমচ আওয়াজ করে। ওখানে আমাদের এক বোন থাকতেন। উনি আমাদের দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। গভীর গ্রাম্য এলাকা, আর্মি যাওয়ার কোনো সম্ভবনাই নাই। আমরা গোপালদী সপ্তাহ খানেক থাকলাম। আব্বা আর থাকতে চাইলেন না। উনি ওনার ভিটামাটিতে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলেন। আবার আমরা কামারখালির দিকে রওনা দিলাম গরুর গাড়ি করে। পথে অনেক মানুষ দেখলাম যারা ঠিক আমাদের মতোই পালিয়া যাচ্ছে।

অনেক রাত হয়ে গেল কামারখালি পৌঁছতে। নদীর ঘাট খালি, কোনো নৌকা নাই। শেষ পর্যন্ত একটা নৌকা পাওয়া গেল। ও রাজি হলো নাকোল যেতে। নাকোল আমাদের গ্রামের বাড়ি। খুব খুশি লাগলো। আব্বা বললেন, নৌকায় দুই ঘণ্টা লাগবে। মাঝি নৌকা ছেড়ে দিলো। নৌকা চলে এলো মাঝ নদীতে। হঠাৎ শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ঝড়। গভীর রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভীষণ ঝড় বাতাস। বিজলি চমকাচ্ছে থেকে থেকে। মনে হলো আমরা আর বাঁচবো না, আমাদের নৌকা এখনি ডুবে যাবে। ভয়ে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে বসলাম। আম্মা জোরে জোরে লা ইলাহা ইল্লেলাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লা পড়তে থাকলেন। আব্বা একেবারে নিশ্চুপ। বললেন, ভয় পেয়ো না তোমারা, সব ঠিক হয়ে যাবে, একটু বৃষ্টি শুরু হলেই ঝড়টা কমে যাবে। আব্বা গ্রামে বড় হয়েছেন, ওনার কাছে ঝড় বৃষ্টি খুব বড় একটা বিষয় না। বিরাট বিরাট ঢেউ এসে নৌকায় বাড়ি খেতে থাকলো। প্রচণ্ড দুলতে থাকলো নৌকা। ডুবে যায় যায় অবস্থা। আব্বা মাঝিকে বললেন চরে নৌকা ভিড়াতে। মাঝি বহু কষ্টে চরে নৌকা ভিড়ালো। ঝড়ের প্রকোপ আরও বেড়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা চরের কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু বুঝলাম, নৌকাটা ডাঙার সাথে বাঁধা আছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক একাধারে ঝড় হলো, সাথে বৃষ্টি। বৃষ্টি যখন বেড়ে গেল ঝড়ের প্রকোপটা একটু কমলো। নদী যখন আরও কিছুটা শান্ত হলো মাঝি আবার নৌকা ছেড়ে দিলো। রাত প্রায় ৩টা। নাকোল ঘাটে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে ৪টা বেজে গেল। নৌকা থেকে নামলাম সবাই। হাঁটা শুরু করলাম। আমাদের তিন ব্যাটারির টর্চটা আব্বা সামনে ধরলেন। আমরা ওই আলোতে পথ চলতে শুরু করলাম। পথে দেখলাম অনেক গাছ ভেঙে পড়ে আছে। সাত থেকে দশ মিনিট লাগে আমাদের বাড়িতে পৌঁছতে। পৌঁছে গেলাম। গভীর রাত। চাচা চাচি কবির ভাই হুমায়ুন ভাই, সবাইকে ডেকে তুললাম আমরা। আমাদের দেখে ওরা ভীষণ খুশি হলো। চাচি আম্মা রান্না চড়ায় দিলেন। ভোর বেলায় সবাই খেতে বসলাম। খাওয়ার পর কখন যেন ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম, মনে নাই। আসলে তখনকার বিপদটাকে এই ছোট্ট আমিও অনুধাবন করতে পেরেছিলাম হাড়ে হাড়ে।

সিঁদ কেটে কিভাবে চুরি হয় তা দেখলাম নিজের চোখে। আমরা আমাদের গ্রামে পৌঁছানোর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই হুমায়ুন ভাইয়ের ঘরে রাতের বেলা চোর সিঁদ কাটলো। হুমায়ুন ভাই টের পেয়ে গেলেন ঘুমের মধ্যেই, চিৎকার করে উঠলেন চোর চোর বলে। তক্ষুণি কবির ভাই, ছোট চাচা, আব্বা, বড় ভাই, মেঝো ভাই সবাই উঠে পড়লো। হুমায়ুন ভাই একটা লাঠি নিয়ে আর হারিকেনটা নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে উঠোন দিয়ে সোজা বাইরের দিকে দৌড় দিলেন, সাথে কবির ভাই। ওনারা কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন। চোর ধরতে পারেন নাই। এর মধ্যে আমাদের সব চাচাদের বাড়িতে হারিকেন জ্বলে উঠেছে। সবাই চলে এসে আমাদের উঠোনে জড়ো হয়েছে। আমি হুমায়ুন ভাইয়ের সাথে ঘরের বাইরের দেয়ালের কাছে গেলাম যেখানে চোর সিঁদ কেটেছে। দেখলাম, বিরাট একটা গর্ত। আমাদের বাসাটার ফাউনডেসন মাটির ছিল, ওপরে টিনের ঘর এবং ঘরের মেঝে মাটির লেবেল থেকে প্রায় চার ফিট উঁচু। সেই চার ফিট জায়গাতেই চোর বিরাট গর্ত করে ফেলেছে। ওই গর্ত দিয়ে ঘরের ভিতর দেখা যাচ্ছে। খুব সহজেই ভিতরে ঢোকা সম্ভব। গর্তটা শেষ হয়েছে হুমায়ুন ভাইয়ের খাটের নিচে। আমি ভাবলাম চোর কতক্ষণ ধরে এই এতবড় গর্ত করলো!

সেবার আমাদের গ্রামে প্রচণ্ড বন্যা হলো। চারদিকে থৈ থৈ পানি। আমাদের উঠোনে পানি চলে এলো। কলাগাছের ভ্যালা বানানো হলো। ভ্যালাতে উঠে পড়লাম ভাইদের সাথে। ঘুরে বেড়ালাম। এত মাছ এলো পানিতে যে হাত দিয়ে টাকি মাছ ধরলাম। আব্বাকে অনেক বলেছিলাম আমাকে একটা ডোঙ্গা নৌকা কিনে দিতে কিন্তু আব্বা দিলেন না। আব্বাকে আরও বলেছিলাম আমাকে একটা ছোট্ট টুকরি আর কিছু বাদাম কিনে দিতে। ওই টুকরিতে করে আমি বাদাম বিক্রি করবো ফটিকের মতো। ফটিক প্রতিদিন বাদাম বেচতে আমাদের বাড়িতে আসতো। যেহেতু কোনো পড়াশোনা নাই তাই ভেবেছিলাম ব্যবসায়ী হয়ে যাই। সেটাও হয় নাই।

আমরা গ্রামে বেশ কয়েক মাস ছিলাম। এরই মধ্যে একবার আর্মি এলো গ্রামের বাজারে। পুড়িয়ে দিলো বেশ কয়েকটা দোকান। মুক্তিবাহিনী খুঁজলো। কিন্তু পেলো না কাউকে। আর্মি চলে যাওয়ার ঠিক এক মাস পরে মুক্তিবাহিনী আমাদের গ্রামে বিরাট ক্যাম্প করলো। হুমায়ুন ভাই, কবির ভাই আর আমার বড় ভাই যোগ দিলো ট্রেনিং এর জন্য। বিকাল বেলা আমিও স্কুলের বিরাট মাঠে চলে যেতাম ওদের ট্রেনিং দেখতে। একদিকে আমরা গোপনে গোপনে রেডিও শুনি, কোথায় কোথায় মুক্তিযোদ্ধারা কত আর্মি মারলো আর আরেকদিকে মুক্তি যোদ্ধাদের ট্রেনিং দেখি। উফ, কিযে ভালো লাগা!

এই গল্পের চরিত্রগুলো সব বাস্তব চরিত্র এবং নামগুলোও আসল নাম। এনাদের মধ্যে আম্মা, আব্বা, ছোট চাচা, ছোট চাচি আম্মা, হামিদ চাচা, কবির ভাই, হুমায়ুন ভাই, শামসুল ভাই সবাই বিদায় নিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে। অনেক কিছুই ভুলে গেছি আবার কিছু কিছু মনে আছে। তবু ভুলিনি পাকিস্তানিদের বর্বরতা। আমি ব্যাক্তিগতভাবে কোনোদিনও ভুলবো না এবং আমার সন্তানদেরও ভুলতে বারণ করে দিবো। এখনও পাকিস্তানিদের দেখলে মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে যায় ওই কালো রাতগুলোর কথা, মনে পড়ে যায় কিভাবে ওরা রেপ করেছে, খুন করেছে। কিছুতেই সরাতে পারি না মন থেকে এই ঘটনাগুলি। কেমন যেন একটা ঘৃণা, রাগ, অপমান কাজ করে। ধীরে ধীরে অনেককিছুর পরিবর্তনের সাথে সাথে আমরা কেমন যেন ভুলতে বসেছি অনেককিছুই এবং আজকাল অনেককে বলেতে শুনি, পাকিস্তানের সবাইতো খারাপ না। হয়তো তাই, কিন্তু মন কেন যেন মানতে চায় না। ওই অপমানগুলি ভোলা বড় কঠিন, যারা ভুলেছে, কিভাবে ভুলেছে জানি না। কিন্তু আমি যদিও একেবারেই ছোট্ট ছিলাম ১৯৭১ তথাপি যতটুকু আগুনের আভা পেয়েছিলাম, কিছুতেই ভুলতে পারি না আজোবধি। আমি অত রাজনীতি বুঝি না। শুধু বুঝি, আমি পাকিস্তান পছন্দ করি না। ব্যাস শেষ, আর কোনো কথা নাই।