আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ৩১

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জুন ২১, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি

দূর্গাপুজা ছাড়াও বারো মাসের তেরো পুজার আচার সারা বছর লেগেই থাকত। আমাকে আকর্ষণ করতো কীর্তন। জিতার মোড়ে মানিকদের বাড়িতে কতবার মুগ্ধ হয়ে থেকেছি কীর্তনের সুর আর ধূপধুনোর ঘ্রাণে। বছরে একবার আসতো সার্কাস। সার্কাস মানে বিশাল এক কর্মযজ্ঞের ব্যাপার। জায়গাও যেমন লাগত প্রচুর, আয়োজনেও থাকত তেমনই বর্ণাঢ্যতা। সঙ্গীত লহরী, জোকারদের হাসানোর নানা কসরত, অ্যাক্রিবাটিক খেলার জাদুময়তা, নৃত্যের মনোমুগ্ধকর বিভাবরী। তারপর যে-জায়গাটায় সার্কাসের আয়োজন হতো, সেটাও ছিল ব্যাপার। কাশিমপুর জমিদারবাড়ির আলাদা একটা রূপ ছিল, পুরনো দরদালানের স্মৃতিময়তার পাশাপাশি এর সামনের যে এক দুটি বিশাল ঝাউগাছ, সে আমাদের নিয়ে যেত অন্য এক পৃথিবীতে। ঝাউগাছ তো সচরাচর আমাদের এলাকায় দেখা যেত না, তাই পুরনো প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন ঝাউগাছগুলো একটা প্রাগৈতিহাসিক রূপ এবং মায়াময়তা দান করতো আমাদের চোখকে। সার্কাস পার্টির আয়োজনটা হতো সেই জমিদারবাড়ি লাগোয়া খোলা মাঠটায়। উঁচু প্রসারী সার্কাসের তাঁবুটা যেন পরিবেশকে আরো ইতিহাসের ছায়াতল করে গড়ে তোলা। আরেকপাশে ছিল বিশাল বিশাল প্রাচীন আমগাছসহ আরো সব অজানা অচেনা গাছ ঘেরা বিস্তীর্ণ জঙ্গল। সে কারণে পরিবেশ আর পরিস্থিতি মিলিয়ে সার্কাস আয়োজনটা যেন আমাদেরকে কোন এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেতে পারত।

সার্কাস পার্টির একটা খেলা আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, আমি তার বীভৎস রসে শুধু জারিতই হতাম না, বাড়িতেও সে খেলার প্র্যাকটিস করতাম। কীভাবে! সেটা বলার আগে সেই খেলাটা সম্পর্কে বোধ হয় বলে নেয়া দরকার। সার্কাসের একেবারে শেষদিকের আয়োজন ছিল সেটা। একটা ধারালো ত্রিফলা নিয়ে একজন দুর্ধর্ষ টাইপের এক্রোবেটিক যেন মানুষের স্নায়ুতন্ত্র নিয়েই শুরু করে দিতেন অন্যরকম খেলা! কী যে ধারালো ছিল সেই ত্রিফলা, যার আগা চিকচিক করতো, মনের ভেতর নিয়ে আসতো ভয়জাগানিয়া কারবালা। সেই বাজিকর আচমকাই চকচকে ধারালো ত্রিফলাটাকে নিজের শরীরের ওপর ছেড়ে দিয়ে ঝড়ের বেগে শুয়ে পড়ত মেঝেতে। কী যে ছিল সেই দুঃসাহসিকতা! যদি সামান্য একটুও এদিক ওদিক হয় হিসেবে, ত্রিফলার তিনটি তীরই সেঁধিয়ে যাবে তার শরীরে। কিন্তু প্রতিবারই ত্রিফলার তিনটি মাথার একটি গিয়ে পড়তো দু’পায়ের মাঝখানে আর বাকি দুটি গিয়ে পড়তো শরীরের দু’পাশে। এতক্ষণে সবারই যেন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা থেকে মুক্তি মিলতো! তবুও কতক্ষণ ঘোরের ভেতরে কেটে যেত, তারপর সে ঘোর যখন ভাঙে সবার সঙ্গে মিলে হাততালি দেয়ার সে-এক মস্ত ঢামাঢোল।

সেই ত্রিফলাটা নিজের শরীরের ওপর ছেড়ে দেয়ার আগে তিনি যে একটা করুণ বিষাদাত্মক পরিবেশ তৈরি করতে পারতেন সার্থকভাবে, সেটাই ছিল আসলে আসল খেলা!  বিষাদ মৌন মুখে গোলাকার মঞ্চের চারপাশের মানুষগুলোর দিকে ঘুরে ঘুরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন, যেনবা নিয়ে নিচ্ছেন শেষ বিদায়! এরপর ফিরে আসতেও পারেন, নাও পারেন। একটা বিউগল বা বেহালা বেজে চলেছে ব্যাকগ্রাউন্ডে করুণ আর্তি ছড়িয়ে দিয়ে। সবাইকে ইশারায় কথা বলতে মানা করে দেয়া হতো, সামান্য যেন শব্দও না হয়, কেউ যেন নড়াচড়াও না করে! সামান্য যদি মনোযোগ নষ্ট হয় বাজিকরের, তার জীবন যে চলে যাবে মুহূর্তেই! এই মেসেজটা সে সার্থকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারত! আমরা সত্যি সত্যি জড়পদার্থের মতো চুপচাপ বসে থাকতাম। এমনকি নিঃশ্বাস পতনের শব্দ পর্যন্ত পাওয়া যেত না। সে কি টেনশন আর শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা! আমি অধিকাংশ সময়ই চোখ বন্ধ করে রাখতাম। এই খেলাটাই আমরা বাড়িতে এসে প্র্যাকটিস করতাম সমলি দিয়ে। সমলি হলো সাদা পাটকাঠি। কাকতালীয়ভাবে সেই সময়ই হয়তো পাট জাগ দেয়া হতো। পাট ছাড়িয়ে কাঠিগুলো স্তূপ স্তূপ করে বেঁধে খাড়া করে শুকাতে দেয়া হতো রোদে। আমরা সেখান থেকে তিনটি সমলি অর্থাৎ তিনটি পাটকাঠি নিয়ে হয়তো বানিয়ে ফেলতাম ত্রিফলা। তারপর নিখুঁত তৎপরতায় নিজের ওপর ছেড়ে দিয়ে অবিকল সেই ম্যাজিশিয়ানের মতো শুয়ে পড়তাম মাটিতে!

হাতি, ভল্লুক, ঘোড়া, বানরদের কেরামতি দেখেও বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাইত না। অত বড় একটা জন্তু হাতি অমন বিনয়ে যে শুঁড় তুলে সালাম জানাতে পারে, বড্ড বেমানান মনে হতো! অতো বড় জন্তুটার যেন ভাঙচুর ছাড়া অন্য কিছু করা কিছুতেই মানায় না। শুঁড়ে হ্যাচকা টান মেরে সবকিছু ভেঙেচুরে উড়িয়ে দিলেই না সার্থকতাটা ওর অত বড় শরীরের! কী উদ্ভট চিন্তা করছি। তার কারণটা হলো, সম্প্রতিকালে ফেসবুকের বদৌলতে বিশাল দেহের বিপুল শক্তিধর সেই হাতিদের নানারকম উল্লম্ফন মস্তানির চিত্র যে ভিডিওতে দেখা হয়ে গেছে! তাই অবাক লাগা আরো বেড়ে যায় পশুশক্তির এমন উন্মত্ততাকে কীভাবে অতোটা পোষ মানিয়ে রাখতে পারত সার্কাসওয়ালারা সেটা ভেবে।

সার্কাসের মেয়েগুলো ছিল ভারী সুন্দর! ওদের সেই সৌন্দর্যও সার্কাস পার্টিকে ঘিরে একটা মোহমুগ্ধতা তৈরি করে রাখতো। কোমল সুন্দর চেহারার সেই মেয়েগুলোই যখন চোখ ধাঁধানো এক্রিবেটিকে যাদু ছড়িয়ে দিত, তখন কেমন তাক লেগে যেত আমাদের! কত উঁচুয় উঠে আকাশের সে প্রান্ত থেকে দড়িতে লাফিয়ে আরেকটা আকাশের দড়ি আঁকড়ে ধরতো, এরপর  ঝুলে পড়ে! ভাবা যায়? দুর্ধর্ষ একেকটি খেলা! দড়ির ওপর দিয়ে ছাতা হাতে ব্যালেন্স সামলিয়ে হাঁটাটাও কম ক্ষমতার পরিচয় নয়। দড়ির ওপর দিয়ে বোধ হয় সাইকেলও চালাতো! ছোটবেলায় সার্কাস না দেখলে কোমল চেহারার আড়ালে যে মেয়েরা শক্তকঠিন কর্মকাণ্ডেও মেতে থাকতে পারে, এ-ব্যাপারটা আমার অগোচরেই থেকে যেত! পরবর্তী জীবনে অবশ্য নারীর কঠিন ও রুদ্র রূপ বারবারই দেখতে হয়েছে, হজম করতেও! জানি না, সার্কাসের মেয়েগুলো এত শক্তি কীভাবে ধারণ করে রাখত নিজের মধ্যে! সৌন্দর্যের সঙ্গে শক্তির মেলবন্ধন ঘটলে একটি মেয়ে আর সাধারণ থাকে না, হয়ে ওঠে দেবীতুল্যা। মেয়েদের এই রূপ আর সত্তাটার আমি আজো দাস, আজো তার বন্দনাপিয়াসী! মাঝে মধ্যেই সার্কাসের মেয়েগুলো নেচে উঠত। নাচেগানে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে দিত, তখনকার সময়ের হিট হিন্দি গানের তালে তালে। শুধু কি তখনকার সময়ের, পুরনো দিনের গানের তালে তালেও ছমাছম নাচত ওরা... শুনো চাম্পা শুনো তারা। অরিজিন্যাল ট্র্যাকে নয়, নিজেদের গায়কীতেই। খানিকটা নাকি নাকি সুরের জন্য একটা ভিন্ন আবহ তৈরি করতো সেই গান। ফাঁকে ফাঁকে জোকাররা এসে নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে মেতে উঠতো খুঁনসুটিতে।

সার্কাস দেখার জন্য বসার আয়োজনেও ছিল একটা হুলুস্থলে ব্যাপার। মাঝখানে বৃত্তের মধ্যে মঞ্চ রেখে চারপাশে সাজানো চেয়ারগুলোতে বসতে পারা যেত স্পেশাল মূল্যের টিকিটে। তারপরই তাবু ঘেষে কাঠের পর কাঠ সাজিয়ে আয়োজন হতো বসার। সে বসার চেয়ারগুলো নিচু থেকে বেশ উপরে ক্রমঃসারি হয়ে প্রায় ত্রিপলের ছাদ পর্যন্ত ছুঁতো। একদম উঁচু চুড়োয় বসে সার্কাস দেখার মধ্যে নিঃসন্দেহে আলাদা একটা থ্রিল কাজ করতো নিশ্চয়ই। সার্কাসের চেয়েও চরম আলোড়ন বিলোড়ন তৈরি করে বছরে একবার আয়োজিত হতো ফুটবল টুর্নামেন্ট। সেটাও ছিল বেশ বাইশ গ্রাম জাগানিয়া ব্যাপার-স্যাপার। মাঠের চারদিকের সামান্য একটু কোনাকাঞ্চি জায়গাও ফাঁকা থাকতো না। মানুষের গা ঘেঁষে মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতো সে-খেলা। দলও আসতো অনেক দূর-দূরান্ত থেকে। হাতীমারা, কাশিমপুর, কোনাবাড়ি, বাগবাড়ি, ভবানীপুর, সারদাগঞ্জ, জরুন, আশপাশের গ্রামের এসব জায়গার দল তো ছিলই, খেলতে আসতো সুদূর সেই টঙ্গী, বোর্ডবাজার, চৌরাস্তা থেকেও। টঙ্গী থেকে আসতো সম্ভবত মেটালিক্স, আশরাফ টেক্সটাইল, কলমেশ্বর। উত্তেজনা চরম হয়ে উঠতো যখন রটে যেত যে অমুক টিম হায়ার করে মোহামেডানের অমুক খেলোয়াড়কে নিয়ে এসেছে। আরেকদল দেখো নিয়ে এলো আবহানী থেকে। হায়ার করার ব্যাপারটা হতো খুব গোপনে। আর যাকে হায়ার করে আনা হলো, দেখো তার রাজত্ব! সাধারণের মধ্যে থেকেও বুঝি সে কত অসাধারণ! তাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারাটাও ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। আমাকে আকর্ষণ করতো সেইসব খেলোয়াড়দের জার্সি। জার্সির সঙ্গে মিলিয়ে বর্ণিল কালারের মোজা। জার্সি, মোজা, বোটজোড়ার মধ্যে অপূর্ব সমন্বয়ের যে রঙিন ঔজ্জ্বল্য। গাঢ় সেই বর্ণাঢ্যতা আমার কল্পনার জগতকে রূপকথার মতো আজো রাঙিয়ে রেখেছে।

চলবে