আশাপূর্ণা দেবীর গল্প ‘অভিনেত্রী’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৮, ২০২১
কথাসাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীর আজ জন্মদিন। ১৯০৯ সালের ৮ জানুয়ারি শুক্রবার সকালে উত্তর কলকাতায় মাতুলালয়ে তার জন্ম। পিতা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন কমর্শিয়াল আর্টিস্ট। মা সরলাসুন্দরী দেবী। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা ‘অভিনেত্রী’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
দালানের মাঝখানে গালচের আসন পেতে গোটা আষ্টেক-দশ বাটি আর অভব্য রকমের বড়ো একখানা থালা সাজিয়ে আহারের আয়োজন করা হয়েছে। জামাইয়ের নয়, বেহাইয়ের। নতুন বৌমার বাপ এসেছেন বিদেশ থেকে। বাড়ীর গৃহিণী নাকি নিতান্তই লজ্জাশীলা, তাই অতিথির অভ্যর্থনার ভার স্বয়ং বধূমাতারই। তা’ অযোগ্য অধিকারীর হাতে ভার ন্যস্ত হয় নি। নতুনবৌ ছেলেমানুষ হলে কি হয়, তিনজনের আহাৰ্যবস্তু একজনের জঠর-গুহায় চালান করিয়ে দেবার চেষ্টার জন্যে যে অধ্যবসায়ের প্রয়োজন সেটা তার আছে।
শ্বশুরবাড়ীতে–বাপ ভাই কুটুম, কাজেই বাপের অতিভোজনের জন্যে পীড়াপীড়ি না করবে কেন অনুপমা? বাপ হেসে বলেন—খুব যে গিন্নী হয়ে উঠেছিস দেখছি? আমার সঙ্গেও কুটুম্বিতা? এতো কখনো খাই আমি?
খান না সে কি আর অনুপমাই জানে না? কিন্তু উপরোধটাই রীতি যে! তাছাড়া—শাশুড়ী সামনা-সামনি না এলেও আনাচে-কানাচে আছেন কোথাও, পরে বৌয়ের ত্রুটি ধরবেনা তাই অনুপমা সোৎসাহে বলে—আচ্ছা মাছটাছ না খেতে পারো থাক, পায়েস মিষ্টি এগুলো তো খাবে? এ সন্দেশ এঁদের দেশ থেকে আনানো—ফেললে চলবে না বাবা!
–না চলে তো তুই খা বসে বসে-বলে বাপ হেসে উঠে পড়েন। ‘অপচয়’ সম্বন্ধে কোনো বক্তৃতা না দিয়েই ওঠেন।।
সাল তারিখের হিসেবে ঘটনাটা দু’ যুগ আগের অপচয়ের ভয়ে অপ্রচুর আয়োজনটা ছিলো তখনকার দিনে বিশেষ নিন্দনীয় একজনকে খেতে বসিয়ে কেবলমাত্র একজনের উপযুক্ত দেওয়া—সে কেমন? ফেলাছড়া না হলে আবার আদর জানানো কি? আহার্য-বস্তুর ওপর মমত্ববোধটা তো মানসিক দৈন্য।
অতিবড়ো কল্পনাবিলাসীও তখন ‘রেশনের বাজারে’র দুঃস্বপ্ন দেখেনি। অতএব—কাক না বেড়াল সম্বন্ধে কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন না হয়েই অনুপমাও বাবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে যায় এবং পাশাপাশি চলতে চলতে প্রায় অস্ফুট স্বরে বলে—আমাকে নিয়ে যাবার কথা বলবে তো বাবা?
এতোক্ষণ বলতে পারেনি, জানতো খাবার সময়টা অনেকের দৃষ্টি নিবদ্ধ আছে এদিকে।
বাপও মেয়ের সঙ্গে স্বরের মিল রেখে বলেন—বলবো বলেই তো এসেছি। এবারে একলা ফিরে গেলে তোমাদের মাঠাকুরুণটি কি আর আস্ত রাখবেন আমাকে?…ভাবছি কাল সকালের গাড়ীতেই নিয়ে যাবো।
আশায় আশঙ্কায় উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় কণ্টকিত কিশোরী-হৃদয়, এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে রাজী হয় না। ‘কাল সকাল’—সে যেন—সুদূর ভবিষ্যৎ!
কিন্তু বৌ’ বলে কথা! দু’ যুগ আগের বৌ। বাপের বাড়ী যাবার ইচ্ছা প্রকাশটাও অমার্জনীয়। অপরাধ তাই পাকাগিন্নীর মতো ফিসফিস করে বাপকে উপদেশ দেয় অনুপমাবেশ গুছিয়েগাছিয়ে বোলো বাবা, জানোই তো আমার শ্বশুর একটু রাগী মানুষ?
—একটু? বাপ প্রায় স্পষ্ট হেসে ওঠেন—বল যে বিলক্ষণ! চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনলে মেজাজ ঠিক রাখা যায় না। যাক গে—এবারে যেমন করে হোক বলে কয়ে—
কঞ্চিৎ আশ্বস্ত অনুপমা বাপকে চোখ টিপে ইশারা করে চুপ করতো কোথায় যেন পায়ের শব্দ হলো, বাপের কাছে নিয়ে যাবার আবেদন করছে—এ অপরাধ ধরা পড়লে রক্ষে আছে?
শাশুড়ী লজ্জাশীলা হ’তে পারেন, তা’ বলে—এতোদূর সহ্যশীলা তো হতে পারেন না সত্যি!
ঘণ্টাখানেক পরে সেই দালানেই শতরঞ্চের আসন বিছিয়ে, আর–গোটা চার পাঁচ বাটি ঘিরে থালা সাজিয়ে আহারে বসেছেন বাড়ীর কর্তা। সামনে পাখা হাতে অনুপমা।
ইনি কুটুম্ব না হলেও—অনুরোধ উপরোধের মাত্রাটা ওঠে প্রায় কুটুম্বের পর্যায়ে। সেটাও রীতি। ছেলের বৌ যত্নআত্তি করবে এই তো সাধ মানুষের।
তা সে সাধ মেটাতে জানে অনুপমা।
কর্তা বেশ খানিকক্ষণ খাওয়ার পর এক সময় মুখ তুলে যেন হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গীতে বলেন —হ্যাঁ ভালো কথা…তোমার বাবা যে নিয়ে যেতে চাইছেন তোমাকে!
—বাবার কথা বাদ দিন—বলে পাখাটা জোরে জোরে চালাতে থাকে অনুপমা হৃৎস্পন্দনের দ্রুত ছন্দটা পাছে ধরা পড়ে তাই আরো ব্যস্ততা।
–বাদ দিলে চলছে কই গো? শ্বশুরঠাকুর শ্লেষের ভঙ্গীতে কথা শেষ করেন—তিনি একেবারে নাছোড়বান্দা। মেয়ে নিয়ে না গেলে তোমার মা নাকি তাঁকে বাড়ী ঢুকতে দেবেন না শুনলাম!
—ওই তো হয়েছে জ্বালা—দইয়ের ওপর চিনি দিতে দিতে অনুপমা যেন অগ্রাহ্যভরে বলে— মার যে কি বাতিক! মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে হলেই কান্না জুড়ে দেবেন! আচ্ছা এ কী? বাবার কি কম মুস্কিল?…সেবারে অমন পুজোর সময় দিদির আসবার কথা ছিলো—আসা হলো না বুঝি, বাস মার সাতদিন খাওয়া বন্ধ। পুজোর সময় কোথায় নতুন কাপড়চোপড় পরবেন—তা’ নয়। আচ্ছা, সব সময় কি আসা বললেই আসা হয়? সংসারের সুবিধে অসুবিধে দেখতে হবে না?
শ্বশুরের মুখের মেঘ কেটে ঈষৎ কৌতুকের বিদ্যুৎছটা দেখা দেয়—আমি তো তোমার বাবাকে কথা দিলাম–বলে পায়েসের বাটীটি কাছের গোড়ায় টেনে নেনা
অনুপমার মুখেও বিদ্যুৎরেখা, কিন্তু সুকৌশলে তার উপর একখানি নকল মেঘ ঢাকা দিয়ে হাতের পাখা নামিয়ে গালে হাত রেখে বলে—সে কি বাবা? কথা দিলেন কি? মার এই শরীর খারাপ, দু’দিন বাদে ঠাকুরঝি আসবেন! বামুনঠাকুর দেশে যাবো’ বলছে—দুশ্চিন্তায় যেন মুষড়ে পড়ে অনুপমা।
—তা’ বললে কি হবে, কথার পিছনে ড্যাশ টেনে কর্তা জলের গ্লাসে দুখানা পাতিলেবু। নিংড়ে তারিয়ে তারিয়ে জলটি খেতে থাকেন
অনুপমার মা অবুঝ হতে পারেন, তাই বলে অনুপমা তো হতে পারে না? সে নুনের পাত্র চিনির কৌটো গুছিয়ে তুলতে তুলতে বিচক্ষণভাবে বলে—এ সময় আমি হঠাৎ বাপের বাড়ী গিয়ে বসে থাকলে ঠাকুরঝি কি মনে করবেন বাবা?বাবাকে আপনি ওই কথাই গুছিয়ে বলে দিন।
–তা হয় না বৌমা–কর্তা মাটিতে বাঁ হাতের ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বলেন—মরদকা বাত হাতীকা দাঁত! একবার যখন ‘হ্যাঁ’ বলেছি, তখন ত্রিভুবন উল্টে গেলেও তার নড়চড় হবে না।
তবে আর কি করতে পারে অনুপমা?
মাত্রাতিরিক্ত উজ্জ্বল মুখের ভাবটা ম্লান করে আনতে একটু বেশী সময় লাগে বলেই তৎপর হয়ে শ্বশুরের খড়ম, খড়কে, গামছা ইত্যাদি এগিয়ে দিয়ে তবে বলে—মুশকিল হলো! মাঝামাঝি হঠাৎ এখন নিয়ে যাবার জন্যে যে কি দরকার পড়লো বাবার বুঝিও না …মার শরীরটা খারাপ–
এ ‘মা’ অবশ্য শাশুড়ী।
তাঁর নিটোল দেহখানিতে কোন রোগ বালাই আছে—এমন অপবাদ শত্রুতেও দিতে পারবে, কিন্তু অনুপমা দেয়। কাগিন্নী উভয়ের মনোরঞ্জনের এক উৎকৃষ্ট দাওয়াই।
পরবর্তী সিন দালানে নয় ঘরে, দিনে নয় রাত্রে। তারানাথকে ছেড়ে যেতে যে কী ভয়ঙ্কর মন কেমন করছে সেই কথাই ছল ছল চোখে বিশদভাবে বোঝাতে হচ্ছে অনুপমাকে।
দুই কর্তা মিলে কথা পাকাপাকি করে ফেললেন, অনুপমা বেচারী করে কি? ওর তো আর এখন শুধু শুধু যাবার ইচ্ছে ছিলো না? হ্যাঁ, একটা উপলক্ষ্য থাকতো—আলাদা কথা। বড়ো অবুঝ অনুপমার মা! অথচ বেহায়ার মতো বলতে পারে না অনুপমা সে কথা!…কাজেই বিরহবেদনার যত রকম লক্ষণ আছে সেগুলো সব প্রকাশ করতে হয়—তারানাথের অভিমান ভাঙাতে।
চতুর্থ দৃশ্যও একটা আছে, সে অনুপমার পিতৃগৃহের পটভূমিকায়। …কিন্তু সে কথা থাকা দু’ যুগ পরেরই কথাই বলি ‘দু’ যুগ’ কেন বরং তার বেশীই।
কালের পরিবর্তন হয়েছে বটে স্থানটা ঠিক আছে। ‘পাত্রটাও’ বলা চলে। সেই দালানে—ঠিক সেই জায়গাটাতেই সেই ভঙ্গীতে বসে আছেন গৃহিণী অনুপমা, পাখা একখানা হাতে। …মুখের গড়নটা কিছু বদলেছে, গায়ের রঙের জেল্লাটা গেছে কমে, তবে চুলে যে পাক ধরেছে সেটা এক নজরে চোখে পড়ে না।
সামনে আহারে বসেছেন–বর্তমান কর্তা তারানাথ। পঁচিশের ওপর আর পঁচিশ যোগ করলে যে পরিবর্তনটুকু অবশ্যম্ভাবী তার বেশী কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না তারানাথের আকৃতিতে।
আসনটা আর বাসনগুলা বাপের আমলের, তবে আহার-আয়োজনটা নয়। তা’তে এ যুগের। শীর্ণ ছাপ! অনুরোধ-উপরোধের কাজটা ফুরিয়েছে গৃহিণীদের। …সচরাচর এ সময় ওই প্রসঙ্গেরই অবতারণা হয়। সে যুগে ‘জলের দরের সঙ্গে এ যুগের ‘অগ্নিমূল্যের তুলনা করে প্রতিদিনই নতুন করে বিস্ময় প্রকাশ করেন অনুপমা আবার এ উৎকণ্ঠাও প্রকাশ করতে ছাড়েন না—সংসারে এই নবাবী-চাল চেলে আর কততদিন চালাতে পারবেন তারানাথ!
ছেলেটি তো—একেবারে লাট সাহেবের পুষ্যি-পুত্তুর। মেয়েটি বাদশার বেগম। এতোটুকু ত্রুটি হলেই রসাতল। ছেলে-মেয়েদের কান বাঁচিয়েই অবশ্য বলেন অনুপমা, এখনকার ছেলে মেয়েদের তো বিশ্বাস নেই!
আজ আর বাজারদরের আলোচনা নয়—কর্তা রেগে আছেন। অনুপমা নীরব। খানিকক্ষণ খাওয়ার পর হঠাৎ মুখ তুলে তারানাথ বলেন—কি নিয়ে এতোক্ষণ বচসা হচ্ছিল বাবুর?
বলা বাহুল্য উদ্দিষ্ট ‘বাবুটি’ তারানাথের বয়স্ক বেকার পুত্র। এহেন অম্লরসাত্মক উষ্ণভাষা আর কার সম্বন্ধে প্রয়োগ করা যেতে পারে—উপযুক্ত বয়সের পুত্র ছাড়া?
একটি বিক্ষোভসূচক শব্দের সঙ্গে অনুপমা উত্তর দেন—আর বলল কেন? সেই দিল্লী যাওয়া! বন্ধুরা যাচ্ছে—অতএব ওঁরও যাওয়াই চাই। দিল্লী দিল্লী করে ক্ষেপে উঠেছে একেবারে
তারানাথ বিরক্ত ভাবে বলেন—এখনো সেই ‘খোট’ ধরে বসে আছে? এককথায় বলে দিচ্ছি যাওয়া হবে না, ব্যস।
বলে তো আমিও দিয়েছিলাম গো—অনুপমা পাখা নামিয়ে হাত উল্টে বলেন—শুনলে তো! সেই তক্কই তো হচ্ছিলো ‘কেন যাবো না’—’গেলে দোষ কি’—’লোকে কি যায় না’—’যারা যাবে তারা সব মরে যাবে না কি—‘ ‘—নিষেধের একটা কারণ থাকা দরকার…’ এই সব পাকা পাকা কথা!
নিষেধের কারণ থাকা দরকার!
শোনো আস্পর্ধার কথা! তারানাথের অনিচ্ছাটাই তো যথেষ্ট কারণ। তা ছাড়াও আবার কারণ দেখাতে হবে ছেলেকে? ক্রুদ্ধ তারানাথ বলেন—আমি ওর তাঁবেদার নই যে কারণ দেখাববা! একপাল চ্যাঙড়া ছোঁড়ার সঙ্গে হৈ চৈ করতে যেতে আমি দেবো না। টাকা জোগাবার বেলায় তো আমি ব্যাটা! তবু যদি এক পয়সা আনবার মুরোদ থাকত! চুল-ছাঁটার পয়সাটি পর্যন্ত তো হাত পেতে নিতে হয়—এই হাবাতে বুড়োর কাছে, তবু কী তেজ! কথাই কওয়া হয় না ভালো করে! আমি যেন একটা কীটস্য কীট!
অনুপমার কণ্ঠেও অনুরূপ সুর—শুধু তুমি কেন, কা-কে নয়? জগৎকেই যেন থোড়াই কেয়ার করে ওরা। …দরকারের সময় হাত পাতার কথা বলছো? তা’ হলেও তো বাঁচতাম, মুখ ফুটে চাইলে—মানের কানা খসে যাবে না?…সেই সেধে সেধে দিতে হবে নিয়ে যেন মাথা কিনবেন।
হুঁঃ! তারানাথ গম্ভীর ভাবে বলেন—বললে এখুনি আবার তোমারই মানের কানা খসে যাবে, তবে ন্যায্য কথা বলবো তোমার আস্কারাতেই এ রকম হয়েছে—।
—আস্কারা আবার কি—অনুপমা অসন্তোষ প্রকাশ করেন—মেজাজটি তো জানো না ছেলের? একটান্যায়-অন্যায় কথা বলবার জো আছে?
—আছে কি না আমি দেখতাম…তারানাথ হুমকি দিয়ে ওঠেন বলতে আমি খুবই পারতাম শুধু পারি না তোমার ভয়ে।
হঠাৎ চল্লিশোত্তীর্ণা অনুপমার মুখে এমন একটা রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে,—যেটা চব্বিশ বছরে মানানসই। …তবে উত্তরটা বয়সের অনুপাতেই দেন ভদ্রমহিলা—আহা মরে যাই! আমার ভয়ে তো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছো তুমি!…ভয় করতে হয়—আজকালকার ছেলেদের খোকাই তো সেদিন বলছিলো—ওর কোন বন্ধুর ভাই নাকি বাপের কাছে বকুনি খেয়ে…কে? কে ওখানে?
তারানাথ অগ্রাহ্যভরে বলেন—কে আবার? মেধো হয় তো!
–কি জানি বাবু—অনুপমা সন্দিগ্ধভাবে বলেন—মনে হলো যেন খোকা উঠে গেলো সিঁড়ি দিয়ে। …।
–খোকা আবার কি? এই তো সাহেব সেজে বেরিয়ে যাওয়া হলো বাবুর! পোর্টফোলিও হাতে ঝোলালে বেরোনো হয় না, যেন মস্ত এক অফিসার!
—হ্যাঁ? ওই এক ফ্যাশান ছেলের। কিন্তু ঘুরে আবার আসেনি তো?
—কেন, ঘুরে আসবে কি জন্যে?
—কি জানি, কিছু ভুলে ফেলে গিয়েছে হয়তো। পরশু অমনিকততদূর গিয়ে ছুটতে ছুটতে এলো—ঘড়ি ভুলে গেছে বলে।
—তা আসবেন বৈকি। কজিতে ঘড়ি না বেঁধে বেরোলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবো কই বলো দিকিন ছুটে গিয়ে সংসারের একটা জিনিস কিনে আন? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে লাট সাহেবের!
বিরক্তি-তিক্ত স্বরে কথাগুলি উচ্চারণ করে ছোট এক টুকরো পাতিলেবু গেলাসের জলে গুলতে থাকেন তারানাথা তিন আনা জোড়া লেবু বড়ো বড়ো দুখানা খাওয়া যায় না।
অনুগামিনী সতী অনুপমা পতি-দেবতার এই ধারালো মন্তব্যটির পিঠোপিঠি বেশ ঘোরালো কিছু বলবার আগে একবার উঠে গিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে নিঃসন্দেহ হয়ে এসে বসেন এবং এখনকার ছেলেরা লেখাপড়া শিখেও যে কতো মুখ আর বাঁদর হয় তারই উদাহরণ দিতে তৎপর হয়ে উঠেন… ভাগ্নে-ভাইপো, ভাসুরপো, বোনপো দেখছেন তো সবাইকে অন্ধ স্নেহের বশে নিজের ছেলের বিষয়ে ছেড়ে কথা কইবেন এমন মুখ মা অনুপমা নন …তিন-তিনটে পাশ করে যে ছেলে নির্বিকার-চিত্তে দু’বছর ধরে শুধু আড্ডা দিয়ে আর সিনেমা দেখে বেড়ায়, তার আবার পদার্থ আছে কিছু? কেন, উঠে পড়ে লেগে চেষ্টা করলে কিছু একটা জুটতো না এতোদিন? তবু তো বাপের একটু আসান হতো!
দামী দামী আর ভালো ভালো আরো অনেক কথাই বলেন অনুপমা। ছুটির দিন খেয়ে তাড়াতাড়ি ওঠবার তাড়া নেই তারানাথেরা।
ধীরে-সুস্থে খেয়ে উঠে পানের ডিবে হাতে বাইরের ঘরে চলে যান, ছুটির দুপুরে দাবার আজ্ঞা বসে পাড়ার হিমাংশুবাবুর সঙ্গে। আসার সময় হয়ে এলো তাঁর।
অনুপমা ঠাকুর-চাকর সকলের খাওয়ার দেখাশোনা করে সবে খেতে বসেছেন, মেয়ে শীলা নেমে এসে ব্যস্তভাবে বলে ঠাকুর, উনুনে আগুন আছে তো? থাকে তো একটু চায়ের জল চড়িয়ে দাও চট করে।
চায়ের জল বেলা দেড়টার সময়!
অনুপমা অবাক হয়ে বলেন—এখন চা খাবি?
শীলা বিরক্তস্বরে বলে—আমি কেন?দাদার ভীষণ মাথা ধরেছে—তাই।
—দাদা? খোকা বাড়ী আছে নাকি?…বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে অনুপমার।
—আছেই তো। বেরিয়ে গিয়ে ঘুরে এসে শুয়ে পড়েছে মাথা ধরেছে বলে। …কই ঠাকুর, দিয়েছো?
শীলার চিত্ত-জগতে একমাত্র সম্মানিত ব্যক্তি দাদা।
গোগ্রাসে ভাত ক’টা গিলে নিয়ে ছুটে ওপরে গিয়ে ছেলের ঘরে ঢুকে একেবারে বিছানায় বসে পড়েন অনুপমা। শঙ্কিতস্বরে বলেন—কি হয়েছে রে খোকা? বেরিয়ে আবার ফিরে এসে শুয়েছিস?শরীর খারাপ হয়েছে?
বলা বাহুল্য, স্নেহাতুর মাতৃকণ্ঠের এই শঙ্কিত প্রশ্নের উত্তর তিনি পান না।
অবস্থা নির্ণয়ের প্রথম পর্যায় হিসাবে গায়ের উত্তাপ পরীক্ষা করতে যেতেই—তৎক্ষণাৎ হাতখানা সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শোয় খোকা।
অনুপমা এ অপমান গায়ে না মেখে পুনঃ প্রশ্ন করেন—কখন এলি তুই?
খোকা নিরুত্তর। অতএব নিঃসন্দেহ, তার সম্বন্ধে মা-বাপের মধ্যে যে উচ্চাঙ্গের আলোচনা চলছিলো সে তার কর্ণগোচর হয়েছে। তা হোক, অনুপমা তো হেরে ফিরে যাবেন না, তাই সক্ষোভ বেদনায় বলেন
—আজই হঠাৎ শরীর খারাপ করলি? পশু তোদের বেরোবার কথা না?
—বেরোনো? খোকা যেভাবে ভুরু কুঁচকে তাকায়, তাতে আর যাই হোক খোকাত্ব প্রকাশ পায় না। বেরোনো মানে? যাচ্ছি কোথায়?
অনুপমা যেন অবোধ, অনুপমা যেন আত্মবিস্মৃত, অনুপমার যেন এখনো শৈশবকাল কাটেনি, তাই প্রায় শিশুসুলভ সরলতাতেই বলে—কেন, তুই যে বলেছিলি মঙ্গলবারেই স্টার্ট করবে ওরা?
—ওরা করবে তার আমার কি? ওদের নিজের পয়সা আছে, ওরা যা খুশি করতে পারে! হঠাৎ আচমকা প্রায় শীলার মতো ভঙ্গীতেই খিলখিল করে হেসে ওঠেন অনুপমা। বিশ বছর আগে দুধ খেতে নারাজ ছেলেকে যে সুরে কথা বলে কায়দায় আনতেন, প্রায় তেমনি ছেলে ভোলানো সুরে বলেন—ওঃ, তাই বলো—বাবুর রাগ হয়েছে! কে বকেছে—কে মেরেছে—কে দিয়েছে গাল?’…তখন বুঝি ওঁর বাক্যবাণগুলি কানে গেছে? (ওর কথাই শুধু উল্লেখ করেন। অনুপমা, স্বচ্ছন্দেই করেন নিজের অপরাধবোধের লেশমাত্র ধরা পড়ে না মুখের চেহারায়) তাই ভাবছি কি হলো খোকার! নে নে, মন খারাপ করিস নি, টাকা তো আমি দেবো বলেছি।
—তুমি আর কোন আকাশ থেকে টাকা পেড়ে আনবে শুনি? তারানাথ রায়ের টাকাই তো?…শখ করে বেড়াতে যাবার রুচি আমার আর নেই মা, একটু ঘুমোতে দাও। বেকারের আবার শখ-সাধ!
অনুপমা যেন তুড়ি দিয়ে ওড়ান ছেলের কথা—হ্যাঁ, বড়ো তুই বুড়ো হয়েছিস, রোজগারের বয়েস পার হয়ে গেছে একেবারে! তাই ‘বেকার’ বলে একেবারে দেগে দে নিজেকে! ওঁর কথায় আবার মানুষ রাগ করে? কথার কোনো মাথা আছে?…ওঁর কথা ধর্তব্য করতে হলে তো ভালো খেতে নেই, ভালো পরতে নেই, আত্মীয় বন্ধুর বাড়ী যেতে নেই, সাধ-আদ সব শিকেয় তুলে রেখে খালি টাকা আনা পাইয়ের হিসেব কষতে হয়।
–উচিত তাই খোকা শ্লেষের সুরে বলে—অন্তত যতদিন ওঁর অন্ন ধ্বংসাচ্ছি।
–তাই বৈকি—আমি তো আজীবন ওঁর অন্ন ধ্বংসাচ্ছি করছি যে তাই! ওই সামনা-সামনি দুটো মনরাখা কথা কয়ে যা তা বুঝিয়ে একটু ঠাণ্ডা রাখা, বুঝলি? গোয়ার্তুমি করে কাজ পণ্ড করে লাভ? তোর ঠাকুদ্দা ছিলেন কী দুর্দান্ত রাগী, কিছুতে যদি একবার ‘না’ বলেছেন তো ‘হ্যাঁ’ করায় কার সাধ্যি! আমিই শুধু ভুলিয়ে-ভালিয়ে—খোশামোদ করে—
খোকা এইবার উঠে বসে, উদ্ধতভাবে বলে—কেন করেছে? অন্যায় করেছে। খোশামোদ করবে কিসের জন্যে? বাবাকেও চিরকাল ভয় করে করে আর খোশামোদ করে করে এই অবস্থা! কিন্তু কেন? তোমার নিজের একটা সত্তা নেই? ভালোমন্দ বিচার-বিবেচনা নেই? যুক্তিতর্ক নেই?
সূক্ষ্ম একটি হাস্যরেখা ফুটে ওঠে অনুপমার বাঁকা ঠোঁটের কোণে যুক্তিতর্ক? অনুপমার ভিতরে যুক্তিতর্ক নেই? এতো অজস্র আছে যে, তার প্রবল স্রোত সমুদ্রস্রোতের মতো ভাসিয়ে দিতে পারে বাপ-ছেলে দু’জনকেই। কিন্তু ভাসিয়ে দিলে চলে কই অনুপমার?…বিচার বিবেচনা? সেটা যে আছে, তার প্রমাণ দিতে গেলেই তো সংসার করা কবে ঘুচে যেতো অনুপমারা।
আর সত্তা?
সে বস্তুটাও তো আমসত্বের মতো জলে গুলে রোদে শুকিয়ে ভাঁড়ারজাত করা হয়েছে। খোশামাদের বিরুদ্ধে তো এতো তড়পানি ছেলের, তাকেই বা এতোক্ষণ কি করলেন তিনি মা। হয়ে?
কিন্তু এ সবের কিছুটি উচ্চারণ করেন না অনুপমা, সূক্ষ্ম হাসির রেখাটা সূক্ষ্মতর হয়ে মিলিয়ে যায়। শুধু ম্লান কণ্ঠে বলেন—কেন নেই, সে আর তুই কি বুঝবি খোকা? লেখাপড়া শিখে পণ্ডিত হলেই কি সব বোঝা যায়? আমার মনে আর দুঃখু দিসনে বাবা, তোর সব বন্ধুরা দিব্যি বেড়াতে যাবে, আর তুই পড়ে থাকবি—এ আমি সইতে পারবো না। …উনি না হয় একটু রাগই করবেন। …নিজে কখনো কোথাও যেতে পাইনি, জগতের কিছু কখনো দেখিনি, চিরদিন বন্দী হয়ে থেকেছি, তোরা মন খুলে সব করলেও শান্তি আমার
খোকা অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে মনে হয় যেন মায়ের দুই চোখের তারায় পুঞ্জীভূত হয়ে আছে সেই চিরদিনের ক্ষোভ …বঞ্চিত জীবনের, বন্দী জীবনের, নিরুপায় জীবনের!
অতঃপর কথার মোড় ঘোরো চা হাতে করে এসে শীলাও যোগ দেয়া খোকার টাকা হলে। মাকে কোন কোন দেশে বেড়াতে নিয়ে যাবে তারই আলোচনা চলে …খোকার যেটা পছন্দ অনুপমার হয়তো নয়, তাঁর মতে—কতো দুঃখে বেরোনো, তা মুসৌরি কেন? বরং পুরী, ভুবনেশ্বর!…শীলার আদর্শদাদা, অতএব সে মার পছন্দকে উপহাস করো …খোকা আবার তখনি মত পাল্টায়, কেন পুরী, ভুবনেশ্বরই কি যা তা জায়গা? ভারতের স্থাপত্য শিল্পের পৌরাণিক নমুনা। …মার পছন্দকে বরং তারিফই করতে হয়।
অতএব তাই। তৎক্ষণাৎ শীলার কটকী শাড়ী কেনা হয়, ক্ষেত্তরে’র কাঁসার বাসনা আবার পরবর্তী ট্রিপটা সম্বন্ধে গবেষণা চলে। …
দেড়টা বেলা গড়িয়ে সাড়ে চারটায় ঠেকে।
হঠাৎ যেন দরজার কাছে বোমা ফাটে।
–বলি আজ কি আর চা-টা হবে না?
শিহরিত অনুপমা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন—চারটে চল্লিশ!…সর্বনাশ! ঠিক চারটে বেলা হচ্ছে—তারানাথের ‘টী টাইম! সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলেই যে তারানাথের হার্টের ট্রাবল বাড়ে!
আচমকা এই প্রশ্ন-বোমাঘাতে নিজের হার্টের অবস্থা যাই হোক, মুখের চেহারাটা ঠিকই রাখেন অনুপমা। সহজ আফসোসের সুরে বলেন—ওমা! এতো বেলা হয়ে গেছে! দেখো কাণ্ড! শীলা, তুইও তো আচ্ছা মেয়ে?…মেধোরই বা কী আক্কেল? বেহুশ হয়ে ঘুমোচ্ছে হয়তো।
—সত্যি—স্বরমাধুর্যে যতোটা তিক্ততা ঢালা সম্ভব তা ঢেলে তারানাথ মন্তব্য করেন—মাইনে করা চাকর-বাকরের আক্কেলটাই বেশী হওয়া উচিত বটে!
স্বামীর কথার উত্তরে—জিভের আগায় কোন কথাটা আসছিলো না অনুপমার?
‘বিনি মাইনের চাকরাণী’র উচিত-বোধের প্রশ্ন?
কি জানি, আসে না তো, কাজেই বোঝা যায় না। শুধু স্বাভাবিক খেদের সুরই ধ্বনিত হয় তাঁর কণ্ঠে—এই দেখোনা, ছেলেটা আবার শরীর খারাপ’ বলে এসে শুয়েছে, কে জানে জ্বরজ্বারি হবে। কি না! যে দিন-কাল!
পরবর্তী সিন দিনে নয়, রাত্রে।
এ ঘরে নয়, ও ঘরো…ঘরের দরজায় খিল লাগানোর পর টাইকো সোডা ট্যাবলেট দুটো আর জলের গ্লাসটা কর্তার হাতে তুলে দিয়ে পানের ডিবেটি নিয়ে বিছানার ওপর গুছিয়ে বসেন অনুপমা…’পান মজাবার’ বহুবিধ উপকরণপূর্ণ কৌটোটি খুলে একটিপ মুখে ফেলে বলেন— বুকের কষ্টটা বেশী হচ্ছে না তো? তোমার তো আবার সময়ের একটু এদিক-ওদিক হলেই কি? তাকানো নেই কেন? রাগ হয়েছে বুঝি? না, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। ছেলেমানুষের মতো রাগ অভিমানটা ঠিক আছে এখনো। …ছেলেটাও হয়েছেন তেমনি বাপের আর কোনো গুণ।
পান, রাগ গুণটা পেয়েছেন মোলো আনা। তখন তোমায় বললাম—খোকার শরীর খারাপ হয়েছে,…শরীর নয় মোটেই, মেজাজ। …ওই যে, বন্ধুদের সব গোছগাছ হয়ে যাচ্ছে তাই মেজাজ খাপপা। রেগেটেগে হুকুম দিয়ে দিয়েছি আমি যেতো শেষটায় মনজরে থেকে সত্যি রোগ করবে, সুধীর শ্যামল সবাই যাচ্ছে যখন, যাকগে একবার দিল্লী গিয়ে কি চারখানা হাত বেরোয় দেখি!…হ্যাঁ, একটা চাকরি জোগাড় করে আসতে পারে—তবে বলি বুদ্ধি! শ্যামলের মামা না যেন। খুব বড়ো চাকরে ওখানকার! আচ্ছা হ্যাঁ গো তোমাদের সুবোধবাবুও না দিল্লীতে বদলী হয়েছেন আজকাল?
–হয়েছে তার কি–তারানাথ বিদ্রূপ-হাস্যে বলেন তোমার ছেলে গিয়ে দাঁড়ালেই একটা চেয়ার এগিয়ে দেবে?
–যাও—হেসে ফেলেন অনুপমা। হাসিটা—দশ-বিশ বছর আগের টাইপের। হেসে বালিশের ওপর এলিয়ে পড়ে বলেন— তোমার সবতাতেই ঠাট্টা! সরোদিকিন, একটু শুই ভালো করে। …ওই যাঃ, মশারিটা টাঙাবো ভাবলাম যে—রোসোটাঙিয়ে দিই। …
—আর থাক—অনুপমার সদ্য বালিশে ফেলা মাথাটার ওপর হাতের একটু চাপ দিয়ে তারানাথ বলে ওঠেন—হয়েছে, খুব হয়েছে, উঠতে হবে না। আজ হঠাৎ এতো কর্তব্যজ্ঞানের উদয় কেন?
–না না, তোমার শরীরটা আজ ভাল নেই—বলে ব্যস্তভাবে উঠে বসেন অনুপমা। ততক্ষণে অবশ্য তারানাথ উঠে দাঁড়িয়েছেন। গোঁফের ফাঁকে মুচকে একটু হেসে বলেন—আচ্ছা খুব পতিভক্তি হয়েছে! এই সাতাশ বছরের মধ্যে ক’দিন মশারী টাঙিয়েছ?
অম্বলের রোগী তারানাথের সহজে ঘুম আসে না, সুদীর্ঘ দিনের কর্মক্লান্ত আর অভিনয়শ্রান্ত অনুপমা ঘুমিয়ে পড়েন মুহূর্তেই…হয়তো অভিনয়টা নিখুঁত উৎরেছে বলেই এতো স্বস্তি।
অভিনয়?
তা ছাড়া আর কি, সুন্দর নিখুঁত অভিনয়, এততা নিখুঁত যে অভিনয় বলে বোঝা অসম্ভব। বোঝা অসম্ভব কোনটা সত্য কোনটা কৃত্রিম।
কিন্তু একা অনুপমাই বা কেন? নারী মাত্রেই কি অভিনেত্রী নয়? অভিনয় ক্ষমতাই তো তার জীবনের মূলধনা জন্মগত সেই মূলধনটুকু সম্বল করেই তো তার যতো কিছু কাজকারবার।
সে মূলধন যার যতো বেশী, তার-ই তো সংসারে ততো বেশী প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, সুনাম, সুখ্যাতি
নদীর মতো আপন বেগে প্রবাহিত হতে চাইলে চলবে কেন তার?…একদিক ভরাট করে তুলতে অপরদিকে ভাঙন ধরাবার মতো বোকামী তার নেই। দুই কূল সযত্নে রক্ষা করে চলতে হয় তাকে রক্ষা করতে হয় সংসার, রক্ষা করতে হয় দাঁড়াবার ঠাঁই।
অনাদরকে তার বড়ো ভয়, বড়ো ভয় অবহেলাকে!
নাকি এ-তথ্যের সবটাই ভুল?
কোনোটাই তার অভিনয় নয়, চিরন্তনী নারীপ্রকৃতির মধ্যে পাশাপাশি বাস করছে সম্পূর্ণ আলাদাদু’টি সত্তা, জননী আর প্রিয়া। নিজের ক্ষেত্রে সে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
মমতাময়ী নারী তার এই বিভিন্ন দুটি সত্তা বিশাল পক্ষপুটের আড়ালে সযত্নে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে চিরশিশু অবোধ পুরুষ জাতিকে।
ছলনাটা তার ছলনা নয়, করুণা…এই করুণার আওতা ছাড়িয়ে ছলনা-লেশহীন উন্মুক্ত পৃথিবীতে বেপরোয়া শিশু ভোলানাথের দলকে যদি মুখোমুখি দাঁড়াতে হতো—ক’দিন লাগতো পৃথিবীটা ধ্বংস হতে?