আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ২৮

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : মে ৩১, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
নানাবাড়িতে আরেকজন পাগল আসতো ঘোড়ায় চড়ে। ক্লিশ ক্লিন্ন এক ঘোড়া। অনেকটা গাধা টাইপের। ঘোড়াটাকে ঈদগাঁ মাঠের কাছে বেঁধে রেখে সে ঈদগাঁওয়ের মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ত। পরনে থাকত সাদা সামরিক পোশাক। পায়ে গামবুট। মাথায়ও সামরিক ক্যাপ ছিল। কোথা থেকে জুটিয়ে নিয়েছিল এমন পোশাক আর ঘোড়া, জানি না। সে অই মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যত জোর গলায় সম্ভব শুরু করত ইংরেজিতে বক্তৃতাবাজি। আমিতো আর তখন অত ইংরেজি বুঝতাম না। শুধু মনে আছে, ইয়েস নো ভেরি গুড অ্যাটেনশন টেন্ডারিজ লেফট রাইট লেফট লেফট রাইট লেফট শব্দগুলো। ও হ্যাঁ, মাঝে মধ্যেই স্যালুট মারতেন কার উদ্দেশে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম যেন নিতেন কী কারণে! আমার নানাকে দেখেও স্যালুট মারতেন। তবে থামতো না কিছুতেই বক্তৃতাবাজি। স্যালুট শেষ করে আবারো ধরতেন অসমাপ্ত বক্তৃতা।

হতভাগিনী মতি পাগলির পরিণতি হয়েছিল খুবই করুণ। কার অভিশাপে নাকি কোনো দৈবচক্রে পুকুরে ডুবে প্রাণ গিয়েছিল নিঃসঙ্গ একলা একা সেই মানুষটির। তবে সে-মৃত্যু নানাবাড়ির পুকুরে নয়। অন্যদিকের অন্য কোনো পুকুরে। কিন্তু সেই ইংরেজি বক্তৃতাজীবী হতভাগা মানুষটির পরবর্তী জীবন থেকে ঘোর অমানিশার কালো অন্ধকার দূর হয়েছিল। আমি যখন বড় হলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো হবো করছি, হঠাৎ একদিন নানাবাড়ির বাজারে সেই পাগলটিকে দেখে চমকে ওঠলাম। নিজের চোখকেও ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছিল না। এটা কি সত্যিই সেই মানুষ, যে ক্লিন্ন কৃশ এক ঘোড়া নিয়ে ঈদগাঁওয়ের মাঠে আসত, মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিত? সে দেখলাম বাজারের যে খোলা দোকানগুলো থাকে টিনের ছাপরা দেয়া, তারই একটাতে হাঁটু মুড়ে বসে নানা প্রকৃতির চাউলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। পরনে লুঙির সঙ্গে নীল রঙের ব্যাপারি পাঞ্জাবি। কাঁধে গামছা। পরে তাকে যখনই দেখেছি এই একই রঙের একই ডিজাইনের পাঞ্জাবিতেই দেখেছি। সারাজীবনই নাকি এই একই রঙের ড্রেস পরেছেন। আমার সঙ্গেও তার কথা হতো। আমাকে দেখলেই ঠাট্টা করে বলে ওঠতেন, কিরে ট্যাঙ্গুইরা, কবে আইলি?

নানাবাড়ির মানুষের কাছে আমরা ছিলাম ট্যাঙ্গুইরা, আর দাদাবাড়ির লোকরা আমাকে নানাবাড়ির পরিচয়ে ক্ষেপাত ভউরা বলে। যা হোক, দাদাবাড়িতেও ছিল পাগলের অস্তিত্ব। সে আরো বড় পাগল। তবে মাঝে মধ্যে বিভ্রান্ত হতে হতো, সে কি আসলেই পাগল, নাকি পাগলের ভান করছে? পাগল হলে কীভাবে সে সেই বড়ফুফুর বাড়ি, প্রায় পনেরো বিশ মাইল দূরের ঠেঙ্গারবান্দ থেকে একা একা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হতো! আর এসেই ঘটাতো ভয়ানক এক কাণ্ড! এসেছে, ভালো কথা, দিব্যি ভালো মানুষ— হঠাৎ করলো কী, বড় ছোট নারী-পুরুষ সবার সামনেই পরনের প্যান্টটা আচমকাই ঝটপট খুলে নিচের দিকে নামিয়ে দিল। সবাই যখন লজ্জাজনক কিছু একটা ঘটছে ভেবে হতভম্ব হতে যাচ্ছে, তখনই দেখো সে খি খি করে হেসে উঠলো। তার হাসির সঙ্গে অন্যরাও কেউ কেউ তাল মেলাতে পারল। কেননা রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা থেকে যে ততক্ষণে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে। পাগলটা তো আর... প্যান্টের নিচে লুঙি আছে যে! আচ্ছা, লুঙি আছে ভালো কথা! কিন্তু তারপরও কি মিলতো স্বস্তি? সে ততক্ষণে আবারো দু’হাতের দু’আঙুলে ঝুলিয়ে ফেলেছে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। যেন যাদুকরি কিছু! বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে হাত দুটো দু’পাশে ছুঁড়ে দিয়ে আবারো বাহাদুরির ভঙ্গি নিয়ে করলো কী, এক টানে লুঙিটাও খুলে সাৎ করে নামিয়ে দিল যত দূরে নামানো যায় সেই মাটি অব্দি! কিন্তু না, এবারো হলো না। এবারও গুলিটা চলে গেল কানের ঠিক পাশ ঘেঁষে। তার লুঙির নিচে যে বেশ বড় সাইজের একটা হাফপ্যান্ট রয়েছে। সেটা আবার গাঢ় মেটে তামাটে রঙের। তখনকার সময়ে যা পুলিশরা পরতো। সবার আতংক দেখে, তখন তার চোখেমুখে সেকি পৈচাশিক বুনো হাসি! খি খি করে হাসতেই থাকত, কিছুতেই আর থামতে চাইতো না খুশির সেই ছররা। মোটা গোঁফটার ভেতর যেন ঝকমকিয়ে উঠতো চ্যাপলিনীয় ক্রুরতা!

নাহ! কোনোদিন হাফপ্যান্টের সীমা অতিক্রম করেনি সে-পাগল, তাহলে যে কী দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার অবতারণা ঘটতো, সেটা আর কাউকে কল্পনা করতে বলছি না। নাম তার ছিল সবুর। অনেক আগেই সব ড্রেসট্রেস ফেলে রেখে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ফেলেছেন! তবে এই সবুর পাগলা অধিকাংশ সময়ই আসতো হাঁটের দিন— সোমবার। আমাদের কাশিমপুরের হাটটা ঠিক হাট ছিল না। হাটের চেয়েও ছিল আরো অধিক কিছু। তাকে বলতে পারেন বর্ণিল কোনো মেলা, তাকে বলতে পারেন ব্রাজিলের বুঝি কোনো কার্নিভ্যাল! আশেপাশের শুধু বাইশ গ্রাম নয়, পুরো গাজীপুর আর সাভার অঞ্চলের মানুষ নড়েচড়ে বসতো সেদিন। প্রতিটি বাড়ি থেকেই কেউ না কেউ একজন হাটে আসতোই আসতো। কেউ কেউ যেত দলবল নিয়ে, কেউবা একা একা। বেচাবিক্রি করতে হয়তো সবাই আসতো না, কিন্তু ফেরার সময় কেনাকাটা করতো ঠিকই। তখন তো আর আমাদের গাজীপুর কিংবা সাভারে শহরের ছোঁয়া লাগেনি, ঘাটে ঘাটে পথে পথে বাজার তো দূরের কথা দোকানপাটেরও অস্তিত্ব ছিল না। না ছিল ঘরে ঘরে ফ্রিজ। গৃহস্থেরা পুরো এক সপ্তাহের বাজার নিয়ে আসতো এক হাটের দিনে। তাছাড়া পাইকারি বাজার হিসেবে বেশ নাম হয়েছিল বলে, গৃহস্থরা তাদের ধান, পাট, গুড়, বাদাম, সরিষাসহ যত কৃষিপণ্য আছে, শিম, লাউ, কদুসহ সবজি, পালা মুরগি, বনের বাঁশ— সবকিছুই নিয়ে আসতো কাশিমপুরের হাটে বিক্রয়ের জন্য।

কী যে উৎসবমুখরতা আর ঘটনার ঘনঘটা ঘটে যেত সেই কাকভোর থেকে সারারাত, সেটা সত্যিই এক বর্ণিল ব্যাপার। সোমবার আমার ঘুম ভেঙে যেত সুবহে সাদিকের সময়। আমার বাড়ির পাশ দিয়ে কোনাবাড়ি-কাশিমপুরের রাস্তায় একের পর এক গরুর গাড়ির যাত্রা শুরু হয়ে যেত। তারই ক্যাচর ম্যাচর আওয়াজে ভাঙত ঘুম। কোনো গরুর গাড়িতে গুড়ের কলস, কোনো গরুর গাড়িতে ধানের বস্তা, কোনো গরুর গাড়িতে পাটের সমাহার, কোনটায় বা শিমসহ অন্যান্য শাকসব্জি থাকত! কাশিমপুরের হাটকে ঘিরে আমাদের ব্যতিব্যস্ততাও কম থাকত না। সে-দিনটা ছিল সত্যিকার অর্থেই বিশেষ কিছু! কখনো ছালা ভরে ধান, কখনো বাদাম, কখনো আবার শিম নিয়ে যেতাম আমরা বেঁচার জন্য, কখনো কাঁঠালও নেয়া হতো। আব্বা যেতেন, বাড়ির রাখাল যেতেন, সঙ্গে আমিও জুটতাম। কোনো কোনোবার শিমের বস্তা আমাকেও মাথায় করে নিয়ে যেতে হয়েছে, এমনকি কাঁঠালও মাথায় করে বেঁচতে নিয়েছি সেই দু’তিন মাইল দূরের কাশিমপুর বাজারে। গুড়ের কলসও নিয়ে যেতাম আমরা। আমাদের আখক্ষেতেই চাষ হতো। এই গুড় ভাঙানির কথাটা বলা হয়নি, আখক্ষেতের কথাও। আগে হাটের কথাটা সেরে নিই। তারপর গুড় ভাঙানোর কথাও রসিয়ে রসিয়ে বলা যাবে! হ্যাঁ। সত্যিই সেটা ছিল রসময়।

তো, যে পণ্য নিয়েই যেতাম হাটে, সেটা নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় আব্বা বা রাখালের সঙ্গে আমিও দাঁড়াতাম। একটু পরেই শুরু হতো ব্যাপারিদের আনাগোনা। যত না ব্যাপারি আসতো, তারচেয়ে বেশি আসতো ফড়িয়া। ফড়িয়া যখন আসতো আব্বা আমাদের রাখালকে ধমকে উঠতেন— অই ফড়িয়াদের সঙ্গে কথা বলবি না। ফড়িয়া মানে আসল পাইকারদের জায়গায় এক শ্রেণির মানুষ ছিল, যারা অল্প দামে কৃষক বা গৃহস্থদের কাছ থেকে পণ্য কিনে, কিনে বলব না প্রায় ভাগিয়ে নিয়ে, ব্যাপারিদের কাছে বেশি দরে বিক্রি করে মাঝখান থেকে একটা লাভ খেতো। অর্থাৎ কইয়ের তেলে কই ভাজা। এরা ব্যাপারিদের সঙ্গে বেশি সুবিধা করতে পারত না, ঠকাতো গৃহস্থদের। তখনো মানুষ চেনার চোখ আমার ফোটেনি। এখনো কি ফুটেছে? তবে ফড়িয়াদের আলগা দরদ দেখানোর সেই তেলতেলে কথা বলার ঢং দেখেই তাদেরকে কেমন হালকা টাইপের মানুষ মনে হতো। কিগো তালৈই, কিমুন আছেন? কিংবা কাহা! শইলটা ভালা নি? তারপরই পিতলা আলাপ শেষে শুরু করে দিল দরাদরি! নামেই দরাদরি! পারলে জোর করেই উঠিয়ে নিয়ে যাবে গৃহস্থের পণ্য!

চলবে