আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের কোলাজ’

প্রকাশিত : আগস্ট ২৫, ২০২০

ও রকম গোঙাচ্ছিলে কেন রাত্রে? কি হয়েছিল?
কিছু না।
দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?
স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন নয়, এ জীবন মানুষের আরেক জীবন। বাস্তবতার অপরদিক। সে তুমি বুঝবে না।
একটু তেড়ে ওঠে ঋতু, না বোঝার কিছুই নেই। তুমি নিজেকে খুব জ্ঞানী ভাবো, না?
সে রকম নয়। আমি আসলে কিছুই ভাবি না। কিছুই না ভাবার পেছনে আসলে জীবনের নির্ভার এক আনন্দ থাকে। আমি সেই আনন্দপুরে থাকি বলেই হয়তো তোমার কখনও কখনও মনে হয়, আমার মুখটা কিংবা কথাবার্তা খুব জ্ঞানীদের মতো।

আর কিছু না বলে চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ঋতু ভেতরে চলে যায়। আমি বসে থাকি বারান্দায়, চুপচাপ। সকাল দশটা-এগারোটা হবে। আজ অফিস নেই। কী এক ধর্মীয়-জাতীয় দিবস উপলক্ষে ছুটি। নিচের গলি দিয়ে সবজিঅলা হেঁকে যাচ্ছে। বাচ্চাদের কোলাহল ভেসে আসছে। সামনের ফ্ল্যাটের খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সে বাড়ির বউটি বিছনায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। টিভির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বউটি এদিকে মুখ ফেরাচ্ছে না। কেবল তার পিঠের দিকটা দেখা যাচ্ছে। এই বউটিকে আমি দেখেছি। মাঝেমধ্যে এ রকম ছুটির দিনগুলোতে তাকে দেখা যায় ওই খাটে। কখনও কখনও জানলার কাছে এসেও সে দাঁড়ায়। মুখের রঙ কালোর দিকে, কিছুটা মাজা। তবে বেশ চকচকে। ভরাট।

ঋতু কী ভাবে আমার বিষয়ে? আমার আর লাভলির যে সম্পর্ক তার কী ব্যাখা রয়েছে ঋতুর কাছে? ভাবনাটা প্রথমে এলো। তারপর জানলার ওই বউটির পিঠের দিকে আবার আমার চোখ চলে গেল। মনে হলো, এই যে আমি চেয়ে আছি আরেক নারীর দিকে, ঋতু তো জানতেও পারছে না। এই সুযোগে আমি কল্পনায় ওই বউটিকে ন্যাংটো করে উল্টেপাল্টে দেখে নিতে পারি। আরও অনেক কিছু পারি। ঋতু কি জানে এসব? তার চেনা আমার বিপরীতে যে আরেক আমি রয়েছি, তা যদি সে জানেই, তবে তার ভেতর প্রতিক্রিয়া কী। এই জানার পথটাই হচ্ছে ধ্বংসাত্মক, আমি জানি।

ঋতুর কাছে যা স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন, আমার কাছে তা বাস্তবতার বিপরীতে আরেক বাস্তব। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার এক উপন্যাসে লিখেছেন, একই পৃথিবী। কিন্তু এই পৃথিবী দিনের আলোয় একরকম, রাত্রের অন্ধকারে আরেক রকম। দিনের আলো ফুটতে ফুটতে ফুল ফোটে। পাখিরা কলকল করে গান গায়। মানুষ জাগে। কাজ করে। খালবিল আলোর ঝিকিমিকিতে ভরে যায়। কোনও ভয় থাকে না। রাত্রে সেই পৃথিবী আরেক রকম। অন্ধকার হতে হতে সেই পৃথিবী শুকোয়। ঝরে পড়ে। পাখিরা ডালে বসে থাকে। চোখে দেখে না। চুপচাপ। মানুষ আরও বদলায়। সে ঘুমোয়। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে। অতৃপ্ত কামনার স্বপ্ন। যারা জেগে থাকে, তাদের প্রায় সবাই দুশ্চিন্তায় জেগে থাকে। ক্রোধে জেগে থাকে। হিংসায় জেগে থাকে।

হ্যাঁ, কেউ কেউ থাকে। আমি কিন্তু ক্রোধ আর হিংসা নিয়ে জেগে থাকি না। ঘুমিয়ে পড়ি। কাল রাত্রেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যে যা দেখি, তা তো আমার অতৃপ্ত কামনার জীবন। এক জীবনে যা যা পেতে পারি না, আরেক জীবনে তা তা পেয়ে যাই। এই দুই জগৎ মিলিয়েই তো আমার পরিপূর্ণ জীবন। স্বপ্ন ভেঙে বাস্তব জীবনে এলে আমি বুঝতে পারি, এই ফিরে এলাম এক জীবনে। আবার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে চলে গেলে বুঝতে পারি, এই ফিরে এলাম আরেক জীবনে। এভাবে আসা-যাওয়ার রহস্য নিয়ে মানুষের জীবন, আমার জীবন। যারা স্বপ্নের জীবনকে মিথ্যে মনে করে, তারা জেগে থাকে। জেগে জেগে নিজের অতৃপ্তিই আসলে বাড়ায়। কিন্তু একসময় না একসময় তাদেরও ঘুমিয়ে পড়তে হয়। ঘুমিয়ে পড়লে তারা স্বপ্নও দেখে। কিন্তু জেগে উঠে ভাবে, কী সব মিথ্যেমিথ্যি ঘটে গেল। সব স্বপ্ন। কিচ্ছু সত্যি নয়।

আমার মনে পড়ল সুরা জুমারের বিয়াল্লিশ নম্বর আয়াত। বলা হচ্ছে, আল্লাহ যার ওপর মৃত্যুর ফরমান জারি করেন, ঘুমের মধ্যে সে আত্মাকে আর ফিরিয়ে দেন না। আর অন্যান্য আত্মা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ছেড়ে দেন। জীবিত এবং মৃত আত্মা একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। মিলিত হয়। মানুষের ভাবনার জগতও মিথ্যে নয়। স্বপ্নের মতো মানুষের আরেক বাস্তবতা। কথিত বাস্তবতার বিপরীতে বেঁচে থাকার দরকারেই অতৃপ্ত আত্মা নিজের মতো করে আরেক বাস্তবতা তৈরি করে নেয়।

ঋতু কি বুঝতে পারে আমার এই বাস্তবতার জগৎ কত রঙের? কত আয়োজনের? বুঝতে তো পারেই। কেন যেন আমার মনে হলো, ঋতুর সব ভাবনা সে লিখে রাখে। সারাদিনে আর তেমন কী কাজ তার? আমি বাইরে থাকলে নির্জন দুপুরে খেয়েটেয়ে ডায়েরির পাতায় একটু আধটু সে লিখতেই পারে। অথবা রাত্রে আমার ফিরতে দেরি হলে সে তার ভাবনার জগৎ একটু একটু খুলতে থাকে ডায়েরির পাতায়। মানুষ তো সেও। তাকেও তো অতৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। ঘুমের মধ্যে তার আত্মাও তো তৃপ্তির জগতে ঘুরে বেড়ায়। সেখানে কী কী সে করে, তা কী আর সে লিখে রাখে না? আমার মনে হলো, ঋতু ডায়েরি লেখে। মানুষের মনে হওয়াই সব। মন যা যা ঘিরে থাকে, তার সব মিলিয়েই তো মন। মানুষ যা ভাবতে পারে তা তার ভাবনার জগতে আছে বলেই পারে, না হলে পারত না। সুতরাং আমি বলছি, ঋতু ডায়েরি লেখে। কিন্তু আমি তা জানি না।

বউটি পাশ ফিরল। চোখে চোখ পড়ল আমার। একটু হাসলাম আমি। কেন হাসলাম জানি না। বউটি শোয়া অবস্থায় থেকেই মাথার ওপর দুহাত দিয়ে হাই ছাড়ল। তারপর হাত বাড়িয়ে জানলার পরদা টেনে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি পেয়ে গেলাম ঋতুর গোপন ডায়েরি। আমি চেয়েই রইলাম লাল-নীল ছোপ দেয়া পরদার দিকে। আর ডায়েরির অক্ষরগুলো রঙ ফুটিয়ে যেতে লাগল আমার চোখের সামনে।

২৭ জুন ২০১১
পরপর বেশ কয়েক রাত একই স্বপ্ন দেখলাম। ঘুম ভেঙে গেলে প্রতিবার বুঝতে পারি, হাতপা অবশ হয়ে গেছে আমার। বুকের ভেতর তেষ্টায় শুকিয়ে চৈত্রদুপুরের কাঠ। স্বপ্নে একজন অচেনা পুরুষ হাতে বল্লম নিয়ে আমাকে খুন করার জন্যে তাড়া করছে। আমি ছুটছি জ্ঞানশূন্য হয়ে। আমার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। আমি চিৎকার করে তাকে বলছি, তোমার ঘরের দেয়ালে টাঙানো ওই ছবির মেয়েটি আমি নই। আমি আরেকজন। আমাকে মেরো না। লোকটি কিন্তু গোঁয়ার। সে আমার পেছন পেছন ছুটছে আর ক্রুদ্ধ স্বরে বলছে, ফের মিথ্যে কথা। ছবির মেয়েটিই তুই। তোকে খুন আমাকে করতেই হবে। ছুটতে ছুটতে প্রতিবার আমি দেখতে পাই ঘরের দেয়ালে টাঙানো একটি মেয়ের ছবি। জলরঙে আঁকা। হুবহু দেখতে আমি। কিন্তু আমি জানি, ছবির মেয়েটি আমি নই। ওই পুরুষটি জানে না। তার বিশ্বাস ছবির মেয়েটি আমি। ছবির মেয়েটির ওপর কী তার রাগ আমি বুঝতে পারি না। যতবার স্বপ্নটা দেখেছি, তার কোনোবারই না। তবে প্রতিবার আমি এসে লুকিয়ে পড়েছি মৃদুলের পেছনে। কেন যেন মৃদুলকে দেখে ওই লোকটি ফিরে যায়। বারবার ফিরে যায়। আর বারবার মৃদুল আমার দিকে চেয়ে হেসে বলে, ভয় নেই। তুমি এখন মুক্ত।

এই স্বপ্ন আমি কেন দেখি সারাদিন ভেবেও কোনও হদিস বের করতে পারিনি। হাসানকে কি জিগেশ করব? হাসানকে কি জিগেশ করা যায়? আচ্ছা, আমি তো এই স্বপ্নের কথা মৃদুলকে জিগেশ করার কথা ভাবতে পারতাম। তা না করে শুরুতেই হাসানকে জিগেশ করার কথা কেন আমার মাথায় এলো?

১৩ অক্টোবর ২০১১
আমি বলেছি না আসতে, তবু আজ সন্ধের পর হাসান এলো। আমার আর ভালো লাগে না। নিজেকে স্খলিত বলে মনে হয়। এ কথা বলেওছি হাসানকে। তবু কেন যেন সে আসে। তবু কেন যেন তাকে বাধা দিতে আমি পারি না। আজ সে এসে অদ্ভুত এক কাণ্ড করল, যা আগে কখনও করেনি। আমার শরীর থেকে সব কাপড় খুলে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে। প্রথমে আমি চোখ খুলতে পারলাম না। তারপর চোখ খুলতেই যাকে দেখলাম, আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এই শরীর কী আমার! আমার শরীর কী তাহলে এরকম সুন্দর? সুঢৌল স্তন আমার। একেবারে মসৃণ ত্বক। নিভাঁজ। পুরুষ্টু পেশি। নাভির নিচের দিকে চোখ পড়তেই আরক্তিম হয়ে উঠল আমার চোখমুখ। পেছনে আমার কাঁধ ধরে আয়নার আমার দিকে তাকিয়ে ছিল হাসান। আমি কামরাঙা রঙের লাজুক চোখ নিয়ে আয়নায় তার চোখের দিকে তাকালাম। সে হাসল। বলল, আশ্চর্য সুন্দর দেখতে তুমি।

আমার শরীরের নগ্নতার ওপর দিয়ে ঝিরঝির হাওয়া বয়ে গেল তার কথা শুনে। সে আমার কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে দিল আমাকে আয়নার দিকে পেছন করে। আমাকে বুকের সঙ্গে লেপ্টে নিয়ে হাসান আয়নার ভেতর আমার পশ্চাৎদেশ দেখতে লাগল, আমি বুঝতে পারি। তার চোখে ছিল চকচকে মুগ্ধতা। চোখ বন্ধ করে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। টের পেলাম আমার পাছার ভরাট মাংসে হাসান হাত দিয়ে একটু একটু চাপ দিচ্ছে। আমি ফিসফিরিয়ে বললাম, না না। ওসব একদম আর না। তুমি আয়নার সামনে আমাকে নগ্ন দেখতে চেয়েছিলে, তাই দাঁড়ালাম। এরপর আর একদম কিছু নয়।

হাসান শোনে না। সে আমার স্তনের বোঁটা পুরে নেয় তার মুখের মধ্যে। কেঁপে উঠি আমি। শিহরিত হই। হিমহিম স্রোতের ভেতর তলিয়ে যেতে থাকি। হাসান আামাকে ভালোবাসতে থাকে।

তবে এভাবে আর না। এই পথ ধ্বংসের একটি আয়োজন। আমি জানি। এ রকম চলতে থাকলে একদিন না একদিন আমাকে মুখোমুখি হতে হবে সেই ধ্বংসের। সে জীবন কী রকম হবে আমি তা ভাবতে পারি না। যে জীবন আমি ভাবতে পারি না, সে জীবনে যেতে কোন মানুষের না ভয় লাগে?

বাথরুমে ঢুকে নোংরা পরিষ্কার করতে করতে হাসানকে বললাম, তুমি আর এসো না। আমাদের কথা হবে মোবাইলে। শরীরের বাইরেও ভালোবাসা থাকে।

পানি ঢেলে শক্ত হয়ে থাকা লিঙ্গ একহাত দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে হাসান বলল, যে ভয় তুমি পাচ্ছ তা অমূলক। মৃদুল আসলে বোকা। সে কিছুই টের পাবে না।

সে কথা হচ্ছে না। আমি নিজের থেকেই চাচ্ছি না আর আমাদের এসব হোক। তুমি এসো না।
হাসান জবাব দেয়, আচ্ছা আর আসব না।
কিন্তু তার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি, সে আবার আসবে। আমি বারবার তাকে আসতে নিষেধ করব, বারবার সে আসবে। আমার কেবলই তাই মনে হচ্ছে।

২৮ অক্টোবর ২০১১
গতকাল দুপুরে এসছিল হাসান। ফোনে অবশ্যি নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু শোনেনি। অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি হয় আমাদের মধ্যে। কী সব বোঝাতে চেয়েছিল আমাকে, আমি কান দিইনি। খুব, খুব রাগ হয়ে গেছিল আমার। মৃদুল ঠিক কিছু একটা আঁচ করে ফেলেছে। আর আমার এসব ভালো লাগছিল না। আমি সে কথাই হাসানকে বোঝাতে চাচ্ছিলাম। একসময় সে উঠে বেরিয়ে চলে যায়। আমি দরজা দিয়ে খাটে এসে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত লাগছিল। ঝিমঝিম করছিল মাথাটা।

মৃদুল এলো বেশ রাত করে। একটা কমলালেবু পকেট থেকে বের করে রাখল ড্রেসিং টেবিলের ওপর। বলল, অফিসে এক কলিগ খেতে দিয়েছিল। খায়নি, আমার জন্যে নিয়ে এসেছে। খুব মায়া হলো আমার মানুষটার জন্যে। ইচ্ছে হলো মৃদুলের ঠোঁটে একটা চুমু খাই। কিন্তু পারলাম না খেতে। ভেতর থেকে কোথায় যেন একটা বাঁধা খেলাম। এর নামই হয়তো দূরত্ব।

দুলে ওঠে পরদা। তারপর সরে যায়। দেখা যায় বউটির মুখ। একটা বাটি হাতে কী যেন খাচ্ছে। ডায়েরির অক্ষর আর খুঁজে পাই না আমি। এরপর আর কী কী লিখেছে ঋতু তা জানা হয় না। কী একটা পাখি এসে বসে বারান্দার কার্নিশে। আমার দিকে একটু চেয়ে থেকে উড়ে চলে যায়। পাখির উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে হয়, ডায়েরিতে ঋতু আর যা যা লিখেছে সব পড়ে ফেলি। কিন্তু ভয় হয় আমার। মনে পড়ে একটা বাক্য, জানায় দুঃখ অজানায় আনন্দ। সব জেনে গেলে যদি জীবনে বেঁচে থাকার আয়োজন না থাকে। তারচে অজানাই থেকে যাক কিছু কিছু।

কোনও মানুষের সামনে বিশাল উঁচু একটা দেয়াল। সে জানে না দেয়ালের ওপাশে কি। সে কিন্তু তার মতো করে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু যে মানুষ জেনে যায় দেয়ালের ওপাশে এক দৈত্য ফুঁসছে, যে কোনও মুহূর্তে দেয়াল ভেঙে এসে পড়বে এপাশে, সে মানুষের পক্ষে কী স্বস্তিতে জীবন কাটানো সম্ভব?

আমি জানি, কেউ তা পারে না। মানুষের নিয়তি এ রকমই। আমি বসে থাকি স্থির। অথর্ব। মাথার মধ্যে কোনও চিন্তাও ক্রিয়াশীল নয়। জীবের স্পন্দন কি থেমে গেছে আমার? কোনও শব্দ নেই এই মুহূর্তে আমার চেতনায়। দৃশ্য নেই। মনে হলো, এভাবে যেন কয়েক কোটি বছর পেরিয়ে এলাম। তারপর শব্দ শুনতে পেলাম। ভেতর থেকে ঋতু বলছে, চা দেব আরেক কাপ?
জীবের স্পন্দন টের পেলাম আমার শরীরে।
নিচে সবজিঅলা হেঁকে যাচ্ছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। শব্দের জগতে ফিরে আসছি আমি। আমিও শব্দের জন্ম দিই। বুকের ভেতর থেকে শব্দ উঠে আসে আমার, দাও এক কাপ। তারপর আমি দেখি, চোখের ওপর একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে উঠছে। জানলার সেই বউটি নেই। টিভি চলছে। হাওয়ায় কাঁপছে জানলার পরদা। ওদিকে বহুতল একটি ভবনের ছাদের ওপর নির্জন রোদে চিকচিক করছে মোবাইল কম্পানির টাওয়ার। আমার সামনে বারান্দার কার্নিশ ধরে একটি পিঁপড়ে মুখে বিস্কুটের গুঁড়ো নিয়ে দাম্ভিক ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। একটু ঝুঁকে কান পেতে আমি পিঁপড়ের পায়ের শব্দ শুনতে চেষ্টা করি। জগৎ-সংসারের নানা শব্দের ভেতর আলাদা করে পিঁপড়ের পদশব্দ আমার কানে ঢোকে না। এই রকমভাবে কত কত শব্দ এই পৃথিবীতে মানুষ শুনতে পায় না, কে বলবে তা। তারপরও মানুষের অহংকার। জীবের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার।

নৈঃশব্দ্যের আদিম গহ্বরে তলিয়ে যেতে যেতে আমি শুনতে চেষ্টা করি পিঁপড়ের পায়ের শব্দ। কী এক মিহি বাতাসের স্পর্শের মতো শব্দ ভেসে আসে আমার চারদিক থেকে। শব্দ যে এত তরঙ্গায়িত হতে পারে, বুঝতে পারিনি তো কখনও।

হায়, শব্দের এই পৃথিবী এত রোমাঞ্চকর, আমার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। আমি ঘুমিয়ে পড়তাম, কিন্তু চোখ পড়ল কনডমের খালি একটা প্যাকেটের ওপর। চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। এবং তা কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই আমি দেখলাম, আমার বাসার বাথরুমের ওপরে ছোট্ট জানলার বাইরে ঝুলে থাকা মাকড়শার জালে বেঁধে আছে প্যাকেটটি।

আর কোথায় থাকে পৃথিবী! সূর্যের আগুন শুষে নিচ্ছে পৃথিবীর তাবৎ সবুজ। আস্তে-ধীরে নির্জীব হয়ে পড়ছে পৃথিবীর তাবৎ প্রাণী। আমার ভেতর জন্ম হলো হিংস্রতার। ভাঙচুর হোক তবে। ছিঁড়ে যাক সম্পর্কের মিহি সুতো। মানুষ ফিরে যাক অ্যামিবার এককোষী জীবসত্তায়। শাঁই শাঁই ছুটে যাচ্ছে আমার সামনে যা কিছু। আমার ভেতর থেকে হুংকারের মতো কে যেন আবৃত্তি করে ওঠে:

আমি দেবশিশু, আমি চঞ্চল
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
            আমি   অর্ফিয়াসের বাঁশরি
            মহা    সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়া করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম
            মম     বাঁশরির তানে পাশরি
            আমি   শ্যামের হাতের বাঁশরি।
আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া।