অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন
আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ৭
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৪, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
এই সাপের কথা ওঠাতে আরেকটা গল্প মনে পড়লো। সেটাও নাসিম মামার। বর্ষার পানি এলে খাল-বিল-নদী-নালা তো বটেই, পুরো নিম্নাঞ্চল ডুবে যায়। তো, তেমনই এক বর্ষায় নাসিম মামা আর জলে উনার নাম কি জলিল ছিল? কী জানি আমার সঙ্গে আলাপ হয়নি কখনো, তবে সবাই তাকে জলে বলেই ডাকত। তো, সেই জলে আর নাসিম মামা রাতের অন্ধকারে নৌকা নিয়ে চকে গেছে মাছ মারতে। হাতে ট্যাটা। ট্যাটা দিয়ে তখন বর্ষার সেই সময়টায় শোল মাছ মারার হিড়িক পড়ে যেত। কোনও কোনও শোল মাছ পোনা নিয়ে ঘোরাঘুরি করতো। তখন এক টিকেটে দুই সিনেমা! শোল মাছও মারো আবার পোনাগুলোও উঠিয়ে নাও জুত মতো।
তো, সেদিন সারারাত চকের মধ্যে নৌকায় চক্কর মারতে মারতে যখন কিছুই মিলল না, দুজনই হতাশ হৃদয়ে বাড়ি ফেরার চিন্তা করছে, তখনই আবছা আলোছায়ায় দেখা গেল কী একটা মাছ যেন পানিতে ভেসে যাচ্ছে। জলে আর দেরি করল না। ট্যাটাটা ছুঁড়ে দিল সেই মাছটার দিকে। মোক্ষম আঘাত। টার্গেট মিস হলো না ঠিকই, কিন্তু মাছটাও যেন দৈত্যসদৃশ। এতো শক্তি! মোচড়াতে মোচড়াতে ট্যাটাশুদ্ধই কোথায় হাওয়া হয়ে গেল নিমিষে। মাছতো মাছ, ট্যাটা পর্যন্ত হারিয়ে দুজনই কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে রইলো! একি কাণ্ড! এমন আশ্চর্য রকমের ঘটনার কথাতো কখনো শুনেনি! ট্যাটাসহ পুরো মাছটাই উধাও? গেল কোথায়? নৌকা নিয়ে এদিক সেদিক টর্চের আলো ফেলে দেখেদেখে অবশেষে দুজনই বিমর্ষ এবং বিস্মিত মন নিয়ে ফিরে আসলেন বাড়ি। হাতমুখ ধুয়ে যে যার বাড়িতে ফিরে নিজ নিজ ঘরে শুয়ে পড়লেন। সকাল হতেই জলের বাড়ির মানুষের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল জলের, আতংকগ্রস্ত হয়ে ঘরের বাইরে এসে ও দেখলো, ঘরের বেড়ার নিচ দিয়ে একটা সাপ ঢুকবার চেষ্টা করেছে ভেতরে, ট্যাটার কারণে ঢুকতে না পেরে সেখানেই পড়ে আছে অসাড়ের মতো। সাপটার শরীরে বিদ্ধ হয়ে আছে কাল রাতের ওর সেই ছুঁড়ে মারা ট্যাটা। ভয়ে আতংকে কেমন কুঁকড়েমুকড়ে গেল জলে। সেই যে জ্বরে পড়ল, সেই জ্বর আর দশদিনেও ফিরল না, দশ দিন পর সেই জ্বর থেকে ওকে মুক্তি পেতে হলো নিজের জীবন দিয়েই!
সত্যি! বড় রোমাঞ্চকর ছিল আমার নানাবাড়ি। বড়ই প্রাকৃতিক আর সন্ধ্যার ধূসর পাণ্ডুলিপির মতোই প্রগাঢ়! আমি যদি আমার নানাবাড়ি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে না বেড়াতাম, রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিজের জন্য খুঁজে পেতাম কিনা সন্দেহ! উপলব্ধি করতে পারতাম না বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্যকেও!
উন্নার কথাতো কিছুটা বলাই হলো। শীতের সময় ছিল আমার নানাবাড়ির আরেক রূপ। এবার আর সেই জিনজিরা থেকে রাজাবাড়ির পুরো সাত আট মাইলের পথ হাঁটতে গিয়ে শরীরের ঘাম ঝরাতে হতো না। উলটো কুয়াশামুড়ানো ঠাণ্ডায় বরং হাঁটতে ভালোই লাগত আমার বা আমাদের। পথের রূপসৌন্দর্য আর প্রকৃতির মায়াব্যঞ্জনা দেখে চোখমন দুইই জুড়াত। সরিষাবনের হলুদ ফুলের সতেজিয়া ঘ্রাণতো ছিলই। রসুন, পিয়াজ, ধনেপাতা, কলুই ক্ষেতসহ আরো নানা রকমের গাছ সবজির সমারোহে প্রকৃতি বৈচিত্র্যের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে উঠত। শীতের কুয়াশামগ্ন নানাবাড়ি যাওয়ার পথকে মনে হতো অচিন কোন রাজ্য।
আমি নানাবাড়ি পৌঁছে কিছুতেই ঘরে থির বসে থাকতে পারতাম না। প্রান্তরে-প্রান্তর চষে বেড়াতাম। সরিষা আর কলুইয়ের হলুদ নীল ফুলের অভিনন্দন গ্রহণ করতে করতে হাঁটতাম দিগন্তের পর দিগন্ত। একাকী সেই পরিভ্রমণে মনে হতো প্রজাপতি ফড়িংয়ের দল যেন আমাকে দেখেই আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে। বাতাসের দোলায় সরিষার বন যেন হিল্লোল তুলছে কেবল আমাকেই সুখবিহ্বলতা দিতে। হেলিকপ্টারের মতো দেখতে ছোট জাতের একটা ফড়িং দেখে প্রথমে উপলধ্বি করেছিলাম বিন্দুমাত্র রঙের মধ্যে যে রোশনাই লুকিয়ে থাকে তা আসলে জীবনের আনন্দেরই বর্ণিল সমারোহ! দূরে অতি দূরে দেখা যেত ধলেশ্বরী নদীতে ছুটে চলা বড় বড় নৌকোর মাথা উঁচু করা বাহারি রঙের সব পাল। সেইসব উজানপংখী নাও দেখতে দেখতে মন হারিয়ে যেত কোনও রূপকথার দেশে। তখনতো আমি আক্ষরিক অর্থেই রূপকথার জগতে নিজেকে হারিয়ে ছিলাম। ফুলের দেশে পরীর বেশে, রাজকন্যা কমলমণি, ঠাকুরমার ঝুলি, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা আরো কত কি বইয়ের কল্পলোক! রাক্ষসখোক্কস, ব্যঙমা ব্যঙমি, ভূতপ্রেত দৈত্যদানো, পঙ্ক্ষিরাজ রাজকুমার আর পরমাসুন্দরী এক রাজকন্যা! মন সব সময় কেড়েই রাখত!
প্রতি শীতেই গ্রামে গ্রামে নাটক হতো। গ্রামের ক্লাব থেকে যুবকের দল একমাসের দীর্ঘ রিহার্সেল আর কঠিন খাটাখাটনির পর একদিন বেশ ঘটা করে নাটক নামাত। মেয়েদের চরিত্রে ছেলেরাই করতো অভিনয়। তবে ড্যান্সার আনা হতো ঢাকা থেকে। তখনো প্রিন্সেস যুগ আসেনি, সেটা এলো আরো পরে। প্রিন্সেস লাকি খান, প্রিন্সেস মায়া আরো কত কে! এই প্রিন্সেস ব্যাপারটা ফোকাস হয়েছিল আসলে ঢাকায় বাণিজ্য মেলা শুরু হওয়ার পর। বাণিজ্য মেলায় যাত্রা হতো, সে যাত্রায় অনুষঙ্গ হিসেবে নাচার জন্য আসতো প্রিন্সেসরা। সেটা আবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হতো। অর্থ-বাণিজ্য-ব্যবসার সঙ্গে যে নারীর যৌনতারও বিকিকিনির একটা ব্যাপার থাকে, এ ঘটনা যেন তারই প্রমাণ। অবশ্য, সেই প্রিন্সেস যুগের আগেই ড্যান্সার আসাকে কেন্দ্র করে গ্রামের শীত মৌসুমের নাটককে ঘিরে এক বাড়তি উত্তেজনা বিরাজ করতো! শুধু ছেলে-যুবক নয়, বুড়োদের মধ্যেও নীরব উন্মাদনা কাজ করত! আশপাশের সব গ্রাম যেন এই নাটকের দিনটির জন্যই উন্মুখ হয়ে থাকত মাসের পর মাস। যারা পাট করতো তারা হেভি ভাব নিয়ে চলতো। প্রেমের জন্য গ্রামের মেয়েদের কাছেও তারা বিশেষ অগ্রাধিকার পেত।
সিনেমার মতো করে কীভাবে যেন আলোকসম্পাতের মাধ্যমে যারা নাটকের কুশীলব, তাদের নাম আসত পর্দায়। ড্রপসিনগুলোও ছিল বিস্ময়কর নিখুঁত। কারা আঁকতো সেইসব ছবি? পৃথিবী কোনোদিন সেই শিল্পীদের নাম কখনোই জানবে না। অথচ তারা যে কত বড় আঁকিয়ে ছিলেন, সেই ড্রপসিনগুলো যারা দেখেছেন তারাই বলতে পারবেন! একবার এক ড্রপসিন আমার মানসজগতকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বলা ভালো, এখনো আমার চৈতন্যে ছুঁয়ে আছে সেই ছবি সেই রঙ। নাটক শুরু হওয়ার আগে মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে ভাসছিল ছবিটা। সেটা অনেক অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যমান ছিল। নেপথ্যে বাজছিল বাঁশির সুর। আর সেই সুরের নির্যাস যেন ছড়িয়ে পড়ছিল ড্রপসিনের কাঁচামাটির পথ, পথকে ঘিরে দু’পাশের শূন্য প্রান্তর আর সেই পথকে নিয়ে হারিয়ে যাওয়া দূরের দিগন্তব্যাপী। গ্রামের সেই নির্জন পথে হেঁটে যাচ্ছে এক বালিকা। অতো দূর পথ সে কীভাবে একা হেঁটে যাবে, কত দূর পথ পাড়ি দিতে হবে ওকে! ভেবে ভেবে মন কেমন হা হা করে উঠেছিল! দৃশ্যটা আমাকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, সময়কে ছাপিয়ে ঢুকে পড়েছিল হৃদয়ের গভীর মর্মমূলে। যার আবেদন এখনও মুছে যায়নি সামান্যও। এরপর কত সিনেমা দেখলাম, কত নাটক, কত পথের কত দৃশ্যপট মানুষের মুখ! কিন্তু সেই সে দৃশ্যটি কেনো যেন সবকিছু উপচিয়ে আমার মানসজগতে অতি উজ্জ্বল হয়ে আছে, তৈরি করে রেখেছে অদ্ভুত এক আনন্দবেদনার মায়া সরোবর! যা আজও আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় দূর পৃথিবীর গন্ধে! যেন আজন্মকাল পথের এই হাতছানি ডাকবেই আমায়!
বাল্যকালে বইয়ে পড়া শীতের আরেকটা ইমেজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। পুরো নাম বলতে পারব না, তবে সত্যপ্রসাদ যে ছিল নামের অংশে এটা হানড্রেড পার্সেন্ট সত্যি, সেই সত্যপ্রসাদ লিখিত শেক্সপীয়রের একটা জীবনী ছিল আমাদের ঘরে। সে আমি শৈশবেই পড়েছিলাম। বইটার প্রচ্ছদেও ছিল শূন্য দিগন্তের মধ্যে গ্রাম্য পথে এক যুবকের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য। সে বইয়ের সব কথা ভুলে গেছি, কেবল ভুলি নাই, বাড়ি থেকে বালক শেক্সপীয়রকে এক কাকভোরে একটা কাজে বাইরে পাঠিয়েছিল ওর বাবা। পথে যেতে যেতে প্রবল কুয়াশার ভেতর এক মেয়ের সঙ্গে ওর শারীরিক সংঘর্ষ ঘটে। তারপর দুজনের মধ্যে কথা হলো। শেক্সপীয়র বললো, আমাদের কি মাঝে মধ্যেই এভাবে দেখা হতে পারে না? মেয়েটি সায় দিল, কেন হতে পারবে না দেখা। এরপর দেখাতো হলোই, দেখা ক্রমশ হতেই লাগলো, পরে তা স্থায়ী সম্পর্কে মোড় নিল। ওরা সারাজীবনের দুঃখসুখের সঙ্গী হয়ে উঠলো। স্ট্র্যাটফোর্ড অন আভনে প্রবল কুয়াশার ভেতর দৈবাৎ দেখা হয়ে যাওয়া ওই মেয়েটির নাম ছিল অ্যানা হ্যাথওয়ে। আমার যে এরপর কী হতো! কুয়াশা, প্রবল কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রোমাঞ্চিত হয়ে যেতাম। মনে হতো ঝাপসা অস্পষ্টতার ভেতর হঠাৎ কোনও এক সুন্দরী নারীর সঙ্গে...
চলবে...