শামসুর রাহমানের সঙ্গে হামিদ কায়সার
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ৬
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুন ১০, ২০১৯
বাথরুম থেকে ফিরি সুবোধ বালক হয়ে। নিজেকে প্রবোধ দেই, মনে করো এখন তোমার ফড়িংবেলা। এখনো তুমি হাফপ্যান্ট পরে থাকো! একলা একলা চড়ুই পাখি দেখে ঘুলঘুলিতে মাতো! দুপুরবেলা হঠাৎ তোমার মন খারাপ করে না। সন্ধ্যাবেলা আঁধার নামলেও মনে নেমে আসে না আঁধার। এখনো তুমি বুঝো না বোধ আর বোধনের পার্থক্য কি? অতো শেক্সপিয়ার হওয়ার দরকার নেই বাপু। আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে থাকো জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে। গাছ দেখো, পাখি খুঁজো। আকাশকে বলো তুমি খুব খারাপ, খুব খুব খারাপ, তোমার ডানা ভালো না!
আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে সোজা বাইরের দিকে ঘুরে বসে থাকি। বসে বসে এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় গুণি। একশো পর্যন্ত গুণে আবার অ আ ই ঈ স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মনে আনার চেষ্টা করি... ওদিকে দেখো আকাশ-গাছপালা-প্রকৃতি এমনকি ট্রেনও গাঢ়স্বরে একযোগে বলতে থাকে, ভেতরে মন দে! ভেতরে মন দে! ভেতরে মন দে! আমি ওদের কথায় কান দিই না। এবার এ বি সি ডি ই এফ নিয়ে এগোই এক্স ওয়াই জেড-এর দিকে। প্রকৃতির চঞ্চল সুর থামে না, প্রলুব্ধ করতেই থাকে— ভেতরে মন দে, ভেতরে মন দে, ভেতরে মন দে... আমি এই প্রথম ওদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলাম, নাহ! আমি ভেতরের দিকে তাকাব না! তাকাব না!! তাকাব না!!! অমনি ওরা ধুয়ো দিয়ে উঠলো, তুই ভিরু তুই কাপুরুষ! তুই একটা...
আমি আমার দুই কানে দুই আঙুল ঢুকিয়ে দিই। চোখ বন্ধ করে থাকি। অমনি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে উনিশার সেই হাসি হাসি মুখ! মাত্র তো উনিশা আমার চোখে চোখ রাখতে শুরু করেছিল! মাত্র তো আমের বউলে বাঁধতে শুরু করেছিল গুটি! আমি কি জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়ে দেব? হঠাৎ যুবরাজ প্যারিসের কথা মনে পড়লো। আমি আমার ভেতরে এক অসীম শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করলাম। যা হবার হবে! এভাবে তীরে এসে তরী ডোবানোর কোনো মানে হয় না। বাঁচবোই যদি সিংহের মতো বাঁচবো! আমি তো ওর দিকে তাকাবই, ওর মায়ের দিকেও তাকাবো, ওর ভয়াল গোঁফি বাপের দিকেও তাকাবো! সাহসের সঙ্গে দরকার শুধু একটু বুদ্ধির! ওর বোন ভাই ওর চৌদ্ধ গোষ্ঠির দিকে এক মিনিট করে তাকিয়ে থাকবো! তখন আমার দোষ ধরবে কে শুনি? সেটা তো হবে একটা ন্যাচারাল ব্যাপার! আমি কি শুধু কোনো একজনের দিকে তাকিয়ে থাকি? আমি তো সবাইকে দেখি! মানুষই তো তাকায় মানুষের দিকে, নাকি?
আমি আবারো ট্রেনের ভেতর-দিকে ঘুরে বসি। একটু দম নিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ওপাশের একেবারে ডান প্রান্তের জানালা দিয়েই শুরু করি অপারেশন সার্চ হান্ট। বোধহয় উনিশার ছোটোবোন। কত হবে বযস চৌদ্ধ কী পনেরো? খুকি তুমি চকোলেট খাবে? আমি ওকে মনে মনে চকোলেট সাধি, আইসক্রিম খাওয়াই। দেন ওর ছোটো ভাইটার দিকে ফোকাস দিই। নয় কি দশ হবে। শালাবাবু তুমি আমার সঙ্গে ক্রিকেট খেলবা? আমি কিন্তু প্রথমে ব্যাটিং করবো। প্রত্যেকের জন্য আমি এক মিনিটের মতো বরাদ্ধ রাখি। পাক্কা এক মিনিট গভীর চোখে তাকিয়ে নিথর দেখি। এরপর আমার পা থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে, বুকের কম্পন বেড়ে যায়। আমি তীব্র এক সাহস নিয়ে আমার সোহেলির দিকে তাকাই আমার নায়িকার দিকে। এক মিনিট সময় আমি পাবো! এই এক মিনিট কেউ আমাকে কিসসু বলতে পারবে না। আমি তো সবার দিকে তাকাচ্ছি, আমি তো সবার দিকেই এক মিনিট করে তাকিয়ে থাকি। এটা তো আমার অভ্যেস! আমার প্রকৃতি! কিন্তু দেখো মেয়েটা আমার চোখে চোখ রাখার আগেই শুরু হয়ে গেছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মিসাইল নিক্ষেপ— গলা খাঁকারির শব্দও যে পাহাড় ভাঙতে পারে কে জান তো! কর্ণকুহরের পর্দা যেন ছিঁড়ে যেতে চাইছে। আমি দ্রুত সেই বাবার দিকে তাকিয়েই তীব্র বেগে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলি! এক পলকের জন্য হলেও অনুভব করি ভূমিকম্পের প্রচণ্ডতা! ওরে বাবা রে! কী ভভভয়ানননক চেচেচেহারা! চোখের মণিটা যেন ছুটে আসতে চাইছে চোখ ছেড়ে! আমি আবারো জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই।
আবারো সেই প্রকৃতির ঝালাপালা! পরাজয়ে ডরে না বীর। ভেতরে মন দে! আমি ভেতরেই মন দিই, তবে কিনা কারোর দিকে তাকাতাকি নয়, ব্যাগটা খুলে কবি শামসুর রাহমানের কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি কাব্যগ্রন্থটা বের করে নিয়ে আসি আলগোছে! একদম শব্দটব্দ বাঁচিয়ে! বলা তো যায় না গোঁফি বাবা যদি গলা খাঁকারি দেয়! ভাগ্যিস বইটা আমি সঙ্গে করি নিয়ে এসেছিলাম। ওটার মধ্যে চোখ নামিয়ে সমস্ত মনোযোগ ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি
গোলাপ নেবো
গুলবাগিচা বিরান বলে, হরহামেশা
ফিরে যাবো,
তা হবে না দিচ্ছি বলে।
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি
গোলাপ নেবো।
ফিরতে হলে বেলাবেলি হাঁটতে হবে অনেকখানি
বুক-পাঁজরের ঘেরাটোপে ফুচকি মারে
আজব পাখি।
পক্ষী তুমি সবুর করো,
শ্যাম-প্রহরের ডোবার আগে, একটু শুধু
মেওয়া খাবো।
শিরায় শিরায় এখনো তো রক্ত করে
অসভ্যতা।
বাচাল কথা খিস্তি করে হাফ গেরস্ত
প্রেমের টানে; হঠাৎ দেখি চক্ষু টেপে
গন্ধবণিক কালাচাঁদের মিষ্টি মিষ্টি
হ্রস্ব পরী।
শামসুর রাহমানের কবিতা তখন আমার সেই গ্লেসিয়ার নিঃসঙ্গতায় জল ঢেলে দিত। সত্যি কথা বলতে কি তিনি যেন নতুন কবিতারাজ্যের হ্যামিলনের বংশীবাদক হয়ে উঠেছিলেন। আমার মতো অনেক তরুণকেই কবিতার পেছনে মিছিল করার জন্য সম্মোহিত করে রেখেছিলেন। চেতনায় জাগিয়ে রেখেছিলেন স্বাধীনতার প্রতি প্রেম, মৌলবাদ বিরোধী চেতনা!
কিন্তু কবিতায় আর কতক্ষণ মন বসতে চায়! আমার উনিশার দিকে তাকাতে প্রচ- ইচ্ছে করে। তাকাতে গেলেই দেখি, সেই হম্বিতম্বি বাবার রক্তচক্ষু! আমি দ্রুত চোখ ফিরিয়ে সমস্ত মনোযোগ বসিয়ে দিই কবিতার সঙ্গে গেরস্থালিতে। আর খোদাতায়ালার প্রতি গাঢ় অভিমানে বলতে থাকি, হা প্রভু! যে নারীকে তুমি এতো রূপ দাও, সৌন্দর্য দাও, তার বাবাকে কেন দাও অমন ভয়ানক ছুরত, আর যদি ভয়ানক ছুরত তাকে দিতেই হয়, তার মেয়ের রূপপিয়াসী যুবকটির মনে কেন দাও না তুমি উপযুক্ত বা পর্যাপ্ত সাহস! ঘা প্রভু, কেন প্রেমের অনল হৃদয়ে জ্বালিয়ে তুমি শুধু ভস্ম করো ভস্ম করো— মনের এই ঝড়োধাক্কা সামলাতে সামলাতে ট্রেনটা যে কখন শ্রীমঙ্গল স্টেশনে পৌঁছে গেল, টেরই পেলাম না। যখন অনেক যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে নেমে যেতে লাগলো, তখনই আমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ সুগভীর ব্যথায় মুচড়ে ওঠলো। আহা! উনিশাকে ছেড়ে আমি নেমে যাবো? নেমে যেতে পারবো আমি? হারিয়ে ফেলবো ওকে চিরতরে? গাঁট মেরে বসে রইলাম। সিট ছেড়ে একটুও উঠতে ইচ্ছে করলো না! শ্রীমঙ্গলে নামাটা কি আমার এতটাই আবশ্যক? যা হবার হবে, উনিশা যেখানে নামবে, আমিও সেখানেই নামবো। টিটি আসলে তখন ম্যানেজ করা যাবে। শ্রীমঙ্গলের একটা টিকিট তো কেটেইছি। ঘুমে ডুবে না থাকলে তো নেমেই যেতাম আমি! দোষ যদি হয়ে থাকে তো সে ওই ঘুমেরই দোষ। আমি চটপট একটা কাগজের মধ্যে আমার নাম আর হলের ঠিকানাটা লিখে ফেললাম, সুযোগ পেলেই উনিশার হাতে যদি ধরিয়ে দেওয়া যায়! তখন তো আর হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। কল্পনাও করা যেত না সে-কথা!
উনিশা নেমেছিল সিলেট স্টেশনে। নামলে কী হবে, এমন টোপলার মতো বস্তাবন্দি হয়েছিল বাবা-মা আর ওর সেই দুই ভাইবোনের মাঝখানে যে, ফাঁক গলে কিছুতেই আর ওর হাতে সেই এড্রেসের টুকলিটা ধরিয়ে দেওয়া গেল না তো গেলই না! দূর থেকে শুধু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখতে হলো, একটা স্কুটারে চড়ে ওদের দ্রুত অন্তর্ধান হওয়া! চাকধান্দা লেগে যে পড়ে যাইনি, এইই বেশি। পড়ে গেলে মাথাটাথা ফেটে যেতে পারতো! কোনোমতো নিজেকে সামলে স্টেশনের চাতালে বসে পুরো একপ্যাক ফাইভ ফিফটি ফাইভ শেষ করে আবারো টিকিট কেটেছিলাম ঢাকার ট্রেনের। আর এক মুহূর্তর জন্যও সহ্য হয়নি সিলেট শহর! ট্রেনেই কি ফিরেছিলাম নাকি বাসে? ভুলে গেলাম যে!
‘হামিদ, রেডি হন! আমরা চলে এসেছি।’ কবি নিতাই সেনের ডাকে ফিরে এলাম বাস্তবে। জিগেশ করলাম, ‘কোথায় এলাম দাদা, শ্রীমঙ্গল?’ নিতাই সেন অবাক হয়ে গেলেন। ‘শ্রীমঙ্গল আসবো কেন? আপনার কি হয়েছে হামিদ। আমরা আখাউড়ায় এসেছি!’
ওহহ। দাদা, স্যরি আখাউড়া! তাই তো শ্রীমঙ্গল হবে কেন! ওতো আমার শুধু প্রথম ট্রেনযাত্রার ঘটকি হয়েই থাকবে। আমি দ্রুত ট্রেন থেকে নামার জন্য তৈরি হয়ে যাই। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক