আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ১০

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৫, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
বর্ষা নিয়েও মনে হয় আরো একটু খোলাসা করে বলার সুযোগ আছে। বর্ষার ব্যাপারটা ছিল পুরোপুরিই আলাদা। ভ্রমণের কষ্টটষ্ট একেবারেই থাকত না। ধরুন, আমাদের দাদাবাড়ি থেকে যেমন কোনাবাড়ি বাস স্টেশনের দেড় দু’ মাইলের পথ হাঁটতে হতো না, তেমনি বুড়িগঙ্গার ওপাশের জিনজিরা থেকে রাজাবাড়ি পর্যন্ত আট নয় মাইল পথ হাঁটারও নিতে হতো না দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা।
গাজীপুরে আমাদের দাদাবাড়ির নামায় পানি আসত। কোপাকান্দির বিল ভরে গিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত তুরাগ নদীর সঙ্গে। তবে ঘরের পাশে গাবতলা বা একটু দূরের কদমতলা, কোথায়ও নৌকা থাকত না। আমাদের গ্রামের মানুষের কারোরই নৌকায় চলাফেরার চল ছিল না, দরকারই হতো না নৌকার। সবাই টানে থাকতেই পছন্দ করত। সেজন্যই বুঝি আমাদের দাদাবাড়ির মানুষকে আমার নানাবাড়ির লোকজন ঠাট্টা করে বলত টেঙ্গুইরা। আর, আমার দাদাবাড়ির লোকজনও ছাড়ত না, নানাবাড়ির লোকজনকে সম্বোধন করত ভৌরা বলে।
যা হোক, নৌকা যে একেবারে থাকত না, তাও নয়। নৌকা থাকত জেলেপাড়ায়, কোপাকান্দি বিলের ওপার। বর্ষায় সেই জেলেপাড়ারই এক দুটা নৌকা পারাপারের জন্য কদমতলায় বাঁধা থাকত। সে নৌকায় না ছিল ছই না ছিল বসবার মতো পাটাতন। কীভাবে থাকবে, সেসব নাও ব্যবহার হতো শুধু মাছ মারার কাজে। ছইঅলা প্যাসেঞ্জার নৌকা ভাড়া করে আনতে হতো কাশিমপুর বাজার থেকে। কাশিমপুর আর কড্ডার মধ্যে তখন নিয়মিত নৌকা চলতো। বাজার-সওদা করার ব্যাপারতো ছিলই, কাশিমপুর অঞ্চলের মানুষ ঢাকাসহ গাজীপুর যাওয়ার জন্য ব্যবহার করত এই নৌপথ।
কাশিমপুর বাজার ছিল বর্ণাঢ্যে ভরা। তুরাগ নদীর গায়ে গা লাগানো এই বাজারের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং গড়ন সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মনে হবে যেন তুরাগ নদীরই একটা পার্ট এ বাজার। তুরাগের উঁচু পাড়, বিশাল এক ঘাটলা, তার মাথায় কালিমন্দির, পরে অবশ্য একটা মসজিদও স্থাপিত হয়েছে মন্দির থেকে সামান্য দূরে, জায়গায় জায়গায় অশথ্থ গাছ, কুমোরপাড়া, একটু দূরেই বল খেলার বিশাল মাঠ, স্কুল, জমিদার বাড়ি, এই জমিদারবাড়ির লোকজনই ঢাকার বলধা গার্ডেন বানিয়েছে, বিশাল বিএডিসি, সব মিলিয়ে বেশ জাকজমকপূর্ণ এক আবহ। কাশিমপুরের জমিদারবাড়ির মানুষগুলোই তৈরি করেছিল ঢাকার বলধা গার্ডেন।

অন্য একটা কারণেও নাম নিতে হবে কাশিমপুরের। জায়গাটি সত্যিকার অর্থেই ছিল হিন্দু-মুসলমানের অপূর্ব এক সম্প্রীতির মিলনকেন্দ্র। এ কথা সত্যি হিন্দু-অধ্যুষিত কাশিমপুর থেকে অনেক হিন্দুরাই চলে গেছে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, তা সত্ত্বেও এখনো কাশিমপুর বাজার হিন্দুপ্রধান। অধিকাংশ দোকানপাট হিন্দুদের এবং এখনো তারাই কাশিমপুর বাজারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। দূর্গাপুজায় এখনো এই কাশিমপুর বাজার থেকে প্রতি বছর চার-পাঁচটি প্রতিমা খুব ঘটা করে বিসর্জন দেয়া হয়। দেখবার মতো হয় সে পূজা। আশপাশের দশবারো গ্রাম থেকে সকল ধর্মমতের মানুষ এসে জড়ো হয় সেখানে। বাজারে অবশ্য এখন মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে। তার সঙ্গে দাপটও। তা সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের সেই অমলিন বন্ধন এখনো ঢিলে হয়ে যায়নি সামান্যও।
দেশের নানাপ্রান্ত থেকে অসম্প্রদায়িক ঘটনার অনেক খবর এলেও আজ পর্যন্ত কাশিমপুরে এ ধরনের হীনতার খবর খুব একটা শোনা যায়নি, এক দুটি ঘটনার ব্যতিক্রম ছাড়া। সেখানে হিন্দুবাড়ির নাড়– যেমন মুসলমানবাড়ি পৌঁছাবেই, মুসলমানের ঈদ হিন্দুর উপস্থিতি ছাড়া জমে না।

এই কাশিমপুর বাজার থেকে শুধু কড্ডাতেই প্যাসেঞ্জার নৌকা যেত না, গয়নার নৌকা বলে এক ধরনের মালামাল বহনেরও সার্ভিস ছিল। প্রতি মঙ্গলবার সেই গয়নার নাও কাশিমপুর বাজার থেকে মাল ভরে একদিন একরাত লাগিয়ে ঢাকা পৌঁছাত। আবার ঢাকা থেকে একই রকম সময় লাগিয়ে ফিরে আসত কাশিমপুর। আব্বা সেই গয়নার নৌকায় নানাবাড়ির জন্য আম-কাঁঠাল পাঠাতেন, লটকনও পাঠাতেন, চম্পাফল। নানাবাড়ির এলাকায় কাঁঠাল, লটকন, চম্পাফল এসব দেখা যেত। দাদাবাড়ির অঞ্চল শিল্পায়নের ফলে সেখানে আজ এসব কোন ফলই দেখা যায় না। দেখা না গেলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কাঁঠাল আর লটকনের অস্তিত্ব ঠিকই রয়েছে। শুধু চম্পাফলই হয়েছে বিলুপ্তির শিকার। অথচ চম্পাফল ছিল কাঁঠালের চেয়েও স্মার্ট আর সুস্বাদু। গয়নার নৌকায় পাঠানো এসব ফল ঢাকা থেকে আবার অন্য এক গয়নার নৌকায় রাজাবাড়ি আমার নানাবাড়িতে পৌঁছাত। তখন আমাদের নানাবাড়ি দাদাবাড়ি কোন অঞ্চলেই ট্রাক বা অন্য কোনও মাল পরিবহন ভেসেলের অস্তিত্ব ছিল না। নৌকাতেই আনানেওয়া হতো সব ভারী জিনিসপত্র। বর্ষাকালে নামায় গেলেই চোখে পড়ত মাল পারাপারের দৃশ্য। তুরাগ নদী আর কোপাকান্দির বিলের পারে ইট, খড়ি আর আম কাঁঠালের স্তূপ হরহামেশাই চোখে পড়ত।  

তো, যা বলছিলাম, আমাদের ঢাকা যাওয়ার সময় হলে আব্বা কাশিমপুর থেকে মানুষ দিয়ে নৌকা রিজার্ভ করে আনাতেন। অধিকাংশ সময়ই নৌকা এনে দিতেন উকিল ভাই। আব্বার স্কুলের পিয়ন। এখনো চেহারাটা চোখের সামনে ভাসে। ডান চোখের নিচের দিকে বড় একটা আঁচিল ছিল, চুল সব সময়ই খাড়া হয়ে থাকত মানুষটার। সাইকেল চালাতেন। আমাদের বাড়িতে যারা রাখাল খাটতেন, তাদের ওপরও পড়তো মাঝে মধ্যে দায়িত্বটা। ছইঅলা নৌকাটি আমাদের জন্য অপেক্ষা করত গাবতলায়। আহারে কোথায় হারিয়ে গেল সেই গাবতলা! ঘন ছায়াভরা সুশীতল সেই গাবতলা আর কি জীবনে কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে? কী আশ্চর্য এক রমণীয় পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল চারদিক থেকে। পেছনে ছিল জঙ্গল। সেই জঙ্গলের ভেতর দিয়েই লম্বা ঢালু লালমাটির পথ দিয়ে নেমে আসতে হতো আমাদের। জঙ্গলের বেত গাছগুলো সে পথের পাশে নিজের শরীর লুটিয়ে দিত। বেতফলগুলো এখনো চোখে ভাসে। আর একটা গাছতো বড় হবার পর খুঁজেই পেলাম না। আজো গাছটাকে আমি খুঁজি। গ্রামেগঞ্জে যেখানেই বেড়াতে যাই, অধীর হয়ে খুঁজি। সেই গাছে ধরতো এক ধরনের গোটা, যার একপাশটা ছিল কালো আর একপাশটা ছিল লাল। মনে হতো যেন কোন শিল্পী নিখুঁতভাবে রং করে রেখেছেন! খুব শক্ত ছিল ছোট্ট পুতিটা। হ্যাঁ, আমরা ওটাকে পুতিই বলতাম। সেটা কি এ পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গেল নাকি? কত কিছু যে হারিয়ে যায় এই পৃথিবী থেকে দিনে দিনে। আজকাল নানা অনলাইন পোর্টালে প্রায়ই শুনি, আমাদের পৃথিবীটারও নাকি হারিয়ে যাবার সময় এসে গেছে। আগে বিশ্বাস হতো না কথাটা। এখন শুধু বিশ্বাস নয়, আমি নিশ্চিত পৃথিবীটা সত্যিই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষই ডেকে আনবে এর বিনাশ, সহসাই।

চন্দন গোটাও আজকাল চোখে পড়ে না। লালকালো পুতির চেয়ে বেশ বড়। টকককে চকচকে লাল। দাদাবাড়ির নামাপাড়ার কাছে সফিজউদ্দিন ভাইদের বাড়ির পাশেই একটা চন্দন গাছ ছিল। সেখানেই চন্দন গোটা পড়ে থাকত মাটিতে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যেত, হাতে নিলে মনে হতো কী যে এক বিপুর ঐশ্বর্য পেলাম! মধুপোকাও হারিয়ে গেছে। মধুপোকা নাকি ভ্রমর? কী সুন্দর রঙিন ঝালর ছিল সারা গায়। বিশেষ একটা গাছে ওদের পাওয়া যেত। কী যেন গাছটার নাম? খুব কমন নাম। বললেই মনে পড়ত আপনাদের। আমি কিছুতেই নামটা স্মরণ করতে পারছি না। আমাদের বাড়ির রাখালেরা ধরে এনে আমার হাতে বসিয়ে দিত। গ্রাম থেকে এইসব সুন্দর জিনিসগুলো কেনো যে হারিয়ে গেল, কোথায় গেল, সে এক মহাবিশ্বের মহা-রহস্যময়তা! গাবতলার ডানদিকের খোলা জমিতে যেখানে বর্ষার পানি এসে ঠেকত, সেখানে ছিল হিজল গাছের সারি। সেই হিজল গাছের লাল হিঙ্গুল ফুল মালার মতো ঝুলে থাকত ডালকে ডাল। প্রচণ্ড গরমে কত মানুষের যে আশ্রয়স্থল ছিল সেই গাবতলা। আদিগন্ত খোলা প্রান্তর আর কোপাকান্দার বিল পেরিয়ে নদীর সুশীতল হাওয়া এসে জুড়িয়ে দিত গা। চোখের সামনে ভেসে উঠত গ্রামবাংলার এক চিরন্তন ছবি। বর্ষায় যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। পানির ওপারে ছোট্ট দ্বীপের মতো ভেসে থাকত জেলেপাড়া। জেলেপাড়ার বাইরের খোলা মাঠ আর প্রান্তর জুড়ে ছিল লম্বা লম্বা সব তাল গাছের সারি। দিগন্তের কিনারে দাঁড়ানো সে তালবৃক্ষের সারি জীবন্ত পেইন্টিং হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত যেন। বর্ষা মিলিয়ে গেলে পানির বদলে জায়গাটা ধান আর বাদাম গাছের উপচানো সবুজে ভরে উঠত।
চলবে...