আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘পান্থশালা’

প্রকাশিত : জুন ২৫, ২০১৯

ঘুটঘুটে রাত। রাজবাড়ির সকলে ঢলে পড়েছে ঘুমের ঘোরে। চারদিক সুনসান। সুরম্য পালঙ্কে কোমল শয্যায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন বাদশাহ ইব্রাহিম বিন আদহাম। নীরবতা ভেঙে হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন কারও পায়ের শব্দ। রাজবাড়ির ছাদে কেউ যেন হাঁটাহাঁটি করছে। ধ্যান ভেঙে অবাক হয়ে গেলেন ইব্রাহিম। কার এত সাহস যে, এই গভীর রাতে রাজবাড়ির ছাদে উঠে এভাবে হাঁটাহাঁটি করে? দেখতে হয়। পালঙ্ক ছেড়ে নামলেন তিনি। উঠে এলেন ছাদে। মেঘ মেঘ আকাশ। অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো একজন মানুষ চোখে পড়ল তার। দৃঢ় স্বরে তিনি জিগেশ করলেন, কে? কে ওখানে?
জবাব এলো, আমি আপনার একজন বন্ধু।
আরও অবাক হলেন ইব্রাহিম। লোকটা বলছে কীনা সে তার বন্ধু। মানে কি এ কথার? তিনি জিগেশ করলেন, এখানে কি করছ তুমি?
লোকটা জবাব দিল, আমার একটা উট হারিয়ে গেছে। তাই খুঁজতে এসেছি।

বেশ হেঁয়ালি করছে তো লোকটা। ধমকের স্বরে ইব্রাহিম বললেন, ইয়ার্কি হচ্ছে, না? রাজবাড়ির ছাদে তুমি এসেছ উট খুঁজতে? সত্যি করে তোমার পরিচয় বলো। না হলে সৈন্য ডেকে আমি এখুনি তোমাকে বন্দি করব।
লোকটা এবার হেসে উঠল। বলল, জনাব, রাজবাড়ির ছাদে যদি উট খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে সুরম্য পালঙ্কে মখমলের বিছানায় বসে আল্লাহকে কোন বুদ্ধিতে আপনি তালাশ করেন? বলখের বাদশাহ আপনি। দামি সুসজ্জিত পোশাক পরেন। রাজকীয় বাহনে রাস্তায় যখন বের হন, আপনার সামনে-পেছনে থাকে সোনার তৈরি ঢালধারী চল্লিশ-চল্লিশ আশিজন দেহরক্ষী। আপনার ভয়ে আশপাশের বাদশাহরা পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে। এভাবে কেউ আল্লাহকে খুঁজে পেয়েছে, শুনেছেন কখনও? কথা বলতে বলতেই অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটি।

ইব্রাহিম তখন কাঁপছেন। তীরের ফলার মতো লোকটার প্রতিটি বাক্য তার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। ঝড় উঠেছে তার ভেতর। দেয়াল ধরে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। তার সামনে ধূসর অন্ধকার। কেউ নেই। অথচ একটু আগেই একজন ছিল। কে সে? এসব কী বলে গেল লোকটা? সত্যিই তো, রাজকীয় ভোগ-বিলাসে থেকে আল্লাহকে খোঁজা আর রাজবাড়ির ছাদে উট খোঁজা একই তো কথা। ধীর পায়ে তিনি ফিরে এলেন ঘরে। ঘুমোতে পারলেন না। কোমল শয্যায় শুয়ে কেবলই ছটফট করতে লাগলেন। বারবার তার কানে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল লোকটার কথাগুলো। তড়পাতে লাগল হৃদয়।

ভোর হলো। রাজবাড়ির বাগান পাখির কিচিরমিচিরে মুখর হয়ে উঠল। জানলা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন বাগানের দিকে। সারারাতের অনিদ্রায় মাথা ভার ভার ঠেকছে। মুখ বিস্বাদ। চোখের দৃষ্টিও ঘোলাটে। কিছুতেই তিনি ভুলতে পারছেন না লোকটার কথাগুলো। কী মর্মভেদী উচ্চারণ লোকটির, রাজবাড়ির ছাদে যদি উট খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে সুরম্য পালঙ্কে মখমলের বিছানায় বসে আল্লাহকে কোন বুদ্ধিতে আপনি তালাশ করেন?

বিছানা ছেড়ে উঠলেন ইব্রাহিম বিন আদহাম। গোছল করে রাজকীয় পোশাক পরলেন। এরপর হালকা কিছু খেলেন। খিদে নেই তেমন। তবে এতক্ষণে শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। শাহি মহল ছেড়ে তিনি রাজদরবারে এলেন। বসলেন রাজ সিংহাসনে। ডানপাশে মন্ত্রী। সভাষদ সকলেই উপস্থিত। শুরু হলো সভার কার্যক্রম। হঠাৎ করেই দরবারে ঢুকে পড়লেন তেজস্বী এক ব্যক্তি। সান্ত্রীরা বাধা দিতে এগিয়ে এলো, কিন্তু লোকটার হাবভাবে আর বলিষ্ঠ পদক্ষেপ দেখে তারা পিছু হটল। থ হয়ে গেল সভাষদরা। মন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন। থমথমে তার মুখ। বারবার তিনি তাকাতে লাগলেন সান্ত্রীদের দিকে। কারও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই আগন্তুকের। দৃঢ় পায়ে সে এসে দাঁড়ালো ইব্রাহিম বিন আদহামের সামনে।

ইব্রাহিম জিগেশ করলেন, কে তুমি? এখানে কী চাও?
আগন্তুক জবাব দিল, আমি পথিক। এই পান্থশালায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে চাই।
ইব্রাহিম বললেন, তুমি ভুল করছ ভাই। এটা পান্থশালা নয়। এটা আমার বাসভবন।
আগন্তুক বলল, পান্থশালা নয়?
না, এটা রাজবাড়ি।
আচ্ছা আমায় বলুন তো, আপনার আগে এই বাসভবনে কে বাস করতো?
ইব্রাহিম জবাব দিলেন, আমার পিতা।
আগন্তুক জিগেশ করলেন, তার আগে?
আমার দাদা।
তার আগে কে বসবাস করত?
আমার দাদার পিতা।
তারা সবাই এখন কোথায়?
ইব্রাহিম বিন আদহাম জবাব দিলেন, তারা সবাই আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।

আগন্তুক বললেন, তাহলে দ্যাখা যাচ্ছে, এ বাসভবনে একজন আসে আর চলে যায়। এরপরও আপনি বলছেন, এটি পান্থশালা নয়। এটা যদি স্থায়ী বাসভবনই হতো, তবে সকলেই আজ এখানে বসবাস করত। কথা শেষ করেই আগন্তুক দ্রুত পায়ে দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন। দরবারজুড়ে নিস্তব্ধতা। কারো মুখে রা নেই। এতক্ষণ যেন জাদুর ঘোরে ছিলেন ইব্রাহিম বিন আদহাম। এবার ফিরে এলেন বাস্তবতায়। তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এরপর ছুটে এলেন বাইরে। ওই তো আগন্তুক, দ্রুত পা ফেলে হাঁটছে। পিছু নিলেন তিনি লোকটার। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা পথ চলার পর তার নাগাল পেলেন। কাঁপা কাঁপা ভীতস্বরে জিগেশ করলেন, জনাব, কে আপনি?
আগন্তুক দাঁড়ালেন। খুবই শান্ত ও গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন, আল্লাহর বান্দা খিজির।

আত্মপরিচয় দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন খিজির (আ.)। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন বলখেল বাদশাহ। নিঃশ্বাস নিতেও যেন তিনি ভুলে গেলেন। যেন এই বাতাসের ভেতর লুকিয়ে আছেন খিজির। খালি চোখে তিনি তা দেখতে পাচ্ছেন না। খালি চোখে তিনি দেখছেন, দু’চারজন পথিক চলেছে রাস্তা দিয়ে। তার দিকে কীরকম চোখে যেন তাকাচ্ছে। দুপুরের রোদ ঝলমল করছে চারদিক। রাস্তার পাশে খেজুরবাগানের ওপর বাতাস দুলছে।

শান্ত ও ধীর পায়ে প্রাসাদের পথ ধরলেন ইব্রাহিম। হৃদপিণ্ডের গতি বেশ মন্থর হয়ে এসেছে। কী এক শূন্যতা বুকের ভেতর হাহাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। স্বস্তি নেই। প্রাসাদে ফিরে দরবারে আর গেলেন না তিনি। অন্দরে চলে এলেন। পালঙ্কের কোমল শয্যায় শুয়ে পড়লেন। বুকের ভেতরকার ছটফটানি বেড়েই চলল। একটু পরেই তার বেগম এলেন। শিয়রে বসতে বসতে তিনি বললেন, কী হয়েছে আপনার? এরকম ছটফট করছেন কেন? ইব্রাহিম জবাব দিলেন না। ফ্যালফ্যাল চোখে তার দিকে চেয়ে রইলেন। কী হলো? কথা বলছেন না কেন? ইব্রাহিম জিগেশ করলেন, পুত্র কোথায়? ঘুমুচ্ছে? হুঁ। কিন্তু আপনার কী হয়েছে, বলুন আমায়। মনে হচ্ছে বেশ অশান্তিতে আছেন আপনি। কোনও দুঃসংবাদ?

বাদশাহি কাজে আমার মন আর বসছে না বেগম। কেবলই মনে হচ্ছে, জগতের সবকিছুই অসার। মরিচিকার পেছনে ছুটে জীবনটা খরচ করে চলেছি। আখেরাতের অর্জন তো কিছুই করিনি। বিবি বললেন, সে কী কথা! প্রজাবৎসল বাদশাহ হিশেবে আপনার সুখ্যাতি আছে। আপনার শাসনে প্রজারা ন্যায়বিচার পায়। আর তাছাড়া, আপনি নিয়মিত নামাজ রোজাও তো করেন। এসবই তো আখেরাতের অর্জন। ইব্রাহিম জবাবে বললেন, তবে তা মহাসমুদ্রে একবিন্দু পানির মতো। মনে রেখো বেগম, কিয়ামত দিবসে সবচে বেশি অপদস্ত হবে শাসকশ্রেণি। সেদিন আমার কৃতকর্মের দায় কেউ নেবে না। আজকের বাদশাহি সেদিন আমার জন্যে লজ্জার কারণ হবে।

বেশ কিছু সময় চুপচাপ পেরিয়ে গেল। একসময় বিবি বললেন, শিকারের উদ্দেশে আপনি কোনও বন থেকে বেড়িয়ে আসুন। এতে আপনার মনে প্রফুল্লতা আসবে। দীর্ঘদিন রাজকাজে আপনার মন বিরক্ত হয়ে উঠেছে। অনেকদিন তো কোথাও যানটান না। ইব্রাহিম জবাব দিলেন, শিকারের মন আর আমার নেই বেগম। নিজেই তো আমি শিকারে পরিণত হয়ে আছি। আমি আর কী শিকার করব!

দাসি এসে দাঁড়ালো দরজায়। অভিবাদন জানিয়ে সে বলল, রানিমা, শাহজাদার ঘুম ভেঙেছে। নিয়ে আসব?
না থাক। আমি যাচ্ছি। বেগম উঠলেন।

নিঃসাড় শুয়ে রইলেন ইব্রাহিম বিন আদহাম। পাঁচ মাস হলো, তাদের পুত্রটি পৃথিবীতে এসেছে। একসময় সে-ই হবে বলখের বাদশাহ। সেসময় এই পান্থশালা থেকে তিনি বিদায় নেবেন। যেরকম বিদায় নিয়েছেন তার পূর্বপুরুষেরা। হায়, জীবন এত ক্ষণস্থায়ী!