আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ১৮
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
সুবর্ণ সেই সুন্দর জগতটা কবেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগত থেকে হারিয়ে গেছে। গানের সেইসব সুর আর আসে না, আসে না নতুন করে কোনও রাজ্জাক-কবরী-শাবানা-ববিতা-জাফর ইকবাল-সোহেল রানা-বুলবুল আহমেদ কিংবা ওয়াসিম। ওয়াসিম আমার ভীষণ প্রিয় ছিলেন শৈশবে। শুধু তলোয়ারবাজির জন্য। কী যে ফাইট জানতেন! কেউ পারতো তার লগে! তা সত্ত্বেও, একবার এই শক্তিধর ওয়াসিম ভীষণ মার খেয়েছিলেন। না, জসীমের কাছে নয়, সামাজিক ছবির কাছে। ব্যাপারটা তাহলে একটু খুলেই বলি। আমার আব্বা যত রাগী হেডমাস্টার ছিলেন ততই ছিলেন একজন প্রাণবন্ত মানুষ। খেলাধুলা, সিনেমা, সাহিত্য সবকিছুর প্রতিই তার ঝোঁক ছিল। ছোটবেলায় আমাকে সুযোগ পেলেই সিনেমা দেখাতেন। বেশিরভাগ সময়েই গুলিস্তান কিংবা নাজ হলে। দুটোতো আবার যমজ ভাই।
তো, একবার যখন আব্বা সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেলেন সেখানে, একটায় চলছিল চাষীর মেয়ে আর আরেকটায় ওয়াসিম অভিনীত বাহাদুর। হলের সামনে বিশাল বিলবোর্ডে দৈত্য জাম্বো নীল আকাশের বুকে উড়ছে। তার হাতের মধ্যে কাঁচা সোনা গায়ের সাগরকন্যা অলিভিয়াকে লাগছিল পিঁপড়ের মতো। টিকেট কাটার আগে আব্বা জানতে চাইলেন, কোনটা দেখবি? আমি ওয়াসিমের ছবি নয়, বেছে নিলাম চাষীর মেয়ে। বিলবোর্ডে হতদরিদ্র চাষীর মেয়ে শাবানা মাথায় করে কার জন্য যেন নাস্তা নিয়ে যাচ্ছেন। সে ছবিটাই মনে বেশি দাগ কেটেছিল আমার! আব্বা খুব অবাক হয়েছিলেন আমার চয়েস দেখে! রূপকথায় ভাসাভাসির বয়সে যখন প্রিয় আবার ওয়াসিম, স্বভাবতই আব্বা ভেবেছিলেন, আমি বুঝি বাহাদুর দেখবো!
নায়ক-নায়িকাদের ঘিরে আমার যে বিশেষ মনোটান, এর পেছনে রয়েছে ঈদসংখ্যা পূর্বাণীর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব। প্রায় প্রতিটি রোজার ঈদই নানাবাড়িতে করতাম বলে আব্বা হাতে করে সেখানে একটা কী দুটা ঈদসংখ্যা নিয়ে যেতেন। তার মধ্যে পূর্বাণী থাকতই। আর সাধারণ সংখ্যা চিত্রালী কী পূর্বাণী তো ছিলই বাঁধাধরা। সেটা পড়ার জন্য কত যে হুমড়ি খেয়ে পড়া, কাড়াকাড়ি। নিস্তার ছিল না। মধ্যবিত্তের সঙ্গে সিনেমা অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল চিত্রালী আর পূর্বাণীর ঘটকালিতে। এই যে মান্টোর বইয়ের কথা বললাম, ঈদসংখ্যার কথা বললাম, আমি কি সেসব বই বা পত্রিকা আব্বার হাত থেকে লুফে নিতাম, নাকি অপেক্ষায় থাকতাম কখন আব্বা ওসব রেখে দেয় বিছানায় বা টেবিলে, তারপর নেব ছোঁ মেরে, সেসব আজ আর কিছুই মনে করতে পারছি না। স্মৃতিশক্তি দেখছি কমে যেতে শুরু করেছে। তবে মনে আছে, হাতে পাওয়ার পর প্রথমেই আমি গন্ধটা শুঁকে নিতাম। চিত্রালী, পূর্বাণীর একটা ঘ্রাণ ছিল। সোভিয়েত ম্যাগাজিনগুলোর একটা ঘ্রাণ ছিল। হারানো সুর ছিল, যা কেবল হারিয়েই যায়, ফেরে না!
তখন এত পত্রপত্রিকা ছিল না। কার আগে কে বাজারে ঈদসংখ্যা আনবে, তা নিয়েও ছিল না কচলাকচলি। ঈদের চার-পাঁচদিন কী সপ্তাহখানেক আগে বেরুত পাঁচ কী ছয়টা ঈদসংখ্যা। যার মধ্যে অন্যতম পূর্বাণীতো ছিলই, আরো ছিল চিত্রালী, রোববার, বিচিত্রা, সন্ধানী। কোনো দৈনিকের ঈদসংখ্যা বেরুতে দেখিনি। পেপারসিটে অবশ্য পরে ধীরে ধীরে বেরুতে শুরু করে। আব্বা সবসময় নিয়ে যেত পূর্বাণী। কখনো কখনো রোববারও থাকত হাতে। তখনকার কিছু ঈদসংখ্যার উপন্যাস পড়তে পড়তে ঘোরাচ্ছন্ন হয়ে যেতাম। মাহমুদুল হকের কালোবরফ, মাটির জাহাজ, রিজিয়া রহমানের একটি অলিখিত উপাখ্যান, সৈয়দ শামসুল হকের দূরত্ব, স্তব্ধতার অনুবাদ, রাহাত খানের অমল ধবল চাকরি, বেলাল চৌধুরীর ডুমুর পাতার আবরণ, আবদুল মান্নান সৈয়দের অ-তে অজগর, হাসনাত আবদুল হাইয়ের যুবরাজ, শওকত আলীর গন্তব্যে অতঃপর। আমার সেই শৈশবের ঈদসংখ্যার যুগে হুমায়ূন আহমেদ তখনো তার বিপুল সম্মোহনী করা যাদুশক্তি নিয়ে উপস্থিত হননি। তিনি এলেন আরো অনেক পরে। ততদিনে আমার জীবন থেকে কৈশোর হারিয়ে গেছে।
ঈদসংখ্যার সেইসব পাঠের সঙ্গে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছেন কাজী হাসান হাবিব, তার কাব্যসুষমামণ্ডিত স্কেচগুলোর জন্য। রণবীর ইলাস্ট্রেশনও মন কাড়ত। পূর্বাণীর কথা তো বললাম, কিন্তু যে-বিষয়টির উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক এই পেপারসিট ম্যাগাজিন, সেই সিনেমা জগতের কথা একটু আলাদাভাবে না বললেই নয়। সিনেমাকে ঘিরে বর্ণিল এবং বর্ণাঢ্য একটা সংস্কৃতিই ছিল তখন, সে আমার রাংতামোড়ানো শৈশবে। আমার মনে হয়, খোলাসা করেই বলবার মতো। সিনেমা নিয়ে আমার নানাবাড়িতে যতটুকু উত্তাপ ছিল তা ওই কাগজে কাগজেই, চিত্রালী বা পূর্বাণীকে ঘিরে। আশপাশে কোনও সিনেমা হল যেমন ছিল না, সিনেমাকে ঘিরে তেমন উত্তেজনাও চোখে পড়ত না, কানেও আসত না কোনও কিছু। এক শুধু চোখে পড়তো, পাড়ার যুবক ছেলেরা পুকুরের ওপারের ঘাটে গোসল করতে নেমে ব্যাপারি বাড়ির মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য দু’তিনটা সিনেমার গানের লাইন জোরে জোরে উগরে দিয়ে পানির ভেতর ডুব মারতো। ‘ওরে তোর রূপ দেখে চোখ ধাঁধে মন মানে না।’ বেশ কতক্ষণ ডুবে-সাঁতরিয়ে আবার উঠে গায়ে সাবান লাগাতে লাগাতে হয়তো বাকি দুটো লাইন সেরে নিত, ‘পরাণখানি কাতরে মরে কেন বুঝিস না?’ ব্যস ওটুকু সেরেই আবার সঙ্গে সঙ্গে মারতো ডুব! ডুব না মেরে বুক চিতিয়ে কেন যে গানটা গাওয়া অব্যাহত রাখতে পারত না, সেটা একটা রহস্যই বটে।
নানাবাড়িতে সিনেমার প্রভাব বলতে ওই অতটুকুই দেখেছি। কিন্তু আমার দাদাবাড়িটার গ্রাম এবং পরিপার্শ্ব ছিল যেন অনেকটা সিনেমাকে ঘিরেই আবর্তিত। একেবারে যাকে বলে মহাসমারোহের ব্যাপার। ছবি যেদিন মুক্তি পেত, সেদিনই দুপুরের আগে আগে কোনাবাড়ির দিক থেকে দ্রুত বেগে ঝড়ো হাওয়ার মতো ছুটে আসত একটা বেবিট্যাক্সি। তখন রাস্তা পাকা ছিল না। কাঁচাপাকা মাটির রাস্তা। ক’দিন পর অবশ্য ইটের সলিং হয়। তারপর আরো অনেক পরে সে রাস্তা পাকা হয়েছে। তো সেই কাঁচারাস্তা দিয়েই যে কী বিপুল বৈভব উত্তেজনা নিয়ে ছুটে আসত সেই যানটা। রাস্তার দু’পাশের গাছগাছড়ার পাতারা সব নড়ে উঠতো। পাখিরা পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে শুরু করতো উড়াওড়ি। অনেক দূর থেকেই শোনা যেত মাইকের আওয়াজ, ভাইসব! ভাইসব! চান্দনা চৌরাস্তার উল্কা সিনেমা হলে চান্দনা চৌরাস্তার উল্কা সিনেমা হলে আজ থেকে মহাসমারোহে মুক্তি পাচ্ছে, আজ থেকে মহাসমারোহে মুক্তি পাচ্ছে ইবনে মিজান পরিচালিত ইবনে মিজান পরিচালিত ডাকু মনসুর! ডাকু মনসুর! সাসপেন্স! অ্যাকশন! ড্রামা! নাচে গানে হাসি আনন্দে ভরপুর, নাচে গানে হাসি আনন্দে ভরপুর, ডাকু মনসুর, ডাকু মনসুর!
বেবিট্যাক্সিটা কিন্তু থামছে না। তুফান মেইলের বেগে ছুটে যাচ্ছে কাশিমপুরের দিকে। একেবারে সুনামির মতো উত্তেজনা ছড়িয়ে। আর একজন দু’হাত দিয়ে দু’পাশে ছিটিয়ে যাচ্ছে নিউজপ্রিন্টে ছাপানো ডাকু মনসুরের লিফলেট। রঙিন এক কালারের সেই লিফলেটটাতে হয়তো ছাপা অস্পষ্ট, নায়িকার মুখ দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দাঁতে ছাপাখানার ময়লা লেগে আছে, চোখে হয়তো কাজলের বদলে বাড়তি মেরুন; কিন্তু দেখো সে লিফলেটটই মাটি থেকে কুড়িয়ে নিতে আমাদের একেকজনের কী ত্রাহি অবস্থা। রাস্তায় আমরা সব হাফপ্যান্ট পরা পোলাপান লিফলেট ধরার জন্য ক্ষিপ্র একটা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। লিফলেট মাটিতে পড়ারও সুযোগ পেত না। কার আগে কে ধরবে, শুরু হতো দৌড়ঝাপ। লিফলেট ধরতে গিয়ে আবার পোস্টার দেখাটাও যেন মিস হয়ে না যায়, সে ব্যাপারেও সবাই বেশ সতর্ক থাকতাম। হিরোইন শাবানাকে হিরো ওয়াসিম নাকি জসিমের মধ্যে কেউ একজন হবে, ছুটন্ত ঘোড়াতে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেই কবে দেখেছি, এখনো স্মৃতির কোষে ছাপা হয়ে আছে। বেবিট্যাক্সিটা উত্তেজনার উত্তাপ ছড়াতে ছড়াতে যাওয়ার পথে দু’ এক জায়গায় থামাত বটে, থামিয়ে সিনেমার পোস্টারটা বিশেষ কৌশলে হ্যাঁচকা টানে খানিকটা ছিঁড়ে আঁঠা মাখিয়ে লাগিয়ে দিত কোনো বাড়ির কিংবা দোকানের দেয়ালে। লাগানোর পর অবশ্য বোঝা যেত না, ওটা ছেঁড়া হয়েছে খানিকটা। সেই পোস্টারটা ওরা কাউকেই দিত না। হাজার চাইলেও না। আর যদি কেউ বহু সাধনায় সেটা নিতে পারত ওদের কাছ থেকে বলে-কয়ে, সে রীতিমতো রাতারাতিই আমাদের কাছে বনে যেত সেলিব্রেটি! মানুষ এত কপাল নিয়েও জন্মায়, অবুঝ মন সিনেমার পোস্টার পেয়েছে! সেও এক চরম মাতামাতির ব্যাপার ছিল।
চলবে...