জীবনানন্দ দাশ
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ১৪
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০১৯
সত্যিই তো, বাংলার নিজস্ব সুরের ধারা এত বিশাল আর পলিপ্লাবিত যে, শুধু সে-সুরকে ধরেই তো আমরা বাংলার একটা আলাদা পরিচয় পৃথিবীর বুকে তুলে ধরতে পারতাম! সেই ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে শুরু করে কত আউল-বাউলের গান, জারি-সারি-ভাটিয়ালি-পল্লীগীতির অঞ্চলভেদে সুরের বৈভব, লালনের আধ্যাতিক ঐশ্বর্য, হাসনের রাজসিক সত্তা— যতই কথা হচ্ছিল পংকজ চক্রবর্তীর সঙ্গে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়েই চলছিল... সেই স্মৃতির আলোড়নের দোলায় হঠাৎ মনে হলো, আগরতলায় যেহেতু আবারো এসেছি, পংকজ চক্রবর্তীকে একবার কল দেয়া যায় না? কিন্তু কল যে দেব, আমার কাছে তো ভারতীয় সিম নেই। বিকেলে বাইরে গেলে হয়তো যোগাড় করা যাবে। কিন্তু সিমই কি শেষ কথা? মোবাইলের নাম্বার! ২০১৬ সালের আগরতলার সে-ভ্রমণের পর তো আমার মোবাইল সেট ঢাকায় হারিয়ে ফেলেছি। পংকজদার নাম্বার কি এখনকার সেটে রয়েছে?
আমার সন্দেহই সঠিক হলো। নাম্বারটা মোবাইলে সেভ নেই। আমি যখন পংকজ চক্রবর্তীর নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে হয়রান জান লবেজান অবস্থা, ঠিক সে-সময়ই লাঞ্চ সেরে রুমে ফিরে এলো পুলিন রায়, মোবাইলে কোন্ পরম আত্মীয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে। ওর কথা বলা যেন ফুরাবেই না কোনো-কালে। বসা থেকে একেবারে বিছানায় শুয়েই পড়লো। শুয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে হারিয়ে গেল পুরোপুরি কথার চক্করে। এক সময় না এক সময় তো সবকিছুরই একটা সমাপ্তি থাকে। পুলিনেরও কথা বলা শেষ হলো। অমনি আমি ঝাঁকিয়ে ধরি, কার সঙ্গে কথা বললে? কবির গোপন প্রেরণাদাত্রী নাকি?
আরে না! আমার কবিতা লেখার আলাদা কোনো প্রেরণাদাত্রী নাই।
বললেই হলো! সবারই তো থাকে, সব কবির! এই দেখো নিতাইদারও ছিল। আমি নিতাই সেনের স্মৃতির খেরোখাতা বই থেকে সখিনা-অংশটা ওকে দেখাই। পুলিন বইটা টেনে নিল নিজ হাতে। চট করে লেখাটায় চোখ বুলিয়ে বললো, যে-বয়সে আমার মেয়েদের দিকে তাকানোর কথা, সে-বয়সেই বন্ধু আমার বাপটা মারা যায়। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। বুঝো কী অবস্থা। বাপ-মায়ের বড় ছেলে বলে সংসারের হাল ধরতে হলো। কবিতা লেখার কথাটা তখন মাথায়ই আসিনি। কঠিন এক জীবনসংগ্রামে জড়িয়ে পড়ি। বলতে পারো এই জীবনসংগ্রামই আমার কবিতা লেখার প্রেরণা।
তাই? জীবনসংগ্রামই কবিতা লেখার প্রেরণা?
হাঁ, বন্ধু! যে স্ট্রাগল আমি জীবনে করেছি, কল্পনাও করতে পারবা না। অনেক কষ্ট করে পয়সা জুটিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিই। পাশও করি। কিন্তু টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারলাম না। ছোটো ভাইবোনগুলোকে তো মানুষ করতে হবে! ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রোজগারে নামলাম। কী কাজ জানো? মানুষের ক্ষেতের কাজ করা। অর্থাৎ কামলা দেয়া, কামলাগিরি। তারপর আরো কত ধরনের যে কাজ আমাকে করতে হয়েছে! মাছ মেরে বাজারে বিক্রি করতাম। ধানচালের ব্যবসা করতাম। এই ধানচালের ব্যবসার সময়ই ক-বছর পর প্রাইভেটে দিলাম এইচএসসি পরীক্ষা। ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশও করলাম। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে ভর্তি হলাম এমসি কলেজে। এ-সময়ই শুরু করি টিউশনি। বন্ধু কয়টা টিউশনি করতাম জানো? আটটা নয়টা। নিজের পড়ালেখার খরচ, ছোট ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ, তারপর সংসার চালানো। কী যে জীবন গেছে আমার। তবু কখনো হাল ছাড়িনি। জীবনের এ-পর্বেই জড়াই পলিটিক্সের সঙ্গে। ছাত্র ইউনিয়ন করা শুরু করলাম। প্রগতিশীল মানুষদের সান্নিধ্যে আসি। সর্বজনশ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী শফিউদ্দিন আহমেদ স্যারের স্নেহ লাভ করি। তারই প্রেরণায় বলতে পারো কবিতা লেখার সূচনা— সমাজের কথা ভেবে, মানুষের কথা ভেবে। কবিতা লিখতে লিখতেই লিটল ম্যাগ আন্দোলনে জড়াই। লিটল ম্যাগ আমার সত্তার অংশ বলতে পারো। পরে আমি নিজেই বের করি ভাস্কর। আজ আমার সম্পাদিত ভাস্করের কবি দিলওয়ার সংখ্যা সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। এটা যে আমার জন্য কী গর্বের ব্যাপার। সে শুধু আমিই বুঝি। তুমি যে প্রেরণা পাওয়ার কথা বলছো, সেই নারী নিয়ে ভাবনা করার সুযোগই আসেনি জীবনে! এ-নিয়ে আমার মনে কোনো খেদও নাই। আজ আমি একজন সরকারি শিক্ষা কর্মকর্তা। এতদূর এসেছি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়।
একটানা কথাগুলো বলে চুপ হয়ে যায় পুলিন রায়। আমারো মুখে কোনো কথা জোগায় না। আমি অকালে বাপ হারাইনি, আমাকে ওর মতো কঠিন জীবনসংগ্রামেরও মুখোমুখি হতে হয়নি! কিন্তু আমার জীবনও কি সুখের স্বর্গ ছিল? আমি নিজের দিকে তাকাই, নিজের অতীতের দিকে। এবং তাকিয়ে আঁতকে উঠি। আমার হৃদয়ে দেখি কত কালশিটে দাগ পড়ে আছে! স্মৃতি সপাং সপাং আমার পিঠে বেত্রাঘাত শুরু করে, স্মৃতি আমাকে লাথি দেয় মুখে, আমার নাক ভেঙে দেয় স্মৃতি, আমার সমস্ত কুয়াশা ভরা রক্ত, আমার সমস্ত মেঘ ভরা অশ্রুকণা, আমার সমস্ত বসন্তের পাপড়িগুলো রক্তেভেজা— নাক দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়া রক্তে! রক্ত দেখেও থামে না স্মৃতির নিষ্ঠুরতা। স্মৃতি আমাকে কান ধরে ওঠবস করায়। আমি পুলিনের সামনে আর বসে থাকতে পারি না। ছুটে যাই বাথরুমে। অঞ্জলি ভরে নিই সমুদ্রের ফেনা। মুখের ওপর চোখের ওপর ঝাপটে দেই সেই অহিফেন সফেন।
রুমে ফিরে এসে আর পুলিনের সঙ্গে কথা বলি না। কথা বলার ইচ্ছেও হয় না। আমার বেডের পাশে জানালা নেই। জানালাটা পুলিনের বেডের ওপর। আমি সেই জানালাহীন বেডেই শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে পুলিনের মতো পা দোলাতে দোলাতে ভাবনার অতলান্ত জগতে তলিয়ে যাই। নিতাই সেন একভাবে কবি হওয়ার অনুভাব পেয়েছে, পুলিন রায় আরেকভাবে, এ কে শেরাম-এরও কাব্যভুবন অন্য। চিন্ময় গুহের ঘুমের দরজা ঠেলে-তে পাই ফরাসী কবি য়্যাজন গিলভিক নিরাবেগ কথনে কবিতায় ছড়িয়ে দিতেন অসহনীয় এক যন্ত্রণা। কেননা, ছোটবেলায় গিলভিক পাননি নিষ্ঠুর মায়ের ভালোবাসা। গিলভিকের কবিতা ‘আমি হই হট্টগোলের মধ্যে ছিলাম/প্রত্যেকবার গর্ত খোঁড়ার আওয়াজ/ আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে/আমি কান্নার জন্য অপেক্ষমান/নতুন করে শুরু করার জন্য/নিস্তব্ধতায় ফিরে যাওয়ার জন্য (হট্টগোল/য়্যাজন গিলভিক/অনুবাদ চিন্ময় গুহ)
আসলে আমরা আমাদের নিজস্ব আমিত্বকেই যার যার নিজস্ব ভাষায় কবিতায় কবিতায় অনুবাদ করে চলি। রবীন্দ্রনাথের আমিত্ব রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়, ‘আমি এলেম, ভাঙল তোমার ঘুম/শূন্যে শূন্যে ফুটলো আলোর আনন্দকুসুম।’ নজরুলের আমিত্ব নজরুলের ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ, ‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না/বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত!’ আবার জীবনানন্দের আমিত্বের স্বরূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন, বাংলার রূপসী স্নিগ্ধ-জালে জড়ানো, ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও— আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব/দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে/দেখিব খয়েরী ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে/ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে/নেচে চলে একবার দুইবার তারপর হঠাৎ।
ওদিকে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের আমিত্ব সহসাই প্রগলভ হয়ে ওঠে, ‘সে ভুলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে/আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না’। আর বুদ্ধদেব বসুর আমিত্বের স্বর রোমান্টিক-সহজাত। চিল্কায় সকাল-এ যেমন, ‘কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়/কেমন করে বলি? কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,/যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ তান/ দিগন্ত থেকে দিগন্তে;
আমাদের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের আমিত্বও পাইয়ে দিয়েছে তাদের দুজনকেই চিরকালের নিজস্ব কাব্যভাষা। কবিতা তাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, নাকি আমিত্ব তাড়িয়ে বেড়িয়েছে কবিতা লিখতে! সে এক অমীমাংসিত ব্যাপার! আমিত্বের এমন প্রস্রবণ কতোবার ঝরেছে শামসুর রাহমানে, ‘আমিও একদা পড়েছি ঝাঁপিয়ে অন্তহীন/নীলিমায়, কতদিন মেঘের প্রাসাদে/কাটিয়েছি মায়াবী প্রহর/আমি আশ্চর্যের যুবরাজ!’ আর আল মাহমুদ তার সমস্ত আমিত্ব ঢেলে দিতে চান নারীর কাছে, ‘আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাসের ফল?/গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী/কোথায় রেখেছ বলো মহুয়ার মাটির বোতল’। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আমিত্ব আবার ত্যাড়া খাড়া রুখা হয়ে হঠাৎ যেন ঘাড় বাঁকিয়ে হাঁক দিয়ে ওঠে, ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে, ফিরিয়ে নে!’ অন্যদিকে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের আমিত্ব খেলা করে যেন নিজের অসহায়ত্ব বোধ নিয়ে, ‘আমি একটু অন্য রকম পেখম মেলার ইচ্ছে রাখি/বুকে আমার একটুখানি অন্য রকম জখম আছে।’
তবে কবির এই আমিত্ব কি শুধুই নিজের আত্মবিবরে হাঁটা? বোধহয় না, একেবারেই না, জীবনানন্দও স্বীকার করে নেন, ‘আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে/আমি থামি, সেও থেমে যায়।’ সে কবির সাথে হাঁটুক বা নাই হাঁটুক, থামুক বা নাই থামুক, কবি সেসব তোয়াক্কা করেন না, কবি তার আমিত্বের জোরে নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলে চলেন, শব্দ গড়েন, কবিতাভাস্কর্য নির্মাণ করেন। এক একজন কবিকে ঘিরে আমিত্বের ঘটতে থাকে নতুন বিস্ফোরণ। তবে সংকটটা তৈরি হয়, একজন কবি যখন আমিত্বটা তার কবিতায় না ছড়িয়ে শুধু ব্যক্তিচরিত্রে লালন করতে চান, ভয়াবহ হয়ে ওঠে তার সত্তা অহংবোধের চরম গরিমায়। দুঃখজনক যে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অধিকাংশ কবিই ভোগছেন সেই মনোবিকারে। তাদের ভয়াবহতম আমিত্ব তাদেরকে অন্ধ বানিয়ে ছেড়েছে! তারা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পান না, কাউকে না। আত্মমুগ্ধ একেকজন যেন মূঢ় আত্মপ্রবঞ্চক! চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক