আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম

পর্ব ৮

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জুন ২৪, ২০১৯

কবি নিতাই সেনের মাত্র দু-গজ সামনে অলৌকিক আনন্দের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কবি জয়দুল হোসেন! দেবব্রত সেন যে এত বড় একটা চমক উপহার দেবে, কে জানতো! বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিতাই সেন নিজের লেখালেখির মেন্টরের দিকে এগিয়ে যান। তাকে বুকের ভেতর আগলে ধরেন। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য চোখের সামনে রচিত হওয়ায় আমিও যেন কোন্ ভালোবাসার পৃথিবীতে হারিয়ে যাই! সে-এক অদ্ভুত অনুভূতি! মণিরত্নমের রোজা ছবির সেই গানের দৃশ্যটি যখন ভেসে ওঠেছিল পর্দায়। ওই যে নায়ক নায়িকার দু-চোখ থেকে দুহাত সরিয়ে ফেলতেই সামনে ভেসে ওঠলো শঙ্খশূভ্র রৌদ্রোজ্জ্বল বরফের পাহাড়! নায়িকা বিস্ময়ে অভিভূত! তারপর ঝর্ণাধারার সঙ্গে ঝাউবন, পাইনের সারি আর খোলা নীল আকাশ আর নারী শরীরের গোপন সৌন্দর্যময়তা, সঙ্গে সুরের হিরন্ময় ঐশ্বর্য— Yeh Haseen Waadiyaan Ye Khula Aasmaan/ Aa Gaye Hum Kahan Aye Mere Saajna/ In Bahaaron Mein Dil Ki Kali Khil Gayi/ Mujhko Tum Jo Mile Har Khushi Mil Gayi/ Tere Honthon Pe Hain Husn Ki Bijliyaan/ Tere Gaalon Pe Hain Zulf Ki Badliyaan/ Tere Baalon Ki Khushboo Se Mehke Chaman/ Sangmarmar Ke Jaisa Ye Tera Badan/ Meri Jaanejaan Ye Hai Teri Chaandni/ Chhed Do Tum Aaj Koi Pyaar Ki Raagini/ Ye Haseen Waadiyaan Ye Khula Aasmaan/ Aa Gaye Hum Kahan Ay Mere Saajna আর এর ভেতর দিয়েই গানের পৃথিবীর সাম্রাজ্য অধিকার করলেন এ আর রহমান।

তারও অনেক আগে এই রোজা-পর্বের, কৈশোর থেকে যৌবন-ব্রিজে ওঠার সময়, কবিতা পড়েই যে কী ভালো লাগা বোধের তীব্র আবেশ! মোহমুগ্ধকর লিরিক্যাল অনুভব! বুদ্ধদেব বসুর চিল্কার সকাল!

কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি?
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;
কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।
তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
স্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তাই দেখতে।
গাড়ি চলে গেল! কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি?

সারা ট্রেনযাত্রায় যে মানুষটির গল্প শোনলাম, কবি নিতাই সেনের স্মৃতির খেরোখাতায় যার কথা পড়লাম— তাকে জলজ্যান্ত চোখের সামনে উপস্থিত দেখে বিস্ময় আমারো কিছুতেই কমছিল না। পুরো মুখভর্তি কাচাপাকা গোফ-দাড়ি। চেহারায় ধ্যানীর সৌম্যতা। বয়স নিতাই সেনের কাছাকাছিই হবে— সত্তর কী পচাত্তর। তিনি তার পুরো জীবন লেখালেখির জন্যই উৎসর্গ করেছেন। বিশেষত কবিতার জন্য। কবিতা যত না লিখেছেন, তার সমান্তরাল তৈরি করেছেন অসংখ্য কবি।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবি নিতাই সেন আর জয়দুল হোসেনের কথা কোনোভাবেই ফুরাতে চায় না। আমার এবং দেবব্রত সেন দুজনের তাড়ায় অবশেষে আমাদের দলটি বর্ডারে যেতে উদ্যোগী হয়। কবি জয়দুল হোসেন তার প্রাইভেট কার নিয়ে এসেছেন। আমাদের সবাইকে সে-কারে ওঠার আহ্বান জানান। কারে ওঠার আগে আমি নিতাই সেনের কানে কানে বলে উঠি, এভাবে যদি সেই সখিনাকেও হঠাৎ পেয়ে যান আপনার সামনে, তখন কী হবে? হেসে উঠলেন নিতাই সেন। আর সেই হাসি উপচে তার মুখে ছড়িয়ে পড়লো কৈশোরদিনের রাঙা আলো। কারে বসতে বসতে শুধু বললেন, পেয়ে গেলে তো আর কবি হওয়া হতো না হামিদ! তাই না?

হুম। তা বটে! কবিকে অতৃপ্তির অনেক কাটায় ক্ষতাক্ত হতে হয়। জীবনের কাছ থেকে নিতে হয় প্রবল রক্তপাঠ! এসেনিন নিজেকে গুলি করেছিলেন, জীবনানন্দ পড়েন ট্রামচাপা, ভলতেয়ার হন বারবার নির্বাসিত, বোদলেয়ারকে পোহাতে হয় অকথ্য যন্ত্রণা, নজরুল মাথা ঠুকে মরেন লৌহ কপাটে!

আখাউড়া টু আগরতলা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবি জয়দুল হোসেনের কারে বসেও জয়দুল হোসেন আর নিতাই সেনের স্মৃতিচারণা চলতেই থাকে। দুজনই শেষ বয়সে পা ফেলেছেন, উচ্ছ্বাস স্বভাবতই কম, তা সত্ত্বে তারা যে এতদিন পর একত্রিত হতে পেরেছেন, সেজন্য একটা তৃপ্তির রোশনাই দুজনের চোখেমুখের ভাষায়ই ফুটে উঠেছে। তাদের দুজনের একজনও কি কেউ কস্মিনকালেও ভাবতে পেরেছিলেন, আবারো এই পৃথিবীতে দেখা হবে!

নিসর্গের ভেতর দিয়েই আমরা এগোতে থাকি বর্ডারের দিকে। দুপাশের সবুজ গাছপালা আমাদেরকে কর্ডন করে নিয়ে চলে। তবে এই নিসর্গ কতদিন থাকবে, সেটাই দেখার বিষয়। মানব সম্প্রদায় প্রাকৃতিক সম্পদ বিনাশে নেমেছে। এভারেস্ট বিজয়ের খায়েশ মানুষের উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বরফের হিমবাহে হিমবাহে মানুষের মল-মগজ-পুঁজ! অ্যান্টার্টিকার বরফও গলতে শুরু করেছে অস্বাভাবিক। এতো গরমের প্রাদুর্ভাবেও মানুষের কিছুতেই হুঁশ হচ্ছে না। সীমান্ত-পথে মাঝে-মধ্যেই ইট-সিমেন্টের মস্তানি চোখে কুট কুট করে দেখো কেমন বিঁধছিল। এই সংক্রমণ ব্যাধি যে অচিরেই দুপাশের পুরো রাস্তাব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে, তাতে আর সন্দেহ কি? পুরো বাংলাদেশই তো পরিণত হতে চলেছে অপরিকল্পিত কংক্রিটের জঙ্গলে!

দ্রুত ছোটা গাড়িতেই জয়দুল হোসেন তার দুটো বই উপহারস্বরূপ তুলে দেন আমাকেসহ সবার হাতে। স্বরবৃত্তে স্বরাঘাত ছড়াগ্রন্থ আর যুগলবন্দি মন কাব্য। কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে এসে আবারো মানুষটার প্রতি আমার গভীর সমীহ জাগে। একটা ভালো কবিতা লেখার জন্য তার মনের ভেতর যে কী তীব্র আকুতি!
‘ক্ষমা করো ক্ষমাকর ক্ষমার আধার
ক্ষমা করো রত্নাকর রত্নের আধার
ক্ষমা করো তিতাস নদী বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন
পূর্বসূরি ও উত্তরসূরিগণ—
ক্ষমা করো প্রিয় কবিতাটি এখনো লিখতে পারিনি বলে—

আমি কাব্যগ্রন্থের পৃষ্ঠা উলটাই আর জয়দুল হোসেনের দিকে তাকাই আর মনে মনে বলি, ভালো কবিতা কোন কবি লিখতে পেরেছেন কবিবর? কবির এই অতৃপ্তি সারাজীবন বুঝি তাকে প্রলুব্ধ করে তাকে প্ররোচনা যুগিয়ে নতুন আরেকটি কবিতা কেবল লিখিয়েই চলে! তাছাড়া কেমন লিখলেন আপনি, কেমন হলো কবিতা তা ভাবার দরকার কী, সারাজীবন আপনি আপনার মতো করেই লিখেছেন, আপনার জীবনের মধু পান করে আপনিই নিজের জগতে বিমোহিত থেকেছেন— এ ঘোর কজন পায়? আপনার কবিতা নিয়ে কে কী বললো, কে ছাপাতে পারলো না— সেসব কথায় কান না দেওয়াই ভালো। সুবোধ সরকারকে যেমন মন্ত্রণা যুগিয়েছিল একজন, সেই যে কবিতাসমগ্রর ভূমিকায়— পড়েননি? ‘নটা বাহান্নর কৃষ্ণনগর লোকালে জানলার ধারে হাতে বই নিয়ে বসে থাকা ছিপছিপে দীর্ঘাঙ্গী, তন্বী কালো মেয়েটির সঙ্গে আমার যদি দেখা না হত, আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিতাম। অনেক ভাল কাজ আছে পৃথিবীতে। পঁচিশ বছর আগে বান্ডেল চার্চে জিশুর সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি আমাকে বলেছিল, ‘লেখো, লিখে যাও।’ পঁচিশ বছর পরে ঢাকুরিয়ার এম আর আই হসপিটালের চারশো আঠাশ নম্বর বেডে শুয়ে আমার হাত ধরে বলেছিল, ‘লেখো, লিখে যাও, কে কী বলল, কান দিয়ো না।’

সুবোধ সরকারেরও কবিতা লেখার একটা গল্প আছে, যেমন আর দশটা কবির থাকে। ‘পিউবার্টি হেয়ার দেখা দিলেই প্রতি তিনজন বাঙালির একজন বাঙালি ছেলে কবিতা লেখে। অপবাদটিকে সম্মান জানিয়ে আমি কলম ধরেছিলাম। ক্লাস ইলেভেন তখন, কৃষ্ণনগর রেল স্টেশনে আমরা তিন বন্ধু সাইকেল সমেত দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছিলাম, একজন ভবঘুরে আমাদের পেছনে ঘুরঘুর করছিল। দেখলাম ট্রেন আসছে কলকাতার দিক থেকে, আমাদের চমকে দিয়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটা, গেল গেল রব। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে স্থির হয়ে দাঁড়াল, আমি দুটো কোচের মাঝখান দিয়ে উলটোদিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখলাম হাতে একটা পাউরুটির ঠোঙা, সে খাচ্ছে আর আমার দিকে ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে যে হাসিটা টাঙানো সেটা শ্মশানঘাট থেকে এইমাত্র ছিনিয়ে আনা নিয়তির টাটকা হাসি। সেদিন ভোররাতে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম, আমার প্রথম কবিতা, যা হারিয়ে গেছে। তার জন্য আমার কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু লোকটার হাসি থেকে গেছে আমার কবিতায়।

বর্ডারের কাছাকাছি পৌঁছাতেই আবারো শুরু হলো বৃষ্টি। খুব জোরে নয় অবশ্য। টিপটিপিয়ে নাকি পিটপিটিয়ে। আমি কার থেকেই বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন রুমের বারান্দায় দাঁড়ানো কবি এ কে শেরামকে এক-নজর দেখেই চিনে ফেললাম। চেনার কারণটা হলো সব মানুষগুলোর মধ্যে তিনিই সবচেয়ে উঁচু-লম্বা। আর চেহারাটাও চেনা ছিল ফেসবুকের বদৌলতে। ফেসবুকে তার ছবি প্রায়-প্রায়ই দেখা হয়েছে। শ্যামল গাত্রবর্ণ, চেহারা দেখে বলে দিতে হয় না যে তিনি মণিপুরী সম্প্রাদয়ের একজন। কারটা মেইন রাস্তা থেকে ইমিগ্রেশন অফিসের সামনের খোলা জায়গায় যেতে চাইলে ওখানকার কর্তব্যরত দারোয়ান বাধা দিল। অ্যান ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট, কর্তব্যপরায়ণ। বৃষ্টিও চোখে পড়ছে না লোকটার। ফলে আমাদেরকে বৃষ্টির মধ্যেই বর্ডারমুখী মেইন রোডে নেমে পড়তে হলো। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক