আমলাতন্ত্র: ক্ষমতার ভুতুরে উৎস

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : মে ১১, ২০১৯

আমলাদের কর্মক্ষেত্রই মুলত তাঁদের পেশাগত দক্ষতা অর্জনের প্রধান জায়গা। একজন আমলা কাজ করতে করতেই তিনি তাঁর কাজটা শিখে উঠেন। পূর্বসূরীদের অভিজ্ঞতাও এ ক্ষেত্রে তাঁর কর্মক্ষেত্রে সহায়ক হয়। আসলে, আমলাদের নানানুখি ট্রেইনিং দিলেই চলে। তাঁদের দরকার দক্ষ ও দীক্ষিত হওয়া। পিএইচডি`র মত দীর্ঘমেয়াদী ডিগ্রী আমলাদের দরকার আছে বলে মনে করিনা। যেমন, পিএইচডি ডিগ্রীর খুব বেশি দরকার নেই ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেবের বা বহুজাতিক কোম্পানির অধিকর্তার। প্রকৃতপ্রস্তাবে, রাষ্ট্রের জন্যে প্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে গবেষণা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং সেই গবেষণার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র নানামুখি উন্নয়ন-পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। রাষ্ট্রের জন্যে প্রয়োজনীয় বিদ্যা উৎপাদনের দায়িত্ব পালন করবে বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের এনার্জি পরস্থিতি, উন্নয়ন ও অবকাঠামো, জনব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়েই তুলতে হবে জাতীয় বস্তুগত ও মননগত এইসব প্রয়োজনকে মেটানোর জন্যে। আমলাতন্ত্র দানবীয় হলে বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়ায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যা করবার কথা, তা বিশ্ববিদ্যালয় করবে। আর আমলাতন্ত্রের কাজ করবে আমলাতন্ত্র।

জ্ঞান সৃষ্টির কাজ মুলত বিশ্ববিদ্যালয়ের, সেটি হোক তত্ত্বীয় বা ব্যবহারিক। পরিকল্পিভাবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয় ফান্ড ও সুযোগ তৈরি না করার ফলে যে এলিট আমলাতন্ত্র তৈরি হয় তা শেষ পর্যন্ত নিজেদের মান-সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রধানত সরকারের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির কাজই করে থাকে। এই আমলাগণ বিস্মৃত হন তাদের ইতিহাস; সমাজ ও শিক্ষার ইতিহাসচ্যুত হয়েই তারা যেন হঠাৎ আসমান থেকে আমলারূপে আবির্ভুত হন। আমলা ও শিক্ষকদের মধ্যে বৈরিভাব না থাকাই উচিত, কিন্তু বাস্তবে পেশাগত অহমিকা ও রাষ্ট্রীয় বিচিত্র সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তিহেতু আমলাদের মধ্যে শিক্ষকদের প্রতি অবজ্ঞার ভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে একটা কারণ আছে অবশ্য, সেটি হোল আমলারা আমুন্ডুপদনখ সেঁধিয়ে থাকে সিস্টেমের ভেতরে এবং সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখাই তাদের প্রধান কাজ। আর, এদেশে শিক্ষকরা যেহেতু, স্বল্পমাত্রায় হলেও, এস্টাব্লিশমেন্টকে প্রশ্ন করতে শেখায়, তারা প্রশ্ন করে নিজেদেরকেও ও অপরকে তো বটেই; অন্যদিকে, আমলতন্ত্র খুব কমই নিজেকে প্রশ্ন করে,আনুগত্যই তার সিগ্নেচার। এই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যও শিক্ষকদের প্রতি আমলাদের বৈরিভাবের তত্ত্বীয় কারণ হতে পারে। যে রাষ্ট্র বা সরকার জনমুখী নয়,নিজেদের ব্যাপারে যারা অনিশ্চয়তায় ভোগে, তারা মুলত আমলাতন্ত্রের সফট ও হার্ড পাওয়ারের উপর নির্ভরশীল।

আমলাতন্ত্রকে আকাশচুম্বী সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পেছনে আমলাতন্ত্রের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য যতটুকু থাকে তারও চেয়ে বেশি থাকে এক নিগুঢ় অভিসন্ধি: আনুগত্য বৃদ্ধি ও শাসনকার্যের ভবিষ্যতকে নির্বিঘ্ন করা।বলপ্রয়োগকারী সংস্থা ও আমলাতন্ত্র এই দুই ভিতের উপর শক্তভাবে দাঁড়াতে পারলে জনতুষ্টি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যায়, এবং জন-অতুষ্টি প্রকাশের পথও বন্ধ করা যায়। একটা সহজসূত্র হলো, আমলাদের সুযোগ সুবিধার দৃষ্টিকটু বৃদ্ধি সব-সময়ই রাষ্ট্রের কোন-না-কোন গভীর ক্ষত ঢাকবার প্রয়াসে হয়। তাছাড়াও, রাষ্ট্রের জনগণসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যেও তুলনামূলক বিচারের কারণে অসন্তোষ ও বঞ্চনার বোধ তৈরি হয়। আমলাদেরকে একই সাথে সাপ ও ওঝা বানানো হয়,ও রাষ্ট্রীয় প্রাশসনে ওভাবেই তাদেরকে ফিট করা হয়। তাদের সুবিধাগুলো তারা নিজেরাই তৈরি ও দেখভাল করে। আর তাদের সর্বোচ্চ পদ থেকে শুরু করে এন্ট্রি লেভেল পর্যন্ত যে গোষ্ঠীপ্রীতি ও স্বাজাত্যবোধ থাকে তা তাদেরকে সর্বদাই সুবিধাজনক এক অবস্থানে রাখে। অন্যের উপর ছড়ি ঘুরানোকে অনেক সময়ই তারা তাদের পেশাগত সাফল্য ভাবেন। জনগণকে সেবা দেয়ার নামে তারা সরকারের এবং জনগণের যে সেবা ও `সমীহ` লাভ করেন তা তাদের প্রাপ্তির আকাণক্ষা আরো বৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রকে যদি বিচার করতে হয় তবে হাজির থাকা ক্ষমতা-কাঠামো ও ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার প্রশ্ন বাদ দিয়ে তা হবে না।

আমলাগণকে নিয়ন্ত্রণ করবার নানা ক্ষমতা দেয়ার ফলে তারা হয়ে উঠে মূলত নিয়ন্ত্রক, সেবাদাতা নয় মোটেই। যদিও শাসক শব্দের ভেতরে থাকা শোষণের মৃদু ব্যঞ্জনা ঢাকবার জন্যে `প্র` উপসর্গ যোগ করে তাদেরকে বলা হয় `প্রশাসক`। যেমন, জেলা প্রশাসক। পুলিশি ক্ষমতার কিছুটা ব্যবহার তারা করতে পারে বলে, আবার সাথে কিছু বিচারক ক্ষমতাও আছে বলে এবং নানাবিধ ক্ষতি করবার ও কিছু আর্থিক বরাদ্দ দেবার ক্ষমতাও এদেরকে দেওয়ার কারণে যে অপরিমেয় আভিজাত্য এরা ভোগ করে তা জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মুল কন্সেপ্টের সাথে যায় না। উন্নয়নশীল দেশে কোন কিছু যখন খারাপ হয়, তা সাধারণেত চরম খারাপই হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মত দেশে আমলাতন্ত্র যদি নেতিবাচক চেহারা ধারণ করে তবে তা হয় সর্বগ্রাসী ও অশোভন নিয়ন্ত্রণকামী। আমলাতন্ত্র এমন এক লবণের খনি, এতে যা-ই পরবে তাই লবনের চেহারাই ধারণ করে। তবে এ পরস্থিতি পরিবর্তন-অযোগ্য নয়। সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, অধিকার ও দায়িত্ব সচেতনতা,রাষ্ট্র ও রাজনীতির ক্রিটিকাল পাঠ জনসেবামুখী আমলাতন্ত্র গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।

সকল কাজের কাজী ও সকল ক্ষমতার একমাত্র ধারক হওয়ার বাসনা থাকাতে জ্ঞান ও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখবার আয়োজন চলে আমলাতন্ত্রে। অথচ নাগরিক ও বিবিধ পেশার মানুষদের নিজ নিজ জ্ঞান ও মেধাকে কাজে লাগানো এবং প্রতিটি পেশা ও মানুষের মর্যাদা রক্ষা করে তাদেরকে নাগরিকতার আস্বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের ওউনারশিপের অনুভূতি দেয়াই হওয়ার কথা রাষ্ট্রের লক্ষ্য।