কমলাপুর রেলস্টেশন

কমলাপুর রেলস্টেশন

আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম

পর্ব ১

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : মে ০৬, ২০১৯

নিকেতন টু কমলাপুর
ঘুম থেকে আঁতকে উঠলাম। আরে কবিতাই তো নেয়া হয়নি! অথচ ইম্ফল যাচ্ছি কবিতা পাঠ করতে। সেই কবিতাই যদি সঙ্গে না থাকে, সেখানে গিয়ে করবোটা কী আমি? লাইট জ্বালিয়ে প্রিন্টারের তার মালটিপ্ল্যাগে ঢুকালাম। তারপর কবি এ কে শেরামের কাছে পাঠানো পিডিএফ কপিটাই প্রিন্ট নেয়ার চেষ্টা করলাম। এখন কি আর ফাইল খোঁজার সময় আছে? ভাগ্য বটে ডেস্কটপে জড়োথরো ঝুলে থাকা পিডিএফ ফাইলটার! এতক্ষণে ওটার রিসাইকেলবিনের গোরে যাওয়ার কথা ছিল। আমার বেখেয়ালে বহাল তবিয়তে এখনো জীবাশ্ম। কিন্তু হা হতোস্মি! মনে মনে যা আশংকা করেছিলাম, তাই হলো। প্রিন্টার বারবার নোটিশ দেখাতে লাগলো যে, Door open করে নাও। Door open করে নাও।
 
আরে বাবা ডোর তো ওপেনই আছে। প্রিন্ট নিচ্ছ না কেন? ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারি, এ-প্রিন্টার থেকে আর কখনো প্রিন্ট নেয়া সম্ভব হবে না। কারণ এর ওপর দিয়ে বহুমাত্রিক ঝড় বয়ে গিয়েছে— আইলা, সিডর, ফণি! ফণি অবশ্য ততোটা ক্ষতি করতে পারেনি। মাঝপথেই শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়েছিল। তবে সিডর আইলারা ঠিকই বিষদাঁত বসিয়ে দিয়ে গেছে! তাহলে একটু খুলেই বলতে হয়। আমার ছোটভাই আনিসুর রহমান দিপু ওর ফ্যামিলি নিয়ে আমেরিকা থেকে ঢাকায় এসেছে। সে-কারণে আজ প্রায় দশদিন হলো আমি আর শাহীন (আমার স্ত্রী) আমাদের বাসার সেই পশ্চিম-প্রান্তের ছোটরুমটা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পুবপাড়ায় অনির্বাণের বড়রুমটায় আশ্রয় নিয়েছি। একেবারে কোনার দিকে মেঝের ওপর একটা বিছানা করে দেওয়া হয়েছে আমাকে। সেই নিচু বিছানারই একপাশে ল্যাপটপ, প্রিন্টার, টেবিল-ল্যাম্প, মালটিপ্ল্যাগসহ গোটা বিশেক বই, লেখার ফাইলপত্র সবকিছু একসঙ্গে গাদাগাদি করে রাখা। প্রিন্টারটা যেভাবে রয়েছে সুন্দরবনবিহীন অরক্ষিত, সেটাই ওর বিধ্বস্ত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তার মধ্যে আবার ওটার ওপর মাঝেমধ্যেই অযাচিতভাবে উঠে যায় টেবিল ল্যাম্প বা শক্তমোটা কোনো বই বা সামর্থবান ম্যাগাজিনসহ এটা-সেটা! সিডর আইলার ঝাপটানি বলে কথা! তাই প্রিন্টারের মাথাটা যে বিগড়োবে না, সে নিশ্চয়তা যিনি প্রিন্টার উদ্ভাবন করেছেন তার পক্ষেও বোধ হয় দেওয়া সম্ভব হবে না।
 
এখন কী করা? হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো। পেনড্রাইভেই তো নেয়া যায় কবিতা। আগরতলা বা ইম্ফল যেখান থেকে সুযোগ পাব প্রিন্ট করিয়ে নিলেই হলো। দুশ্চিন্তার ভার মাথা থেকে নামলো বটে, কিন্তু আরেক ল্যাঠা! পেন ড্রাইভটা যে নেই হাতের কাছে। ওটা রয়ে গেছে আমার সেই ছোট্ট রুমে— যেখানে এখন আব্বা আর মার অস্থায়ী বাস। তাদের বিশাল রুমটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে দিপুদেরকে। কী করি কী করি! রাত বাজে সাড়ে পাঁচটা। অবশ্য এটাকে ঠিক রাত বলা চলে না। শেষ জুলাইয়ের এই ক্ষণকে ভোরের দ্বারপ্রান্ত বলাটাই সমীচিন হবে। সে-ভরসাতেই আমি সেই পশ্চিমের দেশে ছুট লাগালাম। আমাদের বাসাটা সত্যিই পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান যেমন সংযোগহীন একটি রাজ্য ছিল, তেমনই দূরতিক্রম্য। প্লেন ছাড়া যাওয়ার উপায় নাই। ক্যামনে হইলো?

ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। আব্বা ঘুমিয়ে থাকলেও মা জেগে আছেন। বোধহয় প্রার্থনার কারণেই ওঠে থাকবেন। মায়ের অনুমতি নিয়ে দীর্ঘদীর্ঘদিনবাদে আমি আমার ছোট্ট রুমটায় প্রবেশ করি। লেখার টেবিলের ড্রয়ার থেকে পেনড্রাইভটা চুপচাপ নিয়ে বেরিয়ে আসি। পেনড্রাইভের মধ্যে কবিতার ম্যাটারটা ভরে নিয়ে তারপর যেন মিললো স্বস্তি। এখানে তিনটি কবিতা রয়েছে। এ-তিনটি কবিতাই এ কে শেরাম মণিপুরী ভাষায় অনুবাদ করে রেখেছেন। আমি আমার মতো করে বাংলায় কবিতা পাঠের পর ইম্ফলের কেউ একজন তা মণিপুরী ভার্সনে পাঠ করবে। এসব করতে করতে কখন যে পৌনে ছটা বেজে গেছে খেয়াল করিনি। খেয়াল হলো কবি নিতাই সেনের কল আসায়। তিনি আমাকে তৈরি হয়ে বেরিয়ে যেতে আহ্বান জানালেন। ছটায় ড্রাইভার আসার কথা। আমি ঝটপট গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। নিতাই সেন আমাকে সাতটার মধ্যে কমলাপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে থাকতে বলেছেন।

শাহিনও আমার সঙ্গে যাবে এগিয়ে দিতে। মায়ার বাঁধন কাটাতে পারছে না। বৈষ্ণব-ধর্ম প্রভাবিত দেশে যাচ্ছি বলে কথা! ঘুমন্ত অনির্বাণ আর দিপ্রকে চুমু খেয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। দিপ্র দিপুর ছেলে। পৌনে চার বছর হবে বয়স। জোর করে আজ আমাদের ঘরে এসে অনির্বাণ আর শাহীনের সঙ্গে বিছানার দখলদারিত্ব নিয়েছে। ওর মা ঘুমের মধ্যেও নিয়ে যেতে পারেনি। দিপ্র বেশ মায়া তৈরি করে যাচ্ছে আমাদের মধ্যে। ও চলে যাওয়ার পর নিঃসন্দেহে ভীষণ খারাপ লাগবে। আমার বুকের ওপর মাথা দিয়ে কেমন মমতার ভঙ্গি ছড়িয়ে শুয়ে থাকে।

হ্যাঁ, এ-এক অসম্ভব প্রাপ্তি আমার, অপ্রত্যাশিতও। ওরা যেদিন নিউইয়র্ক থেকে এলো— তার তিনদিন পরই দেখলাম, ও আমার বুকের ওপর মাথা রেখে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো। অনেক অনেকক্ষণ আমার বুকের ওপর এভাবে শুয়ে থেকে আবার নিজের মনেই চলে যায়। ব্যাপারটা পরদিনও ঘটে; এবং তারও পরদিন— মা দেখে খুশি হন, ‘বুঝলি একেই বলে রক্তের টান!’ আমি এক অনিন্দ্য পুলকরাজ্যে ভেসে বেড়াই। কোনো শিশুর অখ- মনোযোগ পাওয়াটা এমনিতেই আমার কাছে নোবেলজয়ের চেয়েও বড় আনন্দ, তার মধ্যে আবার বুকের ওপর স্বর্গলাভ! আমি অনির্বাণকে চিৎকার দিয়ে বললাম যে, ‘আমাদের দুজনের একটা ছবি তোলো তো বাবা।’ ও মা! দেখো কা-! ছবি তোলার কথা শুনেই দিপ্র ‘নো নো’ চিৎকার করতে-করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গেল তো গেলই, আর আসে না। সেদিন তো আসে না, তার পরদিনও না। তার পরের দিনও আসে না দিপ্র। বোঝা গেল বুকে শোয়ার ব্যাপারটাকে ছবিতে ধরে রাখব, এটা ওর পছন্দ নয়।

এভাবে, পাক্কা তিনদিন পার হওয়ার পর, ও আবার এলো চারদিনের মাথায়, সম্ভবত ভুলে গেছে ছবি তোলার প্রসঙ্গ। এলো ঠিক সন্ধ্যার পর, এসে আবারো আমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আমি যেন হারানো-স্বর্গের বারান্দাটা খুঁজে পেলাম। তার পরদিনও এলো দিপ্র, আগের মতোই অসংকোচে এসে আমার বুকের ওপর মাথা রেখে দশমিনিট, পনেরোমিনিট শুয়ে থাকে পরম নিশ্চিন্তে। আর, এই দিনই কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেললো অনির্বাণ, আমার ছেলে। ও আমার দিকে এগিয়ে এসে ওর মোবাইল সেটটার স্ক্রিন চোখের সামনে মেলে ধরলো। তিন-তিনটা ছবি যে কখন লুকিয়ে তুলে ফেলেছে আমি বা দিপ্র আমাদের দুজনের কেউই ঠিক ঠাহর করতে পারিনি। খুব সুন্দর ছবিগুলো। আমার বুকের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে দিপ্র।

ছবিতে ধরা পড়ার পর ও আর রি-অ্যাক্ট করলো না, হেসে উঠলো ঈষৎ লাজুক ভঙ্গিতে। যেন কী আর করা! তুলে যেহেতু ফেলেইছো! যাও, ক্ষমা করে দিলাম এমন একটা ভঙ্গিমা! ওর এমনসব ভঙ্গিমা দেখে-দেখে আমার কেবল কয়েকদিন ধরে কবি রফিক আজাদের কথা মনে পড়ছিল। তিনচারবার রফিক ভাইয়ের ধানমন্ডির বাসায় গিয়েছি। যতোবারই গিয়েছি তার কোলজোড়ে দেখেছি বসে আছে কোনো না কোনো দেবশিশু। ওরা নড়েচড়ে দুষ্টুমি করে। আর রফিক ভাই ওদের সাথে সাথে নিজেও শিশু হয়ে ওঠে। পারলে নাকি প্রতিবছরই একজন সন্তান নিতেন এই কবি। ছোট্ট বাচ্চারা নাকি তার কাছে বেহেশতের বাগানের মতো ছিল। প্রথম ঘরের চার আর দ্বিতীয় ঘরের দুজন মিলিয়ে মোট ছয় সন্তানের গর্বিত জনক ছিলেন তিনি। কবির মৃত্যুর পর তার প্রথম স্ত্রী আদিলা বকুল রফিক আজাদকে স্মরণ করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘শিশু ও নারীর কাছে নত হওয়া ছাড়া অন্য কারও কাছে নত হওয়া যার ধাঁচের মধ্যেই ছিল না, সেই কবি সেই মুক্তিযোদ্ধা।’  

রাস্তাঘাটা ফাঁকা থাকায় ছয়টা চল্লিশেই পৌঁছে গেলাম কমলাপুর রেলস্টেশন। যানজট ছিল না একেবারেই। ঢাকা শহর তার নাগরিককে রাতভর জেগে থাকার মন্ত্রণা যোগায় বলেই কিনা, সাতসকালটা ছিল বেশ নিরিবিলি। তাছাড়া হঠাৎই শুরু হয়েছিল বৃষ্টির পাখোয়াজ উল্লাস! হ্যাঁ, হাতিরঝিলে যেতে না যেতেই নামলো ঝুম বৃষ্টি। নির্জন একমুখী রাস্তাটায় বৃষ্টির পানির গলাগলি নাচ দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল। আজ তিনদিন ধরেই শ্রাবণের ধারাপাত অজস্র ধারায় বইছে। তবে রাতে কখন থেমে গিয়েছিল কে জানে। আমাদের দেখেই কিনা সকালে আবার ধিতাং হলো।

আমি আর শাহীনকে ছাড়ি না। একাকিত্বকে ভালোবাসি ঠিকই আবার ডরাইও। এই মুহূর্তে একা থাকতে একদমই ইচ্ছে করছে না। এই যে বাইরে যখন বৃষ্টি, কমলাপুর স্টেশনের পাকা বেঞ্চিতে দুজন মিলে বসে থাকায় অন্যরকম এক সুখ আছে। বিড়ির টানের মতো সেই সুখের কিছু গল্প আছে, ঘুলঘুলিতে বসে থাকা বাকবাকুম পায়রা আছে। আমরা দুজন প্ল্যাটফরমের খঞ্জে বসি, গল্প করি— ভবিষ্যতের স্বপ্ন সাজাই। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক