আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর প্রবন্ধ ‘জীবনানন্দ ট্রমা’
প্রকাশিত : আগস্ট ১৩, ২০২৩
আধুনিকতাবাহিত যুক্তিনির্ভর ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের বাইপ্রোডাক্ট— অপার শূন্যাতা ও নির্জনতাবোধ, অনিকেত জীবনভাবনা ও একজোড়া ভ্রামণিক চোখের পাশপাশি, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় যে আরও একটা পালক যোগ করছেন, সেইটা হইল জীবনানন্দ ট্রমা। গ্রামবাংলার নিসর্গে ক্ষণিক আত্মতৃপ্তির জীয়নকাঠি পাইলেও শেষ পযন্ত ‘লাশকাটা ঘর’ই তার কবিতার সাইকি। এখন আমাদেরকে দেখতে হবে এই রোগ তিনি পাইলেন কোথা থেকে? ট্রমা হইল এমন কোনও ঘটনা যা কোনো ব্যক্তি ক্ষতিকারক বা হুমকি হিসাবে উপলব্ধি করে এবং সেই ব্যক্তির সুস্থতার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। লোকেরা অনেকগুলি উৎসের মাধ্যমে ট্রমা পাইতে পারে। তবে এর মধ্যে যুদ্ধ, অপরাধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈষম্য, মানবিক শক্তির অপব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এই অভিজ্ঞতাগুলি ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে যা বছরের পর বছর স্থায়ী হইতে পারে। মানসিক আঘাতের প্রভাব ব্যক্তির সম্পর্ক, কাজ- শিল্পকাজ, স্বাস্থ্য ও জীবনের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে।
জীবনানন্দের পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন, পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিছিলেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তার মানবহিতৈষী কাজের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। তার পরিবারকে বরিশালে শিক্ষিত ও সম্মানীয় বইলা সবাই মনে করত। তাই বলা যায়, জীবনানন্দ ও তার পরিবার পরিজন বাংলাদেশের বরিশালের জনসমাজ থেকে এমন কিছুর দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হন নাই যাতে তিনি ট্রমাতে ভুগতে পারেন। তো তাহলে কী কারণে বা কোথা থেইকা তিনি ট্রমা পাইলেন? কেন তিনি তার কবিতায় বারবার নিঃসঙ্গতা, শূন্যতা, নিরীশ্বর, মত্যু ও আত্মহত্যাচেতনা ইত্যাদি সিরিয়াস, নেতিবাচকবোধগুলি আমৃত্যু ধরে রাখছেন?
আমরা ধারণা করতে পারি, তার উপরোল্লিখিত বোধগুলির জন্ম হইছিল দুই কারণে। এক. আঠারো শতকে ইউরোপের তথাকথিত এনলাইটেন্টমেন্টের কোলে জন্ম নেয়া সর্বব্যাপি যুক্তি ও অপার স্বাধীনতার অধিকারের নাম করে চিন্তার বিপর্যয়, মানুষের জীবনের স্বাভাবিক সংগঠন ও উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে বস্তু ও বস্তুধর্মে নিজেকে আত্মসমর্পণ। দুই. উপরোক্ত আদর্শবোধের নিচে জন্ম নেওয়া মানুষের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ববোধ, তার রেসিয়াল সুপারিয়টির ভাবনা ও মুনাফাখোর উদার, মুক্ত ও পুঁজিবাদি বাজারব্যবস্থা। কবি শিল্পী সাহিত্যিকেরা অতি স্পর্শকাতর মানুষ। তাই তাদের মানসিক বিপর্যস্ততাবোধ বেশি। কর্মহীনতার কারণে জীবনানন্দ তার কাছের লোকজন দ্বারা এবিউজের শিকার হয়ে থাকতে পারেন, কলেজে অধ্যাপনার করতে গিয়ে, অশ্লীল কবিতা লেখার দায়ে বুলির শিকার হইছেন এবং পরে চাকরি হারাইছেন। এছাড়া কবি সাহিত্যিক-সমালোচক বিশেষ করে সজনীকান্ত দাস থেকে বিরামহীন ভাষা-সন্ত্রাসের শিকার হইছেন। এইগুলি তাকে মানসিকভাবে টর্চার করতে পারে, যার মাধ্যমে তিনি ট্রমাটাইজড হইছেন, এবং তার জীবন সম্পর্কে একটা এলিনিইয়েটেড মানসিকতা সৃষ্টি হইয়া থাকতে পারে।
সতের ও আঠারো শতকে খ্রীস্টান ধর্ম যাজকদের সমাজ ও রাষ্ট্রে দানবীয় প্রভাব ও মনগড়া দেহবেড়ি ও মনবেড়ি থেকে বের হয়ে, বিশেষত কান্টের এনলাইটেন্টমেন্ট ডিস্কোর্স মাধ্যমে পাওয়া পিওর রিজন নামক এক নেগেটিভ অপশক্তির কাছে আধুনিক মানুষেরা মাথা নত করে। তার হাত ধরে উঠে আসা হঠাৎ আলোর ঝলকানির নিচে যে নেতি ও নাস্তির কালো গহবর জন্ম নিতেছিল, জীবনানন্দ আধুনিক শিক্ষিত মানুষ হিসাবে, নিজেকেও তাতে সঁপে দিছিলেন বইলা মনে হয়। বলতে গেলে তার ভাব ও ভাষার উড্ডয়ন সেইখান থেকে শুরু এবং তার এই সীমাবদ্ধ ডাইনামিক্সের ভেতরেই তার কবিতার প্রাণভোমরাটির উত্থান ও পতন। আমাদেরকে বুঝতে হবে, জীবনানন্দের যে ট্রমা তা আসলে আধুনিক বাংলা কবিতারই ট্রমা। আধুনিকতা ক্লাসিকল লিবারেলিজমের হাত ধরে প্রথমে ইউরোপ, আমেরিকা ও ঔপনিবেশিক ব্যবসায়ী ও শাসকদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভারত উপমহাদেশসহ সারা পথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছিল। এর সাথে সাথে ফ্রি মার্কেট যেখানে চালু যেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ চালু, যেখানে মানুষের কোনো রক ফেইথ নাই সেখানে মানুষ দ্বিধান্বিত, নিঃশেসিত, আস্তিত্বিক বিস্ময়বোধে অসুস্থ । তাই তার ভাষা তার মতই বিচ্ছিন্ন, মরবিড, সুসাইডাল ভাষা, এইটা জীবনানন্দের একার নয়, তখনকার ‘আলোকিত’ মানুষের কৌমভাষা ছিল। জীবনানন্দ এইটাকে ঐতিহ্য হিসাবে পাইছিলেন। জীবনানন্দের এই সাইকি কোনোদিন আর ইভোলভ হয় নাই, বরং যতদিন অতিবাহিত হয়েছে ততই এর পুরত্ব ও ঘনত্ব বাড়ছে। যার ফলে এর ইমপ্লিকেশনও হইছে মারাত্মক। কারণ তার কবিতা থেইকা তার পরবর্তী কবিরা এক জীবনানন্দ-ট্রমার লিগ্যাসি পাইছে এবং আধুনিক বাংলা কবিতার সংজ্ঞাকে ক্রমান্বয়ে এই জীবনানন্দ-ট্রমার ভাষায় নির্মাণ এবং বিনির্মাণ করতে পারছে।
জীবনানন্দের আপাত নিরীহ কবিতাভূবনের নিচে তার যে একটা রক্তাক্ত মনোভূমির ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, সেইটা পঞ্চাশ ষাট দশক থেকে শুরু করে আজও পর্যন্ত উভয় বাংলার কবিদের সাইকিতে স্থায়ী ছাপ মারতে সক্ষম হইছে। তার ট্রমা থেইকা তিনি এক প্রকারের ভয়, অবিশ্বাস, আত্মবিশ্বাসহীন এবং পলাতকি মনোভাবে ভুগছেন এবং তিনি তার কাব্য-মানসলোকে এর প্রতিফলন দেখতে পাইতেন। তাই আমরা তার কবিতায় অবসাদ, অন্ধকার, আত্মহত্যা, লাশুকাটা ঘর, শব, পেঁচা ইত্যাদি ট্রমা-কেন্দ্রিক বিষয় আশয়, উপমা ও চিত্রকল্প দেখতে পাই। এতে কোনো সন্দেহ নাই যে, ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজি শিক্ষা ও শাসন ব্যবস্থা এনলাইটেন্টড বাঙালিদের মধ্যে, ইংরেজদের মতো করে সভ্যতার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাইছিল। কবি-সাহিত্যকেরা এর থেকে বাদ পড়ে নাই। জীবনানন্দ ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। স্বাভাবিকভাবেই তার পড়া ছিল রোমান্টিক কীটস, শেলি, বাইরন এবং আধুনিক ইয়েটস, এলিয়ট, পাউন্ড ইত্যাদি কবি সাহিত্যেকদের লেখা। তবে মনে হয় তার ওপর যে বিদেশি কবি বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারছিল সে হইল শার্ল বোদলেয়ার। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ এইখানে একটা বড় ভূমিকা থাকতে পারে। কবিতার পাঠক দেখবেন যে, তার কবিতায় শব্দ অলংকারের তেমন কোনো কাজ নাই, অর্থ অলংকারই তার বড় শক্তি। তিনি মাইকেল বা রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যে বড় হইলেও তাকে মাইকেলীয় বা রবীন্দ্রভাষা, বিষয়বস্তু খুব একটা টানে নাই। শুধুমাত্র তার, ব্যক্তিগত ও সমাজকেন্দ্রিক যোগাযোগ এবং তার ফলে যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং রক্তক্ষরণ চলছিল তার সাথে অভূতপূর্ব উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও ইউরোপীয় ইম্প্রেশিনিস্ট ধারার এক ধীর, বাস্তব এবং পরাবাস্তব ভাষা মিশাইয়া এমন একটা মায়াভাষা তরি করলেন যে কবিতা কবিতাপড়ুয়া আপাত একটা নতুন, অভূতপুর্ব কবিতাপাঠ অভিজ্ঞতার স্বাদ পাইল।
একটা দেশ ও সমাজের লোকেরা যখন পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত একটা বিশেষ চিন্তাধারা ও ভাব-বলয়ে নিজেকে লালন করতে থাকে, তখন তার পঠন-অভ্যাস ও সৃষ্টিশীল কাজগুলি সেই ধারায় চলতে থেকে এবং এর সাথে সাথে তার ভাষাও বদলাইতে থাকে। বিশ শতকের দুই দুইটি বিশ্ব যুদ্ধ ইউরোপীয় গণ মানুষের মন ও মগজ যেমন করে বিশ্বাস থেকে দূরে সরাইয়া নিছিল এবং অস্তিত্ববাদিতার অপার শূন্যতাবোধ, নিঃসঙ্গতা, অনিকেত ভাবনা, নাস্তিক্যবাদে ধাবিত করেছিল তা আগে কখনো ইতিহাসে ঘটে নাই। এইটার সাথে সাথে ঊনিশ ও বিশ শতকের যন্ত্রনির্ভর, শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে আসা আগ্রাসি পুঁজিবাদ মানুষকে করেছিল একাধারে পুঁজি ও বস্তুতান্ত্রিকতার দাস। সভ্যতা ও সমাজের এই যে গতি, তার ফলাফল মানুষের চিন্তা, শিল্পকলা, তার লেখালেখিতে পড়তে বাধ্য। তাই পৃথিবীর অসুখ মানে জীবনানন্দের অসুখ। আধুনিক মানুষের অস্তিত্ববাদি অভিশাপ হইলো এই যে, মানুষ যতই এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাইতে চায় ততই সে এর দিকে ফিরে ফিরে আসে। এর থেকে তার কোনো রেহাই নাই। আমরা দেখছি যে, অস্তিত্ববাদি দার্শনিক ও ঔপন্যাসিকেরা জীবনের এই অর্থহীনতাকে অর্থ দিতে চাইছে, তারা মত্যুর মুখোমুখি হয়ে সাহসের সাথে এইটাকে মোকাবেলা করতে চাইছে। কিন্তু যেহেতু এদের এবস্যুলুট সত্য এবং আত্মার মত্যু পরবর্তী অবস্থানে কোনো বিশ্বাস ছিল না, তাই তারা সেই অন্ধকার গহ্ববরে পইড়াই থাকছেন। তো প্রশ্ন আসে, জীবনানন্দ দাশ কবে থেকে এই ভাবনার শিকার হইলেন?
তার প্রথম দিকের কবিতাগুলি পড়ে দেখলে বুঝা যায় যে, বাংলাদেশে অবস্থানকালীন কবির মন কিছুটা স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু দেশভাগের পর কলিকাতা যাওয়ার পর তার কবিতার স্বর পাল্টাইতে থাকে। মানে পারিবারিক অশান্তি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সাথে কলকাতার নগর জীবনের অন্ধকার জীবনানন্দের সাইকিতে হানা দেয় এবং তার জীবন ও অস্তিত্ব বিষয়ক চিন্তাধারা নেগেটিভ হইতে থাকে। তার সারা জীবনের কবিতাগুলি নাড়াচারা করলে বুঝা যায়, জীবনানন্দ বড় অসুখে আক্রান্ত, এই অসুখ কোনো প্রিটেনশন নয়, সত্য ক্রনিক মানসিক ট্রমা, যার থেইকা তিনি আর বার হয়ে আসতে পারেন নাই। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’থেইকা শুরু করে শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ পর্যন্ত এই ট্রমাতাড়িত কবিতার যাত্রা অব্যাহত থাকে।
তাহলে আমরা কোনো বিকল্প জীবনানন্দের কথা চিন্তা করতে পারি কিনা? বা বিকল্প ভাষার কবি। জীবনানন্দের সমকালীন আরো যে কয়েকজন কবি ছিলেন যেমন সুধীন দত্ত, বিষ্ণ দে, বুদ্ধদেব বসু তাদেরও কম বেশি এই ট্রমা আক্রান্ত করছিল। শুধুমাত্র অমিয় চক্রবর্তী তার একটা শুভবোধ ও কল্যাণময় দষ্টির কারণে আধুনিক কবিতায় কিছুটা আধ্যাত্মিকতার সুরা নিয়া আসছিলেন যা তার বিখ্যাত কবিতা ‘সংগতি’ পড়ে আন্দাজ করা যায়। পরমের শক্তি ও মমতায় তিনি আশ্বাস রাখছিলেন। কিন্তু জীবানন্দের সহজ, কিন্তু সাটল মায়াভাষার ক্রমান্বয় বিস্তার এবং পাঠনের নিমজ্জনের কারণে তা তেমন স্তায়ীত্ব লাভ করে নাই। অন্যান্যরা যেহেতু জীবনানন্দের ইসেন্স এবং কনশাসনেস পান নাই ,তাই তাদের ভাষার এত সাব্লিমিটি এবং ক্রিয়েটিভিটি নাই। সুতরাং জীবনানন্দের বিকল্প শুধুই জীবনানন্দ। অন্যদিকে সমসাময়িক কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একদম ভিন্ন চরিত্রের কবি। যে ভাবধারা আর চিন্তাকল্পে তিনি আক্রান্ত ছিলেন তা শুধু সাবঅল্টার্ন, সর্বহারা, বিক্ষুদ্ধ মনের সাইকি যা বাংলা সাহিত্যে অন্য একটি দ্রোহী, সামাজিক ও রাজনতিক প্যারাডাইম সষ্টিতে সক্ষম হইছিল। সেই অর্থে তার ভোকবুলারি লক্ষ্যভেদি, আগুনের ভাষা। কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যবাদী কবি, সামাজিক কল্যাণের কবি। তাই ব্যক্তিগত মনোবিকারের সময় তিনি পাননি। এই কারণে তার কবিতার সাথে বাঙ্গালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হইছিল বলা যায়। তিনি যে ভাষার কবি সে ভাষার কেন্দ্রে একটি যুগের আশা আকাঙ্ক্ষা, দ্রোহ বিদ্রোহ প্রবল-ভাবে ধরে রাখার কারণে তার অনুসারি ব্যাপকভাবে দেখা যায় নাই। নজরুলের ট্রমা নাই, আছে শেলি ও ওয়াল্ট উইটমেনের মতো সোস্যাল ইনজাস্টিসের প্রতি গর্জে ওঠার দুর্বার মানসিকতা। আধুনিকতার ব্যক্তিসাতন্ত্রবোধ তাকে খুব একটা আক্রমণ করতে পারে নাই। তাই বাংলা কবিতার আধুনিকতার, ক্লিনিক্যাল ক্রনিক ডিজিসটাকে ডায়াগনজ করতে জীবনানন্দের কাছেই ফিরে আসতে হয়।
জীবনানন্দের পর বাংলা কবিতা কোথায় গেল, কোন দিকে আগাইতেছে? প্রশ্ন করি। একটা নিবিড় পাঠ অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে জীবনানন্দের পরের কবিতা কম বেশি তার এই ট্রমা দ্বারাই আক্রান্ত। তার এলিমেন্টসই বেশি। তবে একটু পার্থক্য আছে। জীবনানন্দেরটা খাঁটি, শরীরের ভেতর রক্ত চলাচলের মতো, পরবর্তীদের কবিতায় ট্রমাগুলি কিছুটা নকল, কিছুটা ঐতিহ্যের অভ্যাস। পরবর্তী দশকেই অবশ্য আর একজন কবি বাংলা কবিতায় নিয়া আসেন স্বপ্ন, আশ্বাস, আত্মবিশ্বাসের বাণীবদ্ধ কবিতাবলী। চল্লিশের আধুনিক, শক্তিশালী কবি ফররুখ আহমদের কবিতার মধ্যে বিশ্বাসি ধারার যেই উত্থান দেখা যায় তা আধুনিকতার বেরামের বিরুদ্ধে অনেকটা উপশমের কাজ করছে। তার নিজস্ব পোয়েটিক ডিকশন, রূপক, উপমা ইন্টারটেক্সচ্যুয়ালিটি এবং তার কবিতার বিষয় আশয় এত বেশি ইসলামিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য নির্ভর যে তা বাংলা কবিতার একটা আলাদা, প্রাণময়, গৌরবের কবিতা-ভূবন সৃষ্টি করছিল। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির ব্যাপক পরিবর্তন, গ্লোভালাইজেশন ও মুনাফালোভী, আদর্শহীন কোর্পোরেট ব্যবসায়িক সংস্কৃতির কারণে তলে তলে মানুষের কনশাসনেস, মানুষের শিল্প-রুচিবোধ যেভাবে বদল হইতেছিল, যেভাবে কবিতার ‘শুদ্ধ ফর্ম’ ভেঙে উত্তর আধুনিক ভাষায় -ফার্গমেন্টেড, বহুস্তরভিত্তিক চেতনাবোধের কাব্যকলা-কৌশলের চর্চা হইতেছিল, সেই বদলের ধারায় ফররুখের কোনো উত্তরসূরি আর পাওয়া গেল না। এইটাই হয়ত স্বাভাবিক ছিল। তাছাড়া কবি ও পাঠকের কাছে অন্ধকার এবং আত্মহত্যার মায়া-ভূবনটিই বেশি আকর্ষণীয় ও নন্দনীয় হয়ে থাকলো।
তাহলে উপায় কী? এই জীবনান্দ ট্রমা-কেন্দ্রিক কবিতা-বলয় থেইকা কবিতার স্বরূপে, কবিতার অন্তর্নিহিত ভাষাবোধে, কবিতার নিরাময়ী, শুশ্রুষাময় মালভূমিতে আমাদের পদচারণা কীভাবে সম্ভব? বাংলাদেশের কবিতা কোন দিকে আগাইব?। তার উত্তরে বলা যায়, বাংলদেশের কবিতাকে তার নিজের ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় পরিচয়, তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মগৌরবের কাছে ফিরে আসতে হবে। তার যৌথ সাংস্কৃতিক ফলন ও অর্জনের কাছে ফিরে আসতে হবে। তথাকথিত এনলাইটেন্টমেন্টের হাত ধরে ‘খোদাহীন’ আধুনিকতার গহ্বরে বিশ্বাসের যে গ্রামটি হারাইয়া গেছিল, তার খোঁজ করতে হবে। মানে মানুষ হিসাবে আমাদের যে যৌথ জীবন-বিশ্বাস, যে জ্ঞান ও প্রতীতী, যে আচার নিষ্ঠা আমরা দৈনন্দিন ভাব ও ভাষায় পালন করতেছি, তার দিকে ফিরে আসতে হবে। কবিতা আমার জীবন বা কবিতা ছাড়া আমি বাঁচবো না, এই জাতীয় দায় দায়িত্বহীন শেখা বুলি বাদ দিয়ে ভাবতে হবে, তার হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক অঙ্গীকারটা, ধরতে হবে তার উদ্দেশ্যটা। জানতে হবে, সে কীভাবে তার দেশ, কাল, মানুষ, মানুষের জঙ্গম কালচারের সাথে নিজেকে রিলেট করে। কবিদের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব দরকার, কিন্তু তাই বইলা একাকিত্ব যেন তার সাইকিকে, তার কনশাসনেসকে গ্রাস না করে। এটি কী করে সম্ভব? এটি সম্ভব যখন কবি ও পাঠকেরা নিজেদেরকে এই মহাপৃথিবীর বিস্ময়কর পরিকল্পনা, তার উদ্দেশ্যপূর্ণ সঞ্চালন, এবং এই সঞ্চালনটির নিউক্লিয়াসে থাকা ‘পরম’কে চিনতে পারবে, সেখান থেইকা একদিন হয়ত নতুন ভাষার সষ্টি হবে।
হেগেল এরকম একটা চিন্তা ধারণ করছিলেন। মানুষের ঐতিহাসিক সঞ্চালন, তার কনশাসনেস এর উত্থান, যা পরম আদর্শকে অনুসরণ করে একটা বহত্তর মিলন ধারার সাথে মিশে যাওয়ার জন্য তৈরি হইতেছিল। হেগেল আরও বলছেন, অসুখী চেতনা হইল বিশ্ব ও ধর্মীয় চেতনার অস্বীকারের ফল। অন্যরা যেমন ধর্মকে প্রায়শই ব্যর্থ জীবনের আশ্রয় হিসাবে দেখে- তেমন করে দেখলে হবে না। একটি অতীন্দ্রিয় সত্তার ওপর পুরা মনোনিবেশ করার মাধ্যমে জীবনে সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায়। দুনিয়াতে মানুষ এবং বস্তুর স্বরূপের চেতনায় প্রবেশের প্রাথমিক প্রচেষ্টা হইল এই একক, স্বার্থপর ব্যক্তিকতা থেইকা দায়িত্বশীল, ইতিহাস এবং সমাজমনষ্ক ব্যক্তিকতার ভেতর দিয়া যাওয়া। আর এভাবে চেতনা বিকাশের পরবর্তী ধাপ হল ধর্ম। ধর্ম মূলত নিজের সম্বন্ধে সচেতন একটি সমষ্টিগত চেতনা, এবং তাই এইটা নৈতিক জীবন এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে ভারসাম্যকে ধইরা রাখে। হেগেল ধর্মের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় বর্ণনা করেছেন, যার প্রতিফলন হইলঃ শিল্প, মিথ ও নাটক।
যেদিন আধুনিক মানুষ এই পরম-চেতনাবোধ থেইকা সরে আসছে এবং কেবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের নাম করে, নিজের ‘পরম’ সত্তাকে ভুলে- তথাকথিত এনলাইটেন্টমেন্টের নির্যাসে, একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, তার ক্রিয়েটিভ নেতি এবং নাস্তিবোধের দিকে মন ও মেধাকে কেন্দ্রীভূত করছে সেদিন থেইকাই তার স্বরূপ, তার ঐতিহাসিক চেতনার রুগ্ন, মূমুর্ষ অবস্থার সৃষ্টি হইছে। জীবনানন্দও এই ফাঁদে পা রাখছিলেন এবং আধুনিক বাংলা কবিতার লিগ্যাসিতে ক্রনিক, রুগ্ন চেতনাবোধের উপহার দিয়া গেছেন।
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে আমি দুটি কবিতা লিখছি। একটার নাম ‘জীবনানন্দ দাশ স্মরণে’ যা আমার তৃতীয় কবিতার বই ‘পলাশী ও পানিপথ’(২০০৯) এ ছাপা হইছে। আর একটা হইল নিচের কবিতাটা (২০২১)। এইটাকে জীবনানন্দ দাশকে নতুন চোখে দেখার কবিতা বলা যায়।
ভাষা
ভাষা এক জীবনানন্দ!
শুধু অনিশ্চয়তার দিকে যায়
আর অসীম মা’বুদ ভুলে যায়!
তিমির ডিঙিয়ে ছায়াগুলো আসে
চারদিকে করোটি কঙ্কাল ভরে যায়।
দেখি শত্রুফুল, দেখি ভাই মারছে ভাইকে
হারানো কাবিল তার কবর খুঁড়ছে মাঠে।
ভাষা এক জীবনানন্দ!
যেন অতি পাতাল মুখ- হা
যেন জানালায় লাল রক্ত, হনন পিপাসা।
তুমি কি নেবে না সেই গলাকাটা উট?
হিম হিম শরীর, দরজা খুলছে না, পথ আসছে না
শুধু কুক কুরু কুক করে
ডানা ছিন্ন- পানকৌড়ি, দলছুট!
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক