কবি এ কে শেরাম, কবি নিতাই সেন, কবি এল বীরমঙ্গল সিংহ এবং কবি পুলিন রায়
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ১৫
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : আগস্ট ১২, ২০১৯
কতক্ষণ ভাবনার গহন অন্তর্লোকে ডুবেছিলাম জানি না, হঠাৎ দরজায় নক। একটু পরই খোলা দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলেন কবি এ কে শেরাম, কবি নিতাই সেন। তাদের সঙ্গে আরেকজন শুকনো পাতলা ভদ্রলোক এবং আরো এক যুবক। শেরামদা তাদের পরিচয় জানিয়ে বললেন, হামিদ! পুলিন! আপনাদের কাছে যার গল্প করেছি, এই সেই ত্রিপুরার মণিপুরী কবি এল বীরমঙ্গল সিংহ। আর ও হচ্ছে বিশিষ্ট চাকমা কবি গৌতমলাল দাস। এল বীরমঙ্গল সিংহকে কবি বললে কী হবে, আসলে তিনি আগরতলার বাংলা ভাষাভাষী একজন ব্যস্ততম গদ্যকারও। বিশেষ করে মণিপুরের ওপর লেখালেখি সেখানকার কৃষ্টি-কালচার-ইতিহাসকে বহির্বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
এল বীরমঙ্গল সিংহের আগমনের পর পুরো পরিবেশটাই যেন আমূল পাল্টে গেল! একটা প্রাণচাঞ্চল্যের স্ফূর্তি জেগে ওঠেছে। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন পুরো আগরতলাই আমাদের বরণ করে নিল স্বাগতম-সৌজন্যে। আমরা দল বেঁধে শেরামদার রুমে গিয়ে বসলাম। আড্ডা জমে ওঠতে সময় লাগলো না। বহুল জায়গার মানুষের এক বহুমাত্রিকতার আড্ডাই বলা যায়। আমি আর নিতাই সেন এসেছি ঢাকা থেকে, শেরামদা আর পুলিন রায় প্রতিনিধি সিলেটের আর বীরমঙ্গল সিংহ এবং গৌতমলাল দাস আগরতলার— তারাই হোস্ট। আগরতলা-মণিপুর এবং সিলেটের মণিপুরি সম্প্রদায়ের মানুষের চিরচেনা এল বীরমঙ্গল সিংহের সঙ্গে শেরামদার সম্পর্ক যতোটাই নিবিড় ততটাই প্রগাঢ়। এর একমাত্র কারণটি হলো শেরামদার বারংবার ইম্ফল-গমনাগমন। ইম্ফলের কবিবৃত্তই শুধু নয়, শিল্পসাহিত্য অঙ্গনের মানুষ শেরামদাকে এতোটাই ভালোবাসে যে, তাকে নানা উপলক্ষে মাঝে মধ্যেই ছুটতে হয় সেখানে দাওয়াত কবুল করতে। শেরামদার সেই ইম্ফলযাত্রার আগরতলা অংশে তার ছায়া হয়ে থাকেন বীরমঙ্গল সিংহ। ইম্ফলযাত্রা মানেই তো আগরতলায় একরাত, হোটেল ম্যানেজ করে দাও তো, জুটিয়ে দাও ইন্ডিগোর টিকেট এটা সেটা কত কিছু। তার সঙ্গে যদি পাওয়া যায় বীরমঙ্গল সিংহের সৃজনী-সান্নিধ্য, সে তো এক বোনাস লাভ! এবারো আমাদের হোটেলের রুমদুটো বীরমঙ্গল সিংহদাই বুকিং করে দিয়েছেন, সংগ্রহ করে রেখেছেন ইম্ফলগামী ইন্ডিগোর টিকেটও।
আড্ডায় যেমন হয় আর কি, এক-ছটাক খুনসুটির সরষে ছলকে উঠলো তো কড়াইয়ে, তাতে পড়লো দু-চামচ ঠাট্টার নুন, তার মধ্যে আবার ছিটাও সিরিয়াস কথার কিছু ঝালমশলা, তারপর উপভোগ করো ভাগাড়ের শব্দের মতো চলবলে হাসিখুশির সুঘ্রাণ, তেমনিভাবে চলতে লাগলো অবিশ্রান্ত কথার ফুলঝুরি। এর মধ্যেই শেরামদা বীরমঙ্গল সিংহকে কী এক প্রসঙ্গে খোঁচা মেরে ওঠলেন, বীরমঙ্গল সিংহ কি আর সাধারণ কেউ? ওর পূর্ব-পুরুষ তো মণিপুর থেকে আগরতলা এসেছে মণিপুরি রাজবংশের রাজকন্যার পালকিতে চড়ে! বীরমঙ্গল সিংহ খোঁচাটাকে চট করে হজম করে নিলেন, তারপর বললেন, হ্যাঁ আমরা যেসব মণিপুরি আগরতলায় আছি, আমরা অতিথি হিসেবেই এসেছি মণিপুর থেকে, এ-দাবিটা করতেই পারি। কিন্তু আগরতলা ছাড়া মানে আসাম, কাছাড়, সিলেটে যেসব মণিপুরি সম্প্রদায়ের মানুষ আছে, তারা মণিপুর থেকে একসময় হাতে জান নিয়েই পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, হা হা। হেসে ওঠলেন বীরমঙ্গল সিংহ। শেরামদাও সে-হাসিতে যোগ দিয়ে সায় জানালেন, কথা সত্য। তবে আগে থেকেও কিছু মণিপুরি যে সেসব জায়গায় ছিল না, তা নয়। অল্প ছিল। ছিল বলেই তো তাদের কাছে পালিয়ে আসা মণিপুরিরা আশ্রয় নিতে পেরেছিল।
স্বভাবতই আমরা বাকি সবাই তাদের দুজনের কথোপকথনে কৌতূহলী হয়ে ওঠলাম, কেন, পালিয়ে যেতে হবে কেন মণিপুরীদের মণিপুর ছেড়ে? কী হয়েছিল তখন সে-সম্প্রদায়ের মানুষের? আমাদের কৌতূহল নিবারণে শেরামদা আর বীরমঙ্গল সিংহ শোনালেন বার্মিজদের আরেক বর্বরতার ইতিহাস। আজ যেমন বার্মিজ স্বৈরাচারীদের নির্মম নিষ্ঠুর অত্যাচারে রোহিঙ্গাদের নিজ বসত ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে বাংলাদেশে পার্শ্ববর্তী ভারতে, মণিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষকেও অবিকল সেভাবেই নিজের রাজ্য মণিপুর ছেড়ে একটা সময়ে চলে যেতে হয়েছে আসাম, কাছাড়, সিলেট এবং আগরতলার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে।
শেরামদার ভাষ্যমতে আধুনিক মণিপুরের ইতিহাস আসলে নিংথৌজা রাজবংশেরই ইতিহাস। এই রাজবংশের সবচেয়ে কৃতিমান শাসক ছিলেন মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র! তার শাসনামলেই মণিপুরি সংস্কৃতির প্রভূত উন্নয়ন ঘটে। মণিপুরের ইতিহাসে সংঘটিত হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর মধ্যে অন্যতম বৃটিশদের সাথে পরোক্ষ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। কিন্তু ভাগ্যচন্দ্রের মৃত্যুর পর পরই মণিপুরের আকাশে নেমে আসে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। শুরু হয়ে যায় তার সন্তানদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ভ্রাতৃকলহ, পারস্পারিক সংঘাত। রাজপরিবারের এই অন্তর্কলহের সুযোগ নিল চিরশত্রু প্রতিবেশি বার্মিজরা। তারা ১৮১৯ সালে মণিপুর দখল করে নেয়। ১৮১৯ থেকে ১৮২৫ খৃস্টাব্দ— এই সাত বৎসরকাল মণিপুর রাজপরিবারের অকর্মণ্য কোনো-না কোনো সদস্যকে নামমাত্র রাজা বানিয়ে কার্যত মণিপুর রাজ্য শাসন করে বার্মিজরাই। এ-সময়কালে বার্মিজ-বাহিনি মণিপুরে এতো অত্যাচার-নিপীড়ন চালায় যে, বলা হয়, মণিপুরের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হয় প্রতিবেশি রাজ্যগুলোতে পালিয়ে যায়, না-হয় বার্মিজরা বন্দী করে নিয়ে যায় নিজ দেশে; শুধু এক-তৃতীয়াংশ থেকে যায় মণিপুর। মণিপুরি ইতিহাসে এই কালসীমাকে সাত বৎসরের ধ্বংসযজ্ঞ বলে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আসাম, ত্রিপুরাসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবং বাংলাদেশে ও বর্তমান মিয়ানমারে মণিপুরিদের ব্যাপক বসতিস্থাপনের ঘটনা এ-সময়েরই। যদিও এ-সমস্ত অঞ্চলে মণিপুরিদের বসতি আগে থেকেই ছিল।
বার্মিজদের বর্বরতা তাহলে আজকের নয়? শুনেছি প্রাচীনকালেও এই বাংলা লুটতরাজে আরাকানরাজরা মগদের পর্তুগীজদের উৎসাহ যুগিয়ে চলতো। আমার চোখের সামনে দলে দলে ঘরহারা অন্নহারা রোহিঙা শিশুদের নারীদের অসহায় মুখচ্ছবি ভেসে ওঠতে লাগলো। কীভাবে একেকজন নৌকা থেকে পানিতেই ঝাপিয়ে পড়ছে একটুকু আশ্রয়ের খোঁজে। নৌকা তীরে ভেড়ারও অপেক্ষা করছে না। মানুষকে ভিটেছাড়া করার চেয়ে বড় অন্যায় আর কি হতে পারে? অথচ যুগ যুগ ধরে বার্মিজরা সেই অমানবিক ধারারই বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। এই যুগ-যুগান্তরের ব্যাপারটা মাথায় আসতেই আমার চট করে মনে পড়ে গেল, একদা এই প্রাচীন বাংলা ছেড়ে বৌদ্ধদেরও তো বিতাড়িত হতে হয়েছিল হিন্দুদের কাছে মার খেয়ে! তারা দলে দলে বিতাড়িত হয়েছিল। বৌদ্ধদের পীঠস্থান এই বাংলায় আজ কোথায় বৌদ্ধরা? অবশ্য চট্টগ্রাম আর পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক জনপদে কোনোমতো তাদের অস্তিত্ব আজো সামান্য রয়েছে। তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস কি শুধুই নির্মমতার ইতিহাস, দখলদারিত্বের ইতিহাস? শান্তির নামে অশান্তি তৈরির ইতিহাস? জনবসতির নয়া মেরুকরণের ইতিহাস? ভিটে হারানোর ইতিহাস? কেমন অসহায় বোধ আঁকড়ে ধরতে চায় আমাকে। কিন্তু আমি কোনো মর্বিডি বোধকে প্রশ্রয় দিতে রাজি নই। বেড়াতে এসেছি তো রাজার হালে বেড়াবো, ইচ্ছেমতো এনজয় করবো!
আচ্ছা, বার্মিজদের তাড়া খেয়ে মণিপুর থেকে মণিপুরিদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার কাহিনি না-হয় জানা গেল! কিন্তু বীরমঙ্গল সিংহের পূর্বসুরি পুরুষদের মণিপুর থেকে মণিপুরি রাজবংশের রাজকন্যার পালকিতে চড়ে আগরতলায় আসাটা কেমন করে হলো? সে কৌতূহল আমাকে অনেক আগে থেকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। এক্ষণে প্রশ্নটা ছুঁড়ে মারতেই বীরমঙ্গল সিংহ শেরামদার আগে আগেই তা খপ করে ধরে ফেললেন। শুরু করলেন সেই প্রশ্নের রহস্যের উন্মোচন।
ত্রিপুরার সঙ্গে মণিপুরের সম্পর্কটা আজকের নয়, অনেক পুরনো। এতো পুরনো যে, তার কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন নেই। প্রাচীন গ্রন্থ রাজমালায় শুধু উল্লেখ আছে, ত্রিপুরার আদি রাজা তৈদাক্ষিণ মেখলী রাজকন্যা অর্থাৎ মণিপুরি রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। ধারণা করা হয়, এই বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ত্রিপুরার সঙ্গে মণিপুর রাজ্যের আত্মিক সম্পর্কের সূচনা হয়। পরবর্তীকালে দুই রাজ্যের ইতিহাসের নথিপত্র ঘেটে দেখা যায় যে, এমন মধুময় ঘটনা বারংবারই ঘটেছে। ত্রিপুরার রাজা দ্বিতীয় রাজধর মাণিক্যের সঙ্গে মণিপুরের রাজকন্যা হরিশেশ্বরীর বিয়ে হয়েছিল। ১৭৯৮ সালে মণিপুরের স্বনামধন্য রাজা ভাগ্যচন্দ্র তীর্থ-ভ্রমণের পথে মণিপুরে রাজঅতিথি হিসেবে অবস্থানকালে মণিপুরী রাজা নিজ কন্যা হরিশেশ্বরীকে তদানীন্তন ত্রিপুরার রাজপুত্র দ্বিতীয় রাজধর মাণিক্যের সঙ্গে বিয়ে দেন। রাজকুমারী হরিশেশ্বরী মণিপুর থেকে ত্রিপুরায় সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন রাধা মাধব বিগ্রহ। তিনি সে-সময়ে ত্রিপুরার রাজধানী পুরাতন আগরতলায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মাধবের পুজা-অর্চনা শুরু করেন এবং মন্দির প্রাঙ্গণে বাৎসরিক মণিপুরি রাস উৎসবও প্রচলিত হয়।
আগরতলা আসার সময় মণিপুরের রাজকুমারী হরিশেশ্বরী সঙ্গে এনেছিলেন পুরোহিত, সেবক, গায়ক, খোল বাদক ও রাজকুমারীর অনুচরদের। ত্রিপুরার রাজা তাদের সবাইকেই রাজবাড়ির আশেপাশে বসতি গড়ে দেন।
শেরামদা আবারো মজা করে বলে ওঠলেন, তাদের মধ্যে বীরমঙ্গল সিংহের পূর্ব পুরুষও ছিলেন। এবার বুঝলেন তো হামিদ! বীরমঙ্গল সিংহ ঠাট্টাটা গায়ে লাগালেন না, তিনি তার মতো বলে চললেন, হরিশেশ্বরীর পরও অনেক মণিপুরি রাজকন্যাকে পরবর্তীকালের মণিপুরের অনেক রাজপুত্র বিয়ে করে নিয়ে আসেন ত্রিপুরায়। আর মণিপুরি রাজকন্যারা তো একা আসতেন না। সঙ্গে নিয়ে আসতেন বিরাট দলবল। আর, মণিপুরি রাজকন্যারা তো শুধু রানীই হননি, তাদের সন্তানরা পরবর্তীকালে সিংহাসনেও অধিষ্ঠিত হয়েছে। এভাবেই ধীরে ধীরে ত্রিপুরা রাজপরিবারে মণিপুরি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে। রাজ-পরিবারে প্রচলন হয় মণিপুরি ভাষা। মণিপুরি সংস্কৃতিও ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যজুড়ে। রাস উৎসবের কথা তো বললামই, মণিপুরি নৃত্য শিক্ষাও চালু হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু এই ত্রিপুরা রাজবাড়ি থেকেই মণিপুরি নৃত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনি এ-নৃত্য দেখে এতোটাই মুগ্ধ হন যে, মণিপুরি নৃত্যকে নিয়ে যান শান্তিনিকেতন। সেখানে এ নৃত্যশিক্ষার প্রচলন করেন। জানি না, রবীন্দ্রনাথ মণিপুরি নৃত্যকে এভাবে শান্তিনিকেতনে নিয়ে না গেলে, এ নৃত্য আজ এতোটা মহা-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা পেত কিনা। মণিপুরি নৃত্য প্রসারে ত্রিপুরার নৃত্যগুরুদের মতো রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাও বিশাল। তবে যে-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মণিপুরি নৃত্য প্রসারে এতো ভূমিকা রেখেছেন, তিনি নিজে কিন্তু মণিপুরে যাওয়ার সুযোগ পাননি বা তাকে যেতে দেয়া হয়নি।
তাই নাকি? কেন?
হ্যাঁ, এই একটা জায়গায় আপনি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও ভাগ্যবান, তাকে যেতে দেওয়া হয়নি মণিপুর আর আপনি সেখানে সাড়ম্বরে যাচ্ছেন কবিতা পাঠ করতে।
কে রবীন্দ্রনাথকে যেতে দিল না মণিপুর, বীরমঙ্গলদা? চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক