Painting by Deji Lewis
আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ২৯
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুন ০৭, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
প্রচণ্ড ভিড় ও কোলাহলের ভেতর পণ্য বিক্রি করে আমরা লেগে যেতাম কেনাকাটায়। এক সপ্তাহের আলু পেঁয়াজ রসুন তেল মরিচ লবণ যা যা লাগে একটা সংসারে শাকসবজি পানসুপারি সবকিছু কিনেটিনে শেষে যেতাম মাছের বাজারে। অনেক রকম মাছই কেনা হতো। শিলং, পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, কাজলি, আইড় বোয়াল— তবে অবধারিত থাকতো ইলিশ। কখনো একটা কখনো আবার দুটো। ইলিশ কিন্তু কখনোই ব্যাগের ভেতর ভরে আনা হতো না। ইলিশ আনার রেওয়াজ ছিল, হাতে ঝুলিয়ে। জেলেও যেন জানত সেটা। পরম আদরে ইলিশটার ওপর পানি ছিটিয়ে হাত দিয়ে ধুয়েমুছে কানসার মধ্যে কী যেন একটা গাছের লতি লাগিয়ে দিত, সেটা ধরে ইলিশ মাছ হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসা হতো বাড়ি; আর তার মাশুল দিতে হতো মিনিটে মিনিটে— ইলিশ মাছটা কত দিয়া কিনলেন? যেন ইলিশ মাছ দেখলেই প্রশ্ন করাটা একটা নিয়মের মধ্যে পড়ে যায়, আর খুশিমনে উত্তর দেয়াটাও একটা সংস্কৃতি। দশ টাকা বা পনেরো টাকা! এই যে এত মানুষ জিজ্ঞেস করছে ইলিশের দাম, উত্তর দিতে দিতে কারোর মধ্যে কোনো ক্লান্তির ছিটেফোটাও দৃশ্যগোচর হতো না কখনো। উলটো যেন দামটা বলার জন্যই ভেতরে ভেতরে মুখিয়ে থাকা হতো! অনেক সময় জিজ্ঞেস করার আগেই মুখ ফসকে বেরিয়ে যেত ইলিশের দামটা।
বিকেল যখন পড়ে আসত, তখন থেকেই বাড়ি থেকে বাড়ি বাড়ি, ভেসে আসতো ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ। গ্রামজুড়ে, কাশিমপুর থেকে জরুন, জরুন থেকে কোনাবাড়ি, পথে হেঁটে যেতে যেতে ক্ষুধা চনমনে হয়ে উঠতো ইলিশ ভাজার ঘ্রাণে। সোমবার দিন হাট থেকে টাটকা টাটকা ইলিশ মাছ আনো, আর ভাজা করে খাও। যেন ইলিশ খাওয়ার একটা ধুম লেগে যেত। অধিকাংশদের রান্নাঘরই থাকত দুই ঘরের মাঝখানে, দুয়ারের কোণায়। সেখানে হয়তো মাটির চুলার পাশে কুপি জ্বলতো অথবা কোনো কোনো বাড়িতে হারিকেন। কিন্তু সে অন্ধকার খুব ঝাপসা দেখাতো না। কারণ চুলা থেকে আগুনের রোশনাই এসে শুধু ঘরণীর মুখই রাঙিয়ে তুলতো না, ভাজা ইলিশের পিঠের রুপালি রঙকে আরো বেশি লোভাতুর করে তুলতো। ভাত বাড়ার আগেই বাড়ির কর্তা ছেলেমানুষের মতো নিজেই দাওয়ার মধ্যে পাটি বিছিয়ে বসে পড়তো খাওয়ার জন্য।
সবুর পাগলাও কখন হাট থেকে ফিরে এসে বসে গেছে খাবার খেতে। সারাটা দিন সে হাটের মধ্যে গিয়ে কী করলো না করলো তার খোঁজ কেউ নিত না, জিজ্ঞেস করলেও মিলতো না সদুত্তর। রাতটা কাটিয়ে পাগলা কাউকে কিছু না বলেই চলে যেত পরদিন ভোরবেলা। ওহ! আরেকটা কথা বলা হয়নি। হাটের আনুষঙ্গিক পার্ট ছিল ‘বেহাতি’। বাজার সওদার সঙ্গে কোনো একটা খাবারের আইটেম আনার রেয়াজ ছিল তখন। প্রতিটি বাড়ির আণ্ডাবাচ্চা পোলাপান সবাই যেন সেই বেহাতির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করতো। ওদের হাতে দেয়া মাত্রই হৈ হৈ চিৎকার দিয়ে একটা লাফ দিয়ে উঠতো, বেহাতি বেহাতি বলে। বেহাতির মধ্যে অধিকাংশ সময়ই থাকত নিমটি, মচমচা নিমটি। কখনো থাকত মাসের বুড়া, পিঁয়াজি। মিষ্টি জাতীয় জিনিস কমই থাকত। তবে জিলাপি, গজা, চিনিতে চিনিতে বোঝাই চমচমও আসতো মাঝে মধ্যে। কর্তারা যে হাট করার এক ফাঁকে গরম গরম রসগোল্লা আর তার সিরা দিয়ে বড়সড় আকৃতির রুটি খেয়ে আসতেন, সেটা বাড়িতে বলতেন না। বাড়ির গিন্নিও জানতেন বলে হাটের হাঁড়ি ভাঙতেন না, জানতেন রসগোল্লা দিয়ে রুটি খাওয়াটাও হাট করারই একটা অংশ।
এই যে সোমবারের হাটের এত বিপুল বিশালতা, এত মানুষের আলোড়ন বিলোড়ন, উৎসবের ব্যাপকতা— এসব কোনোকিছুই ছিল না আমাদের নানাবাড়িতে। রাজাবাড়ির হাট বসতো মনে হয় বৃহস্পতিবার। চুপচাপ চোরের মতো সে হাট আসতো, সন্ধ্যা হতে না হতেই যেন মাথা নিচু করেই অনেকটা, পালিয়ে যেত কোথায়। শুনেছি হাট বসা নিয়ে নাকি এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের গণ্ডগোল লেগেই থাকত। হাট তাই কয়েকটা ভাগে ভাগ হয়ে নানা গ্রামে বসতো। হাট না জমলেও সেদিনটা ছিল টকঝালমিষ্টিতে পরিপূর্ণ। কারণ আবদুল্লাহপুরের দিক থেকে মাথায় ঝাঁকা নিয়ে আচারঅলা হাজির হতো। সারাপথ আচার বেচতে বেচতে চলে যেত রাজাবাড়ির হাটে। চালতার আচারই থাকত বেশি। চালতার আচার তেমন ভালো লাগত না আমার। কী করবো! অন্য আচার যে তেমন নেই। বাধ্য হয়েই খেতাম। শুধু খুঁজতাম বরই আর জলপাইয়ের আচার। মিলতো বটে, রেগুলার হয়তো নয়, মাঝে মধ্যে। আর না মিললেই বা কী, আমার নানি আর আমার মা দুজনই বিচিত্র স্বাদের আচার বানাতেন। আম, বরই, জলপাইয়ের। সেসব আচারই খাওয়া যেত বছরভর। এখনো মা বেশ স্বাদের স্বাদের আচার বানিয়ে বৈয়াম ভরাট করে রাখেন। যেদিন একটু মজার মজার খাবার খাই যেমন খিচুড়ি কী ভুনাখিচুড়ি, পোলাও মাংস, সেদিনই চট করে হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেই আচারের কথা, সব সময় মনে আসে না। সেটাই রক্ষে। তাহলে যে সেই আচারের অস্তিত্ব দু’দিনেই ভ্যানিশ হয়ে যেত। আহা! আবদুল্লাহপুরের সেই আচারঅলা আরেকটা জিনিস নিয়ে আনতো সঙ্গে করে। তা হলো, পাকা কতবেল। কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভেতরের অমৃত উদ্ধার করতে হতো। যে না খেয়েছেন সেই পাকা কতবেল, নিঃসন্দেহে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হতভাগাদের একজন।
হাটের কথা বলতে গিয়ে আখক্ষেত আর গুড় ভাঙানির কথাটা মনে পড়ে গেল। সে যেন আমার শৈশবের আরো এক রঙিন বেলুন। আরো এক আম আঁটির ভেঁপু। আখ ক্ষেতের ভেতর দিয়ে যখন স্কুলে যেতাম, ভয়ে আমার গা সিটিয়ে যেত; এই বুঝি শিয়াল বেরিয়ে আসে— কামড়ায়, অথবা বিষধর সাপ এসে দেখায় ফুসফুসানি। ঋতু পরিক্রমায় এক সময় সেই আখক্ষেতের আখগুলো বড় হয় শক্ত এবং রসে ভরে ওঠে, সবুজ পাতাগুলো হয়ে যায় বাদামি বিবর্ণ। তারপর যখন উত্তরের হাওয়া বয়, ঝরাপাতার সেই দিনে আখ মাড়াইয়ের কল আসে মহিষ গাড়ি দিয়ে। তারা এসে চকের আখক্ষেতের কাছে ঢেরা বাঁধে থাকার। তারপর আখ ক্ষেত থেকে কাটা হতো আখ। বেশি না, শ্রমিকদের ধারালো কাঁচির এক ঘায়েই গোড়া থেকে ঝরে পড়ত গাছটা। সে আখ কেটে কেটে ধুয়ে মাড়াইয়ের কলে ঢুকিয়ে দেয়া হতো রস বের করার জন্য। দুটো শক্তিধর বলবান মহিষকে দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আখ মাড়াইয়ের সেই কল থেকে বের করা হতো রস। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে চলতো এই আখ মাড়াইয়ের ব্যাপারটা। তারপর সেই মাড়াইকৃত আখের রস চ্যাপটা ধাঁচের এক বড় স্টিলের পাত্রে ঢেলে জ্বালের পর জ্বাল দেয়া হতো। একটা সময় মিঠা রসের ঘ্রাণে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। পুরো গ্রামটাই যেন হয়ে যেত মধুময়। আমরা কোনো এক অজ্ঞাত লোক থেকে যেন ডাক পেতাম! ঠিক ঠিক সময়েই এসে হাজির হতাম সেই আখরসের সুধা-গন্ধঢালা-ক্ষণে, সে-জায়গায়। তখনো কারিগর সিরিয়াস ভঙ্গিতে রসের বড় চুলায় শুকনো মচমচে আখপাতা দিয়ে চলেছেন। আর মাঝে মধ্যেই সেই জ্বাল দেয়া রস থেকে বের হওয়া গাদ বিশাল দশাসই বড় চামচ দিয়ে উঠিয়ে পাশের এক মাটির সানকিতে ফেলে দিচ্ছে। গুড়ের শুদ্ধ রসের সঙ্গে কখনো মিশতে পারত না অশুদ্ধ কোনো ময়লা বা ধুলো। সেটাই গাদরূপে আলাদা হয়ে সরে যেতে আপনাআপনি। আর রসবতী গুড়গুলো বেশ ডগমগে সাইজের একের পর এক মাটির কলসিতে ভরে ফেলা হতো। সেই রসের দানাগুলো এক সময় জমাট বেঁধে রূপ নিত শক্ত গুড়ে!
আজও চোখে ভাসে, আমাদের ঘরের একটা বিশাল অংশজুড়ে থরে থরে সাজানো থাকত সেই গুড়ের মাটির কলস। খেয়াল রাখতে হতো বাজারের গুড়ের দরের ওঠানামার দিকে। তারপর যখন জুৎসই মনে হতো যে, এখন একটু ভালো দরে বেচা যাবে গুড়, তখনই গরুর গাড়িতে বয়ে হাটে নিয়ে বিক্রি করা হতো সেই মিঠে সম্পদ! আখের চাষ আমাদের গ্রাম থেকে কবেই উঠে গেছে। সেই সঙ্গে যেন সমাপ্ত হয়ে গেছে গ্রাম থেকে এক মিঠে অধ্যায়ের। আখ মাড়াইয়ের সিজনে পুরো গ্রামটাই যেন অন্য রকম এক মধুময় উৎসবে মাতোয়াল থাকত।
চলবে