আল মাহমুদের গল্প ‘কালো নৌকা’

পুনর্মুদ্রণ

প্রকাশিত : জুলাই ১১, ২০১৯

তখন ভাটার সময়। সমুদ্রে কোনো তোলপাড় নেই। ডাঙা থেকে মাইলখানেক দূরে জেলে নৌকাগুলো দিগন্তের অস্পষ্ট ভ্রূরেখার মতো আবছাভাবে দুলছে। মৃদুগতিতে অল্প অল্প বাতাস বইছে। হাওয়ার স্পর্শ তেমন শীতলও নয়। আবার তেমন উষ্ণতাও নেই। তবে ডাঙার ভেজা অংশে যেখান থেকে ভাটার টানে সমুদ্র পিছিয়ে গেছে, সে ভেজাবালিতে খালি পা ফেলে হাঁটলে সারা শরীরে বেশ একটা আরামদায়ক শিহরণ লাগে। শাদা কাঁকড়ার ছোট বাচ্চারা পায়ের ওপর দিয়ে ছোটাছুটি করলেও তখন কেউ লাফিয়ে ওঠে না। মনে হয় নুনের হালকা গন্ধ যেন সমদ্রে সূর্যাস্ত উপভোগকারীদের ইন্দ্রিয়ে একধরনের প্রাকৃতিক আমেজ ঢুকিয়ে দিয়েছে।

মেয়েরা শাড়ি টেনে গোড়ালি উদোম করে হাঁটছিল। কেউ কেউ কাদা মাড়িয়ে বাহাদুরি দেখাতে সমুদ্রের জলসীমায় গিয়ে হাঁটুর ওপর ঢেউয়ের বাড়ি লাগাচ্ছে। ছোট ছোট ঢেউ এসে তাদের শাড়ির নিচের দিকটা হাঁটু পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে। তাদের সঙ্গী পুরুষরা জুতো হাতে ডাঙায় শুকনো বালিতে দাঁড়িয়ে দেখছে। সূর্যাস্তের প্রাকৃতিক মোহকে উপভোগ করার একটা প্রবণতা কিংবা বলা যায় প্রস্তুতি আছে মানুষের মধ্যে। যা ক্ষণস্থায়ী তন্ময়তা এনে দিয়েছে এইসব নরনারীর মুখে।

সূর্যাস্তের সময় আজকাল বেশ ভিড় জমে এ জায়গাটায়। যারা সমুদ্র আর সূর্যাস্ত দেখে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই বন্দরে ফিরে যেতে চায়, তারাই আসে এ ঘাটে। কিন্তু যাদের হাতে প্রচুর সময় আর টাকা-পয়সা আছে তাদের কথা অবশ্য আলাদা। তারা কঙ্বাজার না গিয়ে এই হোটেল-মোটেলহীন ফৌজদারহাট আসবে কোন দুঃখে।

তবে আকাশ পরিষ্কার থাকলে ফৌজদারহাটের বেলাভূমিতেও কম ভিড় হয় না। বেশ লোক জমে যায়। আজ রোববার বলেই যে এত গাড়ি আর মানুষের মেলা জমেছে তা নয়। মেঘবৃষ্টি না থাকলে প্রায় প্রতিদিনই মানুষ আসে। প্রাইভেট কারও আসে অনেক। আর মানুষের সমাগম দেখে কয়েকটা চায়ের দোকানও ডাঙার শুকনো উঁচু জায়গায় জমিয়ে ব্যবসা ফেঁদেছে। প্রতিদিন সূর্য নিভে গেলে পানির কিনারায় বহুদূর হেঁটে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে মানুষ চায়ের দোকানগুলোতে এসে বসে। চা খায়। অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত আর উঠতে চায় না কেউ।

এ বেলা একে একে জেলে নৌকাগুলো ফিরে আসছে। কোনো কোনো নাও তীরের কাদায় পেট ঠেকিয়ে বাঁকা মাথা উঁচু করে দুলছে। জেলেরা কেউ কেউ পানিতে নেমে ভেজা বালুর ওপর দিয়ে নাও ঠেলে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে সূর্যাস্ত-দর্শকদলের নারী-পুরুষ।

কাছেই জেলেপাড়া। এতক্ষণ এই আবাসস্থলের অস্তিত্বই বোঝা যায়নি। শ্রীহীন কয়েকটা শীর্ণ চালাঘর। খুব নিচু করে তৈরি। দূর থেকে স্তব্ধ কালো রেখার মতো দেখা যায়। এখন এই রেখার ওপর থেকে শাদা-কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেয়ে আকাশে উঠেছে। রান্নার আগুনে যেন সারা পাড়াটা প্রাণস্পন্দনে জেগে উঠল। জেলে-বৌরা ঝাঁকা নিয়ে আস্তে আস্তে পাড়া ছেড়ে নাওগুলোর দিকে আসছে। তাদের পেছনে উলঙ্গ শিশুর দল।

রাসু জলদাসের নৌকাটা প্রথম এসে ডাঙায় ভিড়েছে। জল ঝাড়াই আর মাছের দরদামের ব্যাপারটা সঙ্গী দুজনের ঘাড়ে চাপিয়ে রাসু কাদা পার হয়ে ডাঙায় এসে দাঁড়াল। হাতের দাঁড়টা কাঁধে ফেরে তারপর রওনা দিল পাড়ার দিকে।

সূর্য এখনো নিস্তেজ হয়ে দর্শনীয় হয়ে ওঠেনি। সূর্যাস্ত-দর্শকদের দল এখনো ডাঙার ওপর টেনে আনা জেলে নৌকাগুলোকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। তাদের চোখে এখনো সূর্যের প্রাত্যহিক মোহময় মৃত্যুকে উপভোগ করার প্রস্তুতি জেগে ওঠেনি। বরং জেলেনীদের ঝাঁকায় শাদা ছোট ইঁচা মাছের সামান্য স্তূপ দেখে সাগরের কৃপণতার ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে।

রাসু জলদাসের হাঁটাটা এখনো দেখার মতো। পঞ্চাশ বছরের সমুদ্রচারী জেলের গায়ে যতটা সামর্থ্য থাকে রাসু তার চেয়েও শক্তিশালী পুরুষ। তার পেশল হাত-পায়ে বার্ধক্য দূরে থাক, মধ্যবয়স্কেরও কোনো চিহ্ন নেই। বিশাল পুরুষ। পাথরের মতো ছাতি। দাঁড়ের কাঠের মতো মোটা কবজির ওপর শিরা ফুলে আছে। লোকে বলে, একটানা সাত দিন নাকি রাসু মাঝি দাঁড় বাইতে পারে, শুধু সময়মতো খেতে দিলেই হলো।

রাসুর হাঁটাটা সত্যিই ভারি মজার। যেন প্রথম হাঁটতে শেখা শিশু পা ফেলছে। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন গুনে গুনে পড়ছে। একটু অসাবধান হলেই বুঝি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত। রাসু হাঁটে অনেকটা পা টিপে টিপে এগিয়ে যাওয়ার মতো করে। তখন তার মাথাটা নত হয়ে থাকে। চোখ থাকে পায়ের সামনের মাটির ওপর। হাঁটার সময় আশপাশে তাকায় না রাসু। সোজা দরিয়া থেকে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ানোর অভ্যেস তার। আগে নাও নিরাপদ ডাঙায় উবুড় করে রেখে আসার সময় দামোদরের মা রাসুর পাশে পাশে হেঁটে এসে ঘরের দরজা খুলে দাঁড়াত। এখন রাসুকেই খুলতে হয়। গতর নুইয়ে দরজার মরচেপড়া তালাটা খুলতে গেলে কোমরের হাড়ে আজকাল মট করে একটা আরামদায়ক শব্দ হয়। আরাম আর ক্লান্তি তখন রাসু জলদাসকে জড়িয়ে ধরে। রাসু বোঝে যে তার সেই গৌরবময় দিনগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে।

দামোদরের মা গত হয়েছে আজ পনেরো-ষোল বছর। সন্দ্বীপ থেকে রাসু সতী জলদাসীকে বিয়ে করে এনেছিল। জেলেদের মেয়েরা এমনিতেই শক্ত-সমর্থ হয়ে থাকে। তার মধ্যে সতী ছিল এক নামডাকঅলা জলদাস পরিবারের মেয়ে। সতীর মতো নারী-শরীর সচরাচর দেখা যায় না। মাছের ঝাঁকা নিয়ে এই কালো কুচকুচে জেলে-বৌ যখন রাসুর পেছনে পেছনে বেলাভূমি পার হয়ে ছুটত, তখন জাল মেরামতের কাজ করতে করতে জেলে যুবারা একবার ঘাড় ফিরিয়ে এই ধাবমান মাৎস্যগন্ধাকে না দেখে পারত না।

সতী যখন মারা যায় দামোদরের বয়স তখন দশ। সে বছর রাসু জলদাস জেলেদের সাথে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেত। কমপক্ষে পনেরো দিন না কাটিয়ে কেউ দরিয়া থেকে ঘরে ফিরত না। এমনি ধরনের এক ক্ষেপ শেষ করে গাঁয়ে ফিরে জেলেরা জানল যে সপ্তাহখানেক আগে কলেরায় তাদের গাঁয়ের অর্ধেক মানুষ উজাড় হয়ে গেছে। মৃতদের মধ্যে নারী আর শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি। কারণ পুরুষ বলতে যারা ছিল তারা সকলেই ছিল সাগরে। জেলেপাড়ায় কান্নার রোল পড়ে গেল। সতীও এই মড়কের শিকার হয়ে প্রাণ হারায়। সতীর মৃত্যুর চারদিন পর রাসুদের নৌকা এসে ডাঙায় ভেড়ে। খবরটা শুনে রাসু চুপচাপ কতক্ষণ ভেজা বালুর ওপর নত হয়ে বসে থাকে। যতক্ষণ না পাড়ার বিলাপরত আত্মীয়স্বজন দামোদরকে সঙ্গে নিয়ে রাসুর কাছে ছুটে আসে ততক্ষণ রাসু স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো মাটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। মেয়েরা যখন রাসুর চারদিকে লুটিয়ে পড়ে বিলাপ শুরু করে দিল, তখন রাসু চোখ তুলে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকা তার ছেলে দামোদরের দিকে তাকাল। ভয়ে হতচকিত বালক দামোদরের দিকে স্তম্ভিতের মতো কতক্ষণ চেয়ে থেকে রাসু ছেলের হাত ধরে ঘরে ফিরে গেল।

ছেলের মুখ চেয়ে রাসু এই মর্মান্তিক আঘাতটা সামলে নিলেও দশ বছর পরে দামোদরের মৃত্যু তাকে মাটির দিকে নুইয়ে দিল। এই দশ বছর সঙ্গীসাথীদের আর আত্মীয়স্বজনের অনেক অনুরোধেও আর বিয়ে করেনি রাসু। বরং ছেলের বয়স কুড়ি পেরোতেই রাসু তার বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
দামোদর দেখতে ঠিক রাসুর মতোই। ছেলের বুকের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারত না রাসু। গায়ে-গতরে দামোদর রাসুরও দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াল। কালো পাথরে গড়া যেন এক কান্তিমান অসুরের মূর্তি। রাসু ভাবত ছেলের জন্য সতীর মতো বৌ চাই।

শেষ পর্যন্ত সন্দ্বীপেই দামোদরের সম্বন্ধ পাকা হলো। সতীদের গ্রাম থেকেই কৃষ্ণ জলদাসের মেয়ে কালীকে দামোদরের বৌ করে ঘরে আনল রাসু। কালীকে দেখে গাঁয়ের বয়স্ক জেলেনীরা সতীর কথা বলাবলি করত। বলত, ‘সতী আবার দামোদরের বৌ হয়ে জন্মেছে।’ জাল, নৌকার কাজ আর শুঁটকির চালানে কালী যখন স্বামী-শ্বশুরকে সাহায্য করত তখন পরিবারে আবার স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছিল। কিন্তু এ সুখও রাসুর বেশিদিন টিকল না। বঙ্গোপসাগরে এক আকস্মিক তুফানে চৌদ্দজন জেলে যেবার নাওসহ নিখোঁজ হয়ে গেল, সেই দলে ছিল দামোদর। নিখোঁজদের মধ্যে দুই-একজনের লাশ দ্বীপাঞ্চলে ভেসে এলেও দামোদরের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না।

দামোদর নিখোঁজ হওয়ার মাসখানেক পরে কালীর বাপের বাড়ির লোকজন এসে কালীকে সন্দ্বীপ নিয়ে গিয়েছিল। শোকাহত রাসু জলদাস কালী চলে গেলে ভাবল, ‘যাক। মানুষের সাথে আমার আর কোনো সম্বন্ধ রইল না। আমি দরিয়ার জলে হাত ধুয়ে ফেললাম।’ রাসু তখন হঠাৎ দরিয়ায় যাওয়া বাড়িয়ে দিল। সে বেশি বেশি গভীর সমুদ্রে বিচরণ শুরু করল। অনেকটা বেপরোয়ার মতো। সঙ্গী জেলেরা বলে, দরিয়ায় যখন ঘূর্ণি দেখা দেয় এবং ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে তখন তাকে জোর করে ধরে দাঁড়ে বসিয়ে দেয়।

এভাবে চলছিল। কিন্তু হঠাৎ এক আকস্মিক ঘটনায় রাসু জলদাস আবার ঘরমুখো হলো। একদিন ভোরে রাসু ঘরের দরজা খুলে দেখে কালী দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে কাপড় থাকলেও অসম্বৃত। বাতাসে চুল উড়ছে। শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটাচ্ছে। দামোদর নিখোঁজ হওয়ার পরও এত দিন কালী যে বিধবার বেশ নেয়নি, হাতের শাঁখাজোড়া তার প্রমাণ। রাসু কতক্ষণ পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে থেকে অনুচ্চ স্বরে বলল, ‘তুই কিভাবে এলি? কে নিয়ে এলো?’

রাসুর কথার উত্তর না দিয়ে কালী ফিরে দাঁড়াল। রাসুকে পেছন ফিরে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘বৌমা’, রাসু ডাকল। কালী সাড়া না দিয়ে আগের মতোই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। রাসু বুঝল যে কালীর কিছু একটা হয়েছে। কয়েক দিন আগে অবশ্য রাসু সন্দ্বীপের মাঝিদের মুখে একটা কথা শুনেছিল যে কৃষ্ণ জলদাসের মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু রাসু বিশ্বাস করেনি। মাল্লারা বলেছিল, কালী নাকি ঘরে থাকতে চায় না। দিনরাত সমুদ্রের পারে ছুটে আসে। তাই তাকে বেঁধে রাখতে হয়। রাসু মাল্লাদের গালগল্পকে আমল দেয়নি। রাসু জানত, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে এলে মাল্লারা ডাঙ্গা সম্বন্ধে অনেক বাজে মিথ্যে কথা বলে সময় কাটায়।
রাসু কালীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ। পাড়ার লোকেরা চলাফেরা আরম্ভ করেছে। রাসুর দাওয়ায় কালীকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাড়ার জেলে-বৌরা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এলো। প্রতিবেশী মানু জলদাসের পুত্রবধূ শ্যামা এগিয়ে এসে বলল, ‘কী হয়েছে জেঠা, কালীকে কে নিয়ে এসেছে?’

শ্যামার কথার কোনো জবাব না দিয়ে রাসু কালীর দিকে চোখ রেখে বলল, ‘কাপড়টা সামলে নে বৌমা।’

ভোরের বাতাসে কালীর বুকের কাপড় সরে গেছে। নাভির নিচে শাড়ির গিঁট শিথিল হয়ে ঝুলছে। সুগঠিত স্তনমণ্ডল নিরাবরণ। রাসুর ডাকে কালী সাগরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল। তারপর এমন একটা কাণ্ড করল, যাতে সকলেই হতবাক।

কালী একটানে হঠাৎ গায়ের কাপড় খুলে ফেলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হতভম্ব সকলের লজ্জিত দৃষ্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে কালী ঘরের ভেতর ঢুকল। ঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জুড়ে দিল বিলাপ। জেলেপাড়ার সমস্ত নারী-পুরুষ রাসুর দরজায় ভিড় করে দাঁড়াল। সকলেই কালী কিভাবে এসেছে, কে নিয়ে এসেছে এ নিয়ে বলাবলি করতে থাকল। কেউ বলল, সন্দ্বীপের কোনো গয়নায় চেপে এসেছে সে।

যেভাবেই আসুক, রাসু আর কালীকে বাপের বাড়ি পাঠাল না। এমনকি লোকমুখে খবর পাঠানোরও দরকার মনে করল না। এরপর থেকে কালী এখানেই আছে। পাশের ঘরের বৌ শ্যামাই কালীর দেখাশোনা করে। সমস্ত খরচ জোগায় রাসু। তার মাছ ধরার কাজে মনোযোগ কমল না। বলতে গেলে সে এখন সারা দিন টাকা রোজগারের ধান্ধায় ঘোরে।

শ্যামা প্রথম প্রথম কালীকে নিজের ঘরে এনে রেখেছিল। কিন্তু কালীর যখন-তখন নেংটা হয়ে যাওয়া, দিগম্বরী হয়ে পাড়ার মধ্য দিয়ে হেঁটে বেড়ানো আর সুযোগ পেলেই সাগরের দিকে ছুটে যাওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে দেখে শ্যামা ঘাবড়ে গেল। শ্যামা দেখেছে, কালী যখন নিরাবরণ হয়ে পাড়ার মধ্য দিয়ে কিংবা বেলাভূমির ওপর দিয়ে হাঁটে তখন পুরুষমানুষ মাত্রই তার দিকে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ তার পিছু পিছু হেঁটে যায় পর্যন্ত। এখন আর শ্যামা কালীকে নিজের পরিবারে রাখতে ভরসা পায় না। বরং রাসুর ঘরেই তাকে তালাবদ্ধ করে রাখে। নাওয়া-খাওয়ার সময় শ্যামা নিজ হাতে কালীকে চান করিয়ে, খাবার খাইয়ে, শাড়ি পরিয়ে দিয়ে যায়। কালী তালাবদ্ধ রাসুর চালায় কখনো বিলাপ আবার কখনো নিচু স্বরে গান গাইতে থাকে। এভাবেই রাসু জলদাসের দিন যাচ্ছে।

কাঁধে দাঁড়টা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাসু তার উঠোনে এসে গলা খাঁকারি দিল। পুরুষ মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে পাশের বাড়ি থেকে শ্যামা চাবি নিয়ে হাজির হলো। রাসু শ্যামার হাত থেকে চাবি নিয়ে দাঁড়টা গয়আম গাছের গোড়ায় ঠেকিয়ে রেখে কালীর কথা জিজ্ঞেস করল। শ্যামা যেতে যেতে বলল, ‘ঘরেই আছে। বহু কষ্টে চান করিয়ে খাইয়ে দিয়েছি। আজ আবার শাড়ি পরতে চায় না। আমি সাধলাম, আমাকে মারতে আসে।’
শ্যামা চলে গেলে রাসু দরজার তালাটা খুলল। দরজার একটা পাট ধাক্কা দিতেই শায়িত কালীকে দেখল রাসু। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মাদুরের ওপর শুয়ে আছে।

সূর্যের শেষ রশ্মি এসে পড়েছে ঘরের ভেতর। পড়ন্ত তির্যক আলোয় নিরাবরণ নারী-সৌন্দর্যকে প্রত্যক্ষ করল রাসু। নিঃশ্বাসের দোলায় কালীর বুক দুটি ওঠানামা করছে। নিদ্রিতা কালীর ঠোঁটজোড়া ঈষৎ কুষ্ণিত হয়ে আছে। পিঠে, গলায়, উরতের ফাঁকে ঘামের ফোঁটা চিকচিক করছে। মাথার দিকে তাকালে বোঝা যায়, শ্যামা আজ চুলে তেল দিয়ে যত্নে খোঁপা বেঁধে দিয়েছিল। অসাবধান নিদ্রায় তা পিঠে, বালিশের উপর ছড়িয়ে পড়েছে।

এই প্রথম রাসুর সতীর কথা মনে পড়ল। ভুলে যাওয়া আনন্দের গন্ধ যেন বইতে লাগল বুকের ভিতর। একদৃষ্টে কালীর নগ্নদেহের দিকে তাকিয়ে থেকে রাসু ঘরের ভেতর গিয়ে দরজার পাটটা ধাক্কা মেরে লাগিয়ে দিল। দুয়ার বন্ধের শব্দে কালী চোখ মেলে চাইল।

কালীর ঘুমটা আসলে ব্যতিক্রম। কালী ঘুমায় না। এখানে আসার পর কালীকে চেষ্টা করেও ঘুম পাড়ানো যায়নি। সম্প্রতি শ্যামার সেবাযত্নে কয়েক দিন যাবৎ দুপুরের দিকে কালী আপনমনে বকতে বকতে নেশাগ্রস্তের মতো পড়ে থাকে। আজও কালী এভাবেই পড়ে আছে। এখন রাসুকে দেখে উঠে বসল, তারপর আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগল।
রাসু কালীর গা ঘেঁষে মাদুরের ওপর গিয়ে বসল। ঘরের বেড়া থেকে গামছাটা টেনে এনে কালীর দেহের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল, ‘ঘুমিয়েছিলি বৌমা?’

কালী কথার জবাব না দিয়ে একদৃষ্টে রাসুর দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বিড়বিড় শুরু করল। কী বলে কিছুই বোঝা যায় না। রাসু দড়ি থেকে কালীর শাড়িটা এনে মেলে ধরল, ‘পরবি?’
কালী শাড়িটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। নেড়েচেড়ে কতক্ষণ দেখল শাড়িটা। কাপড়টা হাতে নিয়েই দুয়ার খুলে বেরিয়ে এলো উঠোনে। শেষে শাড়িটা গয়আম গাছের ডালে ঝুলিয়ে সাগরের দিকে হাঁটা দিল।

কালীর কাণ্ড দেখে রাসু ঘর থেকে দাওয়ায় এসে দাঁড়াল। পেছন থেকে ডাকার আগেই কালী বেলাভূমির ওপর দিয়ে ছোট জেলে নৌকার মতো তরতর করে কোমর আর বুক দুলিয়ে সমুদ্রের জলরেখার কাছে পৌঁছে গেছে। রাসু কিছুক্ষণ কালীর গতিবিধি লক্ষ করে আবার ঘরের ভেতর ফিরে গেল।

সূর্য এখন তেজ হারিয়ে এক বিপুলাকার গোলক হয়ে গেছে। পশ্চিমাকাশ আর সাগরের জলসীমা পর্যন্ত নিসর্গদৃশ্য গাঢ় লাল রঙে রঞ্চিত। সূর্যাস্ত-দর্শকের দল যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিটিয়ে ঘোরাফেরা করছিল, যেন অজ্ঞাত নির্দেশে তারা পরস্পরের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। পেছন থেকে দেখলে মনে হবে পৃথিবীর সন্তানেরা নিমজ্জমান সৌন্দর্যের কাছে তাদের শেষ আকুতি জানাতে একত্রিত হয়েছে। তাদের ওপর দিয়ে বইছে লবণের গন্ধেভরা বাতাস। কেউ সহজে কোনো শব্দ তুলছে না, বলছে না ‘দ্যাখো দৃশ্যটা কত সুন্দর!’

পূর্ব দিগন্তে আচ্ছন্নতা বিলিয়ে সূর্য যখন তার অতিকায় গোলকের মধ্যেই স্বীয় রূপরাশিকে শোষণ করে নিজেরই রিক্ততাকে প্রকট করল, তখন তার প্রান্তভাগ ঢেউয়ের ওপর আপ্লুত। এমন সময় কালী এসে দাঁড়াল সেখানে। দর্শক আর সূর্যের মধ্যবর্তী হয়ে। তারা দেখল, এক দীর্ঘতমা নগ্ন নারীশরীর সুর্যকে ভেদ করে ঢেউয়ের ওপর দণ্ডায়মান। কোমরে একা হাত রেখে অনেকটা নাচের ভঙ্গিতে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিন্তু ডুবন্ত সূর্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে খুব বেশিক্ষণ দাঁড়াল না কালী। সে সূর্যকে রেহাই দিয়ে জলরেখা ধরে আরো উত্তর দিকে চলতে লাগল।

কালীর অঙ্গরেখার আবরণ থেকে মুক্তি পেলেও নিমজ্জমান দিবাকরের দর্শক থাকল কেবলমাত্র কয়েকজন বন্দরের হতবাক নারী আর শিশু। সূর্যাস্ত-দর্শক দলের পুরুষরা তখন নগ্ন কালীর পেছনে পেছনে হাঁটছে। যেন কালী সূর্যের সন্তানদের তার কালো নিটোল দেহনৌকার অদৃশ্য গুণের সাথে বেঁধে আগে আগে চলেছে।

সূর্য যেন আতঙ্কে ঢেউয়ের ভেতরে দ্রুত আবৃত হয়ে যেতে চাইল। এখন বেলাভূমির ওপর হাল্কা অন্ধকার কাঁপছে। খুব মৃদু একধরনের পিটপিট শব্দ হচ্ছে ভেজাবালির ভেতর থেকে। সূর্যের আলো থাকতে যেসব কাঁকড়ার বাচ্চা বালির ওপর ভাটার সময় গর্ত খুঁড়ছিল, এখন তারা বালির গভীরে নড়াচড়া করছে। তাদের আলোড়নেই সিক্ত বালিয়াড়ি থেকে পিটপিট শব্দটা উঠছে।

অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে নামলে সূর্যাস্ত-দর্শকদলের পরিত্যক্ত অংশ অর্থাৎ বন্দর থেকে আগত নারী ও শিশুর দলে গুঞ্জন উঠল। শিশুরা তাদের পিতাদের নাম ধরে জোরে জোরে ডাকল। নারীরা গালাগাল দিতে লাগল তাদের সঙ্গী আর স্বামীদের। শিশুদের আর্তচিৎকারেই হোক অথবা কর্তব্যবোধেই হোক, সূর্যাস্ত-দর্শকদলের পুরুষেরা কালীকে অন্ধকারে রেখে তাদের রোদনরত শিশু ও ক্ষুব্ধ সঙ্গিনীদের কাছে ফিরে এলো। যেন মোহময় কালো নৌকার যাত্রীরা ঢেউয়ের বাড়ি থেকে খেতে ডাঙায় এসে ভিড়েছে। তারা স্ত্রী আর তাদের সঙ্গিনীদের কাছে এসে হাত কচলে বোকার মতো হাসতে হাসতে বলল, ‘পাগলিটার কী সাহস, অন্ধকারে দরিয়ায় সাঁতার কাটছে!’
অন্ধকার আরো গভীর হয়ে নামলে সূর্যাস্ত-দর্শকদের দল তাদের ক্ষুব্ধ নারীদের নিয়ে বেলাভূমি শূন্য করে চলে গেল।

অন্ধকারে কালীকে আর দেখা যায় না। দূরে জেলেপাড়ার বাতিগুলো বিন্দুর মতো জ্বলতে লাগল। আর বেলাভূমির ওপর যে চায়ের দোকানগুলো আছে তাতেও লণ্ঠনগুলো জ্বলে উঠেছে।
রাত দশটার দিকে চাঁদ উঠলে রাসু কালীর খোঁজে বেরোল। হাঁটতে হাঁটতে সে চায়ের দোকানগুলোর কাছে এসে অধীর জলদাসের চালায় ঢুকল। অধীর একটা টুল এগিয়ে দিল রাসুকে। রাসুর গম্ভীর ক্লান্ত মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ চলবে নাকি জেঠা?’
রাসু মাথা নেড়ে সায় দিলে চৌকির তলা থেকে একটা দেশি মদের পাইট ও গ্লাস এনে তার পায়ের কাছে রাখল। রাসু বোতলটা নিয়ে ডাকল, ‘জল দে।’
অধীর পানির জগটা ভর্তি করে নিয়ে এলো।
দিনমান চায়ের ব্যবসা চালালেও রাতে এসব দোকানে দেশি মদের আড্ডা বসে। জেলেপাড়ার যুবক মাঝিরা সন্ধ্যার পর এখানে এসে জমা হয়।
রাসু খুব কমই এদিকে আসে। মদ খেলেও সে পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের সাথে বসে না। তাদের সামনে বেসামাল হওয়ার ভয়েই রাসু মদের আড্ডা এড়িয়ে চলে। তবে কখনো মনটা ভালো থাকলে কিংবা শুঁটকির মৌসুমে প্রচুর মাছ ধরা পড়লে রাসু একটু-আধটু মদ খায়। গভীর রাতে অধীরের দোকানে এসে বসে। তখন হয়তো লোকজন বড় বেশি থাকে না কিংবা পাড়ার ছেলেরা বেহেড মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।
পাইটটা শেষ করে রাসু যখন উঠল, তখন বেলাভূমি চাঁদের আলোয় দীপ্ত হয়ে উঠেছে। সমুদ্রে ঢেউয়ের দাপানি দূর থেকেও বোঝা যায়। এখন বাতাসে নুনের গন্ধটা ঈষৎ হাল্কা। একটা স্নিগ্ধতা বিচ্ছুরিত হচ্ছে ভেজা বালি থেকে। একটু পরেই জোয়ার এসে বেলাভূমিকে ভাসিয়ে দিয়ে যাবে। জলের উচ্ছ্বাস তখন জেলেপাড়া অবধি পৌঁছুবে।

রাসু সমুদ্রের জলসীমার কাছে গিয়ে চারদিকে দেখতে লাগল। কালীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রাসু একবার ভাবল কালী সম্ভবত ঘরে ফিরে গেছে। কিন্তু উত্তর দিকে একটা ছোট কোষানৌকাকে জলরেখার নিকটবর্তী বালিতে পড়ে আছে দেখে রাসু সেদিকে হাঁটা দিল। জেলেরা জলের এত কাছে তাদের কোষা রেখে যায় না। জোয়ারে নাও একবার ভেসে গেলে আর সহজে পাবার উপায় থাকে না।
রাসু ভাবল, এ নিশ্চয়ই কালীর কাজ। কারো উল্টানো হাল্কা কোষা নাও নিরাপদ ডাঙা থেকে টেনে নামিয়ে এনেছে। রাসু নৌকার কাছে পৌঁছে দেখে তার সন্দেহ মিথ্যে নয়। নৌকার ওপর কালী বসে আছে। দরিয়ার দিকে মুখ করে পা ছড়িয়ে বসে আছে কালী। তার হাতের ভর পেছন দিকে। বাতাসে চুল উড়ছে।

রাসু কালীর পেছনে দাঁড়াল। আর মুহূর্তে কালীর দেহের গন্ধ, চুলের গন্ধ সাগর জলের মেছো নোনতা গন্ধের সাথে একাকার হয়ে রাসুর মনের ওপর একটা আবর্ত সৃষ্টি করল। দেশি মদের নেশা তখন রাসুকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। এখন হাঁটলে পা টলবে এ কথা জানে রাসু। তাই সে নিঃশব্দে নৌকায় উঠে কালীর পাশে বসল। কালী যেন সমুদ্রের ঢেউয়ে চোখ রেখে বসেছিল তেমনি বসে রইল।
কালী একবারও ফিরে তাকাল না দেখে রাসু তার পিঠে হাত রাখল। স্পর্শ পেয়ে কালী এবার ফিরে দেখল রাসুকে। কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে কালী আবার সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাল।
জোয়ারের পানি তখন নৌকার তলদেশ ছুঁইছুঁই করছে। সমুদ্রের দিক থেকে হাওয়ার গতি এখন বেশ জোরালো। কালীর কেশগুচ্ছ বাতাসে লাফিয়ে উঠে রাসুর বকে মুখে ঝাপটা দিতে লাগল। রাসু কালীর পিঠে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকল, ‘কালী।’
কালী ঘাড় ফেরাল।
‘তুই দরিয়ার ঢেউয়ে কাকে খুঁজিস, কালী? দামোদরকে?’
কালী শব্দ না করে রাসুর জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘আমি দামোদর, আমার দিকে দেখ কালী। দামোদরকে আমিই জন্ম দিয়েছিলাম। সে তো আমার মতোই ছিল কালী, আমিই ছিলাম। আরো কাছে আয় কালী।’
বলতে বলতে রাসু কালীকে বুকের কাছে টেনে আনল। কালী কতক্ষণ সম্মোহিতের মতো রাসুর দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর রাসু দুই হাতে কালীর দেহটাকে জড়িয়ে ধরে নৌকার ভেতরে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর উন্মত্তের মতো কালীর গলায় বুকে ঠোঁটের স্পর্শ দিতে দিতে বলল, ‘তুই সতী, তুই সতী—তোর বুকে আমার সতীর গন্ধ। তুই সতী হয়ে যা কালী।’
রাসুর শক্ত বাহুর পেষণে কালী একবার শুধু অস্পষ্টভাবে আওয়াজ তুলে উচ্চারণ করল, ‘দামোদর।’
জোয়ার তখন নৌকাটাকে ঢেউয়ের ওপর ভাসিয়ে দিয়েছে। বঙ্গোপসাগরের নোনা বাতাসের গতি মধ্যরাতে ডুবন্ত বেলাভূমির ওপর দিয়ে হু হু করে বইতে লাগল। আর বাতাসের সাথে ঘুরপাক খেতে খেতে একটা চালকহীন কালো নৌকা অন্যায় ঢেউয়ের ওপর দুলতে দুলতে নিরুদ্দেশের দিকে ভেসে গেল।