আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৫, ২০১৯

নদীর তীর ধরে একজন হেঁটে আসছে। মাথায় বস্তা। পরনে জিনসের প্যান্ট আর টিশার্ট। হাঁটার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুবই ক্লান্ত তার পা দুটো। যেন আর চলতে চাইছে না। তবু কোনোক্রমে পথপাড়ি দেয়া। কাছাকাছি এলে দেখলাম, খুব ঘামছে সে। ঝকঝকে সুন্দর চেহারা। দরদর ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। ফুলেফেপে ঢোল হয়ে যাওয়া পাটের একটি বস্তা মাথায় নিয়ে সে হাঁপাচ্ছে। বিশ-একুশ বছর হবে বয়েস। আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো ছেলেটি। কী সরল তার চোখ দুটো। আর মেয়েদের মতো টানা টানা। দেখলেই মায়া ধরে যায়। একগোছা চুল কপালে লেপ্টে আছে। মাথাভর্তি কুচকুচে ঘন চুল। কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। দেখে তো রুচিমান মনে হচ্ছে। মাথায় বস্তা নিয়ে যাচ্ছে কোথায়?
আমি জিগেশ করলাম, অ্যাই, কে তুমি?
ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমার নাম নেহাল হাসনাইন। বাড়ি ভূবনডাঙা।
জিগেশ করলাম, বস্তায় কি?
নেহাল জবাব দিল, টাকা।
ছিটকে উঠলাম। সে কী, এ যে ভারি আশ্চর্যম! এতদিন শুধু শুনেই এসেছি টাকার বস্তার কথা। এবার আমার চোখের সামনে! ধন্দ লেগে যায় চোখে।
নামাও তো দেখি বস্তা। এতটাকা পাইলা কই তুমি?
নেহালের স্বরে আকুতি ফুটে উঠল, দ্যাখেন, বস্তা নামাতে গেলে আমার দেরি হয়ে যাবে। আমার খুব তাড়া। আমাকে আমার মায়ের কাছে যেতে হবে।
বললাম, আরে বাপু, সে তুমি যেও। কিন্তু এক বস্তা টাকা তুমি পাইলা কই, এর তো একটা জবাব দিবা?
নেহাল এবার একটু থতমত খেল। বলল, দ্যাখেন, এটাকা আমি দশ বছরের পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছি। এটাকা আমার উপার্জনের টাকা, চুরি করা নয়।
জিগেশ করলাম, কী কাজ করতে তুমি?
এক ব্যবসায়ীর রক্ষিতার দেখাশুনা করতাম।
তা, রাস্তা দিয়ে গাড়িতে না এসে তুমি এদিক দিয়ে হেঁটে আসছ, মানে কি?
নেহাল জবাব দিল, কী করব, মানুষের কাছাকাছি গেলে আমি ভয়ংকর দুর্গন্ধ পাই। মানুষগুলোর আত্মা পচে যাওয়ার বিশ্রি দুর্গন্ধ। এ গন্ধ দেহ পচার গন্ধের চেয়েও তীব্র দুর্গন্ধে ভরা। এ গন্ধে আমার গা গুলিয়ে ওঠে। বমি বমি পাই। আজ সকাল থেকেই তো আমি হেঁটে চলেছি।
এই যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো, এখনও পাচ্ছ সে গন্ধ?
পাচ্ছি, তবে দুর্গন্ধটা একটু কম। বুঝতে পারছি, আপনার আত্মা পুরোপুরি এখনও পচেনি। কিন্তু দয়া করে এখন আমাকে যেতে দিন। আমাকে আমার মায়ের কাছে যেতে হবে।
তিনি কোথায়?
বাড়িতে।
কোথায় যেন বললে তোমার বাড়ি?
ভূবনডাঙ্গা।
সে তো এখনও বেশ দূর। এভাবে হেঁটে গেলে তোমার আরও একদিন লাগবে।
নেহাল বলল, সে জানি। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য আমার যে আর তর সইছে না। মা বুড়ো হয়ে গেছেন। দশ বছর আমি বাড়িঘর ছাড়া। ব্যবসায়ীর রক্ষিতার দেখাশুনা করেই কেটে গেছে এ সময়। এবার আমি সেবা করতে চাই আমার মায়ের। কিন্তু এ বস্তা এতটাই ভারি যে, তা মাথায় নিয়ে হাঁটতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তাড়াতাড়ি পাও চালাতে পারছি না। তা না হলে, কত আগেই আমি পৌঁছে যেতাম বাড়ি। এতক্ষণে মায়ের বুকের ভেতর মুখ রেখে হয়তো ঘুমিয়েই পড়তাম। কথা বলতে বলতে নেহালের চোখ ছলছল করে উঠল।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কাঁটাটা আমার ভেতর দুলতে লাগল। তবে কিছু সময়ের জন্যে। এরপর আমার মায়া হলো ছেলেটির জন্যে। তার মুখে মিথ্যের কোনও ছায়া নেই। যা আছে তা সারল্য। ছেলেটি আর যাই হোক, চোর নয়। কে যেন একবার বলেছিল, হৃদয় দিয়ে মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করলে বোঝা যায়। বোঝা যে যাই, এ সত্যি আমার জীবনেই আছে।
নেহালের ছলছল চোখের দিকে চেয়ে মায়া হলো আমার। আহা, মায়ের কাছে পৌঁছতে কী আকুলতা ছেলেটির। বললাম, কিন্তু ভাই, গাড়িতেই গেলেই পারতে। এভাবে তো বোকার পরিচয় দিচ্ছ তুমি। এছাড়া এই টাকার জন্যে তুমি খুনও হয়ে যেতে পারো পথেঘাটে।
নেহাল জবাব দিল, সে আমার ভবিতব্য। তবে মানুষের কাছাকাছি আমি যেতে পারি না। তাদের আত্মা থেকে ভয়ংকর দুর্গন্ধ ছড়ায়।
বললাম, কিন্তু তুমি যা বলছ, তা বড়ই আশ্চর্যের কথা। মানুষের আত্মা পচে যাওয়ার দুর্গন্ধ পাও তুমি, অথচ আর কেউ পায় বলে শুনিনি। ব্যাপারটা কি খটোমটো নয়?
নেহাল সরল চোখে একটুক্ষণ চেয়ে রইল আমার চোখের দিকে। এরপর বলল, কী জানি, আমি বোকা বলেই হয়তো পাই। আরসব মানুষ তো আর বোকা নয়। তাই তারা চাদ্দিকে দুদ্দাড় ছুটছে। যেন এভাবেই তারা ছুটতে থাকবে। কখনও থামবে না। মজা কী জানেন, প্রতিটি মানুষই নির্দিষ্ট একটা সময়ে পৌঁছে থেমে যায়। যখন থামে, তখন বুঝতে পারে, জীবনটা বড় অপচয় করে ফেলল।
অবাক হলাম। কী বলছে এ ছেলে? আমার পরিচিত চারপাশের মানুষের মতো সে তো নয়। চেহারাতেও রুচির আভিজাত্য আছে। প্রশংসা বাক্য বেরিয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে, বাহ, বেশ তো বলো তুমি!
নেহাল হাসল। বলল, আমি এবার তাহলে যাই।
যেভাবে ঘামছ, একটু বসে যেতে পারো কিন্তু। এভাবে আর কতক্ষণ হাঁটতে পারে মানুষ।
নেহাল এবারও হাসল, না, দেরি হয়ে যাবে। আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিকই, কিন্তু আমার মন পৌঁছে গেছে মায়ের কাছে।
কী সরল স্বীকারোক্তি ছেলেটির। আমার মনে পড়ল, বায়েজিদ বোস্তামি পানির পাত্র হাতে সারারাত দাঁড়িয়ে ছিলেন মায়ের শিয়রে। কখন জেগে উঠবেন মা, এই ছিল তার প্রতিক্ষা। এই প্রেমের উৎস কোথায়?
মাথায় ভারি বস্তা নিয়েও নেহাল ছুটছে মায়ের কাছে। ক্লান্ত, তবু একটু বসছেও না। কী এক চুম্বকের টানে সে হেঁটেই চলেছে। পিঠে বোঝা, পা তবু থেমে নেই। মনের এই শক্তি কোথায় থাকে? প্রেমই কি এই শক্তি? যা মানুষকে টেনে নিয়ে যায় জীবনের দিকে। জীবনের নানা আয়োজনের ভেতর। আমার মনে হলো, বেঁচে থাকার এই তো মানে। ছেলেটিকে আমার ভাল্লাগলো। কী দারুণ ঝরঝরে একটি আত্মার অধিকারী এই ছেলে। আর, হাসেও কী অমায়িক। যেন তার আত্মার সৌন্দর্য হাসিতেই প্রকাশ পায়। আমি মুগ্ধচোখে তার দিকে চেয়ে রইলাম। সারল্যের প্রকাশ তার চোখমুখে ঝকমক করছে। বললাম, কিন্তু ভারি বস্তা নিয়ে তো খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার। এভাবে কতক্ষণ হাঁটতে পারবে?
নেহাল ক্লান্তিঝরা হাসি দিয়ে বলল, দু’দিন ধরে হেঁটেই চলেছি। আর তো একদিনের পথ। এ-ও পেরিয়ে যাব। তবু গাড়িতে উঠব না। মানুষের আত্মা পচার গন্ধে আমার খুব বমি পায়। শরীর গুলিয়ে ওঠে।
অদ্ভুত ছেলে তুমি, বলেই হাসলাম আমি। এরপর বললাম, তুমি চাইলে কিছু দূর আমি তোমার বস্তাটা বয়ে দিতে পারি।
এ কথায় নেহাল বেশ খুশি হলো। চোখমুখ উজ্জ্বল করে সে বলল, সে তো খুবই ভালো হয়। আর এজন্য আপনাকে আমি পারিশ্রমিকও দিতে পারি। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
না-না, সে আর এমন কি। তুমি ছেলেটি খুবই সহজ-সরল। সত্যি বলতে কি, তোমর মতো এত সহজ মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। তুমি বায়েজিদ বোস্তামির ওই গল্পটা জানো তো?
কোন গল্পটা বলুন তো?
ওই যে, পানির পাত্র হাতে ঘুমন্ত মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকার গল্পটা।
নেহাল হাসল, ও আচ্ছা।
তোমাকে দেখে আমার বায়েজিদ বোস্তামির এই গল্পটা মনে পড়ে গেল। এখন দ্যাও তো, বস্তাটা আমার মাথায় তুলে দ্যাও। এরপর চলো।
নেহাল বলল, বিশ্বাস কি আপনিও করেছেন? অথচ ওই কাজের জন্যেই আমি দশ বছরের পারিশ্রমিক হিসেবে এ টাকা পেয়েছি।
মাথার বস্তা বেশ ভারি, এতক্ষণে আমি টের পেলাম। এ বস্তা মাথায় নিয়ে ছেলেটি সকাল থেকে হেঁটে চলেছে? একি জাদুর খেলা নাকি? কী অদ্ভুত মনের শক্তি! এরই মধ্যে আমি চাপ টের পাচ্ছি ঘাড়ে। হাঁটতেও হচ্ছে একটু কসরত করে। এমনিতে আমি দুর্বল গোছের মানুষ। ভারি কিছু বইতে পারি না। অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে উঠি। দরদর ঘাম ঝরতে শুরু করেছে আমার কপাল বেয়ে।     
আমি জিগেশ করলাম, কিন্তু সামান্য একটা কাজের জন্য এত টাকা ব্যবসায়ী কেন তোমাকে দেবে? হোক তা দশ বছরের পারিশ্রমিক। সে আর কতই বা। তুমি ধারণা করতে পারো, বস্তায় কত টাকা আছে?
নেহাল মাথা নাড়ল, জানি না।
ওজনে তো আমার মনে হচ্ছে, কয়েক কোটির মতো হবে। এত টাকা ব্যবসায়ী তোমাকে দিয়ে দিলেন? তুমি চুরি করোনি তো?
নেহাল থতমত খেয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে বলল, কী বলছেন আপনি? আমি চুরি করতে যাব কেন? যা সত্যি, তাই তো আপনাকে বললাম। অথচ আপনি দেখছি আমাকে সন্দেহ করছেন।
না-না, সন্দেহ নয়। মানুষের মন তো। তুমি যে চুরিটুরি করোনি, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তবে মনের খটকা, তাই বললাম। কিন্তু বলো তো ভাই, তোমার দশ বছরের পারিশ্রমিক কি এত টাকা? নিশ্চয়ই তা নয়।
ঘাড় একটু নেড়ে নেহাল বলল, তা অবশ্যি নয়। এরসঙ্গে আমার বখশিসও যে আছে। আমার সততার পুরস্কার।
জিগেশ করলাম, কি রকম? তুমি কাজ করতে রক্ষিতার রক্ষক হিসেবে। এখানে আবার কী সততা তুমি দেখালে?
হাঁটতে হাঁটতে নেহাল নদীর ওপর দিয়ে শূন্যে তাকালো। মাথার ওপর গাছের কোনও ডালে বসে ডাকছে একটা ডাহুক। মিষ্টি সুর ছড়িয়ে পড়ছে। নেহালের চোখের দৃষ্টি উদাস। কী যেন ছবির মতো উঠে এলো তার ভাবনায়। চোখ ফিরিয়ে সে বলল, মেয়েটির নাম ছিল অর্ষা। ধারালো সুন্দরী। দেহ যেন গোলাপের পাপড়ি। মুখটা ছিল দিঘির মতো টলটলে। টানা টানা চোখ। সারাক্ষণ আমি এই রূপসীর ধারেকাছে থাকতাম। তার ফাইফরমাস থেকে শুরু করে নানা কাজ করতাম। আমরা থাকতাম ব্যবসায়ীর বাগানবাড়িতে। বাড়িটা ঘিরে প্রচুর গাছপালা। আছে ফুলবাগান। নানা জাতের ফুল সেখানে ফুটত। মাসে একদিন এ বাড়িতে ব্যবসায়ী আসতেন। রাত থেকে পরদিন সকালে চলে যেতেন।
হাঁপ ধরে গেছে আমার। দু’হাত উঁচু রেখে বস্তা ধরে থাকায়, দুই বাহু টনটন করছে। তবু হাঁটতে লাগলাম। আহা, বেচারার একটু যদি আসান হয়। জিগেশ করলাম, তোমার সততার ব্যাপারটি কি ছিল?
নেহাল বলল, ওই একটা রাত ছাড়া পুরোটা মাস বাড়িটাতে থাকতাম আমি আর অর্ষা। দারোয়ান, চাকর আর রান্নার লোক মিলিয়ে ছিল তিনজন। তো হতো কি, মাঝে মাঝে একটু বেশি রাতে অর্ষা আসত আমার ঘরে। পাশাপাশি ঘরে আমরা থাকতাম। অর্ষা আসত চুপিচুপি। এরপর আমাকে জড়িয়ে ধরত। আমার দেহের ভেতর দিয়ে ছুটে যেত বিদ্যুৎ। অর্ষার মুখের সৌন্দর্য আমার ভেতরটা ঝলসে দিত। তবু আমি পারতাম না আমার দায়িত্বে কোনও ফাঁকি দিতে।
জিগেশ করলা, কেন পারতে না?
নেহাল বলল, আমি জানতাম অর্ষার দেহ ভোগ করা আমার কাজ নয়। আমার কাজ তার দেহকে রক্ষণাবেক্ষণ করা। যাতে প্রতি মাসে একবার ব্যবসায়ী এসে তা ভোগ করতে পারে। সুতরাং অর্ষার দেহে আমি ঢুকতে পারিনি।
বললাম, এই এক বস্তা টাকা হচ্ছে তোমার সেই সততার পুরস্কার, তাই তো?
মাথা নাড়ল নেহাল, হ্যাঁ। দু’দিন আগে আমার চাকরির দশ বছর পূর্ণ হয়। ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমি দ্যাখা করে বললাম, এবার আমি বাড়ি ফিরব। আমার পারিশ্রমিক আমাকে বুঝিয়ে দিন।
ব্যবসায়ী বললেন, সেকি, তুমি তাহলে চলেই যাবে? তুমি যে আমার খুব বিশ্বস্ত লোক ছিলে হে? আরও কিছুদিন থেকে যেতে পারো কিন্তু তুমি।
আমি বললাম, না স্যার। বাড়িতে আমার বৃদ্ধ মা আমার জন্য পথ চেয়ে বসে আছেন। দীর্ঘ দশ বছর জীবিকার জন্য আমি আপনার এখানে পড়ে থেকেছি। এবার বাকি জীবন মায়ের সঙ্গে থাকব। যা উপার্জন করেছি, তা ভেঙে আমাদের সুখেই চলে যাবে।
ব্যবসায়ী বললেন, ঠিকাছে, যেতে যাচ্ছ যাও। বিশ্বস্ত একজন কর্মচারী আমাকে হারাতে হবে। তবে যাবার আগে শুনে যাও একটা গোপন কথা। তোমরা জানতে না, বাগানবাড়িটা ছিল সিসি ক্যামেরার পর্যবেক্ষণে। আমি অসংখ্যবার ফুটেজে দেখেছি, অর্ষা কী কাতর হয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরছে। কিন্তু তুমি তাকে বারবার সরিয়ে দিচ্ছ। আর বলছ, অর্ষা, আমার দায়িত্ব তোমাকে দেখভাল করা, সম্ভোগ করা নয়।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোককে কী যেন ইশারা করে ব্যবসায়ী ফের বললেন, তোমার এই সততা দুর্লভ। অর্ষার মতো আগুনরঙা নারীও তোমাকে টলাতে পারেনি। তোমার পারিশ্রমিক তাই এক বস্তা টাকা।
এরই মধ্যে সেই লোকটি টাকাভর্তি একটি বস্তা এনে রাখল আমার সামনে। ব্যবসায়ী বললেন, যাও, তোমার পারিশ্রমিক নিয়ে তুমি এবার বাড়ি ফেরো। তবে তুমি চাইলে অর্ষাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো। দশ বছরে তার কাছ থেকে যা নেয়ার, আমি নিয়েছি। তোমার যদি তাকে ভালো লাগে, তুমি নিয়ে যেতে পারো।
জিগেশ করলাম, তুমি রাজি হলে?
নেহাল জবাব দিল, হ্যাঁ, রাজি হলাম। অর্ষা ছিল আগুন সুন্দরী। ওর রূপ দেখলে যে কোনও পুরুষের বুকেই খিচ ধরে যাবে। যখন সে কথা বলে, মনে হয় চোখ যেন তা বলছে। যখন হাসে, মনে হয় পাহাড় থেকে ঝরনা নামছে। আর বড় কথা যে, অর্ষার কাছাকাছি এত বছর থেকেও আমি কখনও তার আত্মা পচার দুর্গন্ধ পাইনি। আরসব মানুষের পেতাম। এ কারণে বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশি আমার ছিল না। অর্ষাই তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলত।  
একটু হাসি ফুটল আমার মুখে, বেশ তো তাহলে প্রেমে পড়ে গেছিলে মেয়েটার। তো সেই রূপসী কোথায়? তাকে কোথায় ফেলে এলে?
নেহাল জবাব দিল, ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে অর্ষা আমাকে জিগেশ করল, এখন আমরা কোথায় যাব?
আমি বললাম, আমার মায়ের কাছে। তিনি ভূবনডাঙায় থাকেন।
অর্ষা যেন একটু পিছিয়ে গেল। বলল, এরচে ভালো হয় এখানে কোথাও আমরা থেকে যাই। আমাদের কাছে তো অনেক টাকা আছে।
দৃঢ় স্বরে আমি বললাম, না, আমি আমার মায়ের কাছে যাব। কিন্তু তুমি যেতে চাচ্ছ না কেন?
মুহূর্তে অর্ষার মুখে কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়ল। মুখ নিচু করে ফেলল সে। তোমার মা যদি আমাকে মেনে না নেন। আমি তো অপবিত্র।
আমি তখন অর্ষাকে আশ্বস্ত করে বলি, তোমার ভয় নেই। আমার মা পবিত্র। তাই তোমাকে তিনি মেনে নেবেন।
অর্ষা তবু গো ধরল, এসো না নেহাল, আমরা এখানেই বাড়িঘর করে থেকে যাই।
আমি বললাম, আমাকে মায়ের কাছে যেতেই হবে। তোমার সঙ্গে দশ বছর থেকেছি। এবার মায়ের সঙ্গে।
অর্ষা কী রকম যেন মুখ ঝামটা মারল, ছোহ, কী এমন থেকেছো তা তো জানিই। মুরোদ তো ছিল না। এখন আমরা দুজনেই স্বাধীন। তবু আমাকে ছেড়ে মায়ের কাছে তুমি চলে যেতে চাচ্ছ।
আরে আশ্চর্য, তোমাকে ছেড়ে যাব কখন বললাম। তুমিই তো যেতে চাইছ না।
অর্ষা বলল, যাব যে, আমার নিরাপত্তা কি?
আমি জিগেশ করলাম, কীসের নিরাপত্তা?
অর্ষা বলল, জানো না, একজন নারী কীসের নিরাপত্তা চায়?
কীসের?
হঠাৎ একটু গাঝাড়া দিয়ে অর্ষা বলে উঠল, তোমার মাথার বস্তাটা যদি আমাকে দিয়ে দ্যাও, তবেই আমি তোমার সঙ্গে যাব। নয়তো চলে যাব রাজধানীতে। শুনেছি, সেখানে নগদে রূপের সদাগর জুটে যায়। তোমার বাড়িতে গিয়ে হেজেমজে থাকার কোনও ইচ্ছে আমার নেই।
হঠাৎ ভক ভক দুর্গন্ধ এসে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে গেল আমার ফুসফুসে। বমি উঠে এলো আমার। এতটাই দুর্গন্ধ যে, অর্ষাকে গুয়ের ভেতর কিলবিল করতে থাকা গুবরে পোকা বলে মনে হলো আমার। তাড়াতাড়ি আমি নাকে রুমাল চাপা দিলাম। এরপর আলতো হেসে বললাম, আমারও ইচ্ছে নেই টাকার বিনিময়ে প্রেম কেনার। তুমি আসতে পারো। এই বলে অর্ষাকে সেখানে ফেলেই আমি চলে এলাম। পেছনে আর তাকাই নি।
কথা বলতে বলতে আমরা পাকা রাস্তায় উঠে এলাম। গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া চিকন এ রাস্তাটার দু’পাশে গাছাপালা। আর ফসলি ক্ষেত। দূরে-দূরে ছড়ানো-ছেটানো ঘরবাড়ি। ঝিম দুপুরের নির্জনতা ভেঙে দিতে পাখির হট্টগোল ছাড়া আর তেমন শব্দ নেই। এ রাস্তাটাও উঠেছে কুমার নদের বুকের ওপর। এপারে যন্ত্রণা সইতে সইতে কুমার হাঁটু পানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্ষায় অবশ্যি বেশ পানি হয়।
দেখতে পেলাম, একটা ইজিবাইক এগিয়ে আসছে। নেহাল রাস্তা ছেড়ে নেমে গেল একটু নিচে।
জিগেশ করলাম, কী হলো নেহাল?
গাড়িটা যেয়ে নিক।
তুমি চাইলে কিন্তু এ গাড়িটায় দ্রুত বাড়ি পৌঁছে যেতে পারো।
নেহাল যেন একটু আতকে উঠল। বলে উঠল, না-না। বুঝতে পারছি আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে। ঠিকাছে, আপনি বস্তাটা আমাকে দিয়ে দিন।
না-না নেহাল, কষ্টের জন্যে নয়। বলছিলাম যে, এরকম হতে তো পারে, এ গাড়িঅলার আত্মা এখনও হয়তো পুরোপুরি পচেনি। যেরকম তুমি বললে, আমার আত্মার কথা। তাহলে তো আর তোমার দুর্গন্ধের ভয় নেই।
কী একটু ভাবল নেহাল। এরপর বলল, ঠিকাছে দেখুন কথা বলে।
হাত তুলে ইজিবাইক থামালাম। যাত্রী নেই। এসময় গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার যাত্রী থাকেই না বললে চলে। এই ইজিঅলা বাড়িতে হয়তো খেতে এসেছিল। আমি বললাম, ভাই যাবেন নাকি?
চালক জিগেশ করল, কই যাবেন বড়ভাই?
ভূবনডাঙা।
চালক গলা বাড়িয়ে জিগেশ করল, রিজার্ভ যাবেন? তাইলে উঠেন।
এই শালা এক ফ্যাসাদ। এমনিতে যা ভাড়া নেয়, এখন তারচে বেশি নেয়ার মতলব। আমি নেহালকে বললাম, এগিয়ে আসো। দ্যাখো...
কয়েক পা এসেই নাকমুখ কুকচে দ্রুত পিছিয়ে গেল নেহাল। বলে উঠল, না-না, আমি যাব না। যাব না। পেছনেই রাস্তার ঢাল, পা হড়কে পড়ে যেত লাগল নেহাল। তবে তা মুহূর্তের জন্যে, ডান হাতটা বাড়িয়ে আমি ধরে ফেললাম তার হাত। এরই মধ্যে পড়ে গেল মাথার ওপর থেকে টাকার বস্তা। পড়েই ছিঁড়ে গেল বস্তার মুখের সেলাই। রাস্তার ওপর ছড়িয়ে পড়ল টাকার বেশ কিছু বাণ্ডিল। সবই এক হাজার টাকার নোট। তড়াক করে বেরিয়ে এলো ইজিঅলা। তার চোখ কপালে উঠে গেছে। একবার সে রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা বাণ্ডিলগুলোর দিকে, আরবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি দেখলাম, নেহাল বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। কী রকম যেন হয়ে গেছে তার মুখের ভঙ্গি। ইশ, আমার জন্যে ছেলেটির এই দুর্দশা। এখন না জানি কী হয়? টাকা-পয়সা নিয়ে কারবার। তাও রূপকথার গল্পের মতো একবস্তা টাকা।
ইজিঅলার চোখ কপালে তুলে রেখেই আমার দিকে চেয়ে বলল, এই টাকা কই পাইলেন ভাই? নিশ্চয় ডাকাতি করছেন। এই বলে লোকটা এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। বুঝলাম, ঘোরতর প্যাঁচে পড়ে যেতে শুরু করেছি। সুতরাং কঠোর হতে হবে। এবং কৌশলী।
কণ্ঠস্বর একটু নামিয়ে শান্ত স্বরে বললাম, শোন ব্যাটা, চুপচাপ গাড়ি নিয়ে চলে যা। পেছনে তাকাবি না। দিনে-দুপুরে একবস্তা টাকা যে মানুষ মাথায় করে নিয়ে যেতে পারে, তার শেকড় কোথায় কোথায় থাকতে পারে, তা বোঝার বুদ্ধি নিশ্চয়ই তোর আছে। না থাকলে পরে পস্তাবি।
কাজ হলো। ভড়কে গেল লোকটা। ভারি হালকা লাগল ভেতরটা। যাক, মানুষকে ভড়কে দিতে আমিও পারি। তবে আরসব মানুষ যেমন পরস্পর পরস্পরকে ভড়কে দিয়ে বেঁচেবর্তে থাকছে, আমি তাদের মতো পারি না। কেননা, এই বিশ্ব-ব্রক্ষ্মণ্ডের অনন্তের ধারণায় নিজেই আমি ভড়কে আছি। আমি আর কাকে ভড়কাবো?
ছড়িয়ে থাকা টাকার বাণ্ডিল বস্তায় ঢোকাতে লাগলাম আমি। দ্রুত হাতে। রাস্তার ঢালুর নিচে নেহাল জড়োসরো ভঙ্গিতে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তার দিকে চাইতেই বুঝলাম, সে আমার দিকেই চেয়ে ছিল। চোখে চোখ পড়তেই সে বলে উঠল, লোকটাকে বিদেয় করে দ্যান। আমি হেঁটেই যাব। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। লোকটাকে...
হঠাৎ একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়। বললাম, গাড়িটা যদি তুমি কিনে নাও, বেশ হয়। আস্তে-ধীরে চালিয়ে তুমি চলে যেতে পারবে বাড়ি। পারবে না টুকটুক করে চালিয়ে নিতে?
ভাবনা ছিল, লোকটা কিছু দূর গিয়েই লোকজন নিয়ে ফিরে আসবে। মানুষকে বিশ্বাস করা পাপ। মানুষের আদি পাপও এই বিশ্বাস ভঙ্গই। এ কারণেই ইজিবাইকটা কিনে নেয়ার চিন্তা মাথায় এলো।
নেহাল নাকে রুমাল চাপা রেখেই বলল, কিনে ন্যান। তবে যা করবেন দ্রুত। আমার সমস্যা হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে।
টাকা ভরে আমি তখন দ্রুত হাতে বস্তার মুখ বাঁধছি দড়ি দিয়ে। লোকটা ততক্ষণে সিটে গিয়ে বসেছে। জিগেশ করলাম, ওই মিয়া, গাড়িটা কত দিয়ে কিনছিলা?
লোকটা বলল, দেড় লাখ টাকা।
তোমাকে দু’লাখ দিচ্ছি। আমার কাছে বেঁচে দ্যাও। এই বলে নেহালের দিকে তাকালাম। কী বলো নেহাল?
নেহাল বলল, তাড়াতাড়ি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। লোকটা যা চাই, দিয়ে দ্যান।
নেহালের দিকে একটু চেয়ে নেমে এলো ইজিঅলা। ওই ভাই কে? অমন করতেছে কেন?
তুমি মিয়া আমার কথা শোনও। দুই লাখ নিয়া ফোটো।
লোকটা সমঝদার। সমাজের সিস্টেমের ভেতর চলা মানুষ। আমি তার সঙ্গে পারব কেন? এরা গন্ধ শুঁকেই অনেক কিছু বলে দিতে পারে। সন্দেহজনক চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, দু’লাখে আমি গাড়ি বেচব না।
তবে কত হলে বেচবে?
বস্তার অর্ধেকের টাকা আমাকে দিতে হবে।
রাগে গড়গড় করতে করতে আমি বললাম, চোপ ব্যাটা। ফাজলামি পাইছ? বেশি বাড়াবাড়ি কইরো না।
লোকটাও তেড়িয়া হয়ে উঠল, আপনে বাড়ায়েন না। ওই যে দ্যাখেন, একটা হুন্ডা আসতেছে। আমি এখন কয়া দেব, এই বস্তায় টাকা আছে।
প্রায় চিৎকার করে উঠল নেহাল, দিয়ে দেন। ও যা চাই দিয়ে দেন। দ্রুত। আমাকে আমার মায়ের কাছে পৌঁছতে হবে। দ্রুত...
দ্রুত শব্দটা একটা গোলোক হয়ে আমাকে ঘিরে ফেলল। আর আমি অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করলাম। আমার জন্যেই এ অবস্থা। কিন্তু তা কেন? আমি তো ইচ্ছে করে এ পরিস্থিতি তৈরি করিনি। নিছক দুর্ঘটনা এটি। তবু অপরাধীর ছায়া পড়ল আমার দেহের ওপর। আমিও তা টের পেলাম। ইজিঅলাকে বললাম, ঠিকাছে, দেব।
মোটরসাইকেল পেরিয়ে গেল। সিটের তলা থেকে একটা বস্তা বের করল লোকটা। অর্ধেক টাকা তাতে দিয়ে বললাম, এবার পালাও। যাও।
বস্তাটা কাঁধে তুলে নিয়েই ইজিঅলা ছুটল। যত জোড়ে দৌড়ানো যায়।  
নেহাল উঠে এলো। বসল চালকের সিটে। বস্তাটা পেছনে তুলে দিয়ে আমি বললাম, এবার তুমি আরামে বাড়িতে তোমার মায়ের কাছে যেতে পারবে। আমাকে এখানেই বিদায় দ্যাও ভাই।
স্টার্ট দিতে দিতে নেহাল বলল, কিন্তু আপনার পারিশ্রমিক?
সে থাক নেহাল। এমনিতে আমার জন্যেই তোমার অর্ধেক টাকা গচ্চা গেল। আমাকে কিছু দিতে হবে না। তুমি যাও, ভালো থেকো।
গাড়ির চাকা গড়াতে শুরু করল। একহাত বাড়িয়ে নেহাল বলল, আপনিও ভালো থাকুন।
সেদিকে চেয়ে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। কী সরল একজন মানুষের দ্যাখা আজ পেলাম। টাকার জন্যে কোনও মন খারাপ নেই ভেতরে। আছে শুধু মায়ের কাছে ফেরার তীব্র তাড়না। ... এই, এই কী হলো! আমি দেখলাম, কিছু দূর গিয়েই ইজিবাইকটি রাস্তার পাশে একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেল। মুহূর্তে আমিও ছুটে গেলাম। ধাক্কা খেয়েই বাইকটি আটকে গেল গাছটার সঙ্গে। স্টার্ট গেল বন্ধ হয়ে। টাকার বস্তা ছিটকে পড়ল রাস্তার পাশে গাঁদাফুলের বাগানে। এবারও খুলে গেল বস্তার মুখের বাঁধন। কয়েকটা বা-িল ছড়িয়ে পড়ল। পাশেই টিনের একটা বাড়ি। বেরিয়ে এসেছে এক লোক। লুঙি পরা। গলায় ঝুলছে গামছা। গিয়ে দেখি, কপাল ঠুকে গেছে সামনের কাচে। দরদর রক্ত পড়ছে। লোকটিও দৌড়ে এলো। ধরাধরি করে ওকে নামিয়ে এনে বসালাম বাগানে। এরই মধ্যে নেহাল নাকে রুমাল চাপা দিয়েছে। তাকে ছেড়ে দিয়েই লোকটি স্থির হয়ে গেল। টাকাগুলোর দিকে চোখ পড়েছে তার। ভূত দ্যাখার মতো করে সে বলল, অ্যাঁ, এ যে টাকার বস্তা!
নিচু হয়ে আমি দ্রুত বা-িলগুলো বস্তায় ভরতে শুরু করলাম। এরপর দ্রুত হাতে বেশ কিছু গাঁদাফুলের পাতা ছিড়ে দুহাতের তালুতে পিষে নেহালের কপালে প্রলেপ লাগিয়ে দিলাম।
লোকটি বড় বড় চোখ করে জিগেশ করল, ভাই আপনারা কারা? এত টাকা কই পাইলেন?
লোকটার দিকে আমি তাকালাম। এখন কী জবাব দেব? এই হলো দ্বিতীয় ফাঁপড়। প্রথমে বিস্ময়। এরপর জেগে উঠবে লোভ। লোভের সাপটা যখন লকলকে জিভে বের করবে, লোকটা তখন হয়ে যাবে ধূর্ত। তার ধূর্তামির বিস্তারে আমি থই পাব না। আর তাই, সহজভাবেই বললাম, টাকাটা আমার নয়। ওর। দশ বছর ও এক ব্যবসায়ীর চাকরি করেছে। এরপর ওর বেতনের সব টাকা বস্তায় ভরে পায়ে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছিল। পথে আমার সঙ্গে দ্যাখা। আমি ওকে এই ইজিবাইকটা কিনে দেই, যাতে তাড়াতাড়ি সে তার বাড়িতে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু ইজিঅলা এই টাকাগুলো দেখে ফ্যালে। ফলে তাকে পুরো বস্তার অর্ধেক টাকা দিয়ে আসতে হয়েছে। এখন আবার এই বিপদ। অথচ ছেলেটির খুব তাড়া।
নেহালের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম, চোখমুখ কুচকে আছে সে। দুর্গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠছে, তবু সহ্য করে আছে। কেন গাঁদাফুলের পাতায় তার রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। ঘাসের ওপর দু’পা ছড়িয়ে মাথাটা একটু ওপরে তুলে সে বসে আছে। নাকে রুমাল। কপালের যন্ত্রণার কারণে উঠে দূরেও যেতে পারছে না। বেশ যন্ত্রণা তাকে হজম করতে হচ্ছে। মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে।  
তার দিকে চেয়ে লোকটা বলল, ইজিবাইক চালাতে জানো না, তাহলে কিনলে কেন? আর তোমার এত তাড়াই বা কীসের? যাবে কোথায় তুমি?
চোখমুখ কুচকে নেহাল জবাব দিল, আমার মায়ের কাছে।
লোকটি জিগেশ করল, কোথায় থাকে সে?
ভূবনডাঙা।
সে তো এখনও বেশ পথ। এরচে ঘোড়া ভালো। আমার একটা ঘোড়া আছে। তুমি চাইলে আমি ঘোড়াটা তোমাকে দিতে পারি।
লোকটার দিকে না তাকিয়েই নেহাল বলল, তাহলে তো বেশ হয় ভাই। ঘোড়া অনেক জোরে ছুটতে পারে। কিন্তু আমি যে ঘোড়াও চালাতে জানি না।
লোকটি বলল, আরে, এতো খুবই সোজা। তোমার ওসব গাড়িফাড়ির মতো ভজঘট এতে নেই। পিঠে চেপে তুমি শুধু ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকবে। যেদিকে যেতে চাও, সেদিকে লাগাম ঘুরিয়ে দেবে। ঘোড়া বাধ্য খোকার মতো তোমারে সুরসুর বাড়ি পৌঁছে দেবে।
নেহালের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলে উঠল, দারুণ হবে তাহলে। আমার ঘোড়াই দরকার। আপনি আমাকে ঘোড়াটা দ্যান। বিনিময়ে যা টাকা চান, দেব।
লোকটি বলল, দ্যাখো ভাই, এ ঘোড়া আমার শখের ঘোড়া। অনেক শেখানো-পড়ানো। তুমি তো যাবে ভূবনডাঙা, তাই তো?
হ্যাঁ।
লোকটা বলল, তা ধরো, ঘোড়ায় চেপে তুমি ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যেতে পারবে। এ গ্যারান্টি আমি তোমাকে দিচ্ছি।
নেহাল জিগেশ করল, কিন্তু এজন্যে আপনাকে কত টাকা দিতে হবে?
লোকটি বলল, কত নয়, পুরো বস্তার টাকা।
চমকে উঠলাম আমি। এ যে ডাকাতের আব্বা! লোকটা কী রকম চশমখোর, এ কথা বলতে একটুও বাঁধলো না? একটা ঘোড়ার দাম নাকি আধবস্তা টাকা! আমি বলে উঠলাম, না-না নেহাল, লোকটা তোমাকে ঠকাচ্ছে। একটা ঘোড়ার দাম কখনোই অত টাকা হয় না।
লোকটা আমার দিকে চেয়ে বলল, আপনে চুপ করেন তো ভাই। টাকা তো আর আপনার না। আপনেরে মনে হয় আমি চিনি। নদীর ওইপাড়ে না আপনার বাড়ি? নেহালের দিকে চেয়ে আমি বললাম, না নেহাল, লোকটার কথা তুমি শুনো না। সে তোমাকে ঠকাচ্ছে।
নেহাল সহজ স্বরে বলল, তা হয়তো ঠকাচ্ছে, কিন্তু আমার যাত্রাপথের ভারও তো কমিয়ে দিচ্ছে। ঘোড়ায় চড়ে এবার দ্রুত মায়ের কাছে যেতে পারব।
আমি থ। নেহাল কি বোকা? যাত্রাপথের ভার কমাতে কেউ কী অতগুলো টাকা কাউকে দিয়ে দ্যায়? কিন্তু সে দিয়ে দিল। চতুর লোকটি তাকে ঘোড়াটি এনে দিল। হাত ধরে যতেœর সাথে নেহালকে তুলে দিল জন্তুটার পিঠে। হাতে ধরিয়ে দিল ঘোড়ার লাগাম। এরপর টাকার বস্তা তুলে নিয়ে লোকটা দ্রুত পায়ে চলে গেল বাড়ির ভেতর।
ঘোড়ার লাগাম ধরে নেহাল বলল, চলি ভাইজান। ভালো থাকবেন। একটা কথা বলি আপনাকে, যে ঠকে, সে কিন্তু আসলে ঠকে না। কোরআনে আল্লাহ বলছেন, মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। ভেবে দ্যাখেন, আক্ষরিক অর্থেই ব্যাপারটি তাই। বৃহত্তর মানুষ যে সিস্টেমে জীবন-যাপন করে, তা-ই যে ক্ষতি, এই বোধ তাদের নেই। এই বোধ যাদের যাছে, তারা এতটাই চুপচাপ যে, বৃহত্তর মানুষ মনে করে, মানুষটি বোকা। যখন তাদেরকে ক্ষতির কথা আপনি বলতে যাবেন, তারা আপানকে পাগল হিশেবে আলাদা চোখে দেখবে। ঘটনা আসলেই কী তাই?
আমি ধ্যানীর মুগ্ধতা নিয়ে নেহালের মুখের দিকে চেয়ে আছি। মানুষের ভেতর এমন মানুষ, আর তো দেখিনি! ঠকছে জেনেও বুকের ভেতর নির্ভার আনন্দ নিয়ে মানুষটি ঠকে যাচ্ছে। ঠকছে কারণ, সে তার মায়ের কাছে যাবে। মায়ের কাছে যাওয়া মানে জীবনের গভীরতর মানের কাছে ফিরে যাওয়া। এই পথই প্রতিটি ধর্মের পথ। এই পথই বিজ্ঞানের পথ। মানুষের সৌন্দর্যের গন্তব্যের পথ। এই পথে যে পথিক হাঁটছে, যে কোনও মূল্যে সে জাগতিক বোঝা মুক্ত হবেই।
আমি জিগেশ করলাম, কিন্তু নেহাল, বাড়িতে গিয়ে মাকে নিয়ে চলবে ক্যামন করে, ভেবেছো? তোমাকে আবারও তো টাকা উপার্জনে বেরিয়ে পড়তে হবে। সব টাকা যে দিয়ে দিলে!
নেহাল বলল, সূরা শুনুন, আমি কি তোমার বুক তোমার কল্যাণে উন্মুক্ত করে দেইনি? তোমার ওপর থেকে আমি সরিয়ে নিয়েছি সেই ভার, যা তোমার পিঠকে অবনত করে দিয়েছিল। তোমার খ্যাতিকে আমি উঁচু মর্যাদা দিয়েছি। কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে। অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। সুতরা, যখনই অবসর পাও, সাধনা করো এবং তোমার প্রতিপালকের দিকে মনোযোগ দাও। এখন আমায় বলেন তো, সত্যিকার অর্থে মানুষ জীবনের কাছ থেকে কি চায়?
আমি বললাম, সুখ আর শান্তি।
হ্যাঁ। আর এর জন্য টাকার খুব বেশি দরকার নেই। দরকার যা, তা প্রেম। জীবনের স্বস্তি। আল্লাহ বলছেন, কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি রয়েছে। মানে কি?
আমি বললাম, বলো। তোমার কাছ থেকেই জেনে নিই।
নেহাল বলল, যখন আপনি টাকা উপার্জনে বের হবেন, স্বস্তি হরণকারী নানা উপদ্রব আপনাকে ঘিরে ধরবে। এটা প্রাকৃতিক সিস্টেম নয়, মানুষেরই সিস্টেম। যদিও বৃহত্তর জগনগোষ্ঠি মনে করে, এটাই প্রাকৃতিক সিস্টেম। এর মধ্যে মানুষের চিন্তার ইতিহাস জানা লোকগুলো জানে যে, মানুষ প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতির শৃঙ্খলা ভেঙে নিজেদের মতো চলছে। এরই মধ্যে থেকে আপনি যদি স্বস্তি পেতে চান, তবে নিজের মতো নিজের ধ্যানে ডুবে যান। এ অবস্থায় কষ্ট আছে, একইসঙ্গে স্বস্তিও রয়েছে। দ্যাখেন, বাক্যটি একবার বলা হলেই হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ একবার বলেই শেষ করেননি। তিনি জানেন, মানুষ মূলত অকৃতজ্ঞ, নিজের ক্ষতি সে নিজেই করে। তাই পরম দয়ালু সেই সত্তা মানুষকে আবারও নিশ্চয়তা দিয়ে বলছেন, অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।
ঘাড় নড়লাম আমি, হ্যাঁ, স্বস্তি আছে। তবে জীবন-জীবিকা?
নেহাল হাসল, এর জন্যে আর ভাবনা কি! মহা প্রাচুর্যময় সেই সত্তার কাছে আত্মসমর্পণ করলে, ছিঁটেফোঁটা কি আর তিনি আপনাকে দেবেন না? আচ্ছা, চলি ভাইজান। আল্লাহ হাফেজ।
ঘোড়ার লাগাম ধরে টান দিল নেহাল। ডান হাত তুলে ভেজা স্বরে আমিও বললাম, আল্লাহ হাফেজ।
ঘোড়া এগিয়ে চলল। ছলোছলো চোখে আমি চেয়ে রইলাম সেদিকে। ক্ষুরের টগবগ শব্দ তুলে ঘোড়াটি ছুটতে শুরু করেছে। পিঠে স্থির হয়ে বসে লাগাম ধরে আছে নেহাল। একবারও পেছন ফিরে তাকালো না। কিছু দূর যেতেই ঘোড়াটি হোচট খেল। পিঠ থেকে ছিটকে নেহাল পড়ে গেল শর্ষে ক্ষেতে।
এ হে, আবারও! দৌড়ে এগিয়ে গেলাম আমি। টেনে তুললাম মাটি থেকে। পায়ে বেশ আঘাত খেয়েছে। কপাল দিয়েও পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত। অথচ কী সহজ হাসি মুখ। আর অপার্থিব এক আলো, সহজের আলো, তার চোখমুখে। এই আলোই তো আমি খুঁজে চলছি। চারপাশে মানুষগুলোর মুখোশ আর অজ্ঞতা দেখে দেখে, আমি এখন একা। সংসারে থেকেও নির্বাসিত।
আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে নেহাল বলল, কী যে হালকা লাগছে এখন নিজেকে! আর কোনও বোঝা নেই। এবার আমি এক দৌড়ে চলে যাব মায়ের কাছে। চলি ভাইজান, আল্লাহ হাফেজ।
নেহাল দৌড়াতে শুরু করল। সে ছুটছে। মাঠের মধ্যে দিয়ে তীরের ফলার মতো সে ছুটছে। কে বলবে, একটু আগে সে পায়ে দারুণ আঘাত খেয়েছে! হতবিহ্বল আমি চেয়ে আছি তার দিকে। ভারমুক্ত হওয়ার এত যে আনন্দ, কখনও টের তো পাইনি। পৃথিবীর পথে এই যে এতটা পথ হেঁটে এলাম, প্রতি মুহূর্তেই জীবনের বোঝা ছিল ঘাড়ে। এখনও আছে। কই, নেহালের মতো আমি তো পারি না নির্ভার হয়ে যেতে। মানুষজন ঠকাচ্ছে, বুঝতে পেরেও সহজভাবে ঠকে যেতে কী আমি এখনও পারি?