২০০৪ সালে শিলংয়ে লেখকপুত্র অনির্বাণ কায়সার
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ১০
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুলাই ০৮, ২০১৯
হ্যাঁ, সেবারকার সে-ভ্রমণে আমরা প্রথমেই উঠেছিলাম শিলং ক্লাবে। সেখানে দুদিন থাকতে না থাকতেই আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া আত্মীয়দম্পতি এখানে বেশি টাকা নেয়, এই ওজর দেখিয়ে পুলিশবাজারের একটা হোটেলে নিয়ে যেতে বাধ্য করালো। তো, সেটা যে প্রকৃতিরই নির্দেশে হয়েছিল বুঝলাম পরদিন পড়ন্ত দুপুরবেলা। হোটেল-কক্ষের সেই দোতলা বারান্দা থেকে হঠাৎ আমার চোখ পড়লো রাস্তার অপরদিকের ইন্ডিয়ান ট্যুরিজমের শিলং অফিসের সাইনবোর্ডের দিকে। ভাবলাম, যদি ওখান থেকে শিলংয়ের ওপর কোনো স্যুভেনির সংগ্রহ করা যায় মন্দ কি! সে আশাতেই ছুটে গেলাম একা একা।
অফিসে প্রবেশমাত্র সামনে বসা অল্প-বয়স্ক ছেলেটিকে যখন পরিষ্কার বাংলায় শিলংয়ের ওপর কোনো স্যুভেনির আছে কিনা জিজ্ঞেস করছি, অমনি ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ছিপছিপে শরীরের এক সুদর্শন ভদ্রলোক। ফর্সা, কোঁকড়া চুল। আমাদের ঢাকার বাংলার চেয়েও আত্মিক বাংলায় বলে উঠলেন, আপনি কি ঢাকা থেইকা আইছেন নাকি? ব্যস, অপরিচয়ের বাতারাবরণ নিমিষেই চুরমার হয়ে গেল। ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম শিলং শাখার তৎকালিন ডিরেক্টর শঙ্খ শুভ্র দেববর্মণ আমাকে আপন করে নিতে এতটুকুও দেরি করলেন না। ভেতরে সাজানো-গোছানো তার অফিস-কক্ষে বসিয়ে চা তো খাওয়ালেনই, নিজের পরিচয়ও জানালেন, উহু, ইন্ডিয়ান ট্যুরিজমের বড় কর্মকর্তার নয়— কবি তিনি, কল্পনার অধীশ্বর, অমৃতের রাজপুত্র! জানতে চাইলেন ঢাকাইয়া কবিদের কে কেমন আছে তার খোঁজ!
তারপর কী শুধু শিলং! ভারতের যতগুলো রাজ্য আছে, আছে যত দ্রষ্টব্য স্থান— সবগুলোর ওপর এক একটা আলাদা আলাদা রঙিন মোড়কের স্যুভেনির আর ম্যাপ তুলে দিতে লাগলেন শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ আমার হাতে। আমি এক একটা দেখি আর আমার মনের ভেতর তৈরি হয় তীব্র এক ঘোর। বিশেষত সেভেন সিস্টারের ছবিগুলো দেখে— ইম্ফল, আইজল, কোহিমা— মনে হতে লাগলো, শৈশবে পড়া রূপকথার দেশ যেন এক-একটা— যেখানে মায়াপুরি আছে, যক্ষের ধন সামলে রাখে দেওদানো। পরিরা উড়ে বেড়ায় ফুলের বেশে! আবার সেই ইম্ফল, মণিপুরের ইম্ফল নতুন করে তৈরি করলো মায়াব্যঞ্জনা। কী যেন একটা আছে ইম্ফল নামটার ভেতর! কি? চঞ্চল বালিকার সপ্রতিভতার সঙ্গে গম্ভীর সুন্দরী নারীর ব্যক্তিত্বের সবটুকু মাধুর্যের অপূর্ব মিশেল! সেই স্যুভেনিরে ইম্ফল শহরের একটা ছবিও ছিল, পাহাড়ের বাঁকে দাঁড়ানো এক আদিবাসী মায়াময় নারী চোখের ভেতর রাজ্যের আমন্ত্রণ ছড়িয়ে লাস্যময় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সেই ছবির নারীর কাছেই যেন আবারো প্রতিশ্রুতবদ্ধ হলাম— ইম্ফল আমি যাবই যাব।
সে-যাওয়াটা যে এতো সহজেই হয়ে যাবে, কে জানতো? ছ-সাত বছর আগে ফেসবুকে কবি শিহাব শাহরিয়ারের ইম্ফল ভ্রমণের ছবি দেখে, ওর সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র খেদ করে বলেছিলাম, আমার স্বপ্নকুমারীর সঙ্গে দেখা করে এলেন আপনি? আমি যে ঈর্ষায় মরছি!
শিহাব শাহরিয়ার তখন শুধু ওর স্বভাবমতো ভঙ্গিতে জানতে চেয়েছিল, ‘যাবেন আপনি ইম্ফলে?’ সেই জিজ্ঞাসাটা যে শুধু গলা থেকে উচ্চারিত হয়নি, হৃদয়ের অন্তস্থল থেকেই ওঠে এসেছিল, এ কে শেরাম-এর সঙ্গে ভারতীয় বর্ডারে প্রবেশ করতে করতে তা আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম। ভারতীয় ইমিগ্রেশন সেন্টারটি এখানে বেশ বড় আর খোলামেলা। সে-তুলনায় লোকজন একেবারেই কম। দেখলেই শান্তি শান্তি। বেনাপোল সীমান্তের মতো হট্টগোলের বাজার নয়। প্রতিদিন ওই বর্ডার দিয়ে এতো বেশি লোকজন আসা-যাওয়া করে যে, মানুষকে লাইন ধরে দাঁড়াতে হয়। বিএসএফ-এর লোকজন সুযোগ পেলেই দুর্ব্যবহার করে আর উপরির অত্যাচার তো রয়েছেই। বাংলাদেশ বর্ডারে দিতে হয় একশো টাকা। ইন্ডিয়ান বর্ডারেও দিতে হয় একশো টাকা। তাহলে কেউ ব্যাগট্যাগ ছুঁয়েও দেখবে না। আর যদি এ-টাকাটা না দেওয়া হলো, তারপরই দেখো কত চান্সে তোমাকে নাকাল করার পায়তারা চলছে, হয়রানির কোনো শেষ নেই।
তবে এই আগরতলা বর্ডারেও একজন মহিলার ব্যবহার অতি কর্কশ মনে হলো। তিনি এ কে শেরাম-এর মতো প্রবীণ শ্রদ্ধাভাজনকেও অনেক জেরাজেরবার করলেন। পুলিন রায়কে তো পুরোই নাকাল বানিয়ে ছাড়লেন। পুলিন ভিসা করে আসেনি। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এনওসি নিয়ে এসেছে। সেসব কাগজপত্র নিয়েই বাঁধলো ঝামেলা। আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে ভদ্রমহিলা পুলিনের কাগজ নিয়ে ভেতরে যেন কার সঙ্গে কথা বলতে চলে গেলেন। ফিরলেন প্রায় পনেরো মিনিট পর। অবশেষে পুলিন পার পেল, কবি নিতাই সেনেরও হয়ে গেল সহজে। এরপর এলো আমার পালা। ভাগ্য ভালো যে, ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে কোনো রকমের ঝুট-ঝামেলা করলেন না। ঝটপটই হলো আমার কাজকর্ম।
তবে, ডাকসাইটে ভদ্রমহিলা কোনোরকম ঝুট-ঝামেলা না করলে কী হবে, আমি নিজে-নিজেই পাকিয়ে ফেললাম এক মহা-ভজঘট। হয়েছে কী, ইমিগ্রেশনের পাট চুকিয়ে এ কে শেরাম, নিতাই সেন, পুলিন রায় তিনজনই কাস্টমস-এর পর্বও দ্রুত সেরে সামনের দিকে মিলিয়ে গেলেন। সর্বশেষজন হিসেবে আমি যখন কাস্টমস-এর ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়ালাম, তিনি শুরু করলেন বিলম্বিত লয়ের ডিউটি। কী একটা কাগজ ঠিকঠাক করতে বেশ সময় নিলেন। তারপর শুরু করলেন আমার এন্ট্রি নেওয়া। এন্ট্রির কাজ শেষ হতেই আমি প্রায় দৌড়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে! দেখি যে আমার সঙ্গী তিনকবির একজনও নেই। সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে চারদিক খুঁজলাম। নেই তো নেই, হাওয়া। তাহলে কি ওরা ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বেরিয়ে গেছেন? বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য? ইস! সত্যিই আমি এক লেট-মাস্টার! কোনো কাজই সময়মতো করতে পারি না। চোখের সামনে ভেসে ওঠলো ওরা তিনজন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে আর ঘন ঘন হাতের ঘড়ি দেখছে, হাতের তো নয়, মোবাইলের ঘড়ি। এখন তো সব মোবাইলকেন্দ্রিক। মনে মনে লজ্জিত হয়ে বিএসএফ কর্মীকে পাসপোর্টখানা দেখিয়ে ইমিগ্রেশন ভবন থেকে যাকে বলে ঝড়ো গতিতে বের হয়ে মেইন গেট পেরিয়ে একেবারে বাইরে এসে দাঁড়ালাম, মানে পৌঁছে গেলাম সোজা কথা আগরতলায়।
আগরতলা তো পৌঁছালাম, কিন্তু কবিত্রয় কোথায়? কোথায় শেরামদা, নিতাইদা, পুলিন রায়? ওদের টিকিটিরও দেখা নেই। দুপুরের নির্জনতায় জায়গাটা খাঁ খাঁ ফাঁকা। রাস্তার উলটোদিকে শুধু দুজন স্কুটারওয়ালা দুটি স্কুটার পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আমাকে বাক্সপ্যাটরাসহ দেখেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো। চলে আসুন দাদা। কোথায় যাবেন? আমার কী আর কানে যায় ওদের কথা! আমি তখন আতংকিত! আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কি শেষে ধৈর্য হারিয়ে ওরা আমাকে ফেলেই চলে গেলেন আগরতলা? মনে মনে এমন আশংকাও উদয় হলো। শেষে আর থাকতে না পেরে স্কুটারওয়ালাদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠলাম, আচ্ছা, আপনারা কি তিনজন মানুষকে একটু আগে একসঙ্গে বেরোতে দেখেছেন? দুই ড্রাইভারই জানালো, না, তারা একসঙ্গে তিনজন কাউকে বেরিয়ে আসতে দেখেনি।
তাই তো, কেন বেরিয়ে আসবে? তারা আমাকে একা বর্ডারে ফেলে কেন চলে যাবে আগরতলা? এমন একটা ভাবনা কেন আমার মনের মধ্যে এলো— আমি নিজেই নিজেকে ধমকাই। হাজার হলেও ওরা কবি। ব্যবসায়ি না। ব্যবসায়ি হলে না-হয় কথা ছিল, আমাকে ফেলেই চলে যেতো। চলে যেতে পারতো। কিন্তু, কবি কি কখনো কবিকে ফেলে যেতে পারে? কবি কি ছেড়ে যেতে পারে কখনো কবিকে? “আসলে ছেড়ে যায় সবাই। ছাড়ে সবকিছু। শুধু ছেড়ে যায় না স্বপ্ন। কাঁচা, পাকা, আধাখেঁচড়া কোনো স্বপ্নই ছেড়ে যায় না শেষমেশ। তবে ছেঁড়ে। ছিঁড়ে যায়। সবকিছু ছিঁড়ে যেতে থাকে। মানুষের স্বপ্নও ছিঁড়ে যায়। ময়লা লাগে সূতিবস্ত্রে। ঘামে ভেজে। শুকোয়। সূতোয় গন্ধ লেগে থাকে সময়ের। চিতি পড়ে। চিতির দাগ সহজে ওঠে না। আস্তে আস্তে ফেঁসে যায়। ফেঁসে ফেড়ে যায় সবকিছু। ছিঁড়ে যায় মন, মানুষ, মানুষের প্রেম। কবিতার স্বপ্ন বড়ো নাছোড়। আসলে এক স্বপ্নের খপ্পর থেকে আরেক স্বপ্নের খপ্পরে চালান হয়ে যাচ্ছিলাম তখন আমি। যাচ্ছি, ব্রিজের উপর দিয়ে— এক স্লিপার থেকে আরেক স্লিপারে পা রেখে, যাচ্ছি, উন্মোচনের পথ পেরিয়ে ইশকুলে। নিচে তাকাবার ঝুঁকিটা মোটেও কম ছিলো না। নিচে তাকালেই সর্বনাশ! আশু বলতো, এই দেখবি, নিচে তাকাবি না। সোজা হেঁটে যা। একদম নাক বরাবর। নিচে তাকাবি কি মাথা ঘুরে পড়বি।
আশু, আশুতোষ ভৌমিক, আমার বাল্যবন্ধু। লিখতো আশু, পড়তাম আমি। আশু কবি, আমি পাঠক। দু-হাতে কবিতা লিখে ক্লাশের খাতা ভরে ফেলতো এক কিশোর আর সেই আবোলতাবোল কবিতার আগ্রহী পাঠক হয়ে আরো বেশি এলেবেলে ঘুরে বেড়াতো সমবয়সী আরেক কিশোর। বলা চলে, প্রচণ্ড রহস্যকাতর অল্প বয়সের এক প্রচণ্ডতর কবিতাপ্রেম আরেক অল্পবয়স্ক কবিকে আমার প্রতি ভীষণ বন্ধুবৎসল করে তুলেছিলো। অন্যভাবে বললে বলা যায়, কবিতা তার অসম্ভব সুন্দর ও চালাক আঙুলের ইশারায় একবয়সী অনেক বালকের মধ্য থেকে নিষ্ঠুর কায়দায় আলাদা পথে ডেকে নিয়ে যাচ্ছিলো দুটি বালককে (কবিতার স্বপ্ন/আবিদ আজাদ)।
আশু, আশুতোষ ভৌমিক কখনো ছেড়ে যায়নি বলেই শেষাবধি কবি হতে পেরেছিলেন আবিদ আজাদ, তোমাদের উঠোনে কি বৃষ্টি নামে? রেলগাড়ি থামে-র কবি আবিদ আজাদ। কবি কখনো কবিকে ছেড়ে যেতে পারে না। আমারো বিশ্বাস। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক