আলোকচিত্রী: দিপাঞ্জন সরকার
আমার ভ্রমণিয়া দিন (২)
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৪, ২০১৭
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি পর্ব-২
আমার নানাবাড়িটা দেখতে ছিল সেই রকম। পুরনো বৃটিশ আমলের চুনসুরকির একতলা দালান। রেলগাড়ির মতো লম্বা। একেকটা শরিকের দুটো করে ঘর। মোট চার শরিকের বাড়ি। চার শরিকের আট ঘর। তবে ঘরগুলো কিন্তু আজকের জামানার মতো মুরগির কুঠি নয়। বেশ বড়সড়ো, চওড়া। ছাদ অনেক উঁচুতে। পুরো বাড়িটার বাইরের দিক বা সামনের দিকে ছিল বাগান, বড় বড় প্রাচীন গাছপালায় ঘেরা। মাঝখানে লম্বা বিশাল প্যাসেজ রেখে একটা মস্ত বড়ো পুকুর। পুকুরপারে সুপুরি গাছের সারি। শানবাঁধানো এক ঘাট। সেই ঘাটটা সমতল থেকে পুকুরের দিকে নামতে নামতে কোন গভীরে যে হারিয়ে গেছে, সে রহস্য কোনোদিন কেউ উন্মোচন করেছে কীনা, জানা নেই। পুকুরের বাম পাশে একটা বিশাল গম্বুজঅলা মসজিদ, মাঠ, কাচারিঘর, প্রাইমারি স্কুল। সোজা বরাবর ঈদগাহ আর ডানপাশে বিরাট এক বাগিচা। আর বাড়ির পেছন বা ভেতরের দিকে ছিল, মস্ত বড় প্রায় মাঠ সমান এক দুয়ার। দুয়ারের ওপাশে বিশাল এক টিনের গোলাঘর, যত ফসল উঠতো আর গৃহস্থালির যত জিনিসপত্র সব জমা থাকত ওই ঘরে। গোলাঘরের পাশেই আড়াআড়ি রান্নাঘর রেখে মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেছে সরু এক রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছানো যেত টয়লেটে। তখনকার কনসেপ্ট অনুযায়ী যেটা ছিল বাড়ির একেবারে পেছনে, অনেক দূরে। বেশ উঁচু করে তৈরি বলে বর্ষাকালে সেখানে পানি আসতে পারত না, কিন্তু নিচের পুরো জায়গাটাই ভরে যেত পানিতে। টয়লেট সারতে সারতে নিচের দিকে তাকালে দেখা যেত বর্ষার পানির ঢলঢলানি। মূল বাড়ি থেকে এত দূরে বিচ্ছিন্ন এক জায়গায় দিনের বেলায়ই যেখানে আসতে ভয়ে গা ছম ছম করত, তাহলে রাতের বেলায় কী অবস্থা হতে পারে? রাতে কারো প্রাকৃতিক ডাক উপস্থিত হলে হুলস্থূল কাণ্ডই ঘটে যেত বলা যায়। কারণ, নানাবাড়ির মসজিদ, বাগিচা, পুকুর, তারপর আবার বাড়ির এই পেছনদিকের সাইডটা নিয়ে চালু ছিল নানান রকমের গল্পকাহিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার সবটাই জ্বিন, পরি আর ভূতপ্রেত সম্পৃক্ত! রাতে যখন কারো প্রকৃতির ডাক আসতো, সঙ্গে সঙ্গে চলে আসত সেইসব ভয়েধরা গা গা ছম করা সব কাহিনিগুলোও। সেসব কাহিনি সামনে থাকায় আক্রান্তকারী শুয়ে শুয়ে প্রথমে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকার পথটিই বেছে নিতেন! হোক না সকাল, আসুক না আলো! তারপর না হয় যাওয়া যাবে! কিন্তু কথায় বলে না পাপে ছাড়ে না বাপেরে! হ্যাঁ, রাতের বেলা প্রাকৃতিক কার্য সম্পাদনের আমন্ত্রণ আসাটাকে তখন অভিশাপগ্রস্ত ব্যাপারের মতোই মনে হতো। তারপর যখন কিছুতেই আর টিকে থাকা যাচ্ছে না, কোনও উপায়ন্তর না দেখে, এবার মিশন হাতে নাও কাউকে ঠেলেঠুলে ঘুম থেকে উঠানোর! হারিকেনটা হাতে নিয়ে যেন বাইরে দাঁড়িয়ে একটু সঙ্গ দেয়! কিন্তু সেখানেও তো আরেক ক্রাইসিস, যিনি হারিকেন হাতে ধরে বাইরে একা একা দাঁড়িয়ে পাহারা দেবেন, তারও তো একটা ঘাড় আছে নাকি? আছে ঘাড় মটকে যাওয়ার ভয়ও! সুতরাং ডেকে তুলো আরো একজনকে! পুরো বাড়িটাই বুঝি হঠাৎ মাঝরাতে জেগে ওঠে মাথায় চড়ে নাচত! কাঁচা ঘুমের এমন অপমৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও বাড়ির সবাই বিষয়টা ভালোভাবেই মেনেই নিয়েছিল, কারণ ব্যাপারটা তো শুধু মানবিকই নয়, রাতদুপুরের অমন সংকটে পড়তে হয় না কাকে?
সত্যি, পরম ভালোলাগার পাশাপাশি নানাবাড়ি বেড়ানোটার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ভয় আর রোমাঞ্চের অদ্ভুত মিশেলও। মানুষ সাপ-বাঘ ঘেরা গভীর অরণ্যের ভেতর পথ ভাঙার সময় কিংবা কোনো পর্বতারোহী পর্বত জয়ের সময় যে রকম মৃত্যুভয় শংকায় আলোড়িত থাকে, কিন্তু দুর্লংঘকে জয়ের আনন্দে শেষাবধি পেয়ে যায় দুর্লভ অভিজ্ঞতার অতুলনীয় স্বাদ, আমার নানাবাড়ির শৈশবও যেন আমাকে নিয়ে গিয়েছে সেই অনন্তলোকের মহার্ঘ্য জীবনের উৎসবে।
মসজিদ, বাগিচা, পুকুর, গোলাঘর আর বাড়ির পেছন সাইডটা নিয়ে যে কত উপকথা আর কাহিনি বাতাসে ভেসে বেড়াত! সেইসব গল্পরা এসে মনের মধ্যে ছলবলিয়ে উঠতো সন্ধ্যার পর, অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে। তারপর কি আর ঘরের বাইরে বের যাওয়া যায়? ঘর থেকেই তো বাইরের জানালার দিকে চোখ পড়লেই খলবলিয়ে উঠতো দাঁতভেংচানো অন্ধকার! কোনোমতো চোখ বন্ধ করে জানালার পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে কতদিন বন্ধ করে দিয়েছি জানালার পাল্লা! জানি এসব বাহাদুরিমার্কা কথা নয়, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি একাই অমন কাণ্ড করিনি, যারাই বেড়াতে যেত আমার নানাবাড়ি আর শুনতো অমন সব ভূতপ্রেতের কাহিনি, তারাই এমন সব কাণ্ডকীর্তি না করে কিছুতেই পারত না!
যে বাগিচার কথা বললাম, সেটা ছিল বড় বড় গাছপালায় ভরা। কত রকমের যে গাছগাছড়া ছিল, গাছের চেয়ে বেশি ছিল আগাছা। ঘন ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। দিনের বেলায়ও সেখানে অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ত না। বিশাল এক জাতসাপ নাকি সারা জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াত। অনেকের চোখেই পড়েছে। নানা রকমের ভূতের গল্পও শোনা যায় বাগিচাকে ঘিরে। বাগিচা যেখানে শেষ হয়েছে আর চিনির খালের শুরু, সেখানে এক হিজল গাছের তলে রাতদুপুরে নাকি ফুটফুটে এক সুন্দরী মেয়েকে বসে কাঁদতে দেখে নানাবাড়ির মসজিদের এক ইমাম সাহেব বড়ই কাতর হয়ে পড়েছিলেন। অসহায় মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে যখন আশ্রয়ের প্রস্তাব দিলেন, তখনই নাকি সুন্দরী মেয়ের মুখ হঠাৎ উবে গিয়ে সেখানে ভেসে উঠলো অতি কুৎসিত কদাকার এক চেহারা! সেই চেহারাটা এমনভাবে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠেছিল যে, ইমাম সাহেব আর দৌড়ানোরও সুযোগ পাননি, দাঁতকপাটি লেগে পড়েছিলেন সেখানেই।
শুধু যে এমন ছলাকলায় ভোলানো রূপসী নারীর কথাই শোনা যেত, তা না; রাতদুপুরে নাকি বাগিচা থেকে বেরিয়ে একটা ধবধবে সাদা তেজী ঘোড়া দৌড়ে বেড়াত বাড়ির এ সীমান্ত থেকে সে সীমান্ত! গোলাঘরে এক কাজের মেয়ে দুটো সাপকে পেচিয়ে জড়াজড়ি করতে দেখে এ-বাড়ির কাজই দিয়েছিল ছেড়ে! তারপর বাড়ির যে পিছন দিকটার কথা বললাম, সেখানে কয়েকটা হিজল গাছের সারি ছিল ঝোপঝাড়ের ভেতর, সেখান থেকে নাকি কোনো কোনো রাতে আগুনের ফুলকি উঠতে যেতে দেখা যেত আকাশময়। এমনকি পুকুর আর মসজিদকে নিয়েও থেমে থাকেনি ফিসফাস। জানি না, পুকুরে গোসলে নামলে যে আর উঠতে চাইতাম না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবতাম সাঁতরাতামÑ সে কারণেই কিনা, ছোটখালাম্মা জানিয়ে দিত শিকলরাণী এসে নিচ থেকে নাকি পা ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে কোন পাতালনগরীতে! যেখান থেকে আর কখনোই ফিরে আসা যাবে না! আর মসজিদে নাকি থাকত জ্বিন। জ্বিন নামাজ পড়ত অন্যসব মুসল্লিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে, রাতে থাকারও নাকি নির্দিষ্ট একটা জায়গা ছিল জ্বিনের মসজিদে! অন্য কেউ সে জায়গার দখল নিলে, জ্বিন নাকি ক্ষেপে যেত! গল্পকাহিনির কোনও শেষ ছিল না।
জানি না, এসব ঘটনার কতটা সত্য কতটা মিথ্যা। তবে আমাদের চোখে কখনো পড়েনি তেমন কোন অস্বাভাবিক দৃশ্য! আমার মা-খালা-মামাদের চোখেও পড়েনি। তবে মা একবার বাগিচায় কী একটা ব্যাপার ঠিক দৃশ্যমান নয়, অনুধাবন করেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন অনেকক্ষণ। তখনো উনার বিয়ে হয়নি। খুব সকালবেলার নির্জনতায় বাগিচায় গিয়েছিলেন বকুল ফুল কুড়াতে! হঠাৎ মনে হলো মার সঙ্গে সঙ্গে যেন আরো কেউ কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে বকুল ফুল। কিন্তু মা চারদিকে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলেন না। আবারো শুরু করলেন বকুল ফুল কুড়ানো। আবারো অনুধাবন করলেন আর কারোর অস্তিত্ব। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, ছায়াও যেন পড়েছে, কিন্তু আশ্চর্য, কেউ নেই! দেবেন নাকি দৌড়? কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে দেখেন হাঁটু ভেঙে পড়তে চাইছে, গায়ের শক্তি হয়ে আসছে শিথিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন অনেকক্ষণ!
সেই বাগিচার কাছে গেলে আমারো কেমন গা ছমছম করতো। মনে হতো এই বুঝি কেউ পেছন থেকে ধরলো গলা চেপে। বাগিচা পেরুলেই পড়তো সরু একটা খাল। ওটার নাম ছিল চিনির খাল। খালের ওপরে ছিল কাঠের একটা বেশ লম্বা চওড়া শক্তপোক্ত সাঁকো। তাতে বসে বসে পার করে দেওয়া যেত ঘণ্টার পর ঘন্টা।
চলবে...