আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ১৫
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : মার্চ ০১, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
যা হোক, আমি বলছিলাম বইয়ের কথা। আমার দাদাবাড়িতে অন্ধকার খাটের নিচে আব্বার বইয়ের ট্রাঙ্ক আবিষ্কার করাটা ছিল আমার জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। জানি না, এই বইয়ের বহর সেই বয়সে, কতইবা বয়স হবে তখন, হয়তো আট কী নয় বা নয় কী দশ, ফোর কী ফাইভে পড়ি, সেই বয়সে আবিষ্কার না হলে হয়তো আমার জীবনটা অন্যরকমও হতে পারত! অন্যরকম মানে, এই যে লেখালেখির যে পোকাটা কুট কুট করে প্রতিনিয়তই আমার সত্তাকে কেটে চলেছে, এটা হয়তো হতো না, হয়তো চাকরিতে মন বসাতে পারতাম, নয়তো বা হতাম ব্যবসামনস্ক কেউ। কিন্তু সেই ট্রাঙ্কটি, বইভর্তি ট্রাঙ্কটি আমার জীবনটাকেই যেন পাল্টে দিল এক রকম।
বই আমি ছোটবেলা থেকেই পড়তাম। অনেক ছোটবেলা থেকে। যখন পড়তে শিখেছি তখন থেকেই। তবে সে বইয়ে থাকতে হতো ছবির পর ছবি। তাও আবার সাধারণ কোনো কিছুর ছবি নয়, রাক্ষস খোক্কস জ্বীন পরি ভূত পেত্নির ছবি। বেশ ক’টা রূপকথার বই কেনা হয়েছিল হাঁটি হাঁটি পা পা বয়সে। কিছু বা আব্বার কাছ থেকে, কিছুবা নিজেই গো ধরে কিনেছি। তখন নিউ মার্কেটের বিডিআরমুখি গেটে ঢোকার মুখে ভেতরেও ফুটপাথের নিচে খোলা রাস্তাটায় বইয়ের পসরা নিয়ে বসে থাকত দোকানিরা। সেখানে সারি সারি সাজিয়ে রাখা হতো যত রাজ্যির সব রূপকথার বই। মনে আছে, আমি জোর করে কিনেছিলাম পরির দেশে ফুলের বেশে আর রাজকন্যা কমলমণি নামের দুটো বই। কী অসাধারণ বর্ণনার সঙ্গে যে কী নয়নসুখকর ছবির জুটি ছিল, আজো দেখলে হৃদয়-চোখ সবই জুড়ায়। ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদার থলে, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা তো আগে থেকেই ছিল। আরো ছিল রুশদেশের রূপকথা।
রূপকথার একেকটা বই যখন পড়া শেষ হতো, আমি আমাদের ঘরে তন্ন তন্ন করে আরো বই খুঁজে বেড়াতাম। আরো ছবির বই। কল্পনার রঙিন সব মখমল। আমাদের ঘরটা ছিল মাটির। লাল মাটির। উপরে সাদা মাটির প্রলেপ। সেই মাটির ঘরেই ছিল দেয়াল সেঁধানো এক আলমারি। কাঠের তিনটি তাকজুড়ে সাজানো থাকত বই। সেইসব বই যা আব্বা নগদ নগদ পড়তেন। ইংরেজি ডিকশনারি, ইংলিশ-বাংলা গ্রামার বই, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, বৈষ্ণব পদাবলি, ময়মনসিংহ গীতিকা এসব বইয়ের পাশাপাশি সাহিত্যেরও কিছু বই ওখানে দেখতাম। অধিকাংশই শরৎচন্দ্রের। বিমল করের খড়কুটোও ছিল এখানেই এই তাকে। আহা! খড়কুটো! আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস। সর্বোচ্চ পঠিত। এ পর্যন্ত যে কতবার পড়েছি, বলতে পারব না। দশ-বারো বার তো হবেই, বেশিও হতে পারে। আমাকে কী এক অদ্ভুত ঘোরের ভেতর আচ্ছন্ন করে রাখে অমল ভ্রমর। আমি সেই মেসোমশাইয়ের বাড়ির একজন হয়ে যাই। যে বাড়ির ভেন্টিলেটরে চড়ুই পাখি, সকালে নাস্তার রুমে রোদ আসে এক পলক। আমার বড় চেনা, বড় হৃদয়সংলগ্ন! দেওয়ালির বাজি পোড়ানোর উৎসবের বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছিল খড়কুটো। কী যে সেই মগ্ন চৈতন্যে শিষ বাজা। বাজির আলো যখন আকাশে ছড়িয়ে পড়লো, আমরা দেখি এক পূর্ণাবয়াব ময়ূর! ‘ময়ূর পুচ্ছ ছড়াতে ছড়াতে ছড়াতে আকাশের তারা হয়ে যায়, আকাশের তারার সঙ্গে মিলিয়ে যায়, তারাকে স্পর্শ করে আবারো স্ফুলিঙ্গের মতো রূপালি ফুলের বৃষ্টির মতো নেমে আসতে থাকে নিচে। অমল খুশিতে উপচে পড়ছে। ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর চোখে বিষাদ! দ্বিতীয় বাজিটা অন্ধকারে জোনাকির ঝিকিমিকি আলো। তারপর হঠাৎই দপ করে জ্বেলে উঠল সেই আলোর গুচ্ছ। মাটির অন্ধকার থেকে ফোয়ারার মতো উঠল আলো আকাশের দিকে। রঙমশালের তারার মতো, তুবড়ির ফুলের মতো ফরফর করে পুড়তে লাগল, জ্বলতে লাগল, নিভতে থাকল। আলো নিভতে নিভতেই থোকা থোকা জোনাকি জ্বলতে থাকল।’ এখনো সেই বাজি পোড়ানোর বর্ণনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। জব্বলপুরের সেই ক্যান্সার হাসপাতালের কথা মনে পড়লে এখনো বুক চাপড়ানো এক হাহাকার অনুভব করি। কোথায় যেন কোন প্রসঙ্গ ধরে ভ্রমর বলে উঠেছিল, আমরা বড় নিষ্ঠুর। ভালোবাসতে জানি না।’
সেই যে প্রিয় শরৎচন্দ্র, তার দরদিয়া মরমিয়া উপন্যাস সম্ভার, তারচেয়েও প্রিয় খড়কুটো! আমি তখন শরৎচন্দ্রের সেইসব উপন্যাস পড়াতো দূরের কথা, ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখতাম না। কেনো ছুঁবো, ওসবে কি আর ছবি আছে? আমি সবই তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি! শুধু টানা লেখা, টানা টাইপ। খড়কুটোও কিন্তু তাই ছিল। তাই খড়কুটোও তখন পড়া হয়নি, আরো অনেক পরে পড়া হয়েছে। তখন আমার চাই শুধু চোখকাড়া মনকাড়া রঙিন ছবির বই। সেই ছবিঅলা বইয়ের সন্ধানে খুঁজতে খুঁজতেই একদিন হঠাৎ খাটের নিচের ট্রাঙ্কটির দিকে আমার চোখ চলে যায় এবং মনের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয় যে, আচ্ছা, ওটার মধ্যে কি আছে? অনেক আগেই অবশ্য ট্রাঙ্কটি আমার চোখে পড়েছিল, কিন্তু কোনোদিন সেটাকে ঘিরে দানা বাঁধেনি কৌতূহল। কিন্তু একদিন তীব্রতর হলো জিজ্ঞাসা, আচ্ছা! কী আছে ওই ট্রাঙ্কটির মধ্যে! কী? দেখতে হয় একবার।
সেদিন সকাল। হাফপ্যান্ট ছেড়ে কেবল ফুলপ্যান্ট ধরেছি। আব্বা স্কুলে, মা গভীরভাবে ডুবে আছে রান্নায় বাইরের রান্নাঘরে। গোয়েন্দাগিরি করার জন্য আমার ছোট দুই ভাইবোনও ছিল না। ব্যস, মওকা বুঝে আমি খাটের নিচের অন্ধকারে ঢুকে ট্রাঙ্কটা টেনে আনলাম খানিকটা বাইরের দিকে। যাতে আলো পাই। অথচ গোপনীয়তাও বজায় থাকে। বলা তো যায় না, হুট করে রান্নাঘর থেকে কখন না আবার মা এসে হাজির হয়। ভয়ে উত্তেজনায় সেকি আমার গলদঘর্ম অবস্থা! বেশি কুস্তাকুস্তি করতে হলো না। অল্প চেষ্টাতেই খুলে ফেললাম। আগে কি তালা দেয়া ছিল? আমি কি এর আগেও ট্রাঙ্কটা খুলে দেখার চেষ্টা করেছিলাম এবং তালা থাকায় ব্যর্থ হয়েছি ভেতরটা দেখতে? নাকি আগে খুলেই জানা হয়েছিল যে, ওই ট্রাঙ্কটাতে বইয়ের এক স্বর্গরাজ্য আছে। ছবিঅলা বই না পেয়ে আমি আর খুঁজতে উৎসাহী হইনি। নতুন করে আজ আবার খুঁজে দেখছি। কোনো কিছুই ভালো করে মনে পড়ছে না। তবে সেদিন এতগুলো বই একসঙ্গে দেখতে পেয়ে যে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছিলাম, তা বেশ মনে আছে। বইয়ের নিচে বই, থাক থাক সাজানো! বেশ কয়েকটা সারি। এত বই আছে আমাদের বাড়িতে, এত বর্ণাঢ্যতা! কল্পনাও করিনি কখনো! আমি তন্ন তন্ন করে সেই বইয়ের রাজ্যিতে আমার ছবিঅলা বই খুঁজে খুঁজে বেড়াই। পাই না। একটাও ছবিঅলা বই ছিল না সেখানে। আমি হন্যে হয়ে বইয়ের পর বইগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে দেখি। পাতা উল্টাই। যদি ছবিঅলা কোনও বই মিলে যায়। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে, বুঝিবা দৈবেরই ইশারা, একটা বেশ মোটাসোটা বইয়ের পাতা আমার সামনে খুলে যায়, যেন উন্মোচিত হয়ে যায় জীবনের এক অপার রহস্য; আমি আবিষ্কার করি, সেখানে অপু নামের একটা ছেলে দূর্গাদির সঙ্গে কাশবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাহ! এ যে দেখি আমার কথাই লিখে রেখেছে, তখনো আমি জানতাম পৃথিবীতে একমাত্র একটাই অপু আছে, আর সে কেবল আমিই। জানতাম না যে, এই বইয়ের অপুই আসল অপু, এই বইয়ের অপুর প্রেরণাতেই আমার নাম রাখা হয়েছে। যা হোক, সেই অপু নামটা দেখেই আমি বইটা পাঠে অগ্রসর হই। কৌতূহল আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় এবং আমি কিছুদূর পড়তে না পড়তেই নিজেকে প্রবলভাবে খুঁজে পাই। তারপর ওখানেই, ওই খাটের নিচে বসে বসে আমি বইটির আরো দু’তিন পাতা পড়ে ফেললাম। তারপর ট্রাঙ্কটা আলগোছে বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম বাইরে। এ কোন উন্মোচন আমার, বইয়ের অক্ষরে আমার কথা! এ কোন অলৌকিক আনন্দ! ওদিকে ভয়ও করছিল, মা যদি দেখে ফেলেন এখন? একদিন মাটির আলমারির বই হাতড়াতে গিয়ে মায়ের বকুনি খেয়েছিলাম কড়াভাবে। মা নিষেধ করেছিলেন বড়দের বই ধরতে! আমি তাই চুপি চুপি বইটা শার্টের ভেতর ভরে চলে গেলাম দক্ষিণের বাংলাঘরে। আমরা তখন এজমালি বাড়িতে থাকি। তিন শরিকের এক বাংলাঘর। ঘরে সবসময়ই চাচাতো ভাইবোনদের কেউ না কেউ থাকে। এখন কেউ নেই। আমি চৌকিতে বসে সেই বইটাতে মাথা গুঁজে দিই। নিশ্চিন্দপুর, ইন্দির ঠাকরুন, দুর্গাদি, হরিহর- আর তাদেরকে ঘিরে একজন আমি- একজন কল্পরাজ্যে হারিয়ে থাকা অবুঝ অপু!
চলবে...