আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ৭
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুন ১৭, ২০১৯
আখাউড়া স্টেশনে
আখাউড়া স্টেশনের প্ল্যাটফরমে পা ফেলতেই আমার শান্তা সরকারের কথা মনে পড়ে যায়। ওর দীঘল চুলের সিথানে সিথানে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকা আম্রমুকুলের কথা মনে পড়ে যায়। হ্যাঁ, সেই ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ প্রান্তে কী মার্চের প্রথম লগ্নে, আমরা যেদিন আগরতলার আমবাসা বইমেলায় যোগ দেওয়ার জন্য গুলশানের ভারতীয় ভিসা-কেন্দ্রের সামনে ভিসা গ্রহণ কার্যক্রমে অংশ নিতে গভীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলাম, সেদিন ভারী হাওয়া বইছিল। আর আম্রমুকুলগুলো দিশেহারা হয়ে ধরণীপ্রপাততল হচ্ছিল। বেশকিছু আম্র্রমুকুল শ্যামলাসুন্দরী শান্তা সরকারের এলোমেলো চুলে আশ্রয় নিয়েছিল— আমি নিবিষ্ট হয়ে দেখছিলাম। সেদিন শান্তা সরকার ছাড়াও ছিলেন কথাশিল্পী মঞ্জু সরকার, গণসঙ্গীতশিল্পী আরিফ রহমান, নজরুলগীতি গায়িকা সুস্মিতা দেবনাথ শুচি এবং ওর মা রমা রানী দেবী, সেই সাথে পঞ্চকবিসহ সব রকম গান গাইতেই যে পারঙ্গম সেই রীনা ফেরদৌসী।
ভারতীয় ভিসাপ্রাপ্ত হয়ে আমরা ২৭ মার্চ এই একই ট্রেনে ঠিক একই সময়ে হবে— দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে এ-স্টেশনেই এসে একসঙ্গে নেমেছিলাম। সেদিন আমাদের খুব তাড়া ছিল। আমরা শুনেছিলাম যে, আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সেই সকাল থেকে আগরতলা বর্ডারে এসে বসে রয়েছেন আগরতলা এবং আমবাসার বেশ কয়েকজন সম্মানিত মানুষজন। আমরা স্টেশনে নেমেই কোনোদিকে না-তাকিয়ে বর্ডারে যাওয়ার জন্য শশব্যস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমাদের দুজনের— আমার আর কবি নিতাই সেনের মোটেও তাড়া নেই। কেননা কবি এ কে শেরাম সিলেট থেকে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে সাড়ে আটটার সময় উঠে বসেছেন। নিতাই সেন কল দিয়ে খবর নিলেন, কেবলমাত্র শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত তিনি পৌঁছেছেন। আজমপুর স্টেশনে আসতে আসতে তার আরো আড়াই থেকে তিনঘণ্টা লেগে যাবে। এই দীর্ঘ সময়টা নিতাই সেন চাইছেন, বর্ডারে অপেক্ষা না করে আখাউড়া স্টেশনেই কোনোমতো কাটিয়ে দিতে। এ কে শেরাম আজমপুর পৌঁছালে আমরা আখাউড়া স্টেশন থেকে বর্ডারের উদ্দেশে রওনা হবো।
সুন্দর ছিমছাম নির্জন স্টেশন আখাউড়া। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ ওর দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি আমার। আজ বিস্তর সময়। তাই বুঝি কল্পনাবিলাসিতারও সুযোগ পাওয়া গেল! আমি স্টেশনের প্ল্যাটফরমে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলাম যে, দেয়াল আর এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্ত— যেখানেই সুযোগ রয়েছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মুখচ্ছবি পোস্টারে পোস্টারে আর ব্যানার ফেস্টুনে শোভিত। আর সেসব পোস্টার-ব্যানার থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে চাটুকারদের তেল। এই এক রেওয়াজ বাংলাদেশের পলিটিক্সে, পোস্টারের দূষণ— সর্বস্তরের জনগণকে শুভেচ্ছার নামে নিজের খেমা দেখানোর অসুস্থ হিড়িক; একেবারেই ভালো লাগে না আমার। আমি তাই স্বপ্নবিলাসিতায় ভাসতে লাগলাম, আমাদের যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের আগমন উপলক্ষে পোস্টারগুলো লাগানো হয়েছে, তিনি ট্রেন থেকে আখাউড়া স্টেশনে নেমেই বড় বেশি শরমিন্দায় পড়ে গেলেন। নানান বিশেষণে সাজানো পোস্টার দেখে খুশি হবেন কী, লজ্জায় প্রায় চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে রাগী গলায় হুকুম দিলেন, এসব তোমরা কি করেছো? ভক্তবৃন্দ থমকে তাকাল তার দিকে। তিনি ওদের উদ্দেশে প্রশ্নতীর হানলেন, আমার আখাউড়াবাসীর জন্য কোনটা গুরুত্বপূর্ণ? স্টেশনের সৌন্দর্য না আমার পোস্টার!
আখাউড়ার একজন কবিও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সে বেশ সবাক স্ফূরিত গলায় বললো, ভাই, আখাউড়ার সৌন্দর্য! আনিসুল হক তখন প্রধান ভক্তের দিকে ঘুরে তাকালেন, ইয়েস! আখাউড়ার সৌন্দর্য! তোমরা আজকের মধ্যে সব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলবে। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি দেয়ালে দেয়ালে দেখতে চাই আখাউড়ার যত জ্ঞানী গুণী মানুষ আছে তাদের ছবি। কীভাবে সাজাবে জানি না। বড় শিল্পীদের ডাকো ডিজাইনারদের ডাকো, তারা বলে দেবে, স্টেশনের দেয়ালে দেয়ালে থাকবেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, মিন্নাত আলী, হরলাল রায়, শান্তনু কায়সারদের মতো মানুষের মুখ!
এক মুহূর্তেই কথাটা রাষ্ট্র হয়ে গেল আখাউড়ার আকাশে-বাতাসে। ঘরে ঘরে ধন্যি পড়ে গেল! দেখেছিস আনিসুল হক কেমন মানুষ! নিজের ছবির প্রতি কোনো মায়া নাই টান নাই! আত্মপ্রেম নাই! আমাদের প্রাণের আখাউড়ার যারা সম্মান বাড়িয়েছে, তিনি দেখতে চান তাদের ছবি! এই আনিসুল হককেই তো চিরকালের জন্য দরকার! আমরা আনিসুল হক ছাড়া আর কাউকে কখনো ভোট দেব না! আর কাউকে না! তাকে আমরা হৃদয়ের সিংহাসনে বসাব!
পরের সপ্তাহেই আখাউড়া রেলস্টেশনকে ঘিরে উৎসবের ঘনঘটা। সারা আখাউড়ার মানুষ উপচে পড়েছে সেখানে। রাম রহিম যদু মধু আবদুল হাদী একসাথে। দেয়ালে দেয়ালে ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ, অন্নপূর্ণা, অদ্বৈতমল্ল বর্মণ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মতো শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক গায়েন! আনিসুল হক পুলকিত চিত্তে আখাউড়ার সেই কবির উদ্দেশে বললেন, কী, ঠিক আছে না কবি? কবি কাঁচুমাচু কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ। খুব ভালো। তবে কিনা কিসের যেন একটা অভাব পরিলক্ষিত হইতেছে।
আনিসুল হক কৌতূহলী হয়ে উঠলেন, কিসের অভাব বলো তো।
কবি দ্বিধান্বিত।
আনিসুল হকের মধুর ধমক, বলবে তো! নাকি?
কবি তখন গদগদ স্বরে ব্যক্ত করলেন, মানে সুন্দর কোনো মুখ! মানে রমণীর মানে নারীর আর কি!
আনিসুল হক তখন সরোদ হাতে এক ঋদ্ধা-বয়সীর ছবি দেখাতে দেখাতে বললেন, কেন? ওই যে অন্নপূর্ণার ছবি তো দিয়েছে।
কবির দ্বিধাচিত্ত স্বর, তাইলে উনার জোয়ানকালের ছবি দিলেই পারতো!
আনিসুল হক হেসে ওঠলেন, তোমাদের কবিদের নিয়ে এই এক মুসিবত! খালি জোয়ানকাল খুঁজো...
কে জানবে আনিসুল হক নয়, আমিই হাসছিলাম ফিক ফিক করে। নিতাই সেনের অবাক গলা শুনে সে হাসি থামলো, কী ব্যাপার হামিদ! হাসছেন কেন?
কিছু না দাদা, কিছু না।
না, বলেন না শুনি!
না, দাদা, এমনিই হাসছিলাম।
নিতাই সেনের আমার দিকে ঘোর নিরিখ, এমনি কেউ হাসে! চলেন কোথাও গিয়ে বসি।
নিতাই সেন হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্টের রুমে ঢুকলেন। আমি তাকে অনুসরণ করি কেবল। এটাই হলো সরকারি উচ্চপদস্থ পদে চাকরি করার বৈশিষ্ট্য। তিনি এক সময় আমলা ছিলেন। তাই বসার জন্য এখানকার সর্বোচ্চ পদের মানুষটির কামরার কথাই ভেবে নিয়েছেন। আমি একা হলে হয়তো প্ল্যাটফরমের কোনো নিঃসঙ্গ খঞ্জে বসে বই পড়ে বা আঁকাআঁকি করে সময়টা কোনোমতো কাটিয়ে দিতে চাইতাম।
স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট মানুষটা ভালো। হুজুর টাইপের। শুকনা পাতলা। মাথায় টুপি, মুখভর্তি দাড়ি। নাম খলিলুর রহমান। বাড়ি নোয়াখালি। কত বয়স হবে? পঞ্চাশের ওপরে তো অবশ্যই, দুইচারাআনা বেশিও হতে পারে। আমাদেরকে বেশ সমাদর করে বসালেন নিজের অফিসরুমে। তার সঙ্গে গল্প করছি, আখাউড়া রেলস্টেশনের সুখদুঃখ জানছি। এমন সময় রুমের এক কোণের টয়লেট থেকে এক প্রায় সত্তর বছর বয়সী ভদ্রলোক বেরিয়ে আসলেন। সত্তর-বয়সী এবং নিতাই সেন পরস্পরকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। কোন্ কথা রেখে কোন্ কথা বলবেন, একেবারে যাকে বলে দিশেহারা অবস্থা। বোঝা গেল দুজনের অনেকদিন পর দেখা হলো। ভদ্রলোকও নিতাই সেনের মতো রিটায়ার্ডপ্রাপ্ত সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কোনো একটা প্রজেক্টের সঙ্গে আছেন।
সত্তর-বয়সী আমাদের পাশে এসে বসলেন। ধরা যাক তার নাম মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। খুব কথা বলেন। কথা বলার স্বভাব-ভঙ্গিটা যেমন হাসান আজিজুল হকের মতো, চেহারাসুরতও তাই। গায়ের রং কালো, টাকমাথা, চোখে ভারি চশমা। কথা বলতে যত না ভালোবাসেন, জানেন যে অনেক বেশি, সেটা জানাতে আরো ভালোবাসেন বেশি। কাউকেই তেমন কথা বলার সুযোগ দেন না। শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন থেকে শুরু করে ত্রিপুরা-কুমিল্লা, আগরতলা, রবীন্দ্রনাথ কোনো বিষয়ই বাদ গেল না এক মুহূর্তের মধ্যে। তার কাছেই জানা গেল, বাংলাদেশের তুলনায় আগরতলায় শাকসবজির দাম ডাবল। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গেই প্ল্যান করে বসলেন, আগরতলায় শাকসবজি সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করবেন। নিতাই সেনও আগ্রহী কিনা, তাও জেনে নিলেন খানিকটা এগিয়ে এসে। একটা-দেড়টার দিকে তিনি আমাদের কাছ থেকে খড়ম শাহর মাজার জিয়ারত করার উদ্দেশে চলে গেলেন। এই মাজারের নাম কখনো শুনিনি। ভদ্রলোক জানালেন এটা তো বেশ বিখ্যাত মাজার। উনি মাজার জিয়ারত করতেই মূলত ঢাকা থেকে আজ এখানে এসেছেন, আমরা যে-ট্রেনে এসেছি সেটাতেই।
ভদ্রলোক বিদায় হতেই আমি আর নিতাই সেন জিনিসপত্র সুপারিনটেনডেন্টের রুমে রেখে স্টেশনের বাইরের রেস্তোরাঁগুলোয় ঢু মারি। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে সাদা রুটি আর আলুভাজি খাই। বাইরে বেড়াতে গেলে খাওয়াদাওয়া করতে আমার ভয় লাগে। লাঞ্চ সেরে দেবব্রত সেনকে আবারো কল দিই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন থেকে নামার আগে-আগেই আমি ওর কল পেয়েছিলাম। দেবব্রত সেন জানাল যে, ও অলরেডি আখাউড়া স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দিয়ে দিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে এবং আমাদেরকে ও বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। আমরা যেন কোনো চিন্তা না করি। কী আন্তরিকতা ছেলেটার! অফিসের কাজকর্ম সব ফেলে ও আমাদেরকে সময় দেবে। সন্দেহ নেই যে, এই আন্তরিকতাটুকু শুধুই কবিতার জন্য।
এ কে শেরাম দেড়টা কী পৌনে দুটোর সময় কল করে জানালেন, ওরা দুজন আজমপুর নেমেছে। আমরা যেন এখন বর্ডারের উদ্দেশে রওনা দিই। তখনই আমি দেবব্রতকে কল দিলাম, তুমি কোথায়? আমাদের তো এখনই বের হতে হবে। দেবব্রত বলল, আপনারা মেইন গেট দিয়ে বেরুলেই আমাদের দেখতে পাবেন ভাইয়া। চলে আসুন।
আখাউড়া রেলস্টেশনের বাইরে আসার পর দেবব্রতকে দেখেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। কিন্তু নিতাই সেন অবাক! তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়! তিনি রুদ্ধবাক শুধু তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক