আবু তাহের সরফরাজের দরবেশি কিস্সা
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৪, ২০১৯
মানুষ যে
বড়পির আব্দুল কাদের জিলানি তখন যুবক। পথ চলতে চলতে একদিন হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। সৌন্দর্যের বিস্ময়কর ছটায় তিনি হতচকিত। শিরশির কাঁপুনি টের পেলেন রক্তের কোষে কোষে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী। মুচকি হাসি তার ঠোঁটে। হাসি ছড়ানো এই ঠোঁটের জীবন্তদৃশ্য হৃদয় চিরে দেয়ার মতো। বড়পির তাই মাথা নিচু করে রাস্তা পেরিয়ে গেলেন।
মসজিদে এসে দেখলেন, পথে দেখা যুবতী মসজিদের আবর্জনা পরিষ্কার করছে। দ্বিতীয়বার আর তার দিকে তাকালেন না বড়পির। নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। নামাজ শেষ করে তার আবাসস্থল মাদ্রাসাকক্ষে এলেন। দেখলেন, যুবতী মাদ্রাসার বারান্দা ঝাঁট দিচ্ছে। বড়পির জিগেশ করলেন, হে সুন্দরের রানি, তুমি কে?
যুবতী বলল, মায়াবিনী।
বড়পির বললেন, মায়াবিনী তো বটেই। সুন্দরের আরেক নামই যে মায়া। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি তোমার সত্যিকারের পরিচয়। বারবার এভাবে আমাকে প্রলুব্ধ করছ কেন?
মায়াবিনী বলল, আমি পৃথিবী। পৃথিবীর মায়াময় সৌন্দর্যে আপনাকে মুগ্ধ করতে চেষ্টা করছি।
বড়পির বললেন, তোমার চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কেননা, মুগ্ধতার পথ আমি পেরিয়ে এসেছি। বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময় ইবলিস আল্লাহকে বলেছিল, আদম সন্তানকে আমি পৃথিবীর সৌন্দর্যের দিকে আকৃষ্ট করে বিপদগামী করব।
থামলেন বড়পির। বললেন, সৌন্দর্য তবে কি পাপ? না হে, তা নয়। জগৎ-সংসারে মানুষ বেঁচেই থাকে কোনো না কোনো সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে। এ মুগ্ধতা না থাকলে মানুষের অনুভূতির জগৎ ও চেতনা শূন্য হয়ে যায়। শূন্য এই অবস্থানে যে মানুষ চলে যায়, সে পরম সত্ত্বার সাথে লীন হয়ে যায়। কেননা, ততদিনে সে জেনে যায়, জগতের প্রতিটি বস্তুই সুন্দর। আর প্রতিটি সুন্দরই এক একটি মায়ার খেলা। এ খেলায় জয়-পরাজয় আছে। যন্ত্রণা আছে। আবার আনন্দের শিহরণও আছে। তবে শেষমেষ যা পাওয়া যায় তা ব্যর্থতার অবসাদ। সারা দেহে ফুটে থাকে ব্যর্থতার ক্ষত-বিক্ষত চিহ্ন। এ যন্ত্রণা মানুষকে কয়েক টুকরো করে ভেঙে ফ্যালে। আমি মুগ্ধ আছি আমার অন্তর্জগতের সৌন্দর্যে। আর তাই আমি সুখি।
মায়াবিনী চুপচাপ শুনছিল বড়পিরের কথা। এবার জিগেশ করল, অন্তর্জগতেই যদি মুগ্ধ আপনি, তবে বারবার আমাকে দেখে শিহরিত হলেন কেন?
বড়পির জবাব দিলেন, মানুষ যে! তবে আমি ভোগ করি না। উপভোগ করি। ভোগের আনন্দ ভোগের মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। আর উপভোগের আনন্দ থাকে আমৃত্যু।
পাজরের হাড় গোনা যায়
আবু হাশেম কসাইখানার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। কসাই বলল, ভালো মাংস আছে, নিয়ে যান হুজুর।
আবু হাশেম দাঁড়িয়ে বললেন, আমার কাছে মাংস কেনার মতো টাকা নেই।
কসাই বলল, নিয়ে যান, টাকা পরে দিলেও চলবে। আপনি আমাকে ঠকাবেন না, সে আমি জানি।
হাশেম বললেন, এরচে ভালো নফসের কাছ থেকে কিছু সময় নেয়া।
কসাই এবার বলল, নফসের কাছ থেকে সময় নিতে নিতেই তো এখন আপনার পাজরের হাড় গোনা যায়।
হাসলেন আবু হাশিম। বললেন, তবু যে মাংস দেহে এখনও আছে, কবরের কীটগুলোর তাতে অনেকদিন চলে যাবে।
মানুষের চরিত্র আগে থেকেই লিখিত
আখরোট কিনতে গেছেন আবুল আব্বাস সাইয়ারি। দোকানি তাকে দেখেই কর্মচারীকে বলল, হুজুরকে বেছে বেছে ভালো আখরোট দাও। এরপর সাইয়ারিকে জিগেশ করল, ক’টা নেবেন হুজুর?
সাইয়ারি বললেন, সব খদ্দেরকেই কি আপনি বেছে বেছে ভালোগুলো দেন? দোকানি বলল, না হুজুর। আপনি ভালো মানুষ, তাই আপনাকেই দিচ্ছি।
সাইয়ারি বললেন, আমি আমার ভালো মানুষকে আখরোটের বিনিময়ে বেচতে রাজি নই। কেননা এখন আমি তা বেচলে আখেরাতে কি দিয়ে বেহেস্ত কিনব? যে ক’টা আখরোট আমি নিতে চেয়েছিলাম, এই নাও তার পয়সা।
এই বলে তিনি চলে এলেন। কিছু দূর আসার পর পেছন ফিরে দেখলেন, এক লোক তার পিছু পিছু হেঁটে আসছে। তিনি দাঁড়ালেন। লোকটি এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো। সালামের জবাব দিলেন সাইয়ারি।
লোকটি বললেন, আমি এই প্রদেশের শাসনকর্তা। আপনি আমাকে চেনেন না, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আর আখরোটের দোকানে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমার সামনেই ঘটে। যদিও আপনি আমাকে দেখেননি, কিন্তু আমি সেখানে ছিলাম।
সাইয়ারি বললেন, আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?
শাসনকর্তা বললেন, জি।
সাইয়ারি বললেন, তবে বলুন।
শাসনকর্তা বললেন, জ্ঞান কি?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, দেখে-শুনে-পড়ে জগৎ-সংসার বিষয়ে যে ধারণা মানুষ অর্জন করে, তা-ই জ্ঞান।
শাসনকর্তা এবার জিগেশ করলেন, পরম জ্ঞান কি?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, জ্ঞানের স্তূপ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নির্ভার হবার যে আনন্দ, তাই পরম জ্ঞান।
একটু সময় চুপ থেকে শাসনকর্তা বললেন, জগতে আপনি কি আশা করেন?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, যে আশা আল্লাহ আগে থেকেই পূরণ কওে রেখেছেন, তা-ই।
এবারও কিছু সময় চুপ করে থেকে শাসনকর্তা বললেন, আপনি কি নিশ্চিত, জগৎ-সংসারে প্রতিটি মানুষের চিত্রনাট্য আগে থেকেই লিখিত?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, লাওহে মাহফুজে আমাদের যার যে চরিত্র লেখা রয়েছে, তার থেকে মুক্তির কোনো উপায় আমার জানা নেই। অথচ প্রতিটি মানুষই তার লিখিত চরিত্র থেকে মুক্তি পেতে চায়।
থামলেন সাইয়ারি। দেখলেন, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন শাসনকর্তা। বোঝাই যাচ্ছে, তার মনোযোগ দক্ষ তীরন্দাজের মতো অব্যর্থ।
শাসনকর্তার এই মনোযোগে খুশি হলেন সাইয়ারি। জ্ঞান এখনও তার পাত্র পূর্ণ করতে পারেনি। পাত্র পূর্ণ হয়ে গেলে কেউ আর জ্ঞানের কথায় মনোযোগ দেয় না।
সাইয়ারি এবার বললেন, কোরআনের আয়াত ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে যদি নামাজ পড়া হতো, তবে তা এই কবিতা। এরপর সাইয়ারি আবৃত্তি করলেন,
জীবনে বেঁচে আছি, একটাই আশা
মুক্ত কোনো মানুষ যদি দেখতে পাই!
অভাব-অনটন নেই
বায়েজিদ বোস্তামি বসে আছেন। তাকে ঘিরে আছে শিষ্যেরা। এসময় এক বালক এলো সেখানে। এক থলে মুদ্রা বায়েজিদের সামনে রেখে বলল, আমার পক্ষ থেকে আপনাকে সামান্য উপহার।
বায়েজিদ বললেন, তোমার বয়েস কম। এখন তোমার কাছ থেকে এ উপহার নেয়া আমার ঠিক হবে না। তুমি যুবক হলে তারপর এসো।
বালক চলে গেল।
কেটে গেল কয়েক বছর। বালক যুবক হলো। একদিন এলো সে বায়েজিদের বাড়ি। বায়েজিদ সেদিনও শিষ্যদের নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। যুবক তার সামনে মুদ্রার থলেটি রেখে বলল, আমি বালক থেকে যুবক হয়েছি। এবার নিশ্চয়ই আমার উপহার নিতে আপনার আপত্তি থাকার কথা নয়।
বায়েজিদ কিছু না বলে মুদ্রার থলেটি নিয়ে যুবককে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন।
কয়েকদিন পর যুবক জানতে পারল, বায়েজিদ ও তার সঙ্গী দরবেশদের চরম অভাব যাচ্ছে। এ খবর শুনে যুবক আবার এলো এক থলি মুদ্রা নিয়ে। থলে বায়েজিদের সামনে রেখে বলল, লোকমুখে শুনলাম আপনাদের চরম অনটন যাচ্ছে। তাই আমার পক্ষ থেকে সামান্য এ উপহার।
বায়েজিদ এবার তাকে তিনটি মুদ্রা দিয়ে বাজার থেকে আটা কিনে আনতে বললেন। যুবক তার কথা মেনে আটা নিয়ে এলো। বায়েজিদ বললেন, এ আটা দিয়ে তুমি এবার ছোট ছোট গুলি তৈরি করো। যুবক তাই করল। বায়েজিদ বললেন, রোদে শুকিয়ে খটখটে করো। যুবক তাও পালন করল।
বায়েজিদ এরপর বললেন, এবার বাজারে যে মুচি বসে, তার কাছে পাঁচটি গুলি নিয়ে বেচার কথা বলো। সে যা দাম বলে শুনে এসো। কিন্তু গুলি বেচো না।
যুবক মুচির কাছে এলো। বলল, আমি এ গুলিগুলো বেচতে চাই। কত দাম হলে আপনি এগুলো কিনবেন?
মুচি গুলিগুলো হাতে নেড়েচেড়ে দেখে বলল, দুই আনা।
যুবক ফিরে এসে মুচির দামের কথা বায়েজিদকে জানালো। বায়েজিদ এবার তাকে পাঠালো বাজারের সেরা জহুরির কাছে। তবে শর্ত দিল, কোনোভাবেই গুলিগুলো বেচা যাবে না।
যুবক গেল জহুরির কাছে। জহুরি গুলিগুলো নেড়েচেড়ে দেখে দাম হাঁকল, পাঁচ লাখ দিনার।
যুবক ফিরে এসে বায়েজিদকে বিস্ময়ের সাথে বলল, জনাব, জহুরি তো এ গুলির দাম বলল পাঁচ লাখ।
বায়েজিদ হাসলেন। বললেন, এবার যাও, এ গুলিগুলো হামানদিস্তায় গুড়ো করে দজলায় ফেলে দিয়ে এসো।
যুবক বায়েজিদের কথা পালন করল। এরপর নতমুখে এসে দাঁড়ালো তার সামনে। বায়েজিদ যুবকের মাথায় হাত রেখে বললেন, বাবারে, কিছু মনে করো না, তোমার চোখ হচ্ছে ওই মুচির চোখ। যে মানুষ পরম সত্ত্বার সাথে নিজের সত্ত্বা লীন করে দিয়েছে, তার কোনো অভাব-অনটন নেই। তার কোনো সচ্ছলতাও নেই। আছে কেবল আনন্দ। দরবেশরা এ আনন্দ নিয়েই বেঁচে থাকে।
মনের খুঁতখুঁত
কয়েকদিন ধরে মনের খুঁতখুঁতে ভুগছেন আবু আলি মো. রোদবারি। ওজু করছেন, উঠে এসেই আবার মন খুঁতখুঁত করছে। ওজু বোধহয় ঠিকঠাক হয়নি। ফিরে এসে আবার ওজু করছেন।
গোধূলির রঙ ছড়িয়ে সূর্য ডুবতে বসেছে। মাগরিবের সময়। ওজু করলেন রোদবারি। উঠে কয়েক পা বাড়িয়েই মনের খুঁতখুঁত। ফিরে আবার ওজু করলেন। এভাবে এগারোবার তিনি ওজু করলেন। তারপর দেখলেন, পৃথিবীতে সন্ধে নেমে এসেছে। মাগরিবের সময় শেষ।
ভীষণ রকম বিচলিত হয়ে পড়লেন রোদবারি। নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। কাঁদতে লাগলেন তিনি। বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ, আমার মনের খুঁতখুঁত তুমি দূর করে দাও। এই খুঁতখুঁতই আমাকে সরিয়ে দিচ্ছে তোমার ইবাদত থেকে।
একসময় থামলেন রোদবারি। ডুবে গেলেন গভীর নীরবতায়। আর তখন শুনতে পেলেন অলৌকিক স্বর: মনের খুঁতখুঁত তোমার অজ্ঞতা। তুমি জ্ঞান লাভ করো। জ্ঞানেই স্থিরতা পাবে।
রোদবারি বললেন, জ্ঞান মানেই তো নানা মুনির নানা মত। নানা পথ। প্রতিটি জ্ঞানই তাই এক একটি বিভ্রান্তি।
অলৌকিক স্বর বললেন, তা ঠিক। আমি যে জ্ঞানের কথা বলেছি তা আত্মজ্ঞান। নানা মুনির নানা পথ ঘুরে এসে নিজের মতে স্থির হওয়াকেই বলে আত্মজ্ঞান।
বেয়াদব প্রতিবেশী
দরবেশ আবুল হাসান বুশঙ্গির গোঁয়ার টাইপের এক প্রতিবেশী ছিল। একদিন তার একটি গাধা হারিয়ে গেল। কোত্থাও সে গাধাটি খুঁজে না পেয়ে এলো বুশঙ্গির বাড়ি। বুশঙ্গিকে বলল, তুমি আমার গাধা চুরি করেছো। এবার গাধাটি ফেরত দাও।
বুশঙ্গি বললেন, তুমি ভুল করছ ভাই। আমি তোমার গাধা চুরি করিনি।
প্রতিবেশী বলল, তবে কার গাধা চুরি করেছো?
বুশঙ্গি বললেন, কারও গাধাই আমি চুরি করিনি।
প্রতিবেশী বলল, না-না, তুমিই আমার গাধা চুরি করেছো। তুমি যতক্ষণ না আমার গাধা ফেরত দিচ্ছ, ততক্ষণ আমি তোমার বাড়ি থেকে নড়ছি না। এই যে এখানে আমি বসলাম।
বুশঙ্গি পড়লেন মহা ফাপড়ে। কী উপায় এখন? শেষমেষ তিনি ভেতরে গিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে এর সমাধান চাইলেন।
কিছু সময় পরই হারিয়ে যাওয়া গাধাটি এসে দাঁড়ালো বুশঙ্গির বাড়ির দরজায়। লোকটি চেঁচিয়ে উঠল, পেয়েছি, আমার গাধা আমি পেয়েছি। এবার বেরিয়ে আসুন বুশঙ্গি।
বুশঙ্গি বেরিয়ে এলে প্রতিবেশী তাকে বলল, গাধাটি যে আপনি চুরি করেননি, তা আমি জানি। আবার এও জানি, আল্লাহর কাছে আপনি দোয়া করলেই গাধাটি আমি ফেরত পাব। এবার আমার বেয়াদবি আপনি ক্ষমা করুন।
বুশঙ্গি স্থির স্বরে বললেন, তুমি আসলেই বেয়াড়া। এমনিতে আমাকে বললে কি আমি দোয়া করতাম না? তুমি আমার প্রতিবেশী। আর প্রতিবেশীর ওপরই তো প্রতিবেশীর অধিকার থাকে।
কিস্সাসূত্র: তাজকেরাতুল আউলিয়া