আগরতলা বিমানবন্দরের যাত্রী লাউঞ্জে কবি এ কে শেরাম এবং কবি নিতাই সেনের সঙ্গে লেখক
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ২৪
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০১৯
মূল শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে আগরতলা বিমানবন্দর, যার আরেক নাম মহারাজা বীর বিক্রম বিমানবন্দর। দেখতে বেশ ছিমছাম, নিরিবিলি, চোখের আরাম দেয়। ভারিক্কি ভাবটা একদমই নেই। ভারিক্কি মানে বিল্ডিং বিল্ডিং ভাবধারা আর কি! অনেকেই হয়তো আমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকাতে পারেন যে, ইট-সিমেন্টের তৈরি একটা ভবনে বিল্ডিং বিল্ডিং ভাবধারা থাকবে না তো, সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের ছায়া শ্যামলিমা থাকবে নাকি! আমি সে-পয়েন্টেই যেতে চাইছি, সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের ছায়া-শ্যামলিমা না থাক, যে-ভবন বা প্রাসাদ ইট-সিমেন্টের গাঁথুনির ভেতর দিয়েও একটা খোলামেলা ভাব এনে দিতে পারে, মনোজগৎকে নিয়ে যেতে পারে ওপেন স্পেসে, আমি সেই ভবনের আর্কিটেক্টকেই বলবো সার্থক প্রাসাদশিল্পী! দমবদ্ধতা থেকে উদ্ধার করে তিনি আমাদের সবুজ শ্বাস ফেলার খানিকটা অবকাশ তৈরি করে দেন, এখানেই তার ক্রিয়েশনের বাহাদুরি, শিল্পচাতুর্যের পরিচয়!
১৯৪২ সালে নির্মিত আগরতলা এয়ারপোর্টের ভবনকে মনে হবে না যেন শুধু সিমেন্ট আর ইট-রডের স্তম্ভ! ফুরফুরানি হাওয়া রানিও যেন ইচ্ছেমতো এ-এয়ারপোর্টের যেখানে-সেখানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে পারে মনময়ূরী মেলে দিয়ে। তবে খোলামেলা শুধু চেহারা আর ছিরিছাদে, এ-বিমানবন্দর এখন দিন দিনই ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের দ্বিতীয় এ-বৃহৎ বিমান স্টেশন থেকে এখন প্রতিদিনই ইন্ডিগো আর এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে স্বল্প-খরচে পৌঁছানো যায় কলকাতা, দিল্লী, চেন্নাই, ইম্ফল, ব্যাঙ্গালোর আর গৌহাটি। তুলনামূলকভাবে খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশের অনেকেই এখন ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে যেতে এ এয়ারপোর্ট ব্যবহার শুরু করছে। ঢাকা থেকে আখাউড়া খুব বেশি দূরে নয়। প্রাইভেট কারেই হোক কী বাসে-ট্রেনে, আখাউড়া পৌঁছাতে যেমন সময় লাগে না— মাত্র তিন কী সাড়ে তিন ঘণ্টা, আখাউড়া-আগরতলা বর্ডার ক্রসিংয়েও নেই তেমন জটিলতা।
প্রায় সারাদিনই বর্ডারের এ-সাইডটা ফাঁকা পড়ে থাকে! বেনাপোলে যারা বেমাক্কা ভিড়ে দু’পাশের কাস্টমসঅলাদের অযৌক্তিক আর অন্যায় হয়রানির শিকার হয়, তাদের কাছে এ-বর্ডার বিস্ময়কর-রকম শান্তিপূর্ণ মনে হবে! বর্ডার থেকে এয়ারপোর্টেও পৌঁছানো যায় খুব কম-সময়ে। ঢাকা থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার, বর্ডার থেকে এয়ারপোর্ট যেতে সময় লাগে মাত্র পনেরো থেকে বিশ মিনিট। এ-বিমানবন্দর থেকে চেন্নাই আর দিল্লীর বিমানভাড়া পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। তবে আগরতলা বর্ডার দিয়ে যাওয়া-আসা করতে হলে অবশ্যই ভিসা অ্যাপ্লিকেশনের সময় এন্ট্রি পোর্ট অপশনে বাই রোড আগরতলা উল্লেখ করতে হবে।
বেশ কড়াকড়ি চেকিংয়ের অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে যখন ভেতরের বিশাল যাত্রী লাউঞ্জে পৌঁছালাম, তখন খোলামেলা ভাবটা আরো বেশি স্পষ্ট হলো। একপাশটা পুরো কাঁচঘেরা। যাত্রী লাউঞ্জ যাত্রীতে-যাত্রীতে ঠাসা। পোশাকে-আষাকে মনে হলো, উচ্চবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও এখন প্লেনে নিয়মিত যাতায়াত করছে! ইম্ফল বা চেন্নাই বা কলকাতা বা দিল্লী এখান থেকে কেউ ভুলেও আর এখন স্থলপথে যাওয়ার কথা চিন্তায় আনেন না। পথ শুধু দুর্গম নয়, বেশ সময়সাপেক্ষও। প্রতিটি গন্তব্যে ট্রেনে যেতেও বেশ সময় লাগে।
আমাদের দলনেতা কবি এ কে শেরাম বেশ ক’বার স্থলপথে সিলেট থেকে ইম্ফল গিয়েছেন। সে-যাত্রার অভিজ্ঞতা এবং মণিপুর ভ্রমণ নিয়ে তিনি একটি বইও লিখেছেন মৈরা পাইবী নামে। নাম শুনে আবার কেউ ভাববেন না মরার পর কোনো কিছু পাওয়ার ব্যাপার-স্যাপার আছে বইটাতে। একদমই তা নয়। মৈরা পাইবী মণিপুরী শব্দ। মৈরা অর্থ মশাল আর পাইবীর অর্থ ধারক। মৈরা পাইবীর অর্থ মশালবাহী অর্থাৎ যে মশাল বহন করছে। এ-নামে মণিপুরী নারীরা একটি সংগঠন করেছে। যে সংগঠনের মাধ্যমে তারা পুরুষের অন্যায়, সামাজিক শোষণ ও রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই লাভ করেছে অভূতপূর্ব সফলতা। সে ইতিহাস নিয়ে পরে অনেক কথা বলা যাবে। আপাতত শুধু জানিয়ে রাখি, শেরামদার এই বইটাতে সিলেট থেকে স্থলপথে মণিপুরের ইম্ফল-যাত্রার রোমহর্ষক বর্ণনা আছে। কতটা দুর্গম পথ পেরিয়ে যে একদা সেখানে যেতে হতো, কতটা দুরুহ ছিল সে-যাত্রা, আজ তা ইন্ডিগোর প্লেনে বসে নাকি কল্পনাও করা যাবে না।
শেরামদার ভ্রমণ উপন্যাসের নায়ক প্রথমে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছিল আসামের করিমগঞ্জ। সেখান থেকে বিরাম-শেষে আরেক যাত্রায় শিলচর। সেখানে রাত্রিযাপন করে পরদিন রওনা দিয়েছে পর্বতসংকুল বহু চড়াই উৎরাইয়ের দুর্গম পথে। নয়টি পর্বতশ্রেণি পার হয়েই তবে বাসযোগে পৌঁছানো যায় ইম্ফল। এই যাত্রাপথের রোমাঞ্চকর বর্ণনা পাঠকের জন্য এক বড় প্রাপ্তি। গহন চড়াই উৎরাইয়ের বিপদসংকুলতা এবং বুনো পথের সৌন্দর্যের পাশাপাশি আছে রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত হাঙ্গামার কাহিনিও। বিশেষ করে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির মধ্যে দ্বন্ধ সংঘাত সেখানে লেগেই থাকে। মণিপুরের অভ্যন্তরে পৌঁছানোর পর নাগা বিদ্রোহীদের দ্বারা বারবারই শিকার হতে হয় নানাবিধ উৎপীড়নের।
যাত্রী লাউঞ্জের ডিভানে বসে কবি এ কে শেরাম তার দুর্গম পথের ইম্ফল যাত্রার কাহিনি শোনাতে শোনাতে হঠাৎ বলে ওঠলেন, বাড়ির সাথে যদি কেউ কথা বলতে চান, এখনই বলে নিন। এখান থেকে বাংলাদেশের সিমে কথা বলা যায়। শেরামদার হৃদয় সিলেটে যদি আধটুকু পড়ে থাকে তো, বাকি আধটুকু হৃদয় ঘুমায় মণিপুর। ৬৬ বছরের জীবনে এ-নিয়ে তিনি দশমবারের মতো যাচ্ছেন সেখানে। সব তথ্য জানা। ঝটপট সবাই যে যার প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করল মোবাইল ফোন কানে তুলে। সিলেটের কবি পুলিন রায় তো বউবাচ্চার সঙ্গে বললই, বন্ধুবান্ধবও কাউকে বাদ রাখল না। ও জীবনে প্রথমবারের মতো ইন্ডিয়া এলো। উত্তেজনা আমাদের অন্য সবার থেকে একটু বেশিই। এমনকি কোনো একজনের সঙ্গে ফিসফিসিয়েও বলল কথা। কার সঙ্গে? বৌদির? বৌদির সঙ্গে কি ফিসফিসিয়ে কথা বলার প্রয়োজন আছে?
আমি কৌতূহল দমিয়ে নিজের চরকায় তেল দেয়ার চেষ্টা করি। গতকাল আগরতলা আসার পর থেকে ঢাকায় কারোর সঙ্গে কথা বলা হয়নি। মনটা বুঝি ভেতরে ভেতরে সেজন্য কাতর হয়েছিল। আমি মোবাইলটা অন করে প্রথমেই আমার অর্ধাঙ্গিনীকে কল দিই। কল হয়, ধরে না। মাকে অবশ্য এক চান্সেই পেয়ে যাই। মার সঙ্গে কথা বলে মন চাঙ্গাও হয়ে ওঠলো কিছুটা। মার সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পর আমি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে আবারো কল দিই। কোনো সাড়া নেই। অস্থিরতা আমাকে গ্রাস করে ফেললো। কী ব্যাপার! রেসপন্স করছে না কেন? কোনো ঝামেলা হয়নি তো? পুলিন রায় তো পুলিন রায় ঢাকার নিভৃতচারী কবি নিতাই সেনও কী সুন্দর ঘরের মানুষটির সঙ্গে চনমনে মেজাজে কথা বলে ফেললো। আমিই শুধু হতভাগার মতো বসে রইলাম।
শেরামদার ব্যাপারটা ভিন্ন। ‘বাড়ির বাইরে এলে আমি বাড়ির কথা ভুলে যাই।’ জানিয়ে দিলেন তিনি। আহা! সেরকমই যদি হতে পারতাম! তাহলে আর আমার বাড়ির মানুষটির রেসপন্স না পেয়ে এভাবে কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে হতো না। নিশ্চয়ই আমার তিনি এখন পথে রয়েছেন, ছেলেকে নিয়ে ফিরছেন বোধহয় স্কুল থেকে। আর পথের মধ্যে থাকলেই হলো, কল রিসিভ করার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না তার। কারণ মোবাইল সেটটা তিনি হ্যান্ডব্যাগে তো রাখেনই, তার ভেতরেও যদি কোনো ব্যাগ থাকে বা তস্য ব্যাগ বা প্রাচীন গুহা— পারলে সেখানেই রেখে দেন। স্বভাবতই মোবাইলের রিংটোনের শব্দ উনার কর্ণকুহরে সহজে প্রবেশ করে না। আর যদি কোনোমতো শব্দটা কানে পৌঁছায়ও, মোবাইল সেটটা সেখান থেকে উদ্ধারের জন্য উনাকে রূপকথার সেই রাজকুমারের মতো গভীর পাতালরাজ্যে ডুবে যেতে হয়, তারপর গভীর কোনো তল থেকে বের করে নিয়ে আসতে হয় রাক্ষসের সেই প্রাণভোমরাকে!
মোবাইল নিয়ে তার এই অতি সাবধানতার জন্য আমি অবশ্য তাকে নয়, দায়ী করবো ঢাকার আইনি পরিস্থিতিকে। বেচারির মোবাইল কি হাত থেকে একবার ছিনতাই হয়েছে? ছিনতাই, চুরি মিলিয়ে ঢাকার রাজপথে তিনি অন্তত চারবার তার মোবাইল হারিয়ে ফেলেছেন। তাই ঘরের বাইরে বেরোলেই মোবাইল সেটটা আগে রেখে নেন তস্য থেকে তস্য ব্যাগে, ব্যাগের ভেতরের প্রাচীন গুহায়। যাতে ছিনতাইকারী বা চোর কোনোভাবেই খুঁজে না পায় সেই কথ্যতরণীকে। কিন্তু আমি দেশের বাইরে আসার পরও যে উনি সেট আগলে রাখবার সেই ধনুর্ভঙ্গ পণ নিয়েই বসে থাকবেন, আমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য একটুও অপেক্ষায় থাকবেন না— সেই সত্যটা মেনে নিতেই যা একটু কষ্ট হচ্ছিল। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক