আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ১৯
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : মার্চ ২৯, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
নতুন সিনেমা আসার সংবাদ জানানো মাইকের এই উত্তেজনা থামতে না থামতেই খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, পাশের বাড়ির মুসা নাই। নাইতো নাই, পুরা হাওয়া। কোথায় গেছে কোথায় গেছে! কোথায় আবার? চান্দনা চৌরাস্তার উল্কা সিনেমা হলে। ফার্স্ট দিনের ফার্স্ট শোটাই যে ওর দেখা চাই। কোনও ছাড়ন নাই। ওকে কেউ শিকল দিয়েও বেঁধে রাখত পারত না। শুধু কি ফার্স্ট শো, তার পরের দিনও দ্যাখো, মুসা নাই। আবারো চলে গেছে উল্কা হলে। মনে করেছেন দু’দিনের দুটি শো দেখেই মুসা শান্ত হয়েছে! আপনার অনুমান সম্পূর্ণ ভুল। প্রায়শই সাতদিনের সাতদিনই ও দেখে আসত সেই সিনেমা। পরের সপ্তাহেও যদি চলতো, অব্যাহত থাকত ওর লাগাতার দর্শন।
টাকা পেত কোথায়? কেন, ঘরের পাশে শিমের টাল আছে না? সিনেমার টাকা ভূতে জুটাতো। চুপচাপ টাল থেকে শিম তুলে, কখনো বা শসা তুলে, কখনো বা লাউ নিয়ে ছুটে যাও কাশিমপুর বাজার। সিনেমার টিকেটের আর কত মূল্য? যাওয়া-আসার ভাড়া? কোনাবাড়ি থেকে বাসে ঝুলে পড়লেই হলো! আর পড়াশোনার কথা জানতে চাইছেন? সিনেমার চেয়ে কি সেটা গুরুত্বপূর্ণ? তবে তখন যারা সিনেমা দেখতে যেত হলে, বাড়তি একটু টাইম নিয়েই যেত। হলের সামনে দেয়ালের ডিসপ্লেগুলোতে যে সিনেমাটির বিভিন্ন দৃশ্য দেয়া থাকত, তা দেখতে হবে না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে? শুধু কি দেখা, দেখে দেখে একেবারে মুখস্থ করা চাই। একটি সিনেমার টার্নিং পয়েন্টগুলোর দৃশ্যই থাকত সেখানে। দেখে আঁচ করা যেত বটে, কাহিনির হাওয়া কোনদিক থেকে কোনদিকে বইবে! শুধু কি চলতি সিনেমার ডিসপ্লে থাকত? জ্বী, না। সামনে যে ছবি আসবে, তারও চৌম্বক অংশের দৃশ্য বেছে বেছে সাজিয়ে রাখা হতো।
আরেকজনকে দেখতাম সিনেমার সেই মুক্তির দিনে, কাশিমপুর নাকি সুরাবাড়ি থেকে আসতেন সিদ্দিক ভাই, আমাদের বাড়ির পাশঘেঁষা সেই রাস্তা দিয়ে টুংটাং টুংটাং সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে চলে যেতেন কোনাবাড়ি বাস স্টেশনের দিকে। আবার ফিরে আসতেন সে পথে সাড়ে তিন কী চার ঘণ্টা পর। এবার আর সাইকেলের ঘণ্টির আওয়াজ পাওয়া যেত না। সন্ধ্যার অন্ধকারের পুরো নির্জন পথ সদ্য দেখা সিনেমার গানে গানে সুরালোকিত হয়ে যেত। যে সিনেমাটি সিদ্দিক ভাই মাত্র দেখে এলেন চান্দনা চৌরাস্তার উল্কা সিনেমা হলে, সেই সিনেমার সব গান ততক্ষণে তার মুখস্থ! শুধু কি মুখস্থ? সাইকেল চালানো হাতেই অতি কষ্টে ধরে রেখেছেন সদ্য দেখা সিনেমাটির গানের সংকলন, চটি একটি বই।
তখন সিনেমা মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সেই সিনেমার গানগুলোর বইও পাওয়া যেত কিনতে। দাম অল্প হলেও কারোর কারোর কাছে নিউজপ্রিন্টের সেসব চটি বই ছিল অমূল্য সম্পদ! কোনো বাড়িতে বিয়ে লেগেছে কী, বিয়ের এক দু’দিন আগেই আনা হবে মাইক। কাশিমপুর কোনাবাড়িতেই পাওয়া যেত মাইক কোম্পানি। তবে গাজীপুর বাজার থেকে দয়াল সার্ভিস আনতে পারলে প্রেস্টিজ যেত বেড়ে। গানের রেকর্ডও থাকত বেশি। অবশ্য সবাই যে দশগ্রামের মানুষকে মাইক বাজিয়ে মহা ঘটার সঙ্গে জানান দিয়ে বিয়ের আয়োজন করতো, তা নয়। কেউ কেউ চুপিচুপিও সারত বিয়ের কাজ! কেন? একটা বিয়ে হয়তো মাইক বাজিয়ে করা যায়, দুটো বিয়েও হয়তো মাইক বাজিয়ে করা চলে, কিন্তু এগারোটা বিয়ে কি কেউ সবাইকে জানিয়ে করতে পারে, নাকি সম্ভব সেটা?
আমাদের গ্রামের একজন পলান তাই করেছিলেন। কোনো বিয়ে রেডিওর জন্য, কোনো বিয়ে সাইকেলের জন্য, কেনো বিয়ে বা টেপরেকর্ডারের জন্য। রেডিওর পর হয়তো টেপরেকর্ডার নতুন এলো দেশে। তো, সেই পলান ভাই পয়সা খরচ করে সেটা কেনার হিসেবে যেতে চাইতেন না, আরেকটা বিয়ের কথা চিন্তা করে ফেলতেন। এক টিকেটে দুই সিনেমা দেখার কথা শুনেছি, কিন্তু এক বিয়ের মাধ্যমে টেপরেকর্ডার, আরো কিছু নগদ টাকা প্রাপ্তি, আর নতুন জলজ্যান্ত একটা বউ পাবার কথা সহসা কোথাও শুনতে পাওয়া যাবে না। বড় বর্ণাঢ্য চরিত্রের মানুষ ছিলেন তিনি। চেহারা সুরত অনেকটাই মুম্বাই ফিল্মের অমরেশ পুরীর মতো। সেরকমই পাকানো গোঁফ ছিল। সেরকমই দীর্ঘদেহী। কথার ফাঁকে ফাঁকে সেই পাকানো গোঁফটায় একটা দুটা মোচড় লাগাতেন। চোখে বোধহয় হালকা সুরমার প্রলেপ মাখানো থাকত। মুখে সবসময় প্রসন্নতার হাসির রেখা! এগারোটা বউয়ের আদরযত্ন প্রাপ্তি বলে কথা! সাধারণ কোনো কাজ তিনি করতেন না। কখনো কাশিমপুরের তুরাগ নদীতে অক্টো তুলতেন, কখনো করতেন জমির দালালি। তবে নিয়মিতই যে কাজটা করতেন, সেটা হলো গ্রাম্য সালিশির মাতাব্বরি। গ্রামের কেউ ও বাড়ির টাল থেকে চুরি করে শসা খেয়েছে, তো বসাও বিচার। এ বাড়ির গরু সে বাড়ির ক্ষেতের ঘাস খায়, বসাও বিচার। এ বাড়ির বউয়ের সঙ্গে ও বাড়ির জোয়ান ছোকরার চলছে পরকীয়া, বসাও বিচার। গরুচোর ধরা পড়েছে, তো বসাও বিচার। বিচারের কোনও শেষ ছিল না। আমাদের বাড়ির জুম্মাঘরের পাশে এখন যে একটা মাদ্রাসা রয়েছে, তার সামনেই ছিল খোলা মাঠ। সেখানেই বসতো অধিকাংশ সালিশগুলো। একটা বিচার বসা মানে যেন একটা নতুন বিনোদনের বন্দোবস্ত। তামশা দেখার জন্য সারা গ্রামের মানুষ এসে হামলে পড়তো। সবার সামনে একজন বা দুজন মানুষকে অপরাধী বানিয়ে লজ্জা দেয়া হচ্ছে, অপমান করা হচ্ছে, নিগৃহীত করা হচ্ছে, গালি দেয়া হচ্ছে, জুতো মারা হচ্ছে, কানে ধরে ওঠবসানো করা হচ্ছে, সবাই বেশ রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছে বিষয়টা। আমার হাফপ্যান্ট পরা বয়সে, সেটাকে খুব চরম নির্দয়তা মনে হতো। আমি আর সহ্য করতে পারতাম না সেই দৃশ্য। দৌড়ে ছুটে যেতাম ঘরের ভেতর, আশ্রয় খুঁজে বেড়াতাম কোনো রূপকথার বইয়ে।
যাক গে, বলছিলাম মাইক বাজানোর কথা। বিয়ের এক কী দু’দিন আগ থেকেই সারা গ্রাম মাতিয়ে হঠাৎ মাইকে বেজে ওঠতো গান, আমার তিন তিনটে শালি, মুখে দিল চুনকালি। যত বাড়িতেই মাইক আনা হতো বিয়ের আয়োজনে কী মুসলমানির অনুষ্ঠানে, কেন যেন এ গানটি দিয়েই মাইক বাজানো শুরু করতেন মাইকওয়ালা! শালিদের নিয়ে তার মনের মধ্যে যে কেনো এত ফ্যাসিনেশন ছিল, সেটা মনোবিদদের জন্য গবেষণার রসদ হতে পারে, তবে তার ভাবটা ছিল হেভি! সারাক্ষণ শার্টের হাতা গুটিয়ে রাখতেন! একটু পরপরই ছোট এক আয়না বের করে চুলের সিঁথিটা ঠিক করে নিতেন হাত দিয়েই! তাকে বেশ সমীহের চোখেই দেখা হতো! জামাই আদরে না হলেও তার কাছাকাছি। পার্থক্য শুধু জামাই ঘরের কোণে থাকেন শুয়ে, আর মাইকওয়ালা বাইরের ঘরে থাকেন বসে! খাওয়াদাওয়াতেও অবশ্য হেরফের ছিল! জামাইদের মতো তো আর মাছের মাথা পেতেন না, তবে লেজটা পেতেন ঠিকই! প্রশ্ন থাকতে পারে, লেজে মাছের মাংশ থাকত কতটুকু! আহারে! দুনিয়া থেকে বুঝি এ প্রফেশনটাও হারিয়ে গেল পুরোপুরি। কত বাড়ি বাড়ি যে ঘোরার সুযোগ পেত মাইকওয়ালা, কত বাড়ির রান্নার স্বাদ যে সে গ্রহণ করেছে উৎসব-পার্বণের রঙিলা সময়ে! সে এক ভাগ্য বটে! অস্বীকার করব না, আমার সেই হাফপ্যান্ট পরা বয়সে স্বপ্ন ছিল সিনেমা হলের লাইটম্যান হওয়ার, তবে মাইকওয়ালা হওয়ার স্বপ্নও যে মাঝে মধ্যে আমাকে বিভ্রান্ত করত না, এমন নয়। আর বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতাম মিষ্টিওয়ালার মেয়েকে। খুব রসগোল্লার ভক্ত ছিলাম কীনা।
গ্রামের অনেকে সেই মাইকওয়ালার সঙ্গে স্পেশাল খাতির রাখতো। এই যেমন বিড়ি বা সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকলে একটা দুটা টান দেওয়ার সুযোগ দিত। কিংবা খামোখাই তার মাইকের প্রশংসা করতো, সাউন্ড খুব ভালা! রাতে যে মাইকওয়ালা মাইক্রোফোন বের করে গান গাইবার সুযোগ দেয়! সেখানে গান গাইতে হবে না? নগদ নগদ নতুন নতুন সিনেমা দেখে সেই সিনেমার গানের বই কিনে আনো, আর সেই গানের বই থেকে টাটকা টাটকা গান সবাইকে শুনিয়ে বুঝিয়ে দাও, আমার মধ্যেও এক হিরো আছে, হাঁ!
চলবে...