আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর ছয়টি কবিতা

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৮, ২০২১

সালাম বাংলা

সালাম বাংলা, তোমাকে নিয়েছি গুপ্ত ডালিমে
স্কুলের টেবিলে, গোসলের অতি গরম পানিতে।
জনকলরব, লোহার পাথর, খানসেনা আর
পলাশী সিরাজ, ইমাম হোসেন কারবালা খঞ্জরে!
যেনবা আমার কলিজা তোমার
যেনবা তোমাকে দিয়েছি হাজারো পানিপথ!
তোমার শুধুই জয় হোক—ওগো অক্ষয় হিমালয়!

তুমি কি শুধুই সীমানা ছাড়াবে—রক্ত লেগুনে?
কী চাও শিকারি ভাষায় গোলাপ গোকূলে
সবুজে পতাকা পেরিয়ে পাগল কিশোরে?
আমাকে কী দান করবে বলো এ ছিন্ন সকালে?
তামার পাত্র গলিয়ে সাজাবে মনসার বিষ?
নাকি ফেলে যাবে ভারতবর্ষ, নো-ম্যানস ল্যান্ডে?
শরীরে আমার জমেছে খণ্ড বরফ এবং পিপাসার আলো
হাঁটছি রায়টে, বোমারু বিমান, ঘুমন্ত ঘোড়াশালে!
সালাম বাংলা, আমাকে শুইয়ে ধরো তুমি গোপন পাতালে
আমার জানালা বন্ধ! বন্দি আমি রাক্ষসের দখলে!

পুরস্কার

পুরস্কারের কথা বলব না আমি।
তোমরা এই হাতিগাছ নিয়ে চলে যাও
পলাশী, আম্রকাননে।
দেখো—লর্ড ক্লাইভ কিভাবে কাছে টানছে
জগৎ শেঠ, রাজা রাজবল্লভ। আর
দেখো একটি ভাঙা নৌকা ও
সিরাজের পরিত্যক্ত জুতাখানি।
আর শোনো মর্মাহত মুর্শিদাবাদ,
তার দেয়ালের
হায় সিরাজ হায় সিরাজ প্রতিধ্বনি!

তার চেয়ে আমি বাদ মাগরিব এইসব পেস্তা বাদাম
আর মাঠভরা খরগোশের রূপ নিয়ে বসে থাকব।
দেখব অড়হর পাতার শিষ,
দেখব একটি কপিফুলের তন্দ্রা ছিঁড়ে
নেমে আসছে হাজার হাজার মৌ-দরবেশ।
আমি শুধু সারি সারি সবুজ চাই
চন্দ্রচোরদের তরমুজ বাগানে।
যেখানে লাল নিয়ে নৃত্য করছে
এতিম পিঁপড়েদের দল।

হাশর

আমিও হঠাৎ উড়ে পড়ব সীমান্তে তপ্ত বালিসৌধে
গুলিবিদ্ধ ডানা আর রক্তচক্ষু উজাড় করে দেখবো
গুটি পোকার মতোন মানুষের ঢল, খা খা বায়ুস্বর
আত্মভোলা ছায়াসেবীদের ঘুর্ণিনৃত্য—অগ্নিঘর ।  
দেখবো আকাশ চূর্ণ হয়ে পড়ছে অবাক লোকালয়ে!
যেন কার্পাসের ফুল, মাথায় রোদের ছুরি— জল,পানি দূর।
তখন একাকী নিরিবিলি তোমার পাগল দুটি চোখ,
হে পারস্য থেকে ডানা ঝাপটিয়ে আসা—
বিস্ময় সুন্দর!  আমাকে কি চোখ তুলে দেখবে না?
যখন সন্তান চিনবে না তার মাতা ও পিতাকে,
বোন চিনবে না ভাইকে— যখন সারি সারি
আগুনের ড্রাগনকলাম—  দাউ দাউ
গলা পর্যন্ত উঠবে।
বালকেরা বুড়ো হয়ে যাবে ক্রমাগত,
চারদিকে মানুষের কলরব— বাঁচাও বাঁচাও।
সূর্য গিলে খাবে মস্তকের টাটকা গোলাপ।
তুমি কি তাকাবে না আমার দিকে?
ভাবিয়ে দেবে না এক বৃষ্টি পড়া রাতের করবীগান?
একটা ডালিম গাছ বেয়ে নেমে আসা ত্রস্ত গিরগিটি।
জাগিয়ে দেবে না পদ্মনাভ পাতালের ঘুম ভেঙে
গলাগলি করে থাকা দুটি হতভম্ব মাছরাঙা পাখি!

অক্ষয় বাঙলা

মাইকেল মধুসূদন দত্তকে

অক্ষয় বাঙলা, তুমি স্বর্ণগর্ভ— সহস্র ভাষার!
আরবি, ফারসি, তুর্কি, পুর্তগিজ, আর্য বা পাহাড়ি
ভাষাভাব নিয়ে রঙ্গ করো, আলো নাচাও আশার।
কত প্রাণ কত গান তোলো— মধুর রাগিনী ভারি।
তোমার তো নাই লোকঘৃণা— জাতি, বংশ, কুল
নিজেকে বিলিয়ে নির্বিচার কোলে নিয়েছ বিশ্ব।
কিন্তু যদি আমি ভালোবেসে লিখি, আল্লাহ ও রাসুল
আমাকে আসামি করে নিদারুণ কবি ও শিষ্য।
আমাকে ঝুলিয়ে দেয় তারা রক্ত-কবিতার ক্রুশে।
জননী তোমাকে যেন চাই নাই কবিতা-কুহকে
তোমার দুধের স্বাদ উপভোগ করিনি আশ্লেষে।
বাঙালি মুসলমান যদি বাস করে বাঙলা মুল্লুকে
আমি কেন দোষী হই লেখালেখি কবিতা-যাপনে?
আল্লাহ দিয়েছে ভাষা, বাংলা বাঁচে অনেক বচনে।

বাজি

কবিতাই তো লিখব। খুন তো করব না!
তাই তাক করেছি ইশক-ক্যালিবার বুক বরাবর।
নাও দিল দস্তানা, নাও আর গুলি করো গোলাপের
পাপড়ি দিয়ে। আমি গন্ধ শুনে আজান দেব
বেগানা সব পাথর ও পথিকে। যেন তারা
আগুয়ান এক হাতিসেনা—পলকে নিহত করেছে
নিজেদেরকেই। তার চেয়ে তুমি
শুয়ে থেকে পীর-মাছেদের মাস্তানা দেখ।
তোমার নাম শুনে
ফুটে তারাবাতি, ফুটে কাফ্রি কালোদের পাখি।
উড়ে যায় কলহঘুঘু, পায়রা ও নিষাদ।

বাদ ইশা

কী রকম ঘোর লাগে বাদ ইশায়। আশ্চর্য! সব রাস্তা নদী হয়
ডানা পায় চন্দ্রজীবী নারী মৎসকুল। দু’চোখ আন্ধার হয়
দেখি লক্ষ ঝাড়বাতি কল্বের ভেতর।
আল্লাহ আল্লাহ রব-বেমালুম ভুলে যাই নাম ও সাকিন!
দরুদে প্রহর কাটে—প্রিয় নবি মোহাম্মদ—রাহমাতুল্লিল আলামিন।
ফুলে ফুলে মা চাই, মায়ের নামে পাঠশালা খোলা
শত মক্তবের আরবি অক্ষর।
আমি শূন্য আমি ধন্য অসীমের মাঝে। যেন গাছপোকা
নিজেরে হারিয়ে খুঁজি কালো সব গোবরের পাঁকে।
সাত আসমান জোড়া লাগে, সিরাজ সিরাজ করে বৃষ্টিভেজা
পলাশী প্রান্তর। তুমি থাকো দূরে, তবু খোলে চোখ যেন
মাঠে মাঠে নেচে ওঠে হিরামন কইতর।
কে পাগল কেবা নিরঞ্জন
কার আছে সোনা-রূপা ভাড়াটিয়া কবি?
সবই হাজির হয়—রেকাবে কাবাব পুড়ে
জলপাই পাতা জানে মাংস পোড়ার খবর।

কীরকম ঘোর লাগে বাদ ইশায়। আশ্চর্য! কাকপক্ষি কথা বলে
ঠোঁট মেলে কাছে আসে লাল-নীল বট বল্কল।
ভাইবোন বাতি ধরে—তাদের কবরগুলি দুধশাদা ঘর!
নিজের ভেতর নিজে জ্বলি—যেন সারা গ্রাম জ্বলছে পিপাসা-ধূপে
তুমি নাই আমি নাই, ঘর করে জিনপরি, পিঁপড়া সকল।