আরিফ আবদুল্লাহর গল্প ‘কল্পনার সবকিছু’

প্রকাশিত : জুন ২২, ২০২২

চৈত্র মাস। দুপুরবেলা আলুভর্তা আর পটল ভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে কাইলুলার নিয়তে কিছুক্ষণ শুয়েছি। ফ্যানের সুইচ চেপে দেখি, বিদ্যুৎ নেই। গরমে শুয়ে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। আবার প্রতিদিনের সুন্নাতের ধারাবাহিকতাও নষ্ট করতে মন চাইছে না। কিছুক্ষণ পর এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে রুবাইয়া হাজির হলো। এবং আমার হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে যখন দেখলো বিদ্যুৎ নেই ফ্যান ঘুরছে না, তৎক্ষণাৎ একেবারে ছুটে গিয়ে তালপাখা নিয়ে এলো। তালপাখাটার হাতল ভাঙা। তবুও সেটাকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বেশ হাওয়া তুলেছে সে। আমি শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছি।

রুবা বলে উঠলো, কি ব্যপার, খাচ্ছ না যে!
এক গ্লাস কেন? আরেকগ্লাস কই?
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমিই খাও আজ।

আমি রুবার হাত থেকে পাখাটা কেড়ে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলাম। রুবার কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছিল তখন। আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম।  বেচারি প্রতিদিন রান্নাঘরে আগুন ধোঁয়ায় সাথে যুদ্ধ করে রান্না করে। মাঝেমধ্যে আমিও গিয়ে ওর পাশে বসি। বেশিক্ষণ থাকতে পারি না গরমের কারণে। কিন্তু এ কেমন কথা! যেখানে ঠাণ্ডা বাতাস এবং শরবতের প্রয়োজনটা তারই সবচেয়ে বেশি। সেখানে সে নিজে শরবত না খেয়ে আমাকে খেতে দিচ্ছে আবার উল্টো আমাকেই বাতাস করছে!

শরীর তো একেবারে ঘেমে একাকার করে ফেলেছো। এই নাও আগে তুমি খাও। আমি বাতাস করছি। এই বলে আমি দ্রুত ওর হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে বাতাস করতে লাগলাম। আজ যে সকাল থেকেই বিদ্যুৎ ছিলো না এটা খেয়ালই করিনি। নতুবা এত ভ্যাপসা গরমে ওকে রান্নাঘরে থাকতেই দিতাম না।
রুবা বলে উঠলো, কি করছ এটা!
বেশি কথা না বলে খাও তো। সেই সকাল থেকে আগুনের পাশে বসে কাজ করেছো। শরীর ক্লান্ত। তোমার খাওয়া সবচেয়ে বেশি জরুরী!

রুবা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কিছু বললো না। সে ভালো করেই জানে আমি কেমন নাছোড়বান্দা। তবু কয়েক ঢোক কোনমতে গিলে আমাকে দিতে চাইলো, আমি জোর করে পুরো অর্ধেক খাইয়ে দিলাম।
হয়েছে হয়েছে। বাকিটা তুমি খাও এখন। ঘরে চিনি ছিলো না। না হলে দুই গ্লাস-ই বানাতাম।

রুবা গ্লাসের যেদিকে ঠোঁট লাগিয়েছে আমিও সেদিকে ঠোঁট লাগালাম। এবং বাকি অর্ধেকটুকু চোখ বন্ধ করে অল্প অল্প করে গিলতে লাগলাম। তৃপ্তি সহকারে পানীয় খাওয়া সুন্নাহ।
আলহামদুলিল্লাহ, দারুণ স্বাদ হয়েছে। হলফ করে বলতে পারি পৃথিবীতে শরবত বানানোর প্রতিযোগিতা হলে আমার বউ-ই জিতবে।
কচু জিতবে!

রুবা আমার ডান হাতের উপর চিমটি কাটলো। কোনো কিছুর প্রশংসা করলেই সে এমন করে চিমটি কাটে। অবশ্য প্রশংসা না করেও থাকা যায় না। গরমের দিন প্রত্যহ আমার জন্য শরবত বানিয়ে দেয় সে। লেবু এবং বেলের শরবত আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। ভাবতেই অবাক লাগে আল্লাহ পাক সব হারামের-ই কোনো না কোনো বিকল্প দিয়েছেন। যেমন মদ হারাম করে শরবতকে হালাল করেছেন। নয়তো আমরা কি আজ এতো চমৎকার সব পানীয় খেতে পারতাম!

হঠাৎ রুবা আমার কাঁধের উপর মাথা রেখে বলল, জান্নাতেও তোমার সাথে এভাবে শরবত ভাগাভাগি করে খেতে চাই প্রিয়।
আমি হেসে ফেলে বললাম, সেখানে কি কোনো কিছুর অভাব থাকবে যে ভাগাভাগি করে খেতে হবে?
না থাকলেও আমরা খাব ইন শা আল্লাহ। কেননা ওখানে তো যা মনে চাইবে তাই ঘটবে তাই না?
হুম। তা অবশ্য ঠিক।
আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?
হুম করো!
শুনেছি জান্নাতিদের অনেকগুলো হুর দেওয়া হবে। তোমাকেও যদি অনেকগুলো হুর দেওয়া হয়, আমাকে ভুলে যাবে না তো?

রুবার প্রশ্ন শুনে আর হাসি আটকাতে পারলাম না। হাসতে হাসতে বললাম, আরে পাগলি! তোমাকে তো ওদের সর্দারনি বানিয়ে দেওয়া হবে। তুমি যা বলবে ওরা তা-ই শুনতে বাধ্য। আর সেখানে তোমাকে সবচেয়ে সুন্দরী করে দেওয়া হবে। সমস্ত হুর থেকে বেশি সুন্দর হবে তুমি!

খুশিতে রুবার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। এরপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তবু আমি তোমাকে আর অন্য কারো হতে দিব না। তুমি শুধু আমার থাকবে। বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো। এই হলো আমার বউ। অল্পতেই হাসে আবার অল্পতেই কাঁদে, তার হাসি-কান্নার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ঠিক যেন শ্রাবণের আকাশের মতো। এই বৃষ্টি আবার এই রোদ!

দুই.
অফিস থেকে রাত আটটা নাগাদ বাসায় ফিরলাম। পাশেই মসজিদ। এশার নামাজ পড়ে এসে ঘরে ঢুকতেই রুবা আমার হাত ধরে ফেললো। পাশের রুমের দিকে টানতে টানতে ফিসফিসিয়ে বলল, এদিকে আসো। কথা আছে।

কি ব্যপার! হঠাৎ গুপ্তচরদের মতো আচরণ করছো যে! ঘটনা কী?
বলছি শুনো। আমার এক বান্ধবী। নাম মিতু। সে বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে।
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, বলো কি! কেন! কেন!
আমিই তাকে আসতে বলেছি।
কি জন্য?

কিছুদিন আগে ওর বাবা, মা, স্বামী সন্তানসহ সবাই বাস এক্সিডেন্টে মারা যায়। ভাগ্যক্রমে সে মরতে মরতে বেঁচে গেছে। মাসখানেকও যায়নি এরমধ্যেই শ্বশুড়-শাশুড়ি তার ওপর নানা রকম নির্যাতন করতে থাকে। তবুও বেচারি সবকিছু সয্য করে থাকতো। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো তার দেবর। সে মিতুকে প্রতিদিন অপকর্মের প্রস্তাব দিতো। হুটহাট ওর রুমের ভেতর প্রবেশ করে নানা আজেবাজে কথাবার্তা বলতো। তবুও মিতু মুখ বুজে সব সহ্য করে যেত। কিন্তু কাল পরিস্থিতি এমন খারাপ অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছিলো যে সে রুম থেকে কোনরকমে ছুটে বের হয়ে এসে রিকশায় উঠে সোজা রাজবাড়ী স্টেশনে চলে আসে। এরপর আমাকে ফোন করে। আমিই ওকে এখানে আসতে বলি।

সে কি, এখন আমার রুমে?
হুম। সেই আধঘণ্টা ধরে কাঁদছে তো কেঁদেই চলছে৷ কি করি বলো তো?
ওর বাপের বাড়িতে কেউ নেই?
না। কেউ নেই। এমনকি বাড়িটা পর্যন্ত ওর শ্বশুর মশাই বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ভালোই তো সমস্যা হয়ে গেল তাহলে!

যত সমস্যাই হোক। তুমি ওকে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বলিও না প্লিজ। মিতু আমার অনেক ভালো বন্ধু। আমরা একসাথে মাদ্রাসা পড়েছি। একসাথে বড় হয়েছি। বাবা মরে যাওয়ার পর যখন মাদ্রাসা পড়া আর সম্ভব ছিলো না তখন থেকে আমার সমস্ত দায়িত্ব সে তুলে নিয়েছিলো। আল্লাহ পাক তার মতো একজনকে আমার বন্ধু করেছে এটা আমার পরম সৌভাগ্য।

কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল রুবা। আমি ওর চোখ মুছে দিলাম। সত্যিই অনেক কষ্ট করে হাফেজা হয়েছে রুবা৷ মা-বাবা না থাকার কষ্ট নিয়ে কুরআনের হাফেজ হওয়ার জন্য দিনের পর দিন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, এই পাগলি! এভাবে আর কেঁদো না তো৷ তোমার বান্ধবী যতোদিন ইচ্ছে থাকুক এ বাড়িতে। আমি কিছু বলবো না!

রুবা চোখ মুছে জানলার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে রইলো। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, বিয়ের এই এতদিনে তোমার কাছে কখনো কোনো কিছুর জন্য রিকুয়েস্ট করিনি। আজ একটা রিকুয়েস্ট করবো। রাখবে?
রাখবো না মানে? একশোবার রাখবো। বলো কি কথা!
তুমি মিতুকে বিয়ে করে ফেলো প্লিজ!

রুবার কথা শুনে আমি থ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুলো না আমার। সে যে এমন কথা বলতে পারে কল্পনাতেও ভাবা যায় না। যে মেয়ে জান্নাতের হুরদের কাছে আমার ভাগ দিতে চায় না সে কি করে দুনিয়াতেই অন্য কারো হাতে আমাকে তুলে দেওয়ার কথা ভাবতে পারে! আমি কি বলবো না বলবো বুঝতে পারছি না।

রুবা আমার হাতদুটো শক্ত করে ধরে আবার বলল, আমি জানি তুমি আমাকে ভীষণ ভালোবাসো। কিন্তু ওই মেয়েটার কথাও তো একবার ভাবো। যে আমাকে এতগুলো বছর সাহায্য করে এসেছে এখন ওর বিপদে যদি আমরা এগিয়ে না আসি তবে কে আসবে বলো?”
তাই বলে বিয়ে! এটা কি করে হয় রুবা!
কেন হয় না? তুমি তো সুন্নাত পালনে যথেষ্ট সচেতন। তাহলে এই সুন্নাহটার কথা ভুলে যাচ্ছো কিভাবে?

আমি রুবার দিকে ভালো করে তাকালাম। সে যা বোঝাতে চাচ্ছে সেটা আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি। কিন্তু এর পরেও তো কথা থেকে যায়। রুবা কি অন্য কাউকে মেনে নিতে পারবে! আজ না হয় আবেগের ঠেলায় বলছে, কিন্তু কাল!

আমি মৃদু গলায় বললাম, অন্য কাউকে তুমি মেনে নিতে পারবে না রুবা। তাই এসব কথা এখন বাদ দাও। চলো খেতে বসি।
একটা মেয়ে কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছে, কি করবে না করবে ভেবে কোনো কুল-কিনারা পাচ্ছে না, আর তুমি কিনা খাওয়া নিয়ে পরে আছো! এই তোমার বিবেক রাফান?
এবার একটু লজ্জা পেলাম আমি। রুবা যে আমাকে মিতুর সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য অনড়, এতক্ষণে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না।

কি হলো! এভাবে চুপ হয়ে গেলে যে! আমি কিন্তু মিতুর সাথেও কথা বলেছি। সে রাজি আছে। আর তুমি এটা ভেবে পেরেশান হয়ে যেও না যে আমি তোমাদের বিয়েতে কষ্ট পাবো! বরং আমার অনেক ভালোই লাগবে। মিতুর মতো এতো ভালো বন্ধুর সাথে একসঙ্গে থাকতে পারা তো আমার জন্য ভাগ্যের ব্যপার। তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না কি পরিমাণ ভদ্র মেয়ে ও! দ্বীনদারিতেও আমার থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। ওর সুরা তেলাওয়াত যদি একবার শুনো তবে পুরো পাগল হয়ে যাবে। এত্ত মধুর কণ্ঠ মনে হয় না গোটা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে! আর নাশিদ! সে তো...  ”

আমি রুবাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, হয়েছে হয়েছে। এত গুণগান করতে হবে না তোমার বান্ধবীর। যদি তোমার কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে আমি রাজি আছি। কথাটা বলেই জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। রুবা খুশিতে বাকবাক হয়ে উঠলো। আমার হাত ধরে বললো, পাত্রী দেখতে যাবেন না হুজুর?
তার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি দেখেছো তাতেই চলবে।
পাত্রী কিন্তু পরির থেকেও বেশি সুন্দরী। আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ও। দেখলে একেবারে টাশকি খেয়ে উল্টে যাবেন। হিহিহি..
হয়েছে আর ঘটকালি করতে হবে না চলো এবার খেতে চলো।

না এখন তো আমি খাবো না। আগে তোমাদের বিয়ে হবে এরপর খাবো। রুই মাছ আর পটল দিয়ে নয়। পুরো তিন প্যাকেট চিকেন বিরিয়ানি নিয়ে আসবা তিনজনে মিলে এক প্লেটে খাব।

যেমন কথা তেমন কাজ। রাত দশটার আগেই বিয়ে হয়ে গেল আমাদের। মোহর মাত্র আট হাজার টাকা। পাঁচ হাজার নগদ, তিন হাজার টাকা বাকি। তাও আবার প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে ধার করে দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেওয়া! অবশ্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাটা আমার টাকাতেই করতে হলো।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রুবা মিতু আর আমি এক প্লেটে খেতে বসেছি। মিতুর মুখে কোনো কথা নেই। কিছুই খাচ্ছে না সে। রুবা নানা কথা বলে হাসাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু মিতু কিছুতেই হাসতে না। থেকে থেকে চোখ মুছছে শুধু। রুবা এক লোকমা বিরিয়ানি মিতুর মুখে তুলে দিয়ে বলল, নে হা কর। মাদ্রাসায় থাকতে তোর মন খারাপ হলে আমার হাতে খাইয়ে নিতি মনে নেই?

হঠাৎ মিতু রুবাকে জড়িয়ে ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোকে আমি আল্লাহর জন্য ভালোবাসি রে। খুব ভালোবাসি। আমার জন্য যা করলি তা অন্য কেউ হলে কখনোই করতো না। তুই আমার বোনের থেকেও বেশি...

এই পাগলি! কি শুরু করলি তুই! দেখোতো কি শুরু করে দিয়েছে ও! কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে একদম। একে একটা কবিতা বলে থামাও না!

আমি কেশে উঠলাম। রুবা হেসে উঠলো।

তিন.
আজ আমাদের বেড়াতে যাওয়ার দিন। সপ্তাহের এই একটি দিন আমরা নানা জায়গায় ঘুরতে যাই। অবশ্য তেমন কোনো দর্শণীয় জায়গায় নয়। আশপাশের নদী, শালবন, বিল কিংবা কাশফুলের মাঠে। রুবা আজ ঠিক করেছে কাশফুল দেখতে যাবে। শরতের বিকেল মানেই স্নিগ্ধ বাতাসে হাতে হাত ধরে কাশফুলের মাঠে ঘুরে বেড়ানোর দিন। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো মিতুকে নিয়ে। এতদিন তো ছিলাম দুজন মানুষ। সাইকেলে উঠে বেশ যাওয়া যেত। এখন তিনজনের কারণে হয়েছে সমস্যা। মিতুর জন্য আলাদা সিট তো নেই! সামনে বসে নিয়েও যাওয়া সম্ভব নয়। যা এবড়োখেবড়ো মেঠোপথ। ধাক্কা খেতে খেতে জীবন বের হয়ে যাবে!

রুবা অবশ্য চট করে সমস্যার সমাধান করে ফেললো। সে ছোট্ট দুটি কাগজের টুকরো নিয়ে এসে বলল, এই কাগজ দুটিতে দুটি নাম লিখে মুড়িয়ে দিয়েছি। যার নাম উঠবে সে যেতে পারবে এবং যে হারবে সে পরের সপ্তাহে যাবে। ডিল?
মিতু আর আমি একযোগে বলে উঠলাম, ডিল।

রুবার কথামতো কাগজ দুটো ছেড়ে দিলাম বিছানার উপর। মিতুকে বললাম যেকোনো একটি কাগজ তুলতে। সে তুলে খুললো। ভেবেছিলাম রুবার নামটাই উঠবে কিন্তু আমার ধারণা ভুল। উঠলো মিতুর নাম। মিতুও চেয়েছিলো রুবার নাম উঠুক। নিজের নাম দেখে মন খারাপ করে সে বলল, একবার করলে হবে না। আরও তিন বার করতে হবে। যার নাম দুয়ের অধিক উঠবে সে-ই যাবে।

মিতুর কথা মতো আরো তিন বার কাগজ ফেলা হলো এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো তিন বারই মিতুর নামটাই উঠলো! রুবা আনন্দে মিতুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি মন থেকে এটাই চেয়েছিলাম রে। তোরা একান্তে একটু ঘোরাফেরা কর, পরিচিত হ। আয় এখন তোকে একটু সাজিয়ে দিই। চোখে কাজল না হলে আবার কবি সাহেবের কবিতা ঠিক মতো আসে না!

আমি যাব না। তুই যা না প্লিজ!
উহু। এটা বললে তো হবে না। আমাদের এগ্রিমেন্ট তো এরকম ছিল না!
আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।
কেন কি সমস্যা?
তোর বরকে নিয়ে যাই পরে যদি তোর মন খারাপ হয়!
ছিহ! এসব কি বলিস তুই! আমার বর মানে? তোর কিছু না? আর এতদিনে তুই আমাকে এই চিনলি? আচ্ছা যেতে হবে না কাউকে!

রুবা মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। মিতু ধীরে ধীরে রুবার কাছে গিয়ে বলল, সরি। আর কখনো বলবো না এভাবে। আমি যাচ্ছি। দ্রুত ফিরে আসবো ইন শা আল্লাহ।
এই তো ভালো মেয়ের মতো কথা। আয় এখন কাজল দিয়ে দেই।

রুবা মিতুকে সাজিয়ে দিচ্ছে। আমি ততক্ষণে সাইকেলটা বের করে পরিষ্কার করতে লাগলাম। মাত্র কয়েকদিন পরে ছিল তাতেই কেমন ধুলোবালিতে ভরে গেছে! সাইকেলে উঠে দোয়া পড়ে প্যাডেলে পা রাখলাম। মিতু উঠে বসলো। রুবা আমার কাছে এসে বলল, সাবধানে নিয়ে যাবা! রাস্তা কিন্তু অনেক উঁচুনিচু। পরে গেলে তোমার খবর আছে!

তা তো আছেই! শুধু বান্ধবীর প্রতিই দরদ। আমার প্রতি একটুও দরদ নাই তোমার। ইদানীং আমার কথা ভুলেও ভাবো না তুমি! অভিমানের সুরেই কথাগুলো বললাম আমি। অবশ্য মিথ্যে কিছু বলিনি। আমার সাথে আগের মতো সময় দেয় না রুবা। শুধু বান্ধবী আর বান্ধবী।

রুবা হাসতে হাসতে বলল, কবি সাহেবের অভিমানও হয় দেখছি!
রুবার হাসিতে আমার কিছুটা রাগ হলো। আমি বিদায় না নিয়েই প্যাডেলে চাপ দিলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই মনে পড়লো, সর্বনাস! চাকায় তো ঠিকমতো হাওয়াই দেওয়া হয়নি! এখন তো ফিরেও যাওয়াও যাবে না। যাক, শেষমেশ কষ্ট করে পৌঁছে গেলাম কাশফুল মাঠে। সাইকেল স্যান্ড করে রেখে হাঁটতে লাগলাম দুজনে। মিতু তো এসেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। কাশফুলের এতবড় মাঠ আগে নাকি কখনো দেখে নি সে।

শাদা রূপালী রোমশ ফুলগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, মাশাল্লাহ! কত চমৎকার তাই না?
হুম। ফুল মানেই রবের চমৎকার সৃষ্টি। আমরা প্রায়ই এখানে ঘুরতে আসি। অনেক ভালো লাগে জায়গাটা!
জানেন, আমি কখনো এতোবড় খোলা মাঠে স্নিগ্ধ বাতাসে হাঁটার সুযোগ পাইনি।
কেন?
কারণ বিয়ের পরই তো আমার স্বামী চলে গেল শহরে। আর আমি পরে রইলাম ঘরের এক কোণে। উনি আসলে ওনার সাথে কথা হতো কিন্তু কখনো ঘুরতে যাওয়ার কথা বলতে পারিনি। তবে বলেছিলাম একবার এবং সেটাই শেষবার। সেদিন ঠিকমতো সকালের অজিফাও আদায় করা হয়নি। উনি ডেকে বললেন দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে। সবাই মিলে বান্দরবান ঘুরতে যাবো। খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এলো। বাবা আর মাকেও সাথে নিলাম আমি। বাইজিদকে কোলে নিয়ে ওনার হাত ধরে উঠলাম সকাল নয়টার বাসে। বাস ছুটলো সোজা সাজেকতলীর দিকে। মাঝপথে হঠাৎ কি যেন দুম করে উঠলো। এরপর আর কিছু বলতে পারি না...। চোখ খুললাম অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। যদিও বেশি ক্ষতি হয়নি আমার। ডান পাশের হাতটায় চোট পেয়েছি একটু। কিন্তু এরপর যখন একে একে মা, বাবা, বাইজিদ সহ সবার ডেডবডি দেখতে হলো আমার তখন পুরো কলিজটা যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠলো। জানেন, ওনাকে ভালোবাসি কথাটা বলারও সুযোগ পাইনি আমি!.. ”

মিতু হিজাবের আঁচলে চোখ মুছলো৷ আমি ওকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজছি কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলে উঠতে পারছি না। আসলে এমন কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো উপযুক্ত ভাষাও সম্ভবত পৃথিবীতে নেই।

মিতুই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, চলেন ওদিকটায় বসি।
আমরা ঘাসের উপর বসলাম। আমি বললাম, আপনার কি খেতে ভালো লাগে?
হঠাৎ এই প্রশ্ন!
না মানে, যাওয়ার সময় নিয়ে যাওয়া যাবে। রুবার তো প্রতিদিন একটা করে আইসক্রিম বা ললিপপ চাই-ই চাই! আর আপনার?
বিশেষ কিছু না। তবে আইসক্রিম আমারও ভালো লাগে।
আর কি ভালো লাগে?
নৌকায় উঠতে ভালো লাগে। জানেন আমি আগে প্রায়ই কল্পনা করতাম আমার প্রিয় মানুষটার সাথে কোনো এক সন্ধ্যার অন্ধকারে নৌকায় উঠে বসবো। হারিকেনের আলোয় গুটিসুটি মেরে অনেক অনেক গল্প করবো। চারদিকের শুনশান নীরবতায় টলমল জলের উপর চোখ রেখে দুজনে মিলে আসমানের রবের কাছে গভীর এক শুকরিয়ায় ভেঙে পড়ব।

বাহ! আপনি তো অনেক সুন্দর করে কথা বলেন। আরেকদিন আপনাকে নৌকায় ওঠাবো ইন শা আল্লাহ। আজ চলুন। দেরি হয়ে গেলে আবার মাগরিবের নামাজে জামাআত তরক হয়ে যাবে!

মিতুকে নিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরলাম। এসে দেখি রুবা নেই। অনেক ভালো করে খুঁজেও তাকে কোথায় পেলাম না। তবে পাওয়া গেল তার হাতে লেখা এক টুকরো চিরকুট। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—

প্রিয় আমি থাকলে তোমারা একে অপরের সাথে ভালো করে কথা বলতে পারবে না সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। তাই প্লান করে রেখেছিলাম তোমাদের কাশফুল মাঠে পাঠিয়ে আমি কিছুদিন বাপের বাড়িতে থাকবো। প্লান বলছি এই কারণে যে, কাগজে আমার নামই ছিল না। দুটাতেই মিতুর নাম লিখেছি। এজন্য যতবারই কাগজ তোলা হোক মিতু ছাড়া অন্য কারো নাম উঠবেই না। হিহি! কেমন বোকা বানালাম! যাই হোক, টানা পনেরো দিন পর ফিরছি ইন শা আল্লাহ। এই পরনোটা দিন একান্তই তোমাদের দুজনের হোক। ইতি তোমার রুবা

মিতুও চিঠিটা পড়লো। পড়েই আমার দিকে তাকালো। আমি হাসতে হাসতে বললাম, দেখেছেন কি পাজি মেয়ে! যাক, ভালোই হলো। বহুদিন শ্বশুরালয়ে যাওয়া হয় না। এই সুযোগে একবার সেখানে যাওয়াও হলো আর সাথে আপনারও নৌকায় ওঠার সাধটাও মিটলো!

মানে! রুবার বাড়ি যেতে কি নৌকায় উঠতে হয়?
উঠতে হয় বৈ কি! পুরো দেড় ঘন্টা নৌকার পাটাতনে বসে পাড়ি দিতে হবে।

মিতু খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। বলল, বাহ! বেশ তো মজা হবে তাহলে! আপনি নামাজ পড়ে আসুন। আমিও নামজ পড়ে তৈরি হয়ে নেই।

এই প্রথম মেয়েটার মুখে বেশ হাসি দেখলাম আমি। তাও হুবহু রুবার মতোই হাসি! শুধু হাসিই নয় দুজনের ভেতর অদ্ভুতভাবে আরও বেশ কিছু মিল আছে।

নামাজের পর মিতুসহ রওনা দিলাম বাতাসিয়া ঘাটে। নৌকা পেতেও দেরি হলো না। ঘাটেই বাঁধা ছিলো। বেশ সুন্দর ছিমছাম নৌকা। ছইওয়ালা এবং পরিপাটি। ভেতরে হারিকেন জ্বলছে। মাঝি ছেলেটা আমাকে দেখে সালাম দিলো। আমরা উঠে বসলাম। খুশিতে মিতুর চোখে পানি চলে এলো। সে যেমনটা চেয়েছিলো তেমনটাই হচ্ছে। শুধু প্রিয় মানুষটা আমি হতে পেরেছি কি-না সেটাই ভাবছি। নৌকা চলতে শুরু করেলো। সিরসির বাতাস বইছে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। প্রচন্ড বৃষ্টি। মিতু আমার হাত ধরে বলল, আলহামদুলিল্লাহ! আমি আমার কল্পনার সবকিছু পেয়েছি!