আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ৩২
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুন ২৮, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
ফুটবল খেলার আরেকটি অনিবার্য পার্ট ছিল মারামারি। খেলার মধ্যে দেখা গেল, এক পক্ষের খেলোয়াড় আরেক পক্ষের কোনো খেলোয়াড়কে দিল ল্যাঙ মেরে ফেলে। সেই খেলোয়াড় কখনো হয়তো উল্টো উঠে ঘুষি মেরে বসতো বা অজ্ঞান হওয়ার ভান করে শুয়ে থাকতো মাঠে, তখন দেখো অন্যান্য খেলোয়াড়দের মধ্যে লেগে গেল কিল, ঘুষাঘুষির প্রতিযোগিতা— সেটা মাঠ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়লো মাঠের বাইরে সমর্থকে সমর্থকে। তখন কে যে কোন পক্ষের হয়ে কাকে মারতো— সেটা ছিল একটা দেখবার মতোই বিষয়! অনিবার্যভাবেই তখন খেলা বন্ধ হয়ে যেত। কখনো কখনো টুর্নামেন্টও। শ্রীকান্ত উপন্যাসের শুরুই হয়েছিল মাঠের এই মারামারি দিয়ে। কী অনন্য কী নিদারুণ সেই বর্ণনা।
টুর্নামেন্টের চেয়েও বেশি উত্তেজনাকর ফুটবল খেলাটি হতো হাতীমারা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় বনাম কাশিমপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের মধ্যে ইন্টার ডিস্ট্রিক্টের ফুটবল খেলাটিকে ঘিরে। মাত্র তিন-চার মাইল ব্যবধানের এ দুটো স্কুল সবকিছু নিয়েই মেতে থাকত অলিখিত এক প্রতিযোগিতায়। মেট্রিকে কয়টা ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে— কাশিমপুর স্কুল বেশি পেলে যেন হাতীমারা স্কুলের ইজ্জত চলে যেত। হাতীমারা স্কুলের ছেলেমেয়েরা বৃত্তি পরীক্ষায় বেশি পাশ করেছে, কাশিমপুর স্কুলের লোকজন সে-কারণে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতো না। এমনি একটা অবস্থা! প্রতিযোগিতা চূড়ান্ত রূপ পেত— যখন ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট ফুটবল খেলায় এই দুটি স্কুল পরস্পরের মুখোমুখি হতো। একজনের সঙ্গে আরেকজন হারলে যেন অনিবার্য মরণ। অনেকটা ডুয়েল লড়ার মতো ব্যাপার। তাই প্রস্তুতিও ছিল দেখবার মতো। সারা বছরই সেজন্য ফুটবল নিয়ে অনুশীলন লেগেই থাকতো। তুমি লেখাপড়ায় গাড্ডা হও তো কী হয়েছে, ভালো গোল করতে জানো, ঢুকে পড়ো হাতীমারা হাই স্কুলে। বছর শেষে খেলায় কাশিমপুর স্কুলকে একটা গোল দিলেই হবে! তুমি ভালো স্ট্রাইকার, পরীক্ষায় পাশ করতে পারো না, নো প্রব্লেম! জনম জনম ভরে ছাত্র হয়ে থাকো না কাশিমপুর হাই স্কুলের। নইলে হাতীমারা স্কুলকে মাঠে দাবড়ানি দেবে কে?
এমন যে আবহানী-মোহামেডান, এল ক্ল্যাসিকোর মেসি, রোনাল্ডোদের দ্বৈরথ— তারচেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর ছিল এ-দুটি স্কুলের ম্যাচ। একবার এই উত্তেজনা যে উত্ত্যুঙ্গের কী শীর্ষ সীমানায় পৌঁছেছিল— তা বলবার মতোই বটে! এখনো ভাসা ভাসা মনে আছে সেই হাই ভোল্টেজ ম্যাচটির কথা! বিকেলের খেলায় কোনো পক্ষই গোল করতে পারল না। খেলা ছাড়াল অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেও ড্র। পরেরদিন সকালেও চলছিল খেলা। তখনো কোনো পক্ষ গোল করতে পারল না। তারপর খেলা আবার শুরু হলো বিকেলবেলা। সেটা আর গোলাগোলির পর্যায়ে থাকল না, প্রথমে গালাগালি তারপর কেবল হাতাহাতির উপলক্ষ হয়ে উঠলো। শেষে আর কি! প্রসপণন্ড!
আজ মনে প্রশ্ন জাগছে, আচ্ছা, তখন কি পেনাল্টির সিস্টেম ছিল না? পেনাল্টির মাধ্যমেই তো খেলার ফলাফল নির্ধারণ করা যেত। নাকি তখনো সে সিস্টেম ফুটবলে আসেনি? আমাদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল আরো বেশি, যেহেতু আব্বাই ছিলেন হাতীমারা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অভিভাবক, প্রধান শিক্ষক। কাশিমপুর হাই স্কুলের সমর্থকদের চোখ রাঙানিও তাই আমাদেরকেই বেশি সহ্য করতে হয়েছে। চোখ রাঙানি না হোক, উপেক্ষার তীরে বিদ্ধ হতে হয়েছে বরাবর। আজো যেন সূক্ষ্মভাবে বিভেদের সেই বেড়াজাল অদৃশ্য সূতোর মতো ঝুলছে! নাকি আমারই মনের ভুল। আমি অবশ্য কিছু মানুষের আচরণ দেখে এ-কথা বলছি, সবার নয়। আসলে সময়টাই এমন যে, মানুষ ক্রমশই গণ্ডিবদ্ধ, গোত্রবদ্ধ, স্বার্থরুদ্ধ হয়ে পড়ছে! পরশ্রীকাতরতাও মহামারি রূপ ধারণ করেছে। নিজস্ব বৃত্তের বাইরের অন্য কাউকে যেমন গ্রহণ করতে পারছে না, সীমাহীন আকাশের উন্মত্ত দিগন্তের খোলা হাওয়ায় ভাসার আনন্দকেও পারছে না আস্বাদন করতে! কী আর এসে যায় এমন আক্ষেপে!
একবার এই ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে আমারো অনেক দূর ভ্রমণ হয়েছিল। সে খেলার কোন স্মৃতিই মনে নেই, তবে যে স্মৃতি মনে আছে, তা মনে পড়লে নিজের কাছেই নিজে ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে উঠি। সেদিন আমি সেই খেলাটি দেখতে যাওয়ার জন্য কেন যেন স্কুল থেকে প্রবল জিদ ধরেছিলাম। এমনই জিদ যে, শেষপর্যন্ত আমার জেদাজেদির কাছে আব্বা পরাজিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, যতই কষ্ট হোক, খেলাটি তিনি আমাকে আজ দেখাতে নিবেন। তখন আমরা সাভার থানার আওতাধীন ছিলাম। সেই খেলাটিও হয়েছিল সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। তখন সাভার যাওয়াটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। হাতীমারা থেকে রাস্তা বলতে ছিল একটাই। ভবানীপুর হয়ে জিরানি, জিরানি থেকে বাসে নবীনগর হয়ে সাভার! সে এক দুঃসহ অভিযানের মতো ব্যাপার-স্যাপার। আসলে সেবার হাতীমারা হাই স্কুলের ফুটবল টিমটি ছিল দুর্দান্ত শক্তিশালী! একের পর এক স্কুলকে পরাজিত করেই যাচ্ছিল। সে-কারণেই বোধ করি আমার ভেতরে খেলা দেখার উৎসাহ উন্মত্ততার পর্যায়ে পৌঁছেছিল আর আব্বাও সেই জয়ের ধারায় ভেতরে ভেতরে এতটাই উৎফুল্ল যে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে নিমরাজি হলেন না। কী কারণে সেদিন আব্বার ফিফটি হোন্ডাটি ছিল না। আব্বা একটা ফিফটি হোন্ডায় চলাফেরা করতেন। লাল-সাদার ছোট্ট সেই ফিফটি হোন্ডাটা আজো চোখে ভাসে। আমি অবশ্য সে হোন্ডার পিছনে পরে আর বসতে চাইতাম না। একবার চলন্ত হোন্ডার পেছন থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে হোন্ডায় চড়ার একটা ভীতি কাজ করে আমার মধ্যে, এখনো।
যা হোক, সেদিন হাতীমারা স্কুল থেকে আমাদেরকে জিরানি পর্যন্ত প্রায় আট ‘ন মাইলের পথটুকু যেতে হয়েছিল হেঁটে হেঁটে। তখন এই রাস্তাটি ছিল কাঁচামাটির, ভাঙা এবড়ো থেবড়ো। গরু-মহিষের গাড়ি ছাড়া আর কোনো যান চলাচলের উপযোগী ছিল না। আমি কি আর সেই আট ‘ন মাইলের পথ, বংকিম দূর্গম পথ, নিজের পায়ে হাঁটতে পারব? সম্ভব সেটা? ছয় কী সাত বছর বয়স তখন। আমাকে অত কষ্ট পেতে দেখে আব্বার একজন ছাত্র নিজের উৎসাহেই আমাকে তার কাঁধে তুলে নিলেন, আমার শত বাধাকে অগ্রাহ্য করেই। কিছুক্ষণ পর অন্য এক ছাত্র তার কাঁধ থেকে আবার নিজের কাঁধে আমাকে বয়ে নিয়ে কষ্টটুকু শেয়ার করলেন। এভাবে পালাবদল করে তিন চারজন ছাত্র সেদিন আমাকে কাঁধে চড়িয়ে জিরানি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার আড়ষ্ট হওয়ার সেটাই হলো কারণ! আমার জন্য এতগুলো বড় ভাই কষ্ট পেয়েছেন! নিজেরা কষ্ট পেয়ে আমাকে দিয়েছেন ভ্রমণের আরাম। এটা যেমন আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি, তেমনি আজন্ম সেই কৃতজ্ঞতা বয়ে বেড়ানোর ভারও!
আব্বার সেই মহৎ ছাত্ররা আজ কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, জানি না। তাদের মধ্যে কেবল দুজনের মুখ স্মরণ করতে পারি। একজন বর্তমানে একটি জাতীয় ব্যাংকের বেশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পদে অধিষ্ঠিত। আরেকজন আর বেঁচে নেই মাটির পৃথিবীতে। ক্লাস টেনে পড়ার সময় আমার এক বড় আপাকে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম। যারা আমাকে কাঁধে বয়ে খেলা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদেরই একজনকে কোনো এক চেয়ারম্যানের লোকজন নাকি নির্মমভাবে গণপিটুনির মাধ্যমে মেরে ফেলেছিলেন। তার আগে অবশ্য সে মানুষটিই উদ্যত হয়েছিলেন চেয়ারম্যানকে হত্যা করতে। সেই মানুষটার পিস্তলের গুলি ফোটেনি, ব্যর্থ হয়েছিল। তারপরই চেয়ারম্যানের লোকজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সাজিয়েছিল গণপিটুনির নাটক! বড় আপার কান্না দেখে আমারও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
সেদিন জিরানি পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে, জিরানি থেকে বাসে উঠে আমাদের স্কুলের দলটি ঠিকঠাক সময়েই পৌঁছাতে পেরেছিল সাভার অধরচন্দ্র স্কুলে। কিন্তু মন্দ ভাগ্য আমার। খেলাটি হয়নি। প্রতিযোগী স্কুলটি নির্ঘাৎ পরাজিত হবে জেনেই বুঝি, কী একটা কারণ দেখিয়ে মাঠে উপস্থিত হয়নি। না খেলেই হাতীমারা স্কুল সেদিন বিজয়ী হয়ে পরের রাউন্ডে পৌঁছে গিয়েছিল। আমার মনে আছে, আমরা এলোমেলো সাভারের পথে হাঁটছিলাম, অধরচন্দ্র স্কুলেরই কাছাকাছি। গাছে দেয়ালে রাজ্জাক-সুচন্দার বেহুলা সিনেমার পোস্টার! যতবার সাভার গিয়েছি আমার ওই আলাভোলা শৈশবে, ততবারই চোখে পড়েছে জহির রায়হানের এই বেহুলার পোস্টারটি! অনেক পরে অবশ্য বুঝেছি ব্যাপারটা, সাভার শহরটা তখন হিন্দুপ্রধান ছিল।
চলবে