আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘পৃথিবীর জন্মকথা’
পর্ব ২
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৫, ২০২১
সূর্যকে মাঝখানে রেখে ঘুরছে গ্রহের দল
কোত্থেকে আর কীভাবে তা তৈরি হলো বল।
শূন্যের ওপর সৌরজগৎ ঘুরছে যে বনবন
ক্যামন ছিল এসব কিছু সৃষ্টি হওয়ার ক্ষণ?
কোটি কোটি বছর আগের কথা। চাঁদ, সূর্য, আমাদের এই পৃথিবী, রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা অসংখ্য নক্ষত্র— এসব কিছুই তখন ছিল না। ছিল শুধু নীহারিকা। মেঘের মতো পুঞ্জীভূত বাষ্প এই নীহারিকা। এটা থেকে আলো বিকিরণ হয়। এখনো কোটি কোটি নীহারিকা মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাধারণ চোখে তাদেরকে দ্যাখা সম্ভব নয়। এজন্য দরকার খুবই শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র। গ্রহ-উপগ্রহসহ অসংখ্য সৌরজগৎ সীমাহীন মহাকাশে চাকার মতো অবিরাম ঘুরে চলেছে, এই আবর্তন নীহারিকা থেকেই শুরু হয়েছে। যে নীহারিকা থেকে সৌরজগৎ উৎপত্তি, সেটা চাকার মতো ঘুরছিল। পরে তা সাপের গতিতে ঘুরতে আরম্ভ করে।
নীহারিকা থেকে শুরু করে যে আবর্তন আজ পর্যন্ত বিশ্বজগতের প্রতিটি পদার্থে অবিরাম চলছে, এর কারণ কি? এর কারণ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কি? সৌরজগতের প্রতিটি পদার্থের অণু-পরমাণু পরস্পর পরস্পরকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। এই আকর্ষণ পদার্থের গুরুত্ব ও দূরত্ব অনুযায়ী কমবেশি হয়ে থাকে। যে পদার্থ যত ভারি, তার মাধ্যাকর্ষণ তত বেশি। আবার যে পদার্থ যত দূরে, তার মাধ্যাকর্ষণ তত কম। সিঁড়ি দিয়ে ছয়তলায় উঠতে আমাদের যত পরিশ্রম হয়, নিচে নামতে কিন্তু তা হয় না। ছয়তলা থেকে সহজেই আমরা নিচে নেমে আসি। এর কারণ মাধ্যাকর্ষণ। পৃথিবী ছেড়ে ওপর দিকে ওঠার সময় পৃথিবী আমাদেরকে তার দিকে টেনে ধরে রাখে। এজন্য ছয়তলায় উঠতে আমাদের কষ্ট হয়। কিন্তু নামার সময় আমরা পৃথিবীর টানের দিকেই এগিয়ে যাই। ফলে তেমন কষ্ট হয় না।
এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিশ্বজগতের প্রতিটি পদার্থেই রয়েছে। এ কারণে পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। এই আকর্ষণের ফলেই নীহারিকা থেকে শুরু করে গ্রহ-নক্ষত্রসহ সবকিছুর গতির উৎপত্তি হয়েছে। বিশ্বজগৎ সৃষ্টির শুরুর দিকে আবর্তিত নীহারিকা আকাশপথে ভ্রমণের সাথে সাথে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আকারে ছোট হয়ে এসেছিল। এর বাষ্পীয় পদার্থও তখন ঘন থেকে আরও ঘন হতে থাকে। তোমাদের মনে হতে পারে, সুদূর আকাশ একদম ফাঁকা, একদম শূন্য। তাতে কোনো পদার্থ নেই। আসলে কিন্তু তা নয়। এসব ফাঁকা জায়গায় রয়েছে অসংখ্য ধুলোবালি ও পাথর কণা। এছাড়া রয়েছে বড় বড় নানারকম পদার্থ। যেমন: উল্কা ও পাথর।
এরাও সকলে ক্রমাগত আবর্তিত হচ্ছে। আবর্তিত নীহারিকাকে এইসব পদার্থের ভেতর দিয়ে পথ চলতে হয়েছিল। এছাড়া ঘনত্ব ও সঙ্কোচনের কারণে নীহারিকার তাপও ধীরে ধীরে বাড়ছিল। এসব কারণে নীহারিকা ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এইভাবে হাজার হাজার বছর অবিরাম ঘর্ষণ ও উত্তাপ বাড়ার ফলে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে এবং আলোক বিকিরণের ক্ষমতা লাভ করে। কালক্রমে এই নীহারিকাই সূর্যরূপী জ্বলন্ত অগ্নিগোলকে পরিণত হয়।
আমরা জানি, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে একটি গ্রহ অন্য আরেকটি গ্রহকে সজোরে আকর্ষণ করছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, এই আকর্ষণের ফলে ছোট একটি বৃহৎ কোনো গ্রহের দিকে ছুটে গিয়ে ধাক্কা খাবে কিনা। এর সম্ভাবনা যে নেই, তা নয়। বরং এ রকম ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটেও থাকে। এরকম ধাক্কার ফলে কী অবস্থা দাঁড়াবে, তা এবার ভেবে দেখা যাক। দুই গ্রহের ধাক্কায় প্রচণ্ড তাপ সৃষ্টি হবে। এই উত্তাপের মাত্রা যদি বেশি হয় তাহলে গ্রহদুটো আবার নীহারিকায় পরিণত হয়ে যাবে। রাতের আকাশে কখনো কখনো দ্যাখা যায়, কোনো নক্ষত্র হঠাৎ জ্বলে উঠে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। এই হঠাৎ জ্বলে ওঠার কারণ, দুই গ্রহের আকস্মিক ধাক্কা। সৌরজগতে কিন্তু এরকম ধাক্কাধাক্কির ব্যাপার নেই। কারণ, সূর্যকে মাঝখানে রেখে গ্রহগুলো নির্দিষ্ট ভ্রমণপথে ঘুরছে। এই পথ থেকে একচুলও কেউ এদিক-ওদিক হতে পারে না। কারণ, ওই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি।
নীহারিকা থেকে যখন সূর্য তৈরি হলো সেসময়ে সূর্যের ভেতরকার জ্বলন্ত পদার্থগুলো জমাট বেঁধে প্রথমেই আলো ও উত্তাপের কেন্দ্রে পরিণত হয়নি। বর্তমানে সূর্যের যে আকার, তখন তা বহুগুণ বড় ছিল। সেসময় প্রচণ্ড গতিতে সূর্য মহাশূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই ঘূর্ণনের কারণে সূর্যের সকল দিক থেকে খণ্ডে খণ্ডে বহু অংশ চারদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। সেই খণ্ডগুলো থেকেই সৌরজগতের গ্রহগুলো সৃষ্টি হয়। সূর্য থেকে খসে পড়া যে উজ্জ্বল জ্বলন্ত খণ্ড পৃথিবী নামের গ্রহটি তৈরি করেছে, সেই খণ্ডটি আবার দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর মধ্যে বড় খণ্ডটি আমাদের পৃথিবী, আর ছোট খণ্ডটি চাঁদ।
লাখ লাখ কোটি কোটি বছর আগে সূর্যের আকার বর্তমান আকারের চেয়ে চারগুণ বড় ছিল। সেসময় সূর্য থেকে কোটি কোটি গুণ বড় একটি নক্ষত্র সূর্যের কাছ দিয়ে যখন তার গন্তব্যে যাচ্ছিল, তখন সূর্য থেকে কয়েকটি খণ্ড খসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। চাঁদ যখন পৃথিবীর কাছাকাছি আসে তখন সমুদ্রের পানি চাঁদের আকর্ষণে ওপর দিকে ফুলে ওঠে। একইভাবে সূর্যের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বড় নক্ষত্রটি যখন সূর্যের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন এটার আকর্ষণে সূর্যের চারদিকের জ¦লন্ত গ্যাসীয় পদার্থ বৃহৎ নক্ষত্রটির দিকে উথলে ওঠে। বিরাট সেই নক্ষত্রের আকর্ষণে বহু হাজার মাইল পর্যন্ত ওপরে উঠে যায় সূর্যের গ্যাসীয় পদার্থ। এরপর এমন একটা সময় এলো যখন সূর্য থেকে আলাদা হয়ে যায় পাহাড়সমান সেই গ্যাসীয় পদার্থ। বৃহৎ নক্ষত্রটি যখন সূর্য থেকে দূরে চলে গেল তখন গ্যাসীয় পদার্থের ওপর তার আকর্ষণও কমে প্রায় লোপ পেয়ে গেল।
সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্যাসীয় পদার্থ মহাকাশে ভেসে বেড়াতে লাগল। তখন এটা দেখতে অনেকটা পটলের মতো ছিল। এর দুই দিক ছিল ক্রমশ সরু আর মাঝখানটা বেশ মোটা। শীতল হওয়ার সাথে সাথে মেঘ ঘনীভূত হয়ে যেমন ভিন্ন ভিন্ন জলকণার উৎপত্তি হয়, তেমনই মহাকাশে ভেসে বেড়ানো গ্যাসীয় পদার্থ থেকে ভিন্ন ভিন্ন কতগুলো আগুনের গোলক তৈরি হয়। মোটা মধ্যভাগের গোলকগুলো সবচে বড় আকার ধারণ করল, আর দুই দিকের সরু ভাগের গোলকগুলো ছোট আকারে গঠিত হলো। সূর্যের সবচে কাছের ও দূরের গ্রহ বুধ ও প্লুটো সবচে ছোট। কিন্তু সূর্যের মধ্যভাগে অবস্থিত গ্রহ বৃহস্পতি ও শনি অন্যান্য গ্রহ থেকে অনেক বড়। এ দুটো গ্রহের উপগ্রহের সংখ্যাও অনেক বেশি। কারণ, এ দুটো গ্রহ খুব ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়েছে বলে ঘোরার বেগে বহু উপগ্রহ এদের থেকে ছিটকে পড়েছিল।
আগুনের গোলকগুলো পরস্পর পৃথক হয়ে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে লাগল। কেননা, তারা সূর্যের সাথে আর মিশে যেতে পারেনি। বর্তমানে এসব গোলক সূর্যকে মাঝখানে রেখে প্রায় চাকার মতো ভ্রমণপথে ঘুরছে। কিন্তু প্রথম থেকেই তাদের ঘোরার পথটা এরকম নির্দিষ্ট হয়নি। তারা প্রত্যেকেই ধীরে ধীরে শীতল ও সঙ্কুচিত হয়ে এক একটি গ্রহে পরিণত হয়। একইসঙ্গে তাদের গতিপথও নির্দিষ্ট হয়। আমরা এখন পৃথিবীতে যেসব জিনিস দেখি, এর সবকিছুই তৈরি হয়েছে মৌলিক পদার্থ দিয়ে। মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ১১৮টি। আলো পরখ করার যন্ত্র ঝঢ়বপঃৎড়মৎধঢ়য দিয়ে সূর্যের আলো পরীক্ষা করে দ্যাখা গেছে, মাত্র কয়েকটি ছাড়া বাকি সবগুলো মৌলিক পদার্থ সূর্যের আলোয় পাওয়া যায়। অল্প কয়েকটি মৌলিক পদার্থ না পাওয়ার কারণ, সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছনোর আগেই কিছু মৌলিক পদার্থকে বায়ুমণ্ডল শুষে নেয়।
পৃথিবী সৃষ্টির সময়কার সেই জ্বলন্ত অগ্নিগোলকে সবগুলো মৌলিক পদার্থই বাষ্পীয় অবস্থায় ছিল। সূর্যের ভেতর এখনো পৃথিবীর অনেক উপাদান বাষ্প আকারে রয়েছে। কালক্রমে এই বাষ্প শীতল হয়ে পৃথিবীর বর্তমান আকার তৈরি করেছে। একইসঙ্গে মাটি, পানি, বাতাস ইত্যাদি তাদের এখন যা আকার, তা লাভ করেছে। যে কোনো কঠিন পদার্থ ক্রমাগত গরম করতে থাকলে এখনো তা বাষ্পের আকার ধারণ করে। পদার্থভেদে উত্তাপ দেয়ার সময়ের ও পরিমাণের সামান্য এদিক-ওদিক পার্থক্য হলেও শেষপর্যন্ত কোনো পদার্থই বাষ্প না হয়ে যায় না। চলবে