
‘আমাদের নেতা পাকিস্তানিদের আনুগত্য স্বীকার করে নেন’
প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০১৮
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ভাষণের পর দেশব্যাপী ‘সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন শুরু হয়। রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানায় এই কমিটি গঠন করা হয় ১৯৭১ সালের এপ্রিলে। আবদুল হাইকে প্রধান করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন আনোয়ার জাহিদ বজলু। তিনি তখন পাংশা জর্জ হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। তিনি ও তার স্ত্রী মমতাজ বেগম সেখানে বিউটি সানফ্লাওয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। আনোয়ার জাহিদ আমেরিকায় আসেন ১৯৯১ সালে। তাদের দুই সন্তান, ডাক্তার সারওয়ার জাহান ও মাহদী মাহমুদ। তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা নিয়ে গপসপ করেছেন তোফাজ্জল লিটন
লিটন: মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিককার গল্প বলুন। কীভাবে আপনারা প্রতিরোধ শুরু করলেন।
বজলু: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর দেশের অন্যান্য এলাকার মতো পাংশায়ও সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে প্রশিক্ষণ নিতে অনেকে যোগাযোগ শুরু করে। এপ্রিলের শেষদিকে প্রতিরাতে আমরা পাংশা কলেজ মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতাম। আবদুল মতিন, জিল্লুল হাকিম ও নাসিরুল হক সাবু, আমিসহ অনেকে তখন এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। আমরা এখানে টু-টু বোর ও থ্রি নট থ্রিসহ বেশ কিছু রাইফেল চালাতে শিখি। তির-ধনুক চালানো ও তা কর্মকার দিয়ে বানানোর দায়িত্বও ছিল আমাদের। তীরের মাথায় এক ধরনের শক্তিশালী বিষ ব্যবহার করা হতো। এখানকার প্রশিক্ষণ শেষে জিল্লুল হাকিমের নেতৃত্বে সাতজনের একটি অগ্রবর্তী দল প্রশিক্ষণের জন্যে ভারতে যায়।
লিটন: সম্মুখ যুদ্ধের কথা কিছু বলুন।
বজলু: জুনের প্রথমদিকে খবর এলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যশোর থেকে কুষ্টিয়া দখল করতে আসছে। এ খবর শুনে কুমারখালী, পাংশা, রাজবাড়ী এবং গোয়ালন্দের মুক্তিযোদ্ধারাদের সঙ্গে মিলিত য়ে আমরাও কুষ্টিয়া অভিমুখে রওনা দিই। চার-পাঁচদিন ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ বি এম নূরুল ইসলাম, মুসলে উদ্দিন মৃধা, চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম ও ডাক্তার আসজাদ। এ যুদ্ধে আমরা পরাজিত হই। পরাজয়ের চেয়েও আমরা বেশি বিমর্ষ হই যখন দেখি, আমাদের নেতা এ বি এম নূরুল ইসলাম ও ডাক্তার আসজাদ পাকিস্তানিদের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। এই খারাপ লাগার পরও আমি উদ্দীপ্ত হই যুদ্ধে সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ দেখে। এ সময়ে আমাদের খাদ্য আসত আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। খাবার সংগ্রহ করা হতো ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে। খাবার সংগ্রহ করে ট্রেনে তুলে দিত সেই এলাকার স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। আবার ট্রেন যখন যুদ্ধের এলাকায় আসত তখন এই এলাকার ছাত্রছাত্রীরা তা নামিয়ে আমাদের মধ্যে বণ্টন করত। দেশের প্রতি তাদের এই ভালোবাসা আমাকে আপ্লুত করেছে। যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছে।
লিটন: কতটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন?
বজলু: তা’ চার-পাঁচটি তো হবেই। এর মধ্যে একটি দৃশ্য চোখ বন্ধ করলে আজও দেখতে পাই। জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের একটি বিলের দ্বীপের মতো একটি জায়গায় আমরা প্রায় পাঁচশো মুক্তিযোদ্ধা আত্মগোপন করে আছি। খবরটি পাকিস্তানি বাহিনী জেনে রওনা হয়েছে আমাদের আক্রমণ করতে। আমি দূরবিন দিয়ে দেখছি, উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সাঁজোয়া বাহিনী এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আকাশে তাদের যুদ্ধবিমান। তাদের এত কিছুর বিপরীতে আমাদের আছে কিছু রাইফেল। দ্বীপে ঢোকার রাস্তায় কিছু মাইন পোঁতা। সবাই জানে, মৃত্যু নিশ্চিত। তবে কারও চোখে-মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। দেশের জন্য শহিদ হতে পারছি, এও যেন এক রকমের শান্তি। এমন সময় আমাদের একজনের রাইফেল থেকে ভুলে গুলি বের হয়ে গেল, শব্দ হলো। আমরা ভাবলাম, আর রক্ষে নেই! কিন্তু দেখলাম, সাঁজোয়া বাহিনী ফিরে যাচ্ছে। ওরা ভেবেছে, আমরা খুব শক্তিশালী। এজন্য আগে ফায়ার করে তাদের যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছি।
লিটন: হা হা হা... বেশ মজার গল্পটি।
বজলু: ১৩ ডিসেম্বর পাংশা মুক্ত হয়। পরে ৮ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা এসেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের সঙ্গে আমাদের কখনো দেখা হয়নি। আমাদের সব সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেলার নেতা জিল্লুল হাকিম। তিনি এখন পাংশা এলাকার সাংসদ। সারা দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজবাড়ী স্বাধীন হয় ১৮ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও রাজবাড়ীর লোকশেড অঞ্চলের বিহারিরা আমাদের দুজন যোদ্ধার মাথা কেটে নিয়ে যায়। শুধু শরীরটা মসজিদের সামনে রেখে যায়। লোকশেড এলাকায় রেলগাড়ি মেরামতের কাজ করা হতো। এটি ছিল বিহারিদের এলাকা। এ ঘটনার পর আমরা দু’দিন যুদ্ধ করে তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করি। এই যুদ্ধে আমাদের পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহিন হয়েছিলেন।