কবি নিতাই সেন

কবি নিতাই সেন

আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম

পর্ব ২

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : মে ১৩, ২০১৯

কমলাপুর টু আখাউড়া
কবি নিতাই সেন আসেন সাতটা দশে। উনি কাছেই থাকেন, শান্তিনগর। আমি শাহীনকে বিদায় জানিয়ে ভেতরের ফার্স্ট প্ল্যাটফরম থেকে কবির সঙ্গে হাঁটতে থাকি। ট্রেনটা যে প্ল্যাটফরমে ভিড়িয়ে রেখেছে, আমরা সেদিক-পানে এগোই। নিতাই সেনের কুলি ছোঁ মেরে আমার বড় ব্যাগটা নিজের অধিকারে নিয়ে নিয়েছে। বড় দিলদার মনে হলো ক্ষয়ে-যাওয়া যুবকটিকে এবং বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্নও। মানুষকে কিছু দিলে যে, তারচেয়ে আরো বেশি পাওয়া যায় এ-তথ্যটা বা তত্ত্বটা আজকাল অধিকাংশ মানুষই ভুলে গেছে। সবাই শুধু নেওয়ার জন্যই অস্থির থাকে। আমি অভাবে জীর্ণশীর্ণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসি, প্রত্যুত্তরে তিনিও ঝটিতি অম্লান হাসি উপহার দেন।
 
আমরা খুঁজি ‘ভ’ বগি। মহানগর প্রভাতী চিটাগাংয়ের ট্রেন এটা। এ-ট্রেনেই আমি আরো একবার আখাউড়া হয়ে আগরতলা গিয়েছিলাম। বছর দুয়েক আগে হবে, ২০১৬ সালে। আর এখন ২০১৮। দিন যে কীভাবে যায় দ্রুত, হারানো প্রেমিকার মতো ছলনার তোড়ে, একবার পেছনমুখী ফিরেও দেখে না! সেদিন আমার সঙ্গে ছিলেন কথাশিল্পী মঞ্জু সরকার, সঙ্গীতশিল্পী আরিফ রহমান, সঙ্গীতশিল্পী শান্তা সরকার, সঙ্গীতশিল্পী লীনা ফেরদৌসী, সঙ্গীতশিল্পী সুস্মিতা দেবনাথ শুচি এবং ওর মা। আমরা গিয়েছিলাম আগরতলার আমবাসা বইমেলায় যোগ দিতে এবং ওখানকার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। তরতাজা হয়ে আছে সেসব স্মৃতি।

আমাদের সিট নাম্বার ২১ এবং ২২। নিতাই সেন তার ড্রাইভার দিয়ে কাটিয়ে রেখেছেন টিকিট। আসলে ট্রেনে যাওয়ার ইচ্ছে আমাদের একদমই ছিল না। দুজনই চেয়েছিলাম যেহেতু ঢাকা থেকে আগরতলা সরাসরি বিআরটিসি বাস যায়, সে বাসেই যাব। কিন্তু শিডিউলে মেলেনি। আমি নিতাই সেনের উদারতার সুযোগ নিয়ে জানলার পাশেই বসি। বসে থিতু হয়ে তার হাতে বাড়িয়ে দিই আমার ভিজিটিং কার্ড এবং নিউইয়র্ক থেকে দিপুদের আনা চকোলেট। ভিজিটিং কার্ড ইদানিং আমি যাকে-তাকেই দিই, সুযোগ পেলেই হলো। নতুন নতুন একটা জিনিস শুরু করলে যা হয় আর কী। চাকরি ছাড়ার তিনবছর পর এই প্রথম আমি নিজের ভিজিটিং কার্ড নিজেই করে নিয়েছি, ইম্ফল যাওয়াকে কেন্দ্র করেই, বলা তো যায় না তেমন যদি কেউ চেয়ে বসে ঠিকানা!
   
নিতাই সেন আমাকে উপহার দেন ছোট্ট একটা লেখার প্যাড আর উনার লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘স্মৃতি বিস্মৃতির খেরোখাতা’। আজ বই না দিলে কী হবে, আমি কবিকে আগেই দিয়ে রেখেছিলাম আমার লেখা একটি বই এবং ঈদসংখ্যা— যেটাতে আমার গল্প ছিল, এই ট্রেন-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েই। সেদিনই তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। বোধহয় দিন-দশেক আগে হবে। নিতাই সেন আমাকে সে-বিকেলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অফিসার্স ক্লাবে। কেননা আমরা ঢাকা থেকে কীভাবে দুজন একসঙ্গে আখাউড়া বর্ডারে যাব, তা আমাদের নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নেয়ার তাগিদ দিয়ে রেখেছিলেন সিলেট থেকে কবি এ কে শেরাম। অফিসার্স ক্লাবে আমরা জম্পেশ আড্ডা দিই আর নিজেদের মধ্যে পরিচিত হই। তিনি একসময় সরকারের উপসচিব ছিলেন। বেশ কয়েকবছর হলো অবসর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু মায়া কাটাতে পারেননি অফিসার্স ক্লাবের, প্রায় প্রতিদিনই আসেন সাঁতার কাটতে।

ঢাউস সিঙারার সঙ্গে সুবাসিত চা পান করতে করতে সেদিন শুরুতেই আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাম যে, আগরতলা যাব বাসযোগে। সেইমতো দুজন কমলাপুর গিয়েওছিলাম ঢাকা-আগরতলা বাসের টিকেট কাটতে। শিডিউলে মিলল না। আগরতলার উদ্দেশে কমলাপুর থেকে বাস ছাড়বে ২৫ জুলাই রাতে। আর আমাদের আগরতলা পৌছাতে হবে ২৫ জুলাই দিনের মধ্যে। সুতরাং সেদিনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো দাদা তার ড্রাইভার দিয়ে ট্রেনের টিকিট আগেভাগেই কাটিয়ে রাখবেন।

ট্রেন কখন ছাড়বে ঠিক নেই। আমি কবি নিতাই সেনের স্মৃতিকথন পড়তে শুরু করি। পড়ি আর মানুষটার দিকে তাকাই। কত বয়স হবে? চৌষট্টি না পয়ষট্টি? বয়সের তুলনায় তরুণই আছেন। ১৯৫৪ সালের ১১ নভেম্বর জন্ম, ভোলায়। আজ তিনি বার্ধক্যে পড়েছেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। শরীর ঠিক রাখতে প্রতিদিন সাঁতার কাটতে হয়। কিন্তু একটা সময় তিনি ছিলেন শিশু, সেখান থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়েছেন, কৈশোর থেকে পৌঁছে গেছেন যৌবনের উন্মাতাল সময়ে। আর এই যৌবনই তাকে পরিণত করেছে কবিতে। হ্যাঁ, দুরন্ত কৈশোর আর স্পর্ধিত যৌবনের সন্ধিক্ষণেই তিনি হয়ে উঠেছেন কবি। তিনি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘সময়টা ১৯৬৭ সালের গোড়ার দিক। চৌদ্দতে পা রেখেছি। পাটিগণিতের কঠিন কঠিন সমাধান কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। এমতাবস্থায় শরণাপন্ন হলাম কালী মোহন স্যারের। জর্দা দিয়ে একটা পান খাওয়ালেই স্যারের সমস্ত অসম্ভবকে জয় করা যেত। ঠিক প্রাইভেট নয়, রমজানের বন্ধে প্রতিদিন সকালে এক ঘণ্টা করে আমার দ্বারা সমাধানযোগ্য নয় এমন অংকগুলো স্যার থেকে বুঝে নেয়া। আমার বাসা থেকে প্রায় এক মাইল দূরে স্যারের বাড়ি। কালীতারার দিঘি ফেলে প্রায় অর্ধ মাইল পথ হাওলাদারদের নির্জন সুপারি বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে হতো। শৈশবে প্রতিদিন সকালে খাঁচা ভরে বাদুড়কাটা সুপারি কুড়াতাম ওই বাগান থেকে। সুপারির বিনিময়ে দোকান থেকে পেতাম মুড়ির মোয়া। এই কারণে সুপারি বাগানের গা ছম ছম করা রাস্তাটি জনহীন হলেও ততো ভীতিকর ছিল না আমার কাছে। স্যারের বাড়ি যাওয়ার পথে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম বাজারের মক্তবে পড়তে যাওয়া অনিন্দ্য-সুন্দরী কিশোরী সখিনা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এভাবে প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে দৃষ্টি বিনিময় এবং আমার এগিয়ে চলার পথের দিকে একদৃষ্টিতে সখিনার তাকিয়ে থাকা আমার কিশোর মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। অংকের কোনো সূত্র মনে থাকে না, জ্যামিতির সম্পাদ্য উপপাদ্য ভুলে যাই। অস্থির উন্মাদনা কিশোর মনে জন্ম দেয় অলৌকিক এক আনন্দের ভার। কোনো কোনো দিন সখিনা আগে আসলে সুপারি গাছের শরীরে শরীর রেখে অপেক্ষা করে আমার জন্য, আর আমি আগে আসলে সখিনার জন্য। কোনো বাক্য বিনিময় নয়, আবেদন নিবেদন নয়, চোখে চোখে হাজারো কথার বুনন। শুধু এক পলক হাসির জন্য মনে হতো তখত আর চাই না আমি শাহানশার।

রমজানের শেষ সপ্তাহে একদিন সকালে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও সখিনা এলো না। ওইদিন অপেক্ষায় অপেক্ষায় কালক্ষেপণ করে আমিও আর গেলাম না স্যারের বাড়ি। সারাদিনের অস্থিরতা বুকে চেপে বিকেলে গেলাম সখিনাদের প্রতিবেশী বাল্যবন্ধু মুকুন্দের কাছে। ঘটনা তো আর কাউকে বলা যায় না। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক ভূমিকা করে শেষে জিজ্ঞাসা করলাম সখিনার বাবা ইউনুছ মিয়ার কথা, ছেলে মেয়ের কথা। মুকুন্দের মুখেই শুনলাম ইউনুছ মিয়ার বড় মেয়ে সখিনার আক্দ হয়ে গেছে গতরাতে এক মৌলভীর সাথে।

আকাশ ভেঙে পড়লো মাথার উপর। দৌড়ে চলে গেলাম ধোপার দিঘির পাড়ে। বসলাম বটগাছটির নিচে। সে মুহূর্তে মনে হলো জন্ম-জন্মান্তর ধরে আমি শূন্যতার ভেতর আছি। অতল অনন্ত অগাধ অন্ধকার আর শূন্যতার ভেতর অনন্ত শূন্যতা হয়ে ভেসে আছি। মনে হলো, এটাই বেশ, এভাবেই আমি থাকতে চাই, কোনো মানসিক পূর্ণতা নয়, চাই শিল্পের পরিপূর্ণ পূর্ণতা। সংসার চাই না, সুস্থতা চাই না— চাই না ধনেপাতা, মৌরলা মাছ, কাঁচা মরিচ, ইলিশ মাছ, কাসুন্দি, তিলের নাড়–, মুড়ির মোয়া, পাপড় ভাজা— চাই জ্যোৎস্না দিন, তারার রাত, নদীর কলকল, ফসলের গান, বৃষ্টির নৃত্য। চাই না গতানুগতিক জীবন, চাই নক্ষত্র খচিত শিল্পকলা, অমরাবতী, নগরনটী, স্বর্গের অপ্সরা। আমৃত্যু দহন চাই, নীলবিষ চাই, শিল্পের দর্শন চাই— তাই হাতের কাছে পাওয়া মাটির ঢিল ছুঁড়ছি দিঘির মাঝে। টুপটাপ শব্দ এবং বৃত্তাকার তরঙ্গ নেচে নেচে মনের কোণে গেয়ে উঠলে ‘তুমি আমি’ বিষয়ক প্রথম কিশোর প্রেমের কবিতা। এরপর শব্দবাক্য আমাকে হাত ধরে টেনে আনলো কবিতা সুন্দরীর বিশাল উঠোনে।’

এভাবেই কবি হয়ে উঠলেন নিতাই সেন। কবিতার রাজ্যে অভিষেক হলো তার। হয়তো দেশচেনা কবি হতে পারেননি, জীবন-জীবিকা বা পারিবারিক নানা ব্যস্ততার কারণে। কিন্তু সে-কবিতাকে ঘিরেই তো তার আজকের অবসর জীবন কাটে, প্রতিদিনই কবিতাসুন্দরীর চরণতলে তিনি পূজার ঝাঁপি নিয়ে বসে থাকেন। সেই কবিতাসুন্দরীর আহ্বানেই তো আজ কবি এ কে শেরামের হাত ধরে ছুটে যাচ্ছেন সুদূর মনিপুর রাজ্যের ইম্ফল, যার সঙ্গে জুটে গেছি আমিও একজন— হয়তো কবি নই হয়তো অকবি। তবে জুটে যে গেছি এটাই সত্যি। কারণ, পৌনে একঘণ্টা পর আমাদের ট্রেন যে এখন চলতে শুরু করেছে, যে-ট্রেন প্রথমে নিয়ে যাবে আখাউড়া, যে আখাউড়া দ্বারোদ্ঘোটন করবে আগরতলার, যে-আগরতলার বিমানবন্দর আমাদেরকে পৌঁছে দেবে ইম্ফল। যে ইম্ফলে আমরা পাঠ করবো নিজেদের কবিতা। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক