আশিকুজ্জামান টুলুর গল্প ‘ছন্দপতন’
প্রকাশিত : জুলাই ০৬, ২০২০
রাসেল তাকিয়ে থাকে পাগলের মতো অসম্ভব সুন্দর চেহারাটার দিকে। এত পাগলের মতো সুন্দর ও কম দেখেছে। মনটা একেবারে এলোমেলো হয়ে যায় মেহরিনকে দেখলেই। দম আরও বন্ধ হয়ে আসে যখন কিছুই বলতে পারে না। এ এক কেমন জ্বালা। এ এক কেমন কষ্ট, যা কাউকে বলা যায় না, শেয়ার করা যায়, একা একা ভুগতে হয় অসম্ভব এক জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে।
মেহরিন খুব মজা পায় রাসেলের এই জ্বলে যাওয়া দেখে, মনের ভিতর ঈদের মতো আনন্দ লাগে, গোপন গর্বে মনটা ফুলে ফুলে ওঠে, মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে যে, রাসেল ওর জন্য শুধু পাগল না, ছাগলও বটে। ওকে দেখলেই এলোমেলো হয়ে কী যে করে আর কী যে বলে! আহা, দেখতে কী আনন্দই না হয়। ওর কিছু বলতে না পারার জ্বালা দেখে আরও বেশী এঞ্জয় করে মেহরিন।
রাতের অন্ধকারে ঘরের লাইট একটু কমিয়ে কোমর পর্যন্ত পিঠ খোলা ম্যাক্সিটা পরে ওর ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালায় এসে দাঁড়ায়। দমকা দক্ষিণা হাওয়া ওর চুলগুলো উড়িয়ে দেয় বাতাসে, ম্যাক্সির সামনের বড় গলা মিলেমিশে এক হয়ে যায় রাতের মিষ্টি অন্ধকারের সাথে। রাতের মিষ্টতা আরও অনেক বেড়ে যায় মেহরিনের কাছে, যখন ও দেখতে পায় ওদের পাশের বাসার ছেলে রাসেল তিনতলার ছাদে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখছে। ওই ছাদে নিশাচর ঈগলের মতো দাঁড়িয়ে রাসেল একদৃষ্টিতে মেহরিনের শরীরটা না দেখলে রাতটা মেহরিনের কাছে পানসা হয়ে যায়, মিনিংলেস হয়ে যায়। রাসেল যত দেখে, মেহরিন তত পাগল হয়, চুলের গোড়া থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শিরশির করে ওঠে।
এত ভালো লাগার পরেও কিছুতেই মেহরিন একচুল প্রশ্রয় দেয় না, দিতে চায় না। মেহরিন চায় কিছু ভালো লাগা, কিছু প্রেম না বলা থেকে যাক, রাতের দক্ষিণা বাতাসে মিশে থাক, আকাশ ভাঙা বৃষ্টিতে ভিজে যাক। এ ভালোলাগা সবার বোঝার দরকার নেই, ও নিজে বুঝলেই চলবে।
রাসেল মেহরিনের জন্য পাগল কিন্তু বলতে পারেনি কোনোদিন। মেহরিন ওর চাইতে দুই বছরের বড়। এত সুন্দর মেয়ে এই পাড়াতে আর একটাও নেই। বহু বছর ধরে মেহরিনরা ওদের ঠিক পাশের বাসার দোতলায় ভাড়া থাকে। রাসেলদের বাসার ছাদ থেকে মেহরিনের ঘরটা পরিষ্কার দেখা যায়, যেহেতু রাসেলদের বাসার ছাদটা তিনতলার ছাদ। শুধু তাই নয়, ঘরের ভিতর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। রাসেলের দেখার সবচাইতে সুন্দর সময় রাতের বেলা। রাসেলের ঘরের ভেতরটা খুবই গরম ফ্যান ছেড়ে রাখার পরেও। এ কারণেই প্রতিবার সিগারেট খাওয়ার জন্য ওকে যেতে হয় ছাদে। ওর দুই বছরের বড় ভাই পাভেলও ওর সাথে ছাদে গিয়ে সিগারেট খায়। অবশ্য সিগারেট খেলেও মুরব্বিয়ানার বিষয়টায় কোনো ছাড় পাভেল দেয় না। সবসময় একটা সিনিয়ারিটির ভাব নিয়ে থাকে রাসেলের সাথে। রাসেলের তাতে কোনো কিছু আসে যায় না। ও একটা দূরত্ব মেইটেইন করে ওর সাথে।
রাসেলের প্রতিদিনের রুটিন, রাত ১০টার দিকে ছাদে গিয়ে মেহরিনদের দক্ষিণা জানালা বরাবর দাঁড়ানো এবং চোখ আর মন ভরে বৃষ্টিভেজা যৌবনাকে দেখা। মেহরিনও আঁধারের বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে রাসেলের দাঁড়িয়ে থাকাকে না দেখার ভান করে টানটান উত্তেজনায় শরীরের প্রতিটি লোমকূপকে একাকার করে নেয়। যেদিন রাসেল আসে না, সেদিন মেহরিনের মন দক্ষিণা বাতাসে ভাসে না। এভাবেই মেঘলা আকাশে উড়তে থাকে মেহরিন আর রাসেলের ভেসে বেড়ানো স্বপ্নের ফানুশ। ওরা জানে, এ ফানুশ শুধুই আকাশে উড়ে বেড়ানোর, কোনোদিনও মাটিতে অবতরণের নয়।
রাত সাড়ে ১০টা বেজে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে রাসেল। মেহরিনের দেখা নেই। রাসেল ভাবতে থাকে, কী ব্যাপার! কোথায় ও! হঠাৎ ওর মনে পড়ে বিকেলে মেহরিনের মা’র সাথে সিএনজিতে কোথায় যেন যাচ্ছিল মেহরিন। হয়তো কোনো আত্মীয়ের বাসা গিয়েছে, আজ হয়তো আর আসবে না। রাসেল একটা সিগারেট ধরায়। হতাশ হয়ে লম্বা একটা টান দেয়, আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জানালার দিকে তাকিয়ে। দৃষ্টি জানালার দিকে থাকলেও চিন্তা ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যায় এবং সে কারণেই ও দেখতে পায় না ঘরের ভিতরটা।
কয়েক মিনিট পরে হঠাৎ চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় যখন পাশে এসে পাভেল দাঁড়ায় এবং একটা সিগারেট ধরায়। দুজনই চুপচাপ সিগারেট টানতে থাকে। রাসেলে হঠাৎ খেয়াল করে প্রতিদিনের মতো মেহরিনদের কাজের মেয়েটা মেহরিনের ঘর মুছতে শুরু করে। ও সারা ঘর বসে বসে মুচ্ছে। মিনিট খানেক পরে মেহরিনের ঘরে আসে ওর বাবা এবং মেহরিনের বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা পেপার চোখের সামনে নিয়ে পড়তে থাকে। মেয়েটা ঘর মুছছে আর বাবা পেপার পড়ছে। মেহরিনের বাবা কিছু একটা বললো মেয়েটাকে। মেয়েটা এসে ভদ্রলোকের পা টিপতে শুরু করলো। রাসেলের চোখ কিছুটা ছানাবড়া হতে থাকে। সাথে মনটা ক্রমেই নদীর পাড়ভাঙার মতো করে ভাঙতে থাকে। মেহরিনের বাবা আবার কিছু একটা বলে, মেয়েটা উঠে গিয়ে সুইচবোর্ডে হাত দিয়ে লাইটটা অফ করে আবার ফিরে আসে বিছানায়। আধো চাঁদের আলোতে রাসেল যা দেখতে পায়, তা দেখে ওর সব স্বপ্নগুলো মুহূর্তে কর্পূরের মতো নীল আকাশের তারার মেলায় হারিয়ে যায়, বুকটা ফেটে যায় কষ্টে, ভীষণ কান্না পায়।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয় যাতে পাভেল কিছু বুঝতে না পারে। পাভেল ওখানে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা দেখতে পায় এবং একসময় গরম সুরে রাসেলকে বলে ওঠে, পড়তে যা।
রাসেল নিচে চলে আসে। এরপর ও আর কোনোদিনও ছাদে ওঠেনি। কেন ওঠেনি, ও জানে না। আর কোনোদিন ও মেহরিনের মুখোমুখি হতে চায়নি। অবশ্য ওকে আর মুখোমুখি হতে হয়নি। কারণ ওই ঘটনার কয়েক মাস পরেই রাসেল পাড়ি জমায় বিলেতে। হারিয়ে যাওয়া রাসেলের এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় মেহরিনকে। কারণ কিছু ভালোলাগা মনের খুব গভীরে বাসা বাঁধে। যেখানে দিনের আলো কোনো সময় পৌঁছায় না। তাই ওই জায়গাটা কেউ দেখতে পায় না একমাত্র মনের মালিক ছাড়া।