আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর প্রবন্ধ ‘না-ভাষার কবিতা’
প্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০২২
ভাষা যেমন কবিতার বাহন তেমনি ভাষা কবিতার ভারও। আমরা যা ভাবি বা যা তৈরি করতে চাই তা একটি ভাষার আবহে রাখি। কিন্ত কখনো চিন্তা করি না যে ভাষা সব কিছুই প্রকাশ করতে পারে না। কবিতা তো নই। আমরা হাজার বছর ধরে যা ভেবে আসছি তা কেবলই একটি তৈরি ভাষার ছাঁচে লেখা। হাজার বছর ধরে থাকা এই কাঠামোটি আমাদের পাঠে, আমাদের মানসে, আমাদের স্মৃতিতে এমনভাবে শেকড় গেড়ে বসে আছে যে এর বিকল্প আমরা চিন্তাও করতে পারি না।
কবিতা ঠিক আমাদের এই ভাষায় জন্ম নেয় না। আমরা আমাদের অজান্তে, প্রায় জোর করে আমাদের এই জনশ্রুত, জননন্দিত ভাষায় ভাবনাকে সাজিয়ে তুলি। কবির কাজ এই ভাষায় থেকেই কবিতাকে আর একটি ভাষায় রচনা করা। কারণ হিসাবে বলা যায়, প্রথম জন্মকালে কবিতা এই প্রতিষ্ঠিত ভাষায় আমাদের মনে উদয় হয় না। আমরা অভ্যাসবশত এই ‘পাওয়া’ ভাষায় কবিতাতে সাজাতে চাই। তাই কবিতা হয়ে ওঠে পাঠ্য পুস্তকের পড়ার ভাষা, কিছু পরিচিত ভাবনা আর সুন্দর সুন্দর শব্দের খেলা। এতে কবিতাকে কেউ জনবচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ার বিষয়টি চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু আমাদের মেনে নিতে হবে কবিতা আসলেই একটি ছদ্ম-জনবিচ্ছিন্ন কাজ। কবিতা একটা জনগোষ্ঠীর অন্তরে ধরা থাকলেও তা আসলে একটা আলগা, পৃথক রচনাশিল্প। কবিতার কাজ জনসন্তুষ্টিকরণ নয়। জনসন্তুষ্টি হলো গল্প, উপন্যাস ও খবরের কাগজের কাজ।
কবিতার গঠন আমাদের প্রাত্যহিক ভাষার সরল রৈখিক, ব্যাকরণ ভিত্তিক সভ্যতা ও পরম্পরা ধরে ঠিক আগায় না। যারা কবিতাকে আবহমান, জনগণের আশার মোড়কে সাজিয়ে তুলতে চান তারা আর যাই কিছু করে না কেন, কবিতা মোটেই খুঁজে দেখে না, তা ভাবা যায়। এটি একটি বিপদজনক অবস্থা। সত্যিকারের কবিতা এই ভাষাকে লুকিয়ে রেখে নিজের প্রাণের অস্তিত্তকে জানান দেয় বলে, এটি প্রায় না-ভাষায় ধরা একটা মানসিক অবস্থা। তো একজন কবি এই ঝুঁকি নেবেন কিভাবে?
আমার যা ভাবনা তা সবার ভাবনা নয়। তো এখন আমি কি করে আমার ভাবনাটা সবার করে তুলবো? এটি একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয় যখন কবি সবার কথা চিন্তা করে সেই আবহমান ভাষায় কবিতাকে সাজিয়ে তুলতে চান। মনে রাখতে হবে যে কবিতাকে সাজিয়ে তোলার প্রয়োজনেই আমরা ভারবাহি, গুণহীন, অচল ভাষার কাছে চলে আসি। যখন এই সাজিয়ে তোলা থেকে দূরে থাকি তখনই কবিতা নিজেকে রচনা করে ফেলে। এটি একটি পতিত জমির মতোই। আমরা এটিকে ব্যবহার করি আর না করি না কেন, এটি নিজে নিজে ফলমূল জন্মাবেই।
তো একজন কবিতা লেখক এই না-ভাষায় কবিতাকে কিভাবে মূর্ত করে তুলবেন? প্রথমে আমাদের বোধ ও সজ্ঞা দিয়ে আমাদের মনের বাজনাটিকে শুনতে হবে। এটি যে কোনো কারণেই বেজে উঠতে পারে। দ্বিতীয়ত আমার ভেতর ‘হয়ে’ থাকা ভাষার পর্দা সরিয়ে আমার সেই কবিতার ভাষাই কবিতাটিকে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে আমার চোখের সামনে কোনো পাঠক দাঁড়িয়ে নেই। যে আছে সে তো শুধু আমার ভাবনাটি আর আমার আসন্ন কবিতার ভাষা। আমি যদি সমুদ্র ভ্রমণ নিয়ে একাট কবিতা লিখতে চাই তাহলে প্রথমেই আমাকে সেই সমুদ্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ সমুদ্র বিষয়ক ভাষা আমার আগেই কোথাও না কোথাও তৈরি হয়ে আছে। সমুদ্র ভ্রমণ একটি সত্য অভিজ্ঞতা কিন্ত কবিতা ঠিক সেই সমুদ্র-অভিজ্ঞতা নয়। যদি সরাসরি এই সমুদ্র ভ্রমণ নিয়ে আমি কবিতা লিখতে চাই তাহলে এটি আমাদের নিত্য ভাষার, সভ্যতার অচল অংশ হয়ে পড়বে।
তাই যখনই আমার চিন্তায় আর সমুদ্র থাকছে না তখনই আমার কবিতা আর একটি ভাষা পেয়ে যাবে। সমুদ্র ভ্রমণ একটি ঘটনা কিন্তু কবিতা সেই ঘঠনা থেকে মুক্তি। তাই আমার লিখিত কবিতাটি আর সমুদ্র বিষয়ক কবিতা হয়ে উঠবে না। এটি হয়ে উঠবে আমার চিন্তার দ্বিতীয় সমুদ্রলেখা, যেখানে সমুদ্র একটি প্রেক্ষাপট মাত্র। সেই সূত্রে বলা যায় কবিতা আর এক ভাষায় লিখিত হয় বলেই এটি আমার সাথে কথা বলে, পাঠকের চোখকে আর একটি চোখ দিয়ে দেখার প্ররোচনা দেয়।
সৃষ্টিহীন কবি কবিতার ন্যারেটিভিটি পছন্দ করেন। তার কাছে ঘটনা বা প্রেক্ষাপটই প্রধান। কবিতাকে আমাদের পাওয়া ভাষায় লেখার প্রয়োজনীয়তা থেকেই কবিতার ন্যারেটিভিটি কাজ করে। কারণ এটি বেশ সহজ একটি প্রক্রিয়া। এইসব কবিতায় স্বাভাবিক ভাবেই পুরনো শব্দ, পুরনো ম্যাকআপ কবিতাকে অলঙ্কারসমৃদ্ধ ও ভারি করে তোলে। কিন্ত কবির কাজ কবিতাকে ভারহীন করে তোলা, একে শব্দ-উত্তীর্ণ, একে ভাষা-উত্তীর্ণ করা। আমরা যদি আমাদের অভিজ্ঞতাকে, আমাদের জ্ঞানকে, চারিদিকে ছাড়ানো ছিটানো বস্তুর গুণকে এর চিরাচরিত প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে চিন্তা করি তাহলে আমাদের উপলব্ধি সেই প্রাথমিক স্তরেই থেকে যায়। এতে করে আমাদের বোধের কোনো ডাইমেনশন ঘটে না। আবহমানের কবিতা এমনই হবে। আর যখন এই অভিজ্ঞতাকে, বস্তুজ্ঞানকে এর তৈরি গুণের বাইরে চিন্তা করি তাহলে শব্দ শব্দ-উত্তীণ, ভাষা ভাষা-উত্তীর্ণ হবে।
যেমন ছুটে চলা পাখির উড়ালকে আমরা আমাদের তৈরি ভাষায় সাজাতে চাইলে আমরা নিটোল নেরেটিভিটির আশ্রয় নেব। আমরা আকাশ, পাখি, পাখির ডানা, দূরের প্রিয়জন এইসব আমার সভ্যতালব্ধ ভাষার ছাঁচে কবিতাটাকে লিখতে সচেষ্ট হবো।
এই প্রাণহীন, ক্লিশে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এই দৃশ্যটিকে আমরা যদি আর একটি নতুন ভাষায় লিখতে চাই তাহলে আমাদের দেখা আর ভাবার ভিতটিকেও বদলে ফেলতে হবে। ভাষা চিন্তার অনুগামি, তাই এই পাখির এই দলবদ্ধ উড়ালকে আমরা যদি ভিন্ন ডাইমেনশনে চিন্তা করি তাহলে এই ন্যারেটিভিটি বদলে যাবে, ভাষাও বদলে যাবে। আমাদের চিন্তা করার পদ্ধতি আর ভাষার মায়া, উভয়ই আমাদের এই রকম ভাবতে বাঁধা দেয়। তাই প্রথমেই এই প্রতিষ্ঠিত চিন্তাপদ্ধতি আর ভাষার গঠন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক: কবি