আমরা নজরুল ইসলাম বাবুর দালাল

তোফাজ্জল লিটন

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২২, ২০২০

একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার
সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।

এই গানের কথা লিখে বিজয়ের মাসে অনেকেই স্ট্যাটাস দিচ্ছে। শুধু বিজয়ের মাসেই নয়, বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের কোনো গৌরবময় অর্জনেও আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে এই গানের কথার আশ্রয় নিয়ে থাকি। দেশের প্রতি মমতা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে এই গান ছাড়াও আমরা বাজাই—

সব ক’টা জানালা খুলে দাও না।
অথবা—
আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা।

কে এই অবিনশ্বর এই গান লিখেছেন? তার নাম জানার কথা একবারও মনে হয়নি আপনার? হলফ করে বলতে পারি, বেশির ভাগ মানুষ জানে না উপরের তিনটি গানের স্রষ্টার নাম। অমর গানগুলো লিখেছেন গীতিকবি ও মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাবু।

একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ ও ষোলোই ডিসেম্বরের জাতীয় থেকে স্থানীয় যেকোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এ গানগুলো ছাড়া পূর্ণতা পায় না। অবিশ্বস্য হলেও সত্য, তার মতো কিংবদন্তিতুল্য গীতিকবির কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি আজও। অবিশ্বাস্য বল্লাম এজন্য যে, বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না তিনি এখন পর্যন্ত স্বার্ধনতা বা একুশে পদকের মতো রাষ্ট্রীয় কোনো পদক পাননি।

স্বাধীনতাকামী তরুণ নজরুল ইসলাম বাবু ভারত থেকে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে দেশের স্বাধীতার জন্য সম্মুখ সমরে লড়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের যুদ্ধের অবসরে তুরার পাহাড়ে লিখেছেন দেশের জন্য গান। কলম ও অস্ত্র দুটোই সমান দক্ষতায় চালাতেন বাবু। এমন মহৎ মানুষকেও কী রাষ্ট্র ভুলে যায়? যদি ভুলে না গিয়ে থাকে তবে কোনো স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তীর প্রাক্কালেও কালজয়ী দেশেল গানের স্রষ্টা ও মুক্তিযোদ্ধা বাবুকে রাষ্ট্রীয় কোনো পদকে ভূষিত করা হয়নি?

১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জের চরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল ইসলাম বাবু। বাবা বজলুল কাদের ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা রেজিয়া বেগম গৃহিণী। বাবার সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই বড় সন্তান নজরুল ইসলাম বাবুকে প্রভাবিত করে। চার ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বাবু ছিলেন সবার বড়। স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে মামার কর্মস্থল বরিশালে চলে যান।

বরিশাল বিএম স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিক এবং পরে জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বিএসসি ডিগ্রি নেন। শাহীন আক্তারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৮৪ সালে। ১৯৯০ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর বাবু মাত্র ৪১ বছর বয়সে মারা যান। ১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ চলচ্চিত্রের গান রচনার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

এই কলামটি আমার ব্যক্তিগত ফেসবুকে ১১ ডিসেম্বর প্রকাশ করি। https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10224274592481587&id=1506618228। নজরুল ইসলাম বাবুকে ভালোবেসে এমন অসংখ্য মানুষ আমার দাবির সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করে। একাত্তর টিভির যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি শামীম আল আমিন লেখাটি ৭১ টিভি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করান। একাত্তর টিভি এই কলাম হুবহু পাঠ করে এবং এই লেখার উপর ভিত্তি করে ১২ মিনিটের একটি পরিবেশনা প্রচার করে ১৭ ডিসেম্বর। https://www.facebook.com/ekattor.tv/posts/4977373059001949।

রাকিব হাসানের সঞ্চালনায় সেখানে যুক্ত হন সাংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক শেখ সাদী খান এবং নজরুল ইসলাম বাবুর স্ত্রী শাহীন আক্তার। চোখে জল নিয়ে কান্না জড়ানো স্বরে শাহীন আক্তার ক্ষোভ ও আশার কথা বলেন। তিনি জানান, বাবু চাইলে চাকরি করতে পারতেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন করে তিনি একটি প্রেস দেন। ইচ্ছে ছিল, সেখান থেকে শিল্পসাহিত্যের ধারক ছোটকাগজ বের করবেন। পরে সব কিছু বাদ দিয়ে গানেই ঝুঁকে পড়েন। গানই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। তার মৃত্যুর এত বছর পরেও রাষ্ট্র তাকে যোগ্য সম্মান দেয়নি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শাহীন বলেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাবুকে একদিন সম্মানিত করা হবে, এই আশায় এখনো বেঁচে আছি।

শেখ সাদী খান বলেন, আমরা তো চাই, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে সবোর্চ্চ সম্মাননা পদক দেয়া হোক। আমরা চাইলে তো কিছু হবে না। রাষ্ট্রকে চাইতে হবে। আমি রাষ্ট্রের উপর ছেড়ে দিলাম এ গীতিকার ও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান।

নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’ গানটির গীতিকার হিসেবে অনেক জায়গায় দেখেছি ভুল করে আরেক মহান গীতিকার নঈম গহরের নাম লেখা। নঈম গহরের কন্যা অজান্তা গহর বলেছেন, “বাবার লেখা সব গান আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। এ গানটি বাবার লেখা নয়।” তার আরেকটি গান ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’য় নজরুল ইসলাম বাবু জানালা শব্দটির পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি লিখেছিলেন দরজা।

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ খবর রাখেন নজরুল ইসলাম বাবু ও তার পরিবারের। বাবুর দুই মেয়ে নাজিয়া ও নাফিয়ার কথা পর্যন্ত তিনি জানেন। বলছিলেন বাবুর আদ্যোপান্ত জীবনী। মহৎ কোনো মানুষকে পদক পাওয়া না পাওয়া দিয়ে চূড়ান্ত বিচার ঠিক নয় বলে মনে করেন কে এম খালিদ। আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, “জাতি তাকে গানের মাধ্যমে স্মরণ করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে তার নাম প্রচারের চেষ্টা আমরা করছি। কালজয়ী গানের গীতিকবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কীভাবে সম্মানিত করা যায়, সেই চেষ্টা আমরা করছি।

নজরুল ইসলাম বাবুর জন্মস্থান জামালপুরে তার একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা যায় কিনা, একটু ভেবে দেখবেন জামাল পুরের মানুষ অথবা প্রশাসন। রাষ্ট্রীয় দালাল ছাড়া বাংলাদেশে কোনো কাজ হয় না। ভাস্কর্য স্থাপন অথবা রাষ্ট্রীয় পদক তো অনেক দূরের বিষয়। আমি বিশ্বাস করি, সবকিছু এখনো দালালদের খপ্পরের চলে যায়নি। নজরুল ইসলাম বাবুর স্বাধীনতা পদক বা একুশে পদক পেতে যদি দালাল প্রয়োজন হয়, তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের নাগরিক সবাই আমরা বাবুর দালাল।

লেখক: নাট্যকার ও সাংবাদিক