আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ১২

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
সেই টানেল পথেই, বেশ বড় একটা মাঠের কথা মনে আছে। মাঠটার চেয়েও বড় ছিল সে মাঠের স্কুল। নীল ড্রেসে সাদা ওড়না পরা মেয়েগুলো মাঠে দৌড়াচ্ছে, খেলছে, খালের পারে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। হয়তো একটা মেয়ে একা দাঁড়িয়েছিল। চোখের ভেতর চোখ রেখে হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য। কোথাও বা দুই বাড়ির দুই জোয়ান বউ কী একটা ব্যাপার নিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আচ্ছা, কী নিয়ে হাসাহাসি করছিল ওরা? এইভাবে কত দৃশ্যপট ছাড়িয়ে সুড়ঙ্গ টাইপের খালটা একসময় আমাদেরকে একটা অশত্থ গাছের কাছে ছেড়ে দিত। তারপরই নৌকাটা সামান্য বাঁক নিয়ে একটা ব্রিজের নিচ দিয়ে হঠাৎই উপস্থিত হতো অসীম এক আকাশ তলে। যেখানে ডানে বামে সামনে পিছনে কোনো ঘরবাড়ি নেই লোকালয় নেই। দিগন্তের পর দিগন্ত শুধু জলঢাকা খোলা প্রান্তর। সেই প্রান্তরের মাঝে পানির সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠা আমন ধানক্ষেত সবুজতা শুধু বিলিয়েই চলেছে।

বর্ষায় নানাবাড়ি যাওয়ার পথে, যে জার্নি বাই বোট শুরু হতো বুড়িগঙ্গা নদীর সোয়ারিঘাট থেকে, তা একটি খালপথের সুড়ঙ্গ-কাল অতিক্রম করে অবশেষে যেন কোনো এক বন্ধনহীন সবুজ সমুদ্রমেলায় উপনীত হতো। যেখানে বুড়িগঙ্গার মতো দু’পারে সীমানার বেড়াজাল নেই, নেই সরুখাল পথের হাঁসফাস, আছে অসীমের ব্যপ্তি আর সুদূরের আহবান! মাথার ওপর আকাশ ছাড়া আর কোনও গান সেখানে বাজে না। চারিদিকে যতদূর চোখ যায় দেখো শুধু অফুরন্ত সুরের দোলাচল, আদিগন্ত প্রান্তর ঢেকে আছে আমন ক্ষেতের উপচানো সবুজে। দূরে অনেকদূরে দিগন্ত রেখায় গ্রামগুলো কখনো গাঢ় কখনো বা ধূসর সবুজ, কখনো বা একেবারেই ঝাপসা। আমন ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে নারীর চুলের সিঁথির মতো চলে গেছে যে সরু পথ, সেখান দিয়েই নৌকা তির তির করে এগিয়ে চলেছে অবশক্লান্ত গান শুনিয়ে।

রাজাবাড়ির এই নৌকাগুলো ছইহীন থাকায় আরো বেশি প্রকৃতিসংলগ্ন হওয়া যেত। আপনি যেদিকেই তাকান, চোখচোখি হয়ে যাচ্ছে আকাশের সঙ্গে। চারদিক খোলামেলা বলে বাতাসও খেলছে ভালো। সত্যি এ যেন অন্তহীন এক অন্য পৃথিবী। নিঃশব্দ থেকে নিঃশব্দতর, নির্জনতর থেকেও নির্জন। পানির নিচের দিকে তাকালে ভেসে উঠত অদ্ভুত এক মায়াবী জগৎ! কী টলটলে স্বচ্ছ জল, তার নিচে দেখো কত রকমের উদ্ভিজ গুল্ম লতাপাতা, কত সবুজের উন্মাদনা! সেও আরেক রহস্যমোড়ানো জগৎ! শুধু কি জলের অন্তঃকরণে! বহিরাবরণেও সেই দীঘল খাল মোহনীয় হয়ে থাকত শাপলা শালুকের অলংকারে! ঝাঁকে ঝাঁক ফুটে থাকত শাপলা। সেই শাপলাকে উপযুক্ত সহবত দিত পানপাতার মতো বিশাল সব পাতা। কী যেন নাম ওর, ওকেই কি পদ্মপাতা বলে। পদ্মফুলও ফুটে থাকত। আমরা নৌকা থেকে চেষ্টা করতাম শাপলা ছিঁড়তে। কখনো পারতাম, কখনো বা ব্যর্থ হতাম, উলটো শাপলার টানে নৌকাই যেত ঘুরে। তখনো মনে হয় শাপলা খাবার হিসেবে ততটা প্রচলিত হয়নি, নাকি হয়েছে? তবে আমরা সেসময়ে সেভাবে শাপলা খেতাম না। পরে নিয়মিত খেয়েছি এবং এখনো খাই, উপভোগ করি এর পরম স্বাদ। শাপলাদেরই জাতপাত হবে শালুক, ঢ্যাপা। পানির নিচ থেকে ঢ্যাপা তুলে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। তবে সেটা এ বিলপথে নয়, নানাবাড়ির পুকুর থেকে। হঠাৎ হঠাৎই কেউ গোসলের সময় পুকুরের নিচে ডুব দিয়ে কোথা থেকে তুলে আনত ঢ্যাপা। সেটা ভেঙে নিজেও খেত আর আমার কৈশোরকেও আর এক প্রস্থ রাঙিয়ে দিত সেই জলজ রঙে!

নৌকা কখনো বিল পথ ছেড়ে ঢুকে যাচ্ছে আমন ক্ষেতের ভেতর। সেও আরেক ভিন্ন জগত! ধানক্ষেতের উপচানো সবুজ বেজে উঠছে মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে! মাঝি বৈঠা রেখে হাতে লগি নিয়েছে। লগি ঠেলে ঠেলে বহু কষ্টে এগোচ্ছে নৌকা। একটু সামনে গিয়েই হঠাৎ থমকে ‘না যামু না’ এমন একটা ভাব দেখিয়েই সটান দাঁড়িয়ে পড়ছে যেন। আবারো লগির ঠেলায় আরেক ধাক্কা আরেকটু এগোনো। আর এগোনোর পথেই হঠাৎ ধানগাছের আঁচড় লাগছে শরীরে আর একটা দুইটা ঘাসফড়িং গায়ে পড়ার হুমকি দেখিয়ে মুহূর্তেই কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে! সে এক অসম্ভব নির্জনতার আড়ংয়ে প্রকৃতির সঙ্গে লীন হয়ে যাওয়া!

মাঝে মধ্যে তো সেই যাত্রাপথে পৃথিবীর রঙই যেত বদলে, যখন হঠাৎই দুদ্দাড় কালো মেঘে ছেয়ে যেত আকাশ। সমস্ত প্রকৃতি হয়ে উঠতো মায়াকাজল। তারপর আকাশেবাতাসে যেন কী এক প্রলয় কাণ্ড ঘটে যাওয়ার চলতো মহা কোনো আয়োজন! সে এক দৃশ্যপট বটে! আকাশের কোন পারে জমে ওঠা হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ, কীভাবে কীভাবে তাণ্ডব তুলে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চারদিক, বিস্তার করে ফেললো আকাশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা, তারপর কোনদিক থেকে শুরু হলো বৃষ্টি, সে বৃষ্টি ভারতনাট্যম নাচতে নাচতে কীভাবে ছুটে আসলো আমাদের দিকে, সেসব চাক্ষুস করাটা ছিল সত্যিই এক পরম রমণীয় ব্যাপার। আমরা এক ছাতার নিচে এতগুলো মানুষ গাদাগাদি করে বসে থাকতাম। থেকে থেকেই বিদ্যুতের বজ্রগর্জনে বুকের ভেতরটা প্রবল প্রকম্পিত হতো। অপার্থিব সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন করে ঝরতো বৃষ্টির অজস্রধারা। তারপর থেমে গেলে বৃষ্টি, সরে গেলে হালকা ছায়ার বাতাবরণ, যখন আবার ঝলসে উঠতো রোদ, মনে হতো পৃথিবীটা বুঝি নতুন করে শুচিস্নিগ্ধ হয়ে উঠলো। তবে যে সবসময় রোদ ফিরে আসতো তা না, বৃষ্টির মায়াকান্না সঙ্গে নিয়েই আমরা হাজির হতাম নানাবাড়ি! সরোদের শোকার্ত মূর্চ্ছনা যেন থামতেই চাইতো না!

একবার এমনই এক মেঘমল্লার দিনে যখন আকাশ ছেয়ে যেতে লাগলো কালো মেঘে, তুমুল বাতাসের আস্ফালন উঠলো, ঝাঁক বেঁধে একদল বকদের ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে যেতে দেখলাম লক্ষ্যহীন। আমার মা বকদের এমন উড়ে যাওয়া দেখে আশংকা প্রকাশ করলেন, ঝড় হবে মনে হয়! আমাদের উদ্বিগ্নতা দেখে পরমুহূর্তেই মার উল্টো সুর, কত ভয়তাড়ানিয়া কথাবার্তা! না না, কিসের ঝড়! কেটে গেছে! আসবে না ঝড়। সেদিন সত্যিই ঝড় আসেনি। একটু পরেই বাতাসের তড়পানি থেমে গিয়েছিল। শুধু সেদিন কেনো, নানাবাড়ি যেতে কখনোই ঝড়ের মুখে পড়তে হয়নি। তবে দাদাবাড়িতে বেশ কয়েকবারই স্কুলে যাওয়া-আসা করবার পথে হঠাৎই ঝড় এসে পথ আটকে দিয়েছে। ঝড়তো আর পথ আটকাতে পারে না, আতংকের টলমলানিতে ক্ষণকালের জন্য আমাকে দিগভ্রান্ত করে তুলেছে! তখন ছুটো আশেপাশের কোনো বাড়িতে! বারান্দার কোলে নাও আশ্রয়, অথবা বারান্দা না পেলে কী আর করা, উগরতলায় কোনোমতো ঠেকঠুকে দাঁড়িয়ে থাকো। একবার এক বৃদ্ধা, তোমগো বাড়ি কোনহানে গো? জিজ্ঞেস করেছিল, এমন আদর ছিল কন্ঠে, এখনো রিনরিনে বাজে! মুখে অসংখ্য বলিরেখা ছিল, শুধু এইটুকু মনে আছে। আমি আমার আব্বার কথা বলেছিলাম, তিনি আমাকে জোর করে ঘরে বসাতে চেয়েছিলেন, মুড়ি খেতে বসেছিলেন। ততক্ষণে ঝড়ের হাওয়া অনেকটাই কমজোরি হয়ে পড়েছিল। আমি আর বসিনি। বাতরের পথে হাঁটা শুরু করেছিলাম। মাঝে মধ্যে ঝড় হাওয়ার তড়পানি দেখিয়েই অদৃশ্য হয়ে যেত, বৃষ্টির কাছে আর নিজের হতচ্ছাড়া চেহারার রূপটার পরিবর্তন করত না।

প্রায় তিন-চার মাইল পথ হেঁটে হেঁটে স্কুলে আসা যাওয়া করতে হতো আমাকে। কখনো কোনো বাড়ির পাশের ঘন গাছপালার ছায়ার নিচ দিয়ে, কখনো বা গাছপালাহীন উন্মুক্ত প্রান্তরের বাতর ধরে ধরে যাওয়া-আসা করতে হতো। জরুনের প্রায় পুরোটাই ছিল গাছপালার ছায়াপথ। জরুন থেকে এনায়েতপুরের মাঝখানের জাযগাটায় ছিল বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর। তারপর এনায়েতপুরে আবার কিছু ঘরবাড়ি পড়ত, তবে আমাদের জরুন গ্রামের মতো অতো ঘনবসতি ছিল না। খোলা জমিই বেশি চোখে পড়তো। দূরে দূরে একেকটা দ্বীপের মতো ঘরবাড়ি। অধিকাংশই মাটির ঘর। টিনগুলো দূর থেকে রোদে চকচক করত। বিল্ডিংয়ের অস্তিত্ব ছিলই না বলতে গেলে! কোথাও ছিল না, কী জরুন, এনায়েতপুর, হাতীমারা। সবখানেই মাটির ঘর। কোনও সিজনে আখের ক্ষেতের ভেতর দিয়ে পড়ত রাস্তা। শিয়ালের ভয় করত, অন্য কিছুর না। কোনও সিজনে আবার ক্ষেতে ক্ষেতে মেলা বসে যেত সর্ষেফুলের। তখন সকালে শিশির পা ধুয়ে দিত ঘাসের ঘাসের। কখনো আবার ধানের হালির কচিপাতার নৃত্যের ছন্দ বাজত বাতাসে। মোহনীয় বৈচিত্র্যের বিমুগ্ধতায় জড়ানো ছিল সেই পথ।

চলবে...