নিসর্গের কাছে আগরতলার সর্বজনপ্রিয় কবি রাতুল দেববর্মণ
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ২১
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : অক্টোবর ২১, ২০১৯
সন্ধ্যার আগরতলা শহরটিকে স্তিমিত আলো-আবছায়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা যখন রয়্যাল গেস্ট হাউজে ফিরে এলাম, সময় তখন সাড়ে নটা কী দশটা। গেস্ট হাউজের ডাইনিং রুমেই সারতে হলো খাওয়াদাওয়া। বড়ই বৈচিত্র্যহীন! যে মাছটির নাম শুনলেই আমার খাওয়ার ইচ্ছেটাই মাঠে মারা যায়, সেই রুই মাছ। রুই মাছ ছাড়া যেন কী ঢাকা, কী কলকাতা, কী আগরতলার গড়পড়তা মানের হোটেলের রেস্তোরাঁর মালিকেরা যেন আর কোনো মাছ চেনে না জানে না বা ধনুর্ভঙ্গু পণ করে বসে আছে, চেনাজানা থাকলেও অন্য কোনো মাছ আনবে না তো আনবে না। শুধু রুইমাছ দিয়েই চালাবে বিজনেস। অবশ্য অন্য কোনো মাছ বোধহয় তেমন মেলেও না এখানে। মিললেও হয়তো দাম আকাশচুম্বী। ইলিশ তো রাখতে পারতো! নাকি সেও দামের ভারে ভারী? পরে শুনেছি, সেবার সর্বক্ষেত্রেই রয়্যাল গেস্ট হাউজে একটা শৈথিল্যভাব নেমে এসেছিল। আসল যিনি মালিক, তিনি নাকি বিগত হয়েছেন সম্প্রতি, সে-ভদ্রলোকের হোটেল-চালনার প্যাশন তো ছড়িয়ে পড়েনি এখনো তার কোনো উত্তরাধিকারের গাত্রে। সেটা হতে সময় লাগে, কখনো কখনো হয়তো উত্তরাধিকার সে-দায় ভালোভাবে বহনও করতে পারে না, তখনই শুরু হয় পতনের যুগ।
একটা জোড়াতালি দেওয়া ডিনার শেষে আমি যখন পুলিন রায়-সমেত কবি এ কে শেরাম আর নিতাই সেনের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখনই অবিশ্বাস্যভাবে সে রুমে প্রবেশ করলেন কথাশিল্পী শ্যামল বৈদ্য! সঙ্গে আগরতলার সর্বজনপ্রিয় কবি রাতুল দেববর্মণ! নিজের চোখকেও যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তারা আমাদেরকে একটু চমকে দিতেই বুঝি এসেছেন! কার কাছ থেকে শুনেছেন আমাদের আসার সংবাদ, জানি না। হয়তো বীরমঙ্গলদার কাছে নতুবা নিতাই সেন বা এ কে শেরাম কেউ একজন তাদের কল করে থাকবেন। কৌশলে আমাদের থাকার জায়গার খবরটা জেনে নিয়ে চলে এসেছেন দেখা করতে! সত্যি, এ-এক ভালোবাসার অমূল্য নিদর্শন! শ্যামল বৈদ্য-দা অবশ্য বরাবরই তা করে থাকেন। গতবারও যখন ২০১৬ সালে এসেছিলাম আগরতলা, শহীদ ভগত সিং যুবা আবাসন সেন্টারে তিনি একদিন কবি আকবর আহমেদের সঙ্গে এসেছিলেন আমার আর মঞ্জু সরকারের সঙ্গে দেখা করতে! সেদিন তিনি দীর্ঘক্ষণ আমাদের সাথে আড্ডা মেরে গেছেন। আমাকে এবং মঞ্জু সরকারকে উপহার দিয়েছেন তার উপন্যাস উজানভাটি। যা ১৯৭১ সালের আগরতলায় অবস্থানকারী বাংলাদেশের শরণার্থিদের জীবনকেন্দ্রিক একমাত্র উপন্যাস।
আমি আগেও শ্যামলদা এবং তার সে বইটি নিয়ে আলোকপাত করেছি বলে এখানে আর বলতে চাইছি না। হয়তো পুনর্কথন হয়ে যাবে। যা হোক তাদের দুজনের সরব উপস্থিতিতে আমাদের আড্ডা আরো প্রাঞ্জল হয়ে উঠলো। অবশ্য খুব বেশিক্ষণ সময় তারা নিলেন না আমাদের। বললেন যে, আপানারা ভ্রমণের ধকলে আছেন, ভালো করে বিশ্রাম নিন।
কথাশিল্পী শ্যামল বৈদ্য এবং কবি রাতুল দেববর্মণ আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন বটে, কিন্তু মনজুড়ে পরিব্যপ্ত রইলেন। দুজনই আগরতলা-কেন্দ্রিক বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্য-চর্চায় অগ্রগণ্য নাম। একজন কথাশিল্পের জগতকে পরিপুষ্ট করে চলেছেন তো, আরেকজন কবিতার রাজ্যকে সাজাচ্ছেন নতুন এক বাগানে। হ্যাঁ, আমি অনেক আগ থেকেই রাতুল দেববর্মণের কবিতার অনুরাগী। তার ‘আমি যাব না’ কবিতাটি এতই ভালো লাগে যে, সেটা আমার মুখস্থ হয়ে আছে। আমি অবিলম্বে কবি এ কে শেরাম আর নিতাই সেনকে শুভরাত্রি জানিয়ে আমার রুমে ফিরে আসি। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে আপন মনে পাঠ করি রাতুল দেববর্মণের সেই সহজ সরল অথচ গভীর তাৎপর্যময়ী কবিতা।
আমি যাবো না, যে ভ্রমণে সীমানা চিহ্নিত আছে
নিঃসঙ্গ গন্ধ আছে, সেখানে আমি কোনদিন
যাবো না, যে ভ্রমণে টমেটোর রঙের মতো
শুধু বিলাসী আহলাদ, ঝুলন্ত বাতাবী লেবুর
মতো টলমল চোখ, কথাহীন ঝুলুঝুলু
কুয়াশা মেশানো কিশোরীর মুখ
সোনালী চামচে ঠোকাঠুকি ঝাঁজালো খাবার
শুধু সিল্কী নারীর মরীচিকাময় চিকন সুর,
সে ভ্রমণে কেউ যেতে চায় যাক
আমি অন্তত সে মুখো হবো না।
আমাকে যেতে দাও তন্বী রাস্তায়
যেখানে শুধু পাশাপাশি হাঁটা
বুকখোলা জামার ভেতর দিয়ে
বুকে এসে বিঁধে যাবে কিষাণী নারীর
ভাটিয়ালী সুর, আবদুল-শচীনের গান
ধানীগন্ধে-মাখামাখি লেবাং বুমানীর সুর
মুক্ত উপত্যকায় মাদলের বাউল বাতাস
আমাকে তোমরা সেখানেই যেতে দাও।
এই যে তার ভ্রমণ নিয়ে এমন মনোবাসনা, যেখানে তিনি তন্বী রাস্তায় নিঃসঙ্গ নয়, কাউকে নিয়ে শুধু পাশাপাশি হাঁটতে চান ভাটিয়ালী সুর মাখা, ধানীগন্ধ গাঁথা, মুক্ত উপত্যকার মাদলের বাউল বাতাসে, আমার সৌভাগ্য যে, ভ্রমণপ্রিয় এ-কবির সঙ্গে আমারো রয়েছে অসম্ভব সুন্দর এক ভ্রমণের কিংখাব ঝালরময় তরতাজা স্মৃতি। আমিও তার পাশাপাশি হাঁটার সুযোগ পেয়েছিলাম। হ্যাঁ, সেই ২০১৬ সালের আগরতলা ভ্রমণের একদিন সুপ্রিয় তাপস দেবনাথ আমাকে আর মঞ্জু সরকারকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাড়িতে। সেটা আক্ষরিক অর্থেই ছিল কবির বাড়ি।
বাড়ি তো বাড়িই, কবির বাড়ি বলে কি আবার আলাদা কিছু হয় নাকি? হাঁ হয়, অবশ্যই হয়। যারা কবি, যারা সত্যিকারের কবি, তাদের মনের ভেতর কুটিল ইর্ষা সাপের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকে না, পরশ্রীকাতরতার বিষধর বিচ্ছু অস্থির দৌড়াদৌড়ি করে না সতেজে, আত্মঅহমিকা বা দম্ভের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে কীটদুষ্ট মন পায়চারির পর পায়চারি করে না দঙ্গলে! যারা কবি তারা তো নিজের অজান্তেই নিজের সঙ্গে কখন শপথ করে বসে থাকেন যে, পৃথিবীর সমস্ত ফুল ও শিশুকে তিনি বাঁচিয়ে রাখবেন, বন্ধ্যামাটিতে ফলাবেন হিরন্ময় ধানের সোনা! নিসর্গের ঘটকালি করে ঘটাবেন আকাশ মাটির মহামিলন! কবির বাড়িতে তার অলক্ষ্যেই অনেক শিশুর কোমল নিষ্পাপ ঘ্রাণ জিইয়ে থাকে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে, ফুলের অনন্য সুরভি ঘুরে বেড়ায় অলিন্দে দেয়ালে জানালা দরজায়, ধান্যগন্ধের সুবাস উপচানো থাকে শয্যা থেকে শয়নে-স্বপনে। কবির বাড়ি থেকে মুছে যায় না কখনোই গায়ের কাদামাটির ছাপ, তালদিঘির বুকভরা স্মৃতি আর নিসর্গের নির্জনতা! আমি রাতুল দেববর্মণের ড্রয়িং রুমে বেশ কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে বসেছিলাম। মন থেকে সে-বাড়ির সুঘ্রাণ আহরণ করছিলাম।
কিছু কিছু মানুষ আছে যার মুখের দিকে তাকালেই রোদ ঝলমলিয়ে উঠে, মনে হয় আহা পৃথিবীতে বাঁচার কী সুখ! রাতুল দেব বর্মণের মুখের ভাষাও ঠিক এরকম! আনন্দশংকরের রাগ আনন্দ ভৈরবী যেন বেজে ওঠে সরোদ-সেতারের ঝংকারে ঝংকারে! সেদিন তার বাড়িতে আমাদের চারজনের আড্ডাটা দারুণ জমাটি বেঁধেছিল আর সে-আনন্দ পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছিল খাবার টেবিলে। বৌদির হাতের সুস্বাদু রান্নার কথা কখনো ভোলা যাবে না, নানা পদের চিরচেনা মাছ তো ছিলই, ছিল ঢাকার শুটকিও। এতো মখমলে শান আড্ডা দিয়েও কি পরাণ ভরে রাতুলদার! তার একটা ছোট্ট প্রাইভেট কার আছে। যেন আদরের বিড়ালছানা! সেটা নিয়ে, লাঞ্চের পর ছোট্ট একটা বিশ্রাম লাভের সুযোগ দিয়ে, তারপর বললেন যে, চলো! শহরের বাইরে কোথাও বেড়িয়ে আসি! কোথায় নেবেন, কোথায় বেড়াবেন, তা পুরোপুরি ভাঙলেন না। রহস্যের অন্তর্জাল ছড়িয়ে দিয়ে শুধু ইশারায় জানালেন, জলে-জঙ্গলে কোথাও হবে আর কি। চলোই না! চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক