আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ৩
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : মে ২০, ২০১৯
সখিনার বিরহ যন্ত্রণায় কবি হয়েছেন নিতাই সেন। আর আদিকবি বাল্মিকী তমসাতীরে প্রথম শ্লোক উচ্চারণ করেছিলেন কামমোহিত ক্রৌঞ্চযুগলের পুরুষটিকে হত্যা করার অনুশোচনা বোধ থেকে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কে যে কখন কীভাবে নিভৃতে গোপনে কবি হয়ে ওঠে আমরা তা কখনোই পরিমাপ করতে পারবো না, তবে এই কবি হওয়ার পেছনে যে একটা গল্প থাকে, তীব্র এক যন্ত্রণার কাহিনি, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। অবশ্য প্রচণ্ড ভালোলাগা বোধ থেকেও প্রেমাবেগ থেকেও হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে কোনো কবির প্রথম কবিতা। আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যপট দেখি আর এইসব ভাবি। এইসব ভাবতে ভাবতে আমি ভাবনাহীন পুলকে ভেসে বেড়াই। হ্যাঁ, ভাবনাহীন অকারণ পুলকে। এ আমার মজ্জাগত। ট্রেনে উঠলেই হলো, যখন ট্রেন চলতে থাকে, গতি পায়, আমি কোন্ এক আনন্দের জগতে উড়ে যেতে থাকি। উড়ে উড়ে দিগন্ত ছিড়েখুঁড়ে দৌড়ে যেতে থাকি যেন কোন্ অসীমের স্পন্দনে।
যদিও এই রাজধানীকেন্দ্রিকতায় বাইরের দিকে তাকিয়ে আনন্দের উপলক্ষ তেমন মেলে না, মেলবার কথাও নয়। শুধুই তো মানুষের ভিড়! ব্যস্ততা! যানজট! হন্তদন্ত ছুটাছুটি! ময়লা! আবর্জনা! দুর্গন্ধ! নর্দমার থিকথিকে কাদা! বস্তির অসহনীয় জীবন! এইসব দেখে দেখে শান্তি লাগে না, শান্তি লাগার কথাও নয়! হাঁসফাঁস লাগে, বিবমিষা হয়! তবুও দেখি। দূর পৃথিবীর ইশারাতেই দেখি। সামনেই বন পড়বে। আসবে বনানি। অন্তরঙ্গ গাঢ় সবুজের কনসার্ট হবে! সেই আশাবাদে ভাসতে ভাসতে আমি এই চেনা জবুথবু শহরটাকেই দেখি, দেখতে থাকি। দেখাটাই যে নেশা, বুঝি অভ্যাসও। সেই অভ্যাসের বশেই দেখি। সঙ্গে সঙ্গে ভাবিও। ভাবনার অতলান্ত জগতে তলিয়ে যাই। কবি নিতাই সেনের সখিনা কেমন ছিল ছবিটা ফুটিয়ে তুলতে চাই কল্পনার মানসলোকে। বলাই বাহুল্য সখিনার ছবি আসে না, আসে অন্য ছবি অন্য মুখ। সে মুখ মেঘভাজা, কাশবনসিদ্ধ, কুয়াশায় বলকানো। সে মুখ কার আমি শুধু মরে যাওয়ার পরই বলবো, বলবো কাকে তাও জানি না।
একটু অসংলগ্ন মনে হচ্ছে তো? হ্যাঁ, এটা আমার হয়, ট্রেনের গতি যতো বাড়ে, আমার কথাগুলো ততোই জড়িয়ে আসতে থাকে, এলোমিপনাও বেড়ে যায়। ওদিকে দেখো জাতে মাতাল হলে কী হবে, তালে ঠিকই আছি। কবি নিতাই সেনকে খুশি রাখতেই যেন নিজের অলক্ষ্যেই তার স্মৃতির খেরোখাতার পৃষ্ঠা উলটিয়ে চলেছি। ভাবটা এমন যেন তার বই পড়ছি খুব; পড়তে পড়তেই উদ্দিষ্ট ভাবনাটুকু আত্মস্থ করার জন্যই বুঝিবা চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে বারবার তাকাচ্ছি বাইরে। এমন একটা ভাব আনার চেষ্টা আমি করে যেতে থাকি। তিনিও কম মানুষ চড়ান নি। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। পরখ করছিলেন আমাকে ভালোমতোই। পৃষ্ঠা উলটাতে উলটাতে যেই না আমি গানের শহর ফুলের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিচ্ছদে এলাম, অমনি তিনি সরব হয়ে উঠলেন, ‘এই চ্যাপ্টারটা আপনাকে পড়তে হবে। একটু পড়েন।’
আমি এবার জানালাবিমুখ। কবি নিতাই সেনের দিকে তাকাই। তার কথা শুনি, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া আমার জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আমি তো লেখালেখির জগৎ থেকে এক-রকম হারিয়েই গিয়েছিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলি হয়ে না এলে হয়তো আর লেখালেখি করাই হতো না। এখানে জয়দুল হোসেন বলে একজনকে পেয়েছিলাম। সেই আমাকে নতুন করে লেখালেখিতে উজ্জীবিত করেছে। জয়দুল আমাকে জোর করিয়ে লিখিয়ে নিত, বিভিন্ন সাহিত্য-আড্ডায় নিয়ে যেতো। ওই আমার লেখালেখির ম্যান্টর। কতজনের সঙ্গে যে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, কতজনের সঙ্গে যে আড্ডা মেরেছি— অধ্যক্ষ মিন্নাত আলী, শান্তনু কায়সার, হরলাল রায়। আহমদ ছফাও যেত, বলতো ব্রাহ্মণবাড়িয়া আমার সেকেন্ড হোম।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়ায় আমি হঠাৎই বইটির মলাট বন্ধ করে দিই, সেই সঙ্গে নিতাই সেনের কথা শোনাও। আমার মস্তিষ্ককে জয়দুল হোসেন পুরোই অধিকার করে ফেলে। এই জয়দুল হোসেন কি সেই জয়দুল হোসেন, যার কথা আমি কবি সরকার আমিনের কাছে শুনেছি, কবি পিয়াস মজিদের কাছে শুনেছি, কবি দেবব্রত সেনের কাছে শুনেছি, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মুহূর্তে! হ্যাঁ, আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, বাংলা একাডেমিতে সরকার আমিন ওর অফিসে একদিন আড্ডায় জয়দুল হোসেনের কথা বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। ’জানেন অপুভাই! আমরা ছোটবেলা থেকেই তাদের দেখে দেখে বড় হয়েছি, কবিতা লেখা শিখেছি। কিন্তু আমার একটা ট্র্যাজেডি কী জানেন, আমি বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকারের সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়েও জয়দুল ভাইয়ের একটা কবিতাও ছাপতে পারিনি। কেননা, আমার কাছে মনে হয়নি তার কবিতা উত্তরাধিকারে ছাপার উপযুক্ত এবং এ-কথাটা আমি জয়দুল ভাইকে মুখের ওপর বলেছিও। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানেন, জয়দুল ভাই আমার প্রতি সামান্যও রাগ দেখাননি, অভিমান করেননি, তার সঙ্গে সম্পর্ক আমার আগের মতোই আছে, সেই গুরুশিষ্যের মতোই। আমি জয়দুল হোসেনকে অবাক চোখে দেখি আর শ্রদ্ধায় অবনত হই শুধু।
পিয়াস মজিদও বলেছিল জয়দুল হোসেনের কথা। একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাব শুনে পিয়াস মজিদ আশ্বস্ত করেছিল, ‘যাওয়ার আগে বলবেন, আমি জয়দুল ভাইয়ের মোবাইল নাম্বার আর এড্রেস দিয়ে দেব। উনিই আপনাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাবেন।’ আর দেবব্রত সেন তো কতবারই বলেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসেন ভাইয়া। কটা দিন থেকে যান। আপনাকে আমি ঘুরে ঘুরে সব দেখাবো। জয়দুল ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাব!’
আমি সঙ্গে সঙ্গেই দেবব্রত সেনকে কল দিয়ে বসি। ততক্ষণে ট্রেন বনানি ছেড়ে যাচ্ছে। বাইরে ভিড়ের দঙ্গল, মানুষের হাঁসফাঁসও কমতে শুরু করেছে। একটু একটু করে ট্রেনের জানালা দিয়ে গাছগাছালির সবুজ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ছে ভেতরে। আমার কল পেয়েই উচ্ছসিত হয়ে উঠলো নবীন কবি দেবব্রত সেন। ও আরো চমৎকৃত হলো যখন শুনলো যে, আমরা এখন আখাউড়া যাচ্ছি, আগরতলা হয়ে ইম্ফল যাব। দেবব্রত সকাতরে অনুরোধ জানায়, তাহলে ভাইয়া দুপুরবেলা আমার এখানে লাঞ্চ করেন। আখাউড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসতে আধাঘণ্টাও লাগবে না। আমি বললাম, সেটা সম্ভব নয়। একা হলে হয়তো পারতাম। আমার সঙ্গে কবি নিতাই সেন আছেন, তারপর সিলেট থেকে আসবেন কবি এ কে শেরাম। তার সঙ্গে কে আরেকজন রয়েছে নবীন কবি! আমাকে উনাদের বাওয়ে বাওয়ে চলতে হবে। পারলে তুমি আসো আখাউড়া রেলস্টেশন। ওখানে আমরা অনেকক্ষণ থাকব। নিতাই সেনের নাম বলাতেই চিনলো দেবব্রত, বললো, উনি তো মনে হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ছিলেন একসময়। আমি বললাম, হ্যাঁ, সেই গল্পই হচ্ছিল এতক্ষণ। উনি তো ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ভুলতেই পারেননি কখনো।
দেবব্রতর সঙ্গে কথা বলা শেষ হতেই নিতাই সেন জিজ্ঞেস করলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকে মনে হচ্ছে?
জি। ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইউসিবিএল ব্যাংকের ম্যানেজার। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবে আখাউড়া।
আচ্ছা আসুক বলে নিতাই সেন আবারো বইটার গানের শহর ফুলের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া চ্যাপ্টারটা তুলে ধরলেন আমার চোখের সামনে। আগে এটা পড়ে নাও। তারপর কথা বলবো। নিতাই সেন আমাকে তুমি বলতে শুরু করেছেন। ভালোই লাগে আমার। আমি পুরো লেখাটিই পড়ে ফেলি। খুব বড় লেখা নয়। তবে ছোট হলেও গভীর। সেই আশির দশকের কোনো এক লগ্নে তিনি কক্সবাজার থেকে সহকারি খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপজেলা প্রশাসনে। বস হিসেবে পেয়েছিলেন আরেক সাহিত্যিক ইশতিয়াক আলমকে। তারপর কীভাবে কীভাবে অধ্যক্ষ মিন্নাত আলীর সঙ্গে পরিচয় হলো, সে-সূত্রে মহিলা কলেজের সবুজ ঘাসে আড্ডা, ক্রমে ক্রমে জয়দুল হোসেনদের মতো কবি, সাহিত্যরসিকদের সঙ্গে পরিচয় এবং লেখালেখিতে আবারো নতুন করে ফিরে আসা, সবই তিনি তুলে ধরেছেন সবিস্তারে। অধ্যক্ষ মিন্নাত আলীর মতো শান্তনু কায়সার এবং হরলাল রায় আজীবন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেই সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তাকে ঠিকই তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। নিতাই সেন তার কবিজন্মের দ্বিতীয় পর্বের জন্য বারবারই লেখাটিতে জয়দুল হোসেনসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা অকুণ্ঠভাবে প্রকাশ করেছেন।
অধ্যক্ষ মিন্নাত আলী, শান্তনু কায়সার, হরলাল রায় সবাই বড় মাপের মানুষ, কৃতিময় তাদের জীবন। এমন আরো বড় মানুষের জন্ম দিয়েছে নিতাই সেনের স্মৃতির শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, অন্নপূর্ণা-এর মতো আরো কত সঙ্গীতজ্ঞ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আহমদ রফিকের মতো ভাষা আন্দোলনকারী, তারও আগে সগর্বে উচ্চারণ করা যাবে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের একঝাঁক বিপ্লবীর নাম! কবি-সাহিত্যিকও কি কম দিয়েছে ব্রাম্মণবাড়িয়া! অদ্বৈতমল্ল বর্মণ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, প্রবোধচন্দ্র সেন, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দিন থেকে শুরু করে আজকের হাসনাত আবদুল হাই। তাছাড়া আরো একটা নাম অনিবার্যভাবেই এসে যায়, অবধারিতভাবেই মনে পড়ে। একে তো সদ্যই তিনি প্রয়াত হয়েছেন, দ্বিতীয়ত যতোই বিতর্কিত হন না কেন, তিনি অমর হয়ে থাকবেন চিরদিন বাংলা কবিতায়। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক