ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

আর দশটা ব্যবসার মতো শিক্ষাও একটি ব্যবসা

আসাদুল হক খোকন

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২২, ২০২০

নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত বই বা নোট পড়ানো বা কিনতে বাধ্য করা, ভর্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ফি নেয়া বন্ধ করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এ বিষয়ে মাউশির সব আঞ্চলিক পরিচালক এবং জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের সইয়ে জারি করা ওই নির্দেশনাপত্রে বলা হয়, মাউশির আওতাধীন দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি স্কুল ও কলেজের বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি, সেশন ফি ও ফরম পূরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড–নির্ধারিত ফির চেয়ে অতিরিক্ত ফি এবং বিভিন্ন খাতে অর্থ আদায় করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত বই বা নোট পড়তে ও কিনতে বাধ্য করছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

নির্দেশনাপত্রে বিধিপরিপন্থী এসব কার্যক্রম বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। খুবই ভালো নির্দেশ। কিন্তু এই নির্দেশনা কে কতটুকু পালন করে, সেটি মনিটর করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়াই আসল কাজ। তা না হলে নির্দেশনা মাঠে মারা যাবে। অতিরিক্ত অর্থহীন বইয়ের বোঝা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড নড়বড়ে করে দেয়। আর গা হিম হয়ে যাবার মতো ভর্তি ফি, সেসন ফি-এর দণ্ড সৎ উপোর্জনের ভিভাবকদের মেরুদণ্ডে অস্ট্রিওপোরেসিসের ক্ষত তৈরি করে। তাছাড়া বাচ্চাদের স্কুলে নেয়া-আনার গাড়ি বা স্কুল ভ্যানওয়ালাদের সিন্ডিকেট কী ইনডিকেট করে ভূক্তভোগী অভিভাবকরাই একমাত্র তা বুঝবেন। রাজধানীতে হাজারো নিয়ন্ত্রহীন যানের ফাঁক-ফোকর গলে কিভাবে সেইসব স্কুলভ্যান বা স্কুলের বাচ্চাদের বহনকারী গাড়ি প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করে— সেই অব্যক্ত কাহিনি অব্যক্তই থাকে। দুর্ঘটনার শিকার হলে কী হয়, কীভাবে একটি বাচ্চা বা তার পরিবার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়— তা অজানাই থাকে...।

ভুলে ভরা অতিরিক্ত বই থেকে ভুল শেখানো শুরু হয় বাচ্চাদের। সেসব বইয়ের ভুল নিয়ে কথা বললে, ক্লাসে সংশ্লিষ্ট বাচ্চাদের কি কি ও কি রকম শারিরীক এবং মানসিক শাস্তি দেয়া হয়, তাও গোপনেই থাকে। স্কুলে হাবিজাবি মানের অতিরিক্ত বই পাঠ্য করতে বইওয়ালাদের কাছ থেকে নেয়া হয় লাখ থেকে হাজার হাজার টাকা। সে কারণেই ভুলে ভারা বই বাচ্চাদের পড়তে হয়।

স্কুলের গাড়ি ও স্কুল ভ্যানওয়ালাদের কাছ থেকেও নেয়া হয় টাকা। সে কারণে নির্দিষ্ট ভ্যান-গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো ভ্যান-গাড়ি ওই স্কুলে শিক্ষার্থীদের নেয়া আনা করতে পারে না। এসএসসি পরীক্ষায় নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফি এর চাইতে অনেক গুণ বেশি ফি নেয়াও কোনো নতুন ঘটনা নয়। এসবই হয় গোপনে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী।

মাত্র একটি ফ্লোরে কয়েকটি রুম নিয়ে শুরু করা স্কুলগুলো কিভাবে রাজধানীর বুকে শত কাঠার স্থায়ী ভবন গড়ে তুলে কয়েক বছরের ব্যবধানে? সে সব হিসাব কে নেবে? অথচ হাজার হাজার অভিভাবকদের টাকায়, শিক্ষা-ব্যবসার মোটা অংকের লাভের টাকায় গড়ে ওঠা ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা বারণ অভিভাবকদের। অথচ স্কুলের বার্ষিক নানা জাকজমক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী-রাজনৈতিক নেতা-পাতিনেতা— স্কুল কমিটির আত্মীয়-স্বজনদের সম্মানে মঞ্চে আসন হয়, সেখানে বসে অভিভাবকদের দেখিয়ে দেখিয়ে তারা তারা আপেল-আঙুর খান। বক্তব্যের নামে ফালতু গল্প বলেন।

যাদের টাকায় শত কাঠার শত কোটি টাকার জমি-বহুতল ভবন, তাদের কেউ মঞ্চে স্থান পান না। আপেল-আঙুর তো দূরের কথা। প্লে-নার্সারির ভর্তিতে লাখ থেকে শুরু করে কেন ৩০/৪০ হাজার টাকা নেয়া হয়? একটি প্রথম শ্রেণির বাচ্চার স্টেশনারির জন্য কেন ৫০ থেকে ৩/৪ হাজার টাকা নেয়া হয়? সে হিসাবটা কি একটু বোঝাবেন কেউ?

একটা ডিম, সিঙ্গারা, মিস্টি আর এক প্যাকেট পচা চিকেন বিরানি দিয়ে ক্লাস পার্টির নামে কেন একটি শিশুর কাছ থেকে এক হাজার থেকে পাঁচশো টাকা নেয়া হয়? কম ব্যয় করে তা থেকে অধিক মুনাফা লাভের এই উপায়কে কেন ব্যবসা বলা হবে না? কেন গার্মেন্ট, শেয়ারবাজার বা আর দশটা ব্যবসার মতো একেও ‘শিক্ষা ব্যবসা’ বলা হবে না? সোজা মেরুণ্ডের বদলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম হবে নমনীয় ও তেরা-বাঁকা মেরুদণ্ডের মানুষ।

লেখক: কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী