আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ২১
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : এপ্রিল ১৩, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
ভরা বর্ষায় নানাবাড়ি বেড়ানোর যেমন এক জলজআনন্দ সুখ ছিল, বর্ষার পানি আসার মুহূর্তগুলোতে নানাবাড়ি যেতে পারাটাও ছিল আরও এক বাড়তি বোনাস। কীভাবে মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে বর্ষার জল গড়াতে গড়াতে একটার পর একটা ফসলের ক্ষেত ভরিয়ে দিচ্ছে, চাক্ষুস করাটা ছিল সত্যিই এক অনির্ণেয় সুখ। মানুষের শরীরে যেমন কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবন আসে, যৌবন যেমন পৃথিবীর রূপরসে পরিব্যপ্ত হয়, তেমনি শুকনো খটখটে মাটিগুলো কীভাবে জলে জলে ভরে উঠছে, পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে জল কীভাবে সয়লাব করে দিচ্ছে পুরো ক্ষেতকেই, তারপর দিনের মধ্যেই পানি বেড়ে বেড়ে কীভাবে গাছগুলোকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, তলিয়ে নিচ্ছে নিচে, আদিগন্ত ভূমিই কীভাবে হয়ে উঠছে জলবতী- সেসব দেখা ছিল এক আবহমান সুখ।
আমাদের নানাবাড়ির পাশের নিচু জমিতে প্রতি বছর বোনা হতো পাট। পাট গাছের ছিপছিপে সবুজ শরীরের আলাদা একটা মোহিনী রূপ ছিল। সম্ভবত এই রূপের কারণেই ওর শরীরে মোহমুগ্ধ হয়ে থাকত ছ্যাঙ্গার দল। দুনিয়ার সব ছ্যাঙ্গা কোথা থেকে এসে যে বাসা বাঁধতো! কিলবিলিয়ে পাতায় পাতায় বসে আছে তো, পরমুহূর্তেই গা বেয়ে নেমে আসছে নিচে। শুধু কি পাট গাছ আর পাটক্ষেত- কোনো কোনো ছ্যাঙ্গা সাহসী হয়ে বাড়িতে এসেও হানা দিত। কোনোটি দুয়ার ঠেলে উঠে আসত সিঁড়ি-বারান্দায়! দেখলেই গা রি রি করে উঠত ঘৃণায়। ছোট খালাম্মা কোথা থেকে শুনেছে, দোজখ নাকি ভরে থাকবে ছ্যাঙ্গায় ছ্যাঙ্গায়। ছ্যাঙ্গার ভয়ে আমার আর পানি বা পানিপারে একচ্ছত্র দিগভ্রমণ করা হতো না। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঘরের ভেতর বসে থাকতাম। আবার গিয়ে বসতাম পুকুরপারের সিঁড়িঘাটে।
নানাবাড়ির পুকুরটার পার ছিল বেশ উঁচু। চারদিক থেকেই যাকে বলে সুরক্ষিত। পুবে মসজিদ, তার পাশেই মাঠ, কাচারি ঘর, প্রাইমারি স্কুল, উত্তরে সেই ট্রেন লাইনের মতো লম্বা পুরনো দরদালান, পশ্চিমে বাগিচা, জঙ্গল, দক্ষিণে বিশাল সেই ঈদগাঁও। তার পেছন দিয়ে চলে গেছে আবদুল্লাহপুর-রাজাবাড়ি বাজারের রাস্তা। এই দক্ষিণ আর পশ্চিমের কোণ দিয়েই পুকুরটা কেটে এমনভাবে নিচু করা হয়েছিল, যাতে বাইরের ভরা বর্ষার পানি একটা অবস্থার পর পুকুরে নেমে আসতে পারে। এর লক্ষ্য ছিল, পুকুরের পানি যেন নতুনভাবে রিফ্রেশ হয়ে উঠে। আবদ্ধতার স্যাঁতস্যাতানি কাটিয়ে প্রাকৃতিক সুখ পায়। সেই নালা দিয়ে কী কেবল বাইরের জোয়ারের পানিই আসতো? সেই ঢলঢলানি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পুকুরে নেমে আসত যে কত রকমের মাছ, এসে শুধু সাঁতরাতোই না, কোনো গর্তখন্দর বা জঙ্গুলে বিস্তারে নিজেদের ঠাঁই খুজে নিত, বংশবিস্তার করত। আমার মৌলকৈশোরে একবার সুযোগ হয়েছিল নালা দিয়ে বাইরের সেই ঢলঢলানি পানির প্রবেশদৃশ্য দেখার।
সেটা রাতের কথা। বর্ষার পানি পুকুরে উপচে উপচে পড়ছে শুনে আমরা- মানে আমি আর ছোটমামা, পাশের বাড়ির নেলি মামা, অরুণ, সবাই মিলে ছুটে গিয়েছিলাম পুকুরের সেই দক্ষিণ-পশ্চিম কোণাটায়। সেখানে টর্চলাইট ফেলে দেখেছিলাম পানির স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা মাছদের পুকুরে নামবার দৃশ্য। প্রকৃতি সেদিন সত্যিই আমাকে বিমুখ করেনি। কী মাছ, আজ আর বলতে পারব না, নলা নাকি পুঁটি, ট্যাংরা, খলসেও হতে পারে। তবে মাছের পর মাছ, বেশ কিছু মাছকে দেখেছি পানির স্রোতে যেন নিজেকে আলগোছে ছেড়ে দিয়েছে এমনভাবে ভাসতে ভাসতে পুকুরের ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে। সেদিন কী আর জানতাম যে, সে-রাতের এই ছোট্ট দৃশ্যপটটিও আমার জীবনের এক অন্যতম সুখস্মৃতির আসন দখল করে থাকবে?
কোথা থেকে যে আসত বর্ষার এত পানি! আজ ভাবলেও অবাক লাগে। সেই সোয়ারিঘাট থেকে দু’পাড় উপচে পড়া বুড়িগঙ্গার পানির মধ্য দিয়ে শুরু হতো আমাদের যাত্রা। চার পাঁচ ঘণ্টা ধরে এই বিপুল অসীম স্রোতবেয়ে পানিপথেই যেতে হতো নানাবাড়ি! পুরো পথটিই সমুদ্রের মতো পানির অসীম পুঞ্জ ধারণ করে রাখত। পরে শুনেছি, আমাদের নানাবাড়ি ছিল পদ্মাবিধৌত অঞ্চল। পদ্মা উপচানো পানি এসে পুরো বিক্রমপুর, কেরানিগঞ্জ ওদিকে মানিকগঞ্জের বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করে দিত। নতুন আসা পানির এই অন্তহীন স্রোতকে ঘিরে বদলে যেত জীবনাচার। নানাবাড়িটা হাওর অঞ্চল না হলেও সে-এলাকার কিছু বৈশিষ্ট্য যেন ধারণ করে রাখত নিজের মধ্যে। ব্যাপারী বাড়ি থেকে খাঁ বাড়ি, খাঁ বাড়ি থেকে মোল্লা বাড়ি, মোল্লা বাড়ি থেকে কাজি বাড়ি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছিল আলাদা আলাদা। বর্ষায় একবাড়ি থেকে আরেকবাড়ি হেঁটে যাওয়া যেত না। এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ির মাঝখানে কোথাও হয় ডোবা, কোথাও বা নিচু পথ, কোথাও বা জঙ্গলাচ্ছন্ন থাকত। ফলে বর্ষায় এক বাড়ি থেকে আরেকবাড়ি নৌকা ছাড়া যাওয়াটা ছিল দুষ্কর। তবে যতই দিন গিয়েছে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। শরিক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ঘরবাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে। বাড়তে বাড়তে এ বাড়ির মাটির সঙ্গে ও বাড়ির মাটির মধ্যেও তৈরি হয়েছে বন্ধন। এখন আর পানি যত্রতত্র প্রবেশের সুযোগ পায় না। আগের মতো পানির সেই প্রবল স্রোতের ঢলও নেই। বদলে গেছে বর্ষার চরিত্রটাই! তখন চারদিকে জলাবদ্ধতা বলে বাড়ির মধ্যেই নানা কাজকর্ম বা খেলাধুলা করে সময় কাটাতে হতো। কেউবা আবার এই বর্ষার সময়টাতে ব্যস্ত থাকত মাছ মারা নিয়ে।
আমরাতো আর তেমনভাবে মাছ মারায় যুক্ত হতে পারতাম না। তবে বাড়ির চারপাশে ঘুরে ঘুরে পানির দিকে তাকিয়ে মাছ দেখাটা ছিল প্রিয় এক নেশা। পানির মধ্যে মাছের ঘোরাফেরা জীবনাচারণ সঞ্চরণশীলতা অবাক হয়ে দেখতাম। দেখতাম কীভাবে ধীরে ধীরে ভেসে সামনে আসছে, থির হয়ে অবলোকন করে নিচ্ছে সবকিছু। তারপর হঠাৎই লেজ নাড়িয়ে একটা বাঁক দিয়ে দ্রুত ভঙ্গিতে মিলিয়ে যাচ্ছে অন্য কোনোদিকে! টের পাওয়া যেত পানির ভেতর ওদের রয়েছে নিজস্ব এক ভুবন! আমরা মানুষ নিশ্চিতভাবেই ওদের সেই শান্তিময় জগতে হানা দিতাম ভয়ংকর ত্রাস হয়ে। আমাদের মধ্যে যে সবাই কেবল মাছের জীবনের চালচিত্র দেখতে গিয়েছে তা না, কারোর কারোর হাতে থাকত ট্যাটা। এদের মূল টার্গেট ছিল টাকিমাছ। বিশেষ করে বর্ষার পানি যখন পুরো ভরাট হয়ে যেত, তখন শোলমাছগুলো উজিয়ে উঠতো। মা শোলমাছের সঙ্গে থাকত হাজার হাজার পোনা। ট্যাটায় গেঁথে ফেলা হতো বড় শোলমাছটিকে। আর বিশেষ এক জালে ধরা হতো পোনার ঝাঁক। মনে আছে সেই শৈশবেই পোনামাছগুলোর জন্য মন কেমন করত! পোনাগুলো বেঁচে থাকলে কত্তো কত্তো শোল মাছ হতো! তবে অস্বীকার করবো না, সেই পোনার চচ্চড়ি বা বিশেষ কোন পদটাও খেতাম মজা ভরে, তখন আর বিবেকটিবেকের দায়ভার কাজ করতো না!
একটা সার্কাস পার্টিকে ঘিরে যেমন একসঙ্গে আসে- জাদুকর, অ্যাক্রিবেটিক, জোকার, বাদ্যশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, বাঘ, বানর, হাতি-ঘোড়া; জোয়ারের পানির সঙ্গেও যেন তেমনি জীবনের বিপুল অনুষঙ্গ বা সম্ভার পোটলাপোটলি বেঁধে হাজির হতো। এদের মধ্যে হলো এই মাছের দল, কোথা থেকে যে আসত ওরা দলে দলে, কেউ আবার একা একা- পেছনে দু’হাত জোড় বেঁধে হাঁটা ভদ্রলোকের মতো আনমনা। ওরা আসত বটে, তবে ফিরে যেতে পারত কিনা সন্দেহ! চারদিকে মানুষ যেভাবে জাল বিস্তার করে রাখত, নির্মাণ করে রাখত ধরবার ফাঁদ, অধিকাংশরাই নগদ নগদ মানুষের খাদ্যতালিকায় চলে যেত। এছাড়াও কোনো কোনো মাছ আটকা পড়ে থাকত খানাখন্দে, কেউ বা আবার পুকুরের মায়ার কুহকে পড়ে থেকে যেত চারদেয়ালের সীমানায়। পানি শুকিয়ে যাবার পর বেরোনোর পথ পেত না। এই মাছের মতোই যেন হাজারো পসরা নিয়ে হাজির হতো পানির নিচের উদ্ভিজগুল্মলতা। টলটলে স্বচ্ছ পানির নিচে তাকালে কত রকমের যে বাহারি উদ্ভিজগুল্মের দেখা মিলতো, সে এক রহস্যমোড়ানো জগত! যা আমার ভ্রমণিয়া পথকে দিয়েছে রোমাঞ্চের স্বাদ! এছাড়াও আসত বক, ডাহুক বা মাছরাঙা। এরা হয়ত সব সময়ই থাকত, বর্ষায় দৃশ্যমান হতো বেশি বেশি।
চলবে