আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ১৪

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি

আমার কাছে পরম রোমাঞ্চকর হয়ে থাকা এই জলপথটি পৃথিবীতে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন এত সড়ক পথ হয়েছে, এতসব বাঁধ নির্মা হয়েছে জায়গায় জায়গায় যে, আগের মতো যেমন পানিও আসে না, তেমনি বোধহয় প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়েছে। যে পথ পাড়ি দিতে এখন এক ঘণ্টাও লাগে না, সে পথ কার দায় ঠেকেছে পাঁচ ঘণ্টা ছয় ঘণ্টা লাগিয়ে পাড়ি দেয়ার? তখন জানতাম না, পরে জেনেছি, আমার এই নৌকাপথটি বুড়িগঙ্গা থেকে বরিসুরের সেই খালপথ থেকে বেরিয়ে, সোনাখালি খাল হয়ে নারিকেলবাগ গ্রামের ভেতর দিয়ে বোয়াইল গ্রামের পূবদিক পেরিয়ে তবেই পৌঁছাতো রাজাবাড়ি আমাদের নানাবাড়িতে।

নানাবাড়ি ছাড়িয়ে আরো দূর থেকে দূরে ছুটে যেত কত নৌকা। গ্রামের যেমন কোনও শেষ ছিল না, ছিল না বাঁধসহ উঁচু রাস্তাঘাটের বাধাও। আমরা চিনির খালের কাঠের সাঁকোর ওপর বসে শূন্যে পা দোলাতে দোলাতে সাতসকালে দেখতাম শহরমুখী যাওয়া নৌকার মিছিল। খালের মুখেই ছিল লুরানি মামার ভেসাল। খালে ঢুকতে হলে ভেসালের সেই বেড়াজাল না সরিয়ে আসা যেত না। লুরানি মামা তার বিখ্যাত সেই আধন্যাংটো কাঁছাটা প্রদর্শন করে ভেসালের বাঁশে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে চাপ দিলেই জালটা উপরের দিকে উঠে যেত। আর পাশ দিয়ে নৌকা আসার পথ তৈরি হতো। এরপর নৌকাগুলো খালে ঢুকে আমরা যেখানে বসে আছি সেই সাঁকোর নিচ দিয়ে বেরিয়ে যেত অন্যপ্রান্তে। কিছুটা দূর পেরুলেই আবার গ্রামটিকে সাইডে রেখে পড়ত খোলা প্রান্তরে।

কত রকমের যে নৌকা যেত। ছোট বড় মাঝারি নানা সাইজ। প্রায় সবই ছইছাড়া। কোনো কোনো নৌকাতে পালও থাকত। ছোট, মাঝারি নৌকাগুলোতে যেত ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী মানুষ। লম্বা টাইপের নৌকাগুলোয় যেত মালপত্র, গোয়ালার দল। মাঝিও থাকত দুজন। একজন সামনে তো আরেকজন পেছনে। এই খালপথ পেরিয়ে যাবার পরই হঠাৎ হঠাৎ দূর থেকেই আমাদের চোখে পড়তো গোয়ালা-নৌকার কোনো কোনো গোয়ালা খাল থেকে মগে পানি উঠিয়ে তা ঢেলে দিচ্ছে সিলভার কালারের বিশাল গামলায়। প্রতিদিন গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় গামলা ভরে দুধ বেচতে যেত যেসব গোয়ালা, হয়তো সারাপথই এভাবে জলের প্রাচুর্য দেখে তা মগে উঠিয়ে বাড়িয়ে নিতে চাইত দুধের পরিমাণ। জানি না দোষটা কার, সেই গোয়ালার নাকি পানির প্রাচুর্যের? দুধের গামলায় কি কচুরির পাতাও দিয়ে রাখতো? বোধহয় দেখেছি।

সন্ধ্যায় আবার সব নৌকাগুলো সার বেঁধে-বেঁধে ফিরে আসতো একই পথে। গোয়ালাগুলোর কেউ কেউ ঘুমে চুর হয়ে থাকত। গামলাগুলোতে তো আর দুধ নেই যে পানি মেশানোর জন্য জেগে থাকতে হবে! কেউ কেউ মেতে থাকত তাসখেলায়। সিগারেটে একটা টান দিচ্ছে তো আরেক হাতে তাস ছাড়ছে। বেশ পুরুষালি একটা দৃশ্য বটে! এখন মনে পড়ছে, বৃষ্টি আচ্ছন্ন দিনগুলোতে লুডু খেলার পাশাপাশি আমরা তাসও খেলতাম নানাবাড়িতে। কিন্তু সেটা ছোটদের তাসখেলা। চারটা চারটা করে একই শব্দের তাসগুলো মেলানোর যেন কী একটা ব্যাপার ছিল। আজ ভুলে গিয়েছি। তবে তাস খেলাটা বোধহয় শেখা দরকার ছিল, পরবর্তী জীবনে অনেকবারই সেটা অনুভব করেছি। আজ সেই চিনির খাল নেই, সেই নৌপথও কবেই উধাও। চিনির খালের মতো ছোটবড় অনেক খালই আজ বলতে গেলে বিলুপ্ত। জায়গায় জায়গায় দেয়া হয়েছে অপরিকল্পিত বাঁধ। কোথাকার জল যে কোথায় গড়াতে গড়াতে যায়, সেই হিসেবটুকু বোধ হয় কেউই মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেনি, এখনো করে না। ফলে জলাবদ্ধতা বলে সমস্যাটা আজ শুধু শহর নয়, গ্রামে-গঞ্জেও প্রকট হয়ে উঠেছে। উচিত ছিল সাঁকোর পর সাঁকো বানিয়ে প্রতিটি খালের প্রবাহমানতা বজায় রাখার।এখন যারা আমার নানাবাড়ি যায়, খুশি মনেই যায়। যাতায়াতের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় বসে থাকতে হয় না, উন্নার সাত আট মাইল পথ হাঁটারও মামলা নেই। চাইলে জিনজিরা দিয়ে আধাঘণ্টাতেই পৌঁছানো যায় যে কোনো ভেসেলে। ঢাকা-মাওয়া রোড দিয়ে আবদুল্লাহপুর হয়ে রাজাবাড়ি পৌঁছানোটা আরো নির্ভেজাল। এমন নির্ভেজালভাবে যদি পানির প্রবাহমানতাও ধরে রাখা যেত তাহলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হতো। তার জন্য উপযুক্ত নগর-পরিকল্পনা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।

ওই যে বলেছি একেকবার বৃষ্টির ঘোর মায়াকান্না মাথায় নিয়ে উপস্থিত হতাম নানাবাড়ি। হ্যাঁ, একমাথা বৃষ্টি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিপথ পেরিয়ে নানাবাড়ি যাওয়ার পরও বৃষ্টির তন্দ্রার ঘোরে আমাদেরকে আচ্ছন্ন থাকতে হতো। একদিন দু’দিন তিনদিন বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই- অবিরাম। থামার কোনো লক্ষণ নেই। মাঝে মধ্যে ভয় হতো, কোনোদিন বৃষ্টি বুঝি পৃথিবী থেকে আর যাবেই না। সারাজীবন আমাদেরকে বৃষ্টির মধ্যে এমন ম্লান বিবর্ণ পরিবেশে বসবাস করতে হবে! তখন সময় কাটানোটাও মাঝে মধ্যে অসহনীয় লাগতো। কতক্ষণ আর জানালার কাছে বসে বসে বৃষ্টি উপভোগ করা যায়? একঘেয়েমিতে পেয়ে বসতো খুব। মনে আছে, খালাম্মাদের সঙ্গে তখন খুব লুডুখেলা হতো। সে কী সিরিয়াসনেস লুডুখেলায়। মারামারি বেধে যেত প্রায়ই। চোরামি করাও যেন ছিল খেলার একটি অংশ। মারামারি লাগত সেটা নিয়েই। যে দেশে বৃষ্টি নেই, সে দেশে বোধহয় লুডুখেলারও প্রচলন নেই, এটা শুধু আমার ধারণা!

লুডুখেলার মোহ কাটিয়ে আমি মাঝে মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠতাম বই পড়ায়। আমার দাদাবাড়িতে আব্বার যেমন বইভর্তি বিশাল ট্রাঙ্ক ছিল, নানাবাড়িতে বইয়ের সেরকম বিপুল সমারোহ না থাকলেও বেশ কিছু বই আমি মামা-খালাম্মাদের বইয়ের র‌্যাকে আবিষ্কার করেছি। বিষাদসিন্ধু আমি নানাবাড়িতেই পাই। নানার বাবার হস্তাক্ষরও আছে বইটিতে। কোব্বাদ ব্যাপারী। মৌলভী আবদুল ফাত্তাহ কোরেশীর সালেহা, শাহাদত হোসেনের নতুন আলো উপন্যাস দুটোও এবাড়িতেই পড়ি। শুধু কি পড়ি? মেরেও দেই। সব বইগুলো এখনো আমার কাছে আছে আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে।

বিষাদসিন্ধু পড়তে পড়তে এতটাই একাত্ম হয়ে উঠেছিলাম যে, নিজেকে মনে হয়েছিল কারবালা প্রান্তরেই আছি। হাসান হোসেন জয়নুল এদের পরিণতি দেখে চোখ দিয়ে পানির অবিশ্রান্ত ধারাপাত বইতো। ভাষার যে কী অসম্ভব শক্তি আর ধরে রাখবার যে কী সম্মোহনী টান, বিষাদসিন্ধু না পড়লে তা কখনোই বোঝা যাবে না। আলাদা একটা ভাষাভঙ্গি এবং উপস্থাপনার স্টাইল তৈরি করতে পেরেছিলেন মীর মশাররফ হোসেন, সার্থকভাবে। সালেহাও রোমান্টিক মুগ্ধতায় আমাকে বেশ কিছুদিন আবিষ্ট করে রাখে। আকবর হোসেনের কী পাইনি উপন্যাসটিও বোধ হয় এ-বাড়িতেই আবিষ্কার করেছিলাম। এর আগেই অবশ্য আমাদের দাদাবাড়িতে আব্বার সেই ট্রাঙ্ক থেকে আমার আকবর হোসেন আবিষ্কার এবং পঠন হয়ে গেছে। অবাঞ্চিত, মেঘ বিজলী বাদল- এ দুটো বই। আকবর হোসেনের বোধহয় এই তিনটি উপন্যাসের বাইরে আর কোনও সাহিত্যকর্ম ছিল না। পরে জেনেছি, আকবর নাকি অসম্ভব জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলেন। ঘরে ঘরে থাকত তার বই। বই বেচে নাকি তিনি ঢাকা শহরে বাড়িও করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের আগে তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক। আমার শৈশবে পড়া তার মেঘ বিজলী বাদল আমাকেও পরম নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি বহু বছর ওই উপন্যাসের নায়িকার মতো একজন প্রেমিকা খুঁজেছি। ধনীর দুলালী সেই মেয়েটি তার চেয়েও সামাজিক অবস্থানে নিচু একটা ছেলেকে কী তীব্রভাবে ভালোবেসেছিল। নিজের জীবনকে সংকটাপন্ন করে ছেলেটিকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। পুরো কাহিনিটা এখন আর মনে নেই। পরবর্তী জীবনে দেখেছি, বাংলাদেশের সাহিত্য সমালোচকেরা ধনীর দুলালীদের এভাবে দরিদ্র নায়কের প্রেমে পড়াটাকে ভালোভাবে দেখেননি। মনে করেছেন সিনেমাটিক, আবেগসর্বস্ব এবং অবাস্তব। হুমায়ূন আহমেদও কিন্তু ধনীর দুলালীকে গরিব ছেলের প্রেমে পড়িয়েছেন বারবারই। আমাদের পথের পাঁচালীর অপুর প্রেমেও পড়েছিল ধনীর কোনো দুলালী, নামটা মনে করতে পারছি না। শুধু মনে আছে, অপুর বউ অপর্ণার কথা। বাস্তববাদী লেখক বলেই বোধ হয়, সেই ধনীর দুলালী অপুর জীবনে আসেনি।

চলবে...