ছবিতে বাঁ দিক থেকে কবি দেবব্রত সেন, হামিদ কায়সার, কবি পুলিন রায়, কবি নিতাই সেন, কবি এ কে শেরাম এবং কবি জয়দুল হোসেন
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ৯
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুলাই ০১, ২০১৯
বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজে ভিজেই দৌড়ে উঠে গেলাম বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন সেন্টারের বারান্দায়। কবি এ কে শেরামকে আলিঙ্গনে বেঁধে ফেললাম। এই মানুষটার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। জানতেন না, চিনতেন না, অথচ কত সহজেই তিনি আমার বন্ধু কবি শিহাব শাহরিয়ারের প্রস্তাব শোনামাত্র আমাকে তার সঙ্গে মণিপুর নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছেন। শুধু কী সম্মত! যখনই ঠিক হলো আমি মণিপুর যাচ্ছি, তারপর থেকে নিয়মিত কল করে আপডেট জানাতেন। পাসপোর্ট আর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি পাঠান, বিমানের টিকিট কাটার জন্য লাগবে। আপনার কবিতা পাঠান অনেকগুলো। ওখানে পাঠের জন্য মণিপুরী ভাষায় অনুবাদ করা লাগবে। তারপর নিজে-নিজেই তিনি আমার তিনটি কবিতার অনুবাদ পর্যন্ত করে রেখেছেন। এই যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শুভ্রতার আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছেন, এমনই নাকি তার স্বভাব! অন্যের জন্য উৎসর্গকৃত জীবন। স্বভাবতই তার ওপর কিছু সামাজিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। তিনি সিলেট জেলার উদীচী সভাপতি। এছাড়াও আরো অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত।
এ কে শেরামের আড়ালে অনন্ত কুমার শেরাম সিলেটের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতের অত্যন্ত সমীহ জাগানিয়া এক নাম। বাংলাদেশের মণিপুরী সম্প্রদায় এবং ভারতের মণিপুর রাজ্যের সাহিত্য-সংস্কৃতি মহলেও অতি নমস্য। মণিপুরের কবিরা এবার রাজধানী ইম্ফলে ২৮ জুলাই পালন করতে যাচ্ছে পোয়েট্রি ডে উৎসব। সেদিন সেই বর্ণিল মুখরতায় তাকে প্রদান করা হবে মহাকবি হিজাম অঙাংহল অ্যাওয়ার্ড। সে-উপলক্ষেই আমরা, মানে কবি নিতাই সেন, সিলেটের কবি পুলিন রায় এবং আমি— তার সফরসঙ্গী হয়ে ইম্ফল যাচ্ছি। অবশ্য আমরা সে কবিতা উৎসবের আমন্ত্রিত কবিও।
এই আত্মকেন্দ্রিকতার যুগে এ কে শেরামের মতো মানুষের সান্নিধ্য-লাভ দুর্লভ প্রাপ্তিই বটে। কবি শিহাব শাহরিয়ার যথার্থই বলেছেন, অপু! আপনি শেরামদাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন ইম্ফল যেতে, এটা আপনার সৌভাগ্য। কথাটা যে কত সত্যি, সে আমি প্রথম দেখাতেই উপলব্ধি করলাম। তিনি যেন মাথার ওপরকার ছায়া। এমন গাঢ় অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে আমার পাসপোর্ট দেখলেন, ইমিগ্রেশনের কাগজটায় কী করবো না-করবো কোথায় কী লিখবো পরম যত্নে বুঝিয়ে দিলেন। ইমিগ্রেশন ফরম ফিলাপ করার সময়ই পরিচয় হলো আমার ইম্ফলযাত্রার আরেক সঙ্গীর সাথে। যিনি কবি এ কে শেরামের সঙ্গে ট্রেনে সিলেট থেকে এসেছেন। তিনি আমার দিকে উষ্ণতর হাত প্রসারিত করে বললেন, আমি লিটল ম্যাগাজিন ভাস্কর সম্পাদক পুলিন রায়।
আমি আমার প্রায় সমবয়সী মানুষটার দিকে অবাক চোখে তাকাই। যিনি তার নামের আগে পরিচয় দিয়েছেন তার কর্মসম্পদের। পুলিন রায়ের আগে বলেছেন ভাস্করের কথা। তার জাত তো ভিন্ন! হ্যাঁ, লিটল ম্যাগওয়ালাদের মধ্যে আমি দু-জাতের মানুষ পেয়েছি। একজাতের মানুষের হৃদয় আকাশের মতো প্রসারিত। যারা সুন্দর একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন মানুষের সারা বিশ্বের। তারা মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক এবং সাচ্চা দেশপ্রেমিক। খ্যাতির মোহ নয়, অর্থের লিপ্সা নয়, পুরস্কারের জন্য কাঙালিপানা নয়— তারা বড় একটা আদর্শকে লালন করে সম্পৃক্ত হোন লিটলম্যাগ আন্দোলনে। সরকারি বা বড় প্রতিষ্ঠানের পেছনে দৌড়ান না— বরং প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতায় মেতে থাকেন চারিত্র্যিক দৃঢ়তার অহংকারে! এড়িয়ে চলেন বড়লোক বড় পদমর্যাদার কবি-সাহিত্যিক এবং ক্ষমতার বৃত্তকে! তারা আপন নিষ্ঠায় খুঁজে বেড়ান শ্যামল কিনারে কোনো প্রকৃত কবি আছেন কিনা। মাটির সান্নিধ্য থেকে তুলে আনেন পরম যত্নে অচেনা কোনো কথাশিল্পীকে। পরার্থেই ব্যয় হয় তাদের সমস্ত জীবন। নিজেরটা খেয়ে তাড়ান বনের মোষ।
আরেকদল লিটলম্যাগওয়ালার অস্তিত্ব আছে, যারা একটা লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে মেতে ওঠেন স্বার্থ-উদ্ধার-উন্মত্ত খেলায়। এদের হৃদয় হয় আক্ষরিক অর্থেই নর্দমার কাদা, সেখানে ঈর্ষা-পোকা থিকথিক করে। যারা তার সময়ে ভালো লিখছেন, তাদেরকে মোটেও সহ্য করতে পারেন না। দূর থেকে গালাগালি তো আছেই, সামনে পেলে গোলাগুলি করতেও ছাড়েন না! কীভাবে অপমান করবেন, তার ফিকির খুঁজে বেড়ান। বডিল্যাঙ্গুয়েজে জানিয়ে দিতে চান, তোমার তো কোনোদিন নামই শুনিনি। তুমি কে হে সাধু? এরা আপন স্বার্থে কূপমণ্ডুকদের নিয়ে দল গড়েন, নোংরাকাদায় খাবি খেতে খেতে গোষ্ঠিবদ্ধ হন। পরস্পর করেন পিঠ চাপড়াচাপড়ি! বাইরে ভাব দেখান খুব আদর্শবান, কিন্তু লিটলম্যাগটা প্রকাশমাত্রই দৌড়ে ছুটে যান— যদি থাকেন ঢাকার বাইরে তাহলে ডিসি, পুলিশ সুপার, স্থানীয় এমপির কাছে, তারপর সেই ছবি ফেসবুকে জুড়ে দিতেও এদের বাধে না। আর যদি সেই লিটলম্যাগওয়ালার বাস হয় ঢাকা শহরে, তাহলে তো কথাই নেই! লেজ নাড়াতে নাড়াতে ছোটেন কাস্টমসের কোনো লেখক আছেন কিনা তার কাছে! তারপর দাপিয়ে খুঁজে বেড়ানো কে আমলা লেখক বা কে ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা বা কার আছে বিশাল কোনো ব্যবসা বা কে বেশ ঘুষটুষ খেয়ে হম্বিতম্বিওয়ালা বা কে প্রভাবশালী কোন পত্রিকার হিরো-বাহাদুর বা পুলিশের অধস্তন কর্মকর্তা বা নিদেন কোনো মন্ত্রীর বউ অথবা অমুক পুরস্কার কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত— খুঁজো তাকে, তাকে পাকড়াও করো, তোষামোদের শিল্পে ভেজাও, রাখো আপ্লুত! হয় তার ওপর প্রকাশ করো বিশেষ একটা সংখ্যা বা ছাপাও তেল চুবচুবা বুকরিভিউ অথবা তার গোপন প্রেমিকার কবিতা ছাপিয়ে দাও সুঅলংকরণসমেত! তারপর, খেলা দেখে যান বাবু! টাকা! পুরস্কার! গার্লফ্রেন্ড! কোনো কিছুরই অভাব নেই! আমাদের পুলিন রায়কে মনে হলো না কিছুতেই এ সম্প্রদায়ের— মনে হলো ভাস্কর ও প্রকাশ করে সাহিত্যের প্রতি নিঁখাদ ভালোবাসা বোধ থেকে। সে নিঃসন্দেহে প্রথমোক্ত শ্রেণির!
এ দু-শ্রেণির মাঝামাঝি যে আর কোনো শ্রেণি নেই, তা কিন্তু নয়। কেউ আধা ভালো, কেউ আধা মন্দ। কেউ ক্ষমতার বৃত্তে যায় না বটে, কিন্তু যা বের করে, তা কিছুতেই পাতে ওঠানোর জো থাকে না। কেউ আবার দু-তিনটে কবিতা লিখে আর চার-পাঁচটে লিটল ম্যাগের সংখ্যা বের করে এমন আত্মমুগ্ধ থাকে যে, কী বলবো! নার্সিসিজমের চূড়ান্ত! তার নামটা না নিলে কী গোস্বা!
বাংলাদেশ অংশের ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর আমরা কবি দেবব্রত সেন এবং কবি জয়দুল হোসেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নো-ম্যানস ল্যান্ডের দিকে হাঁটি। ভারতীয় সীমান্তে পা ফেলতেই নিজের ভেতর আমি কেমন এক রোমাঞ্চকর উত্তেজনা অনুভব করি। সত্যি সত্যি তাহলে আমার মণিপুর যাওয়া হচ্ছে? সত্যিই আমি তাহলে স্পর্শ করতে যাচ্ছি ইম্ফলের মাটি?
মানুষ চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের পাশের রাস্তায় হাঁটার আশায় ভেসে বেড়ায়, হাওয়াই দ্বীপে বসে সুরাপানের কথা ভাবে, ইস্তান্বুলের আলো-আঁধারির কোন ঘুপচিতে প্রেমিকার সাথে কফিপানের অভিলাষে মগ্ন থাকে, বুঁদ হয়ে থাকে আবেশে আফ্রিকার লায়নের সাথে সেলফি তোলার— আর, আমি কিনা শ্লা সেই কবে থেকে মনের ভেতর বয়ে বেড়াচ্ছি ইম্ফল যাওয়ার স্বপ্ন! কবে থেকে সেটা?
বিশ-একুশ বছর তো হবেই। তারও বেশি হতে পারে! থোকচাম মণিহারের চলতে চলতে বইটা আমি কবে কিনেছিলাম? যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন? নাকি ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে আসার পর যখন চাকরিতে ঢুকেছি— সে-সময়? যখনই কিনে থাকি, সে-বইটা পড়ার পর থেকেই ইম্ফলকে ঘিরে আমার মনের মধ্যে তৈরি হয়ে থাকবে ভীষণ মোহগ্রস্ততা। সাহিত্য প্রকাশ থেকে বেরোনো সে-বইটা খুবই সুখপাঠ্য। ভারি অকপট তিনি, থোকচাম মণিহার। বলতে গেলে লুকাননি কিছুই। কী করে মেয়ের পর মেয়ে এসেছে জীবনে বলেছেন দ্বিধাহীনচিত্তে। সে-কারণেই যে বইটি পড়ে ভালো লেগেছে এটা বললে আমার প্রতি যেমন অবিচার করা হবে, লেখকের প্রতিও তীব্র অন্যায় হবে। আসলে বইটার মূল শক্তি অসাধারণ বর্ণনাগুণ আর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। সেই সঙ্গে রয়েছে বৈচিত্র্যময় ঘটনাপ্রবাহ। থোকচাম মণিহার এখন বোধহয় কানাডায় থাকেন। তিনি মণিপুরের মানুষ হিসেবে পরিচিত হলেও, আদতে ছিলেন বাংলাদেশেরই একজন। সিলেটের কুলাউড়ায় ছিল তার মূল শেকড়। এখানে কাটে দুরন্ত শৈশব আর অবাধ্য যৌবন। এরপর একাত্তর সালের পটপরিবর্তনের পর একদিন করিমগঞ্জ হয়ে পাড়ি জমান মণিপুর। পরে সেখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা বনে যান। পরে মণিপুর থেকে লন্ডন। লন্ডন থেকে কখনো একা কখনো বা তার জোর-ভাগ্যের বরাতে বান্ধবীসমেত চষে বেড়িয়েছেন পুরো ইউরোপ! সে এক জাফরিকাটা বর্ণাঢ্যতা, মুগ্ধকর বাউন্ডুলেমি! পড়ে আমি শুধু থোকচাম মণিহারের ভক্ত হইনি, মণিপুরী সমাজটার প্রতিও তৈরি হয়েছে ঘোর মায়ামুগ্ধতা!
পরে এই মায়ামুগ্ধতা প্রগাঢ় হয়, ষোলো-সতেরো বছর আগে শিলং ভ্রমণকালে। সেও আর এক রংধনু আবিলতা। স্ত্রী-পুত্র ছত্রছায়ায় সেবারকার সেই শিলং ভ্রমণে গিয়ে যে শুধু চেরাপুঞ্জির মেঘপ্লাবিত পাহাড়িঅরণ্যের বিশাল চিত্রপটই লাভ করেছি, তা নয়, গভীর তৃণভূমির দিগন্তবিস্তারি সঙ্গীতমঞ্জুরির পাশাপাশি দেখা মিলেছিল পরম স্বজন এক কবির! সেও এক প্রকৃতিরই যেন অমূল্য উপহার! চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক