১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পাক বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ত্রিপুরার রাজপথে সর্বস্তরের মানুষের সংহতি মিছিল। আলোকচিত্রী: রবীন সেনগুপ্ত
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ১৭
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : আগস্ট ২৬, ২০১৯
হোটেলের গলি পেরিয়ে আমরা— কবি এ কে শেরাম, নিতাই সেন, এল বীরমঙ্গল সিংহ, পুলিন রায়, গৌতমলাল চাকমা এবং আমি কর্নেল চৌধুরী রোড ধরে হাঁটতে থাকি। নির্জন-নিস্তব্ধ পরিবেশ। শহরের ভিড় কোলাহল চিৎকার ঠেলাঠেলি কিচ্ছু নেই। ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলোও ঔদ্ধত্যহীন, লণ্ঠনচরিত্র নিয়ে জ্বলছে। খানিকটা দূর এগোতেই মিলল কর্নেল চৌধুরীর দেখা। কর্নেল মহিম চৌধুরী। মোড়ের মাঝখানে বিশাল মূর্তি তার। কোথায় যেন কর্নেল চৌধুরীর কথা পড়েছিলাম! কোথায়? কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ধ্যাত্তেরি বলে ছেড়ে দিলাম। গতবার বোধহয় এদিকটায় আসা হয়নি। তাহলে তো চোখে পড়তো। এদিকে আসিনি, তবু আমার কেমন পরিচিত লাগছে জায়গাটা। যেন এখানে আমি অনেক অনেকদিন ছিলাম, বাস করেছি, হেমন্তে-বসন্তে শিস দিয়ে-দিয়ে গান গেয়ে বেড়িয়েছি! আগে আগে এটা আমার খুব হতো। ভীষণভাবেই হতো। এই যে অপরিচিত কোনো জায়গাকেও চেনা চেনা লাগা— এমন মনোভ্রমচারিতা।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম অক্ষর প্রকাশনীর সামনে। সামনে বলাটা তো ঠিক হলো না, পাশে বলাটাই সঙ্গত হবে। কেননা আমরা পাশের মোবাইল সিম প্লাস ফ্লেক্সি করার দোকানটার মধ্যে এমনভাবে গেড়ে দাঁড়ালাম যে, সেখান থেকে নড়াটা আর সম্ভব হলো না। বহু সাধনার পর মিলেছে ফ্লেক্সিলোডের খোঁজ। আমাদের যার যার কাছে ছিল ভারতীয় মোবাইল ফোনের সিম, তারা প্রয়োজনমতো ভরে নিতে লাগলো যতটুকু লাগে তেল-গ্যাস অকটেন। তবে নতুন করে ভারতীয় সিম কিছুতেই কেনা গেল না। কী সব বাধ্যবাধকতা আর কালাকানুনে ভরপুর। যা একদমই নেই কোলকাতায়। সেখানে সিম নিতে দশমিনিটের বেশি লাগে না কোনো বাংলাদেশির।
অক্ষরে এসেছি আড্ডা দিতে অথচ অক্ষরে আর ঢোকা হচ্ছে না। ফ্লেক্সি নিচ্ছে তো কথা চলছে, কথা চলছে তো আড্ডা জমাটি বাঁধছে। পঞ্চ কবির সমাহার বলে কথা! কী জানি এক তালগোল পাকানো জটিলতা। তালগোল মানে তাল হলো গোল, কোন তাল? ফল না তো? না না এখানে ফল হবে কেন? তাল মানে জ্ঞান, জ্ঞানে গোল বেঁধে যাচ্ছে, মানে তালগোল পেকে যাচ্ছে, আবার পেকে ঢুকে গেল কেন— পেকে ঢুকলে যে গাছের তালই ধরে নিতে হবে, এখানে গাছের তাল আসবে কোন যুক্তিতে, আবারো দেখছি তালগোল— আরে সে কি শুভব্রত দেব যে বেরিয়ে যাচ্ছেন? আমরা তাহলে আড্ডা মারবো কার সঙ্গে? হ্যাঁ, দীর্ঘ, ঋজু, স্বাস্থ্যবান, শ্যামল, শ্মশ্রুমন্ডিত মানুষটি হন হন করে বেরিয়ে অক্ষরের পাশের গলি দিয়ে ভেতরের দিকে কোথায় মিলিয়ে গেলেন।
ভাবছেন, অক্ষরের সত্ত্বাধিকারী শুভব্রত দেবকে চিনি কীভাবে? এও কি আমার সেই অপরিচিত জায়গাকে চেনা লাগার মতো কোনো মনস্তাত্বিক ঘোর কিনা! জি না, মোটেও তা নয়। শুভব্রত দেব আমার চেনা, ভালোভাবেই চেনা। আমার বিশ্বাস, এই বেরিয়ে যাওয়ার মুখে উনি যদি আমাকে দেখতেন, নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে পড়তেন, মুখে স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইতেন, কবে এলেন আগরতলা? গতযাত্রায় যে আমরা দুজন আমবাসা বইমেলার সেই সমাপনী অনুষ্ঠান-মঞ্চে একসঙ্গে বসেছিলাম, একসঙ্গে নিয়েছি সম্মাননা উত্তরীয়।
হ্যাঁ, সেদিন সেই সন্ধ্যায় আমবাসা সার্কিট হাউজ থেকে একটা জিপে আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়েছিলেন পংকজ চক্রবর্তী। আমাকে, মঞ্জু সরকারকে, শান্তা সরকারকে, আরিফ রহমানকে আরো আরো যারা ছিলেন, সবাইকে একসাথে। যেতে যেতেই পংকজ চক্রবর্তী আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেই একাত্তরের রণাঙ্গনে। আসলে তিনি শুধু আমাদেরকে জানাতে চেয়েছিলেন যে, এই আমবাসা গ্রামেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক মহান সেনানি বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানকে। পংকজদার কাছ থেকে নতুন করে জানা গেল, সেই অকুতোভয় সৈনিক মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ১ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেওয়ার পর, পরম বিক্রমে একের পর এক অপারেশনে অংশ নিচ্ছিলেন। তছনছ করে দিচ্ছিলেন শত্রুশিবিরের স্বস্তি। যুদ্ধের চূড়ান্ত এক সন্ধিক্ষণে একাত্তরের অক্টোবরের শেষদিকে মৌলভীবাজার জেলাস্থ কমলগঞ্জ উপজেলার চা-বাগান বিস্তৃত ধলাই সীমান্ত চৌকিতে তিনি সহযোদ্ধাসহ পাক হানাদার বাহিনীর ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালান। সেখানেই সম্মুখ-সমরে বীরের মতো লড়তে লড়তে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। তখন তাকে প্রতিবেশি এই ত্রিপুরা রাজ্যের কমলপুর জেলাধীন আমবাসা গ্রামে এনে সমাধিস্থ করা হয়। পরে অবশ্য ২০১৬ সালের দিকে তার দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে এনে ঢাকাস্থ শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
সন্ধ্যার আলো-আঁধারি ঘেরা আমবাসার চান্দ্রাইপাড়া দ্বাদশ শ্রেণি বিদ্যালয় ময়দানে জিপ থেকে নামতেই, কোনো উদ্বেগ বা উৎকন্ঠা নয়, বিপুল এক হর্ষধ্বনিই যেন টের পাচ্ছিলাম নিজের ভেতর। মাঠভর্তি মানুষ, মাঠের কিনারে কিনারে বইয়ের স্টলের সামনে পাশে মানুষ। অগনিত অগণন মানুষ— যেন আমার জরুন গ্রামের সব মানুষ এসে উপস্থিত হয়েছে, জরুনের-কাশিমপুরের-কোনাবাড়ির-এনায়েতপুরের-হাতীমারার-ভবানীপুরের-সারদাগঞ্জের-সুরাবাড়ির-বাগবাড়ির-কৈজুরির-ধনঞ্জয়খালির-দেওয়ালিয়াবাড়ির-হরিণাচালার-বাইমাইলের মানুষ; যেন সবাই আমার অতি আপনজন, চিরচেনা। আমি মফিদুল হক এবং অলোক দাশ গুপ্তর প্রতি অসীম এক কৃতজ্ঞতা বোধ অনুভব করতে করতে মঞ্চে আসন গ্রহণ করি। তাদের দুজনের আন্তরিকতার কারণেই কেবল আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে এই প্রথমবারের মতো সসম্মানে কোনো মঞ্চে আসন গ্রহণ করার। মঞ্চে আসীন ছিলেন অক্ষর প্রকাশনীর শুভব্রত দেব, আমার বাংলাদেশ-সহযাত্রী মঞ্জু সরকারসহ আমবাসা-আগরতলার সম্ভ্রান্ত সব মানুষ, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তিগণ।
সম্মাননা স্মারক প্রদান, উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়ার পর এগিয়ে এসেছিল বক্তৃতা প্রদান-পর্ব। যথারীতি উচ্চারিত হয়েছিল আমার নামও। আসন থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে টের পেয়েছিলাম এক আত্মপ্রত্যয়ী আমাকে! কোথায় আমার সেই ভীরু সত্তা, বুক ঢিপ ঢিপ কম্পমানতা? কিসসু নেই। মা-আ-গো ভাবনা কেন? আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে... আমি ডায়াসের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শান্ত চোখে দেখছিলাম মানুষ আর মানুষ, হাজার হাজার মানুষ, অযুত অযুত মানুষ। যারা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কথা শুনবে বলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এ-আমার কাছে এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। আমিও তাদের দিকে তাকাই, কোনো একজনের প্রতি নয়, সমগ্রর প্রতি— এবং, আমার মন অতি দ্রুতই তাদের প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। আমার মনে পড়ে যায়, এই আমবাসা এই আগরতলা এই ত্রিপুরা রাজ্যের প্রতিটি মানুষ প্রতিটি ঘর সেদিন, সেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রাণের ভয় নিয়ে ছুটে আসা ১৫ লক্ষ শরণার্থি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কী পরম মমতা নিয়ে, কী দরদভরা ভালোবাসাসহ।
সেদিন সোনামোড়া থেকে বিলোনিয়া, ধর্মনগর থেকে সাব্রুম— ত্রিপুরার প্রতিটি প্রান্তের মানুষ— আমরা খোলা আকাশের নিচে কোথায় থাকবো, আমাদের ঘর তুলে দিয়েছে, স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিয়েছে! অন্ন যুগিয়েছে। শ্মশ্রুষার জন্য খুলে দিয়েছে চিকিৎসা-কেন্দ্র। সেদিন ত্রিপুরার প্রতিটি হাসপাতাল, চিকিৎসালয় এগিয়ে এসেছিল শরণার্থিদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে। বিপুল-সংখ্যক মানুষের হঠাৎ পদভারে নেমে আসা সামাজিক স্থবিরতাকেও তারা মেনে নিয়েছিল হাসিমুখে; জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ সবকিছুকেই।
সেদিন ত্রিপুরার ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, মূখ্যমন্ত্রী-মহারাজা— প্রতিটি শ্রেণির মানুষ লক্ষ লক্ষ অসহায় আর্ত ঘরহারা ঠিকানাহারা বাংলাদেশের মানুষকে আপন বুকে ঠাঁই দিয়ে ত্রিপুরাকে পরিণত করেছিল মহামানবের মিলনক্ষেত্রে। আগরতলা যেমন হয়ে উঠেছিল যুদ্ধরত নতুন দেশটির অলিখিত রাজধানী, তেমনি ত্রিপুরার প্রতিটি সংবাদকর্মী আর সংবাদপত্র, রেডিও স্টেশন হয়ে উঠেছিল লড়াকু জাতিটার অনন্য মুখপত্র। সারা বিশ্বের কাছে তারা ছড়িয়ে দিয়েছে পাক হানাদার বাহিনির বর্বরতার চিত্র, তুলে ধরেছে অসমসাহী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের এক-একটি এপিক পর্ব।
সেদিন ত্রিপুরায়, ত্রিপুরার মাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হয়েছিল বাংলার যতো নদনদী— পদ্মা, মেঘনা, সুরমা, যমুনা, আড়িঅল খাঁ, গোমতি, তুরাগ, ইছামতি, তিতাস আরো আরো যত নদী আছে। ত্রিপুরার উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত প্রতিটি প্রান্তজুড়ে জিইয়ে থাকা বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের নিয়ে গড়ে ওঠা গেরিলা বাহিনির বিভিন্ন গ্রুপকে নাম দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের নদীর নামে নামে। আর এক একটা নদী বিপুল খর-বেগে গজরাতে গজরাতে ঢেউয়ের দুরন্ত ছোবলে ছোবলে বর্বর হানাদার বাহিনীর সমস্ত দুর্বোধ্য প্রাচীর ভেঙে দিয়েছিল, সমস্ত দুর্গম কুল ধসিয়ে দিয়েছিল, ভাসিয়ে দিয়েছিল তাদের দাঁড়িয়ে থাকবার সমস্ত চরাচর।
ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে আমার আরো আরো মনে পড়ে যাচ্ছিল এই আমবাসার মাটিতেই শুয়ে আছে আমাদের মহান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বিশাল তর্জনি তুলে, বিগ ক্লোজ আপে আমি দেখছিলাম তার সেই অসীম হাতের স্পন্দন— আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে, এই ত্রিপুরার আগরতলা শব্দটা তার সত্তার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়েছিল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ঠুকে আইয়ুবশাহী বঙ্গবন্ধুকে ভরেছিল জেলে, চেয়েছিল ফাসির মঞ্চে ঝুলিয়ে দিতে! দুর্বার গণজোয়ার তাদের অশুভ সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করেছে, দীপ্ত হাতে উদিত করেছে স্বাধীনতার সোনালি সূর্য। আমি কোন ঘোর থেকে যে বলে গিয়েছি, জানি না। শুধু টের পেয়েছি আমার বলা যেন থামতেই চাইছিল না। হঠাৎই যেন লাগাম টেনে ধরে সেদিন সেই আমবাসা বইমেলার মুক্তমঞ্চে আমি বিপুল জনতার কাছে আমার মাথা নুইয়ে দিয়ে আমার বক্তব্য সমাপ্ত করেছিলাম। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক