আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘নিঃশেষ হইনি কোথাও’
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৬, ২০২১
আমরা দৌড়োচ্ছি। পরস্পর ধরে আছি পরস্পরের হাত।
গোলগাল চাঁদ ঝুলে রয়েছে পৃথিবীর ওপরে। এত আলো, এই রকম আলো যে, মাটির রাস্তার দুপাশে গাছপালা লালচে গোলাপি আভায় আশ্চর্য কুহক ছড়াচ্ছে। চারদিক নীরবতা। স্তব্ধতা ভেঙে ভেঙে যে রকম ঝরঝরে হয়ে যায়, সে রকম তরল এক নীরব রাত্রির ভেতর দিয়ে আমরা দৌড়োচ্ছি। দৌড়োচ্ছি আর হাঁপাচ্ছি। বেশি হাঁপাচ্ছে লাভলি। ঘাম ঝরছে তার। চাঁদের আলোয় দেখতে পাচ্ছি, তার মুখের ঘাম কী মোহনীয় রকম বেয়ে পড়ছে থুতনি আর গলা বেয়ে। ক্লান্তি আর মনের ভেতর নানা ভাবনার ভাঙচুর নিয়ে তবু সে দৌড়োচ্ছে। থেকে থেকে ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছছে লাভলি। বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। ভরাট পশ্চাৎদেশ আর শরীরে মাংসের স্ফিতি নিয়ে সে তাল রাখতে পারছে না আমার সঙ্গে।
দুপাশে গাছপালা, আর তার নিচে ছোট ছোট ঝোপজঙ্গল। চাঁদ না থাকলে এ রকম রাস্তায় পথ দেখাই মুশকিল হয়ে যেত। কিন্তু এখন চাঁদের আলো রয়েছে। এই আলো কেবল পথই চেনায় না, মানুষের ইন্দ্রিয়ের ভেতর আয়নার ওপর গিয়ে পড়ে। আর তখন আরও আরও কিছু চেনা যায়, যা কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য।
আমার ইন্দ্রিয় এই মুহূর্তে উত্তেজিত।
লাভলির ইন্দ্রিয় এই মুহূর্তে উত্তেজিত।
আমরা কেবল দৌড়োচ্ছি। আমাদের সামনে-পেছনে সব কিছুই অথবা সব সম্পর্কই এখন ইন্দ্রিয়ের বাইরে। চেনা সব সম্পর্ক পেছনে ফেলে আমাদের সঙ্গেই দৌড়োচ্ছে আমাদের ইন্দ্রিয়। যাবতীয় অনুভূতি নতুন নতুন সম্পর্কের জন্যে তৈরি হচ্ছে। একটু একটু করে উপলব্ধি করতে চাইছে দুজন দুজনকে। আর যা কিছু, যেন এই মুহূর্তে চিন্তার বাইরে।
রাস্তার পাশেই একটা উঠোন। তার ওদিকে টিনশেড বাড়ি। হাট করে খুলে রাখা দরজা। কারও কোনও সাড়া শব্দ নেই। উঠোনটা গোবরছড়া দিয়ে নিকোনো, চাঁদের আলোয় কী মসৃণ দেখাচ্ছে। চাঁদে-পাওয়া কয়েকটি কুকুর কেবল ওপরের দিকে চেয়ে ঘেঁউঘেঁউ করছে উঠোন ঘিরে। ফিরেও দেখল না আমাদের। এ রকম কি হয়? গেরস্তবাড়ির কুকুর এত রাত্রে অচেনা মানুষ দেখেও তাড়া করে না এসে অন্যদিকে চেয়ে এভাবে ডাক ছাড়তে থাকে? দূর থেকে আরও আরও কুকুরের ডাক শোনা যায়। কোনও মানুষের স্বর শোনা যায় না। যেন এ বাড়িতে কেউ থাকে না। অথচ ছিল একসময়। তার চিহ্ন রয়েছে উঠোনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
থমকে দাঁড়ায় লাভলি। ভয় খাওয়া চোখে তাকায় আমার দিকে। তারপর কুকুরগুলোর দিকে। আমার একটা বাহু আঁকড়ে ধরে বলে, যদি তেড়ে আসে?
আসবে না।
বললেই হলো! কী রকম ডাকছে শুনতে পাচ্ছ না? যদি চোরটোর মনে করে...
তবে আর কী, ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে।
আঁতকে ওঠে লাভলি, বাপ রে! আমার বুকের সঙ্গে বুক মিশিয়ে এসে দাঁড়ায়। তার বুকের মাংসের উত্তাপ টের পাই। বুঝতে পারি, কম্পনের মাত্রা। কাঁপছে তার বুক। দুহাতে আমার বাহু আঁকড়ে বলে, এ রকম দুটো কুকুর একসময় ছিল আমাদের। ভয়ংকর হয় এরা, তুমি জানো না। ভয়ংকর হিংস্র।
আমি সান্ত্বনা দেই, দেখো, ওরা কিন্তু মোটেও আমাদের দেখছে না। তেড়েও আসছে না। আর তুমি নিশ্চিত থাকো, আসবেও না।
এবার বাহু ছেড়ে বুকের কাছ থেকে সরে গিয়ে লাভলি ঠোঁট উলটে জিগেশ করে, তুমিই বা ওমন নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?
চাঁদে-পাওয়া কুকুর। বলেই হাসতে থাকি আমি। দেখছ না ওপরের দিকে চেয়ে কী রকম গলাবাজি করছে।
এ কথার পর একটু সময় কুকুরগুলোকে দেখল লাভলি। তারপর অস্ফুট স্বরে বলল, আশ্চর্য! কোনও দিকে খেয়াল নেই। আর দেখেছো বাড়িটার দরজা খোলা। কেউ নেই নাকি ভেতরে?
জানি না। চাঁদে পেয়ে বসেছে আজ সবকিছু। নাও থাকতে পারে। চলো...
দুজন দুজনের হাত ধরে ফের দৌড়োতে থাকি আমরা। শরীরের ঝাঁকুনির সঙ্গে উঠছে-নামছে লাভলির স্তন। ওড়না গলা পেঁচিয়ে পিঠের ওপর দিয়ে দুই প্রান্ত ঝুলে রয়েছে। ভরাট মাংসের দুই খণ্ডের ওঠানামা দেখে শরীরের ভেতর কোথায় যেন উত্তেজনা টের পাই। গেরস্তজীবনের আস্বাদ নিতে অস্থিরতা আমার বুকের ভেতর ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি বাড়িঘর পেরিয়ে এলাম আমরা। খেয়াল করলাম, প্রতিটি ঘরের দরজা খোলা। মানুষ সব গেছে কোথায়? একটা রহস্য শিরা-উপশিরা দিয়ে আমার ভেতর আগ্রাসী হয়ে ওঠে। মানুষ যে রকম কাঁদে, সেই স্বরে গাছপালার আড়াল থেকে বিরতিহীন ডেকে চলেছে ডাহুক। এই ডাক, কী যে আকুতি আর তাড়না মেশানো। আমার মনে হতে থাকে, কোটি কোটি বছরের ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে যেন আমরা যাচ্ছি।
একটা বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি এসে পড়েছি আমরা। ছোট ছোট বাঁশপাতার আড়ালে ঝিলিমিলি চাঁদের আলো। সরু একটা কঞ্চি অনেক ওপরে গোল হয়ে বেঁকে গেছে। আমার চোখ আটকে গেল তার বৃত্তে। এবং গোলগাল চাঁদটাও স্থির হয়ে রয়েছে সেখানে। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। দাঁড়িয়ে পড়ল লাভলি। একটু ঝুঁকে পড়ে সে হাঁপাচ্ছে। তার চওড়া কপাল ভিজে জবজবে। হাত ছাড়িয়ে ওড়না টেনে নিয়ে মুখের ঘাম মুছল সে। তার কণ্ঠস্বরে কাতরতা ছড়িয়ে পড়ে, ইস, এ রকম দৌড়োতে পারে কোনও মানুষ!
আমার মনে পড়ে যাচ্ছে একটি পঙক্তি। মনে পড়ে যাচ্ছে ঝরনার শব্দের মতো, তবলার টুংটাং আর্তনাদের মতো।
রাতবিরেতে ডাকছে ডাহুক
বাঁশবাগানে চাঁদ
যাচ্ছি, তবে যাবার আগে
খুলতে হবে ফাঁদ।
আমারই তো লেখা এই কবিতা। অথবা ঠিক আমারও নয়, যে মানুষের জীবন আমি বহন করে চলেছি, সেই হয়তো লিখেছিল এই রকম। আমি তো জানতাম না যে, এভাবে একে একে গেরস্তজীবনের সব ফাঁদ খুলে ফেলে কোনও একদিন এইভাবে ছুটে বেরিয়ে আসতে হবে আমাকে। বাঁশবাগানের চাঁদ আর বুকচেরা কাতর কান্নার মতো ডাহুকের ডাক এইভাবে আমাকে ডেকে নিতে পারে, এই রকম তো আমার ভাবনায় ছিল না কখনও। অথচ সেই আমিই এখন কী যেন কীসের ডাকে আচ্ছন্ন হয়ে চেনা জীবনের ফাঁদ খুলে ছুটে চলেছি। যে লিখেছিল এই পঙক্তি, সে কি তবে জানত এইভাবে একদিন আমাকে বেরিয়েই পড়তে হবে? সে কি তবে আমার জীবনের লিপিকর, যে এইভাবে লিখতে পারে আমার সবকিছু। আমার চেনা-অচেনা সব?
আমি তবে কে?
আমি তবে কাকে লিখি?
সে তবে কাকে লেখে?
কী হলো? চমকে উঠে দেখি, লাভলি চেয়ে আছে আমার দিকে। হাঁপাচ্ছে সে তখনও। বলল, কী ভাবছ হঠাৎ?
হাসতে চেষ্টা করলাম আমি, না, কিছু না।
ইস, যা ঘেমে গেছ তুমি! বলে, লাভলি এগিয়ে এসে ওড়না দিয়ে আমার মুখের ঘাম মুছিয়ে দিল। তার বুকের ভেতর থেকে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে, শুনতে পেলাম। ঘাম মুছিয়ে ওড়না ঠিকঠাক গলায় পেঁচাতে পেঁচাতে সে বলল, কুকুরগুলো দেখে যা ভয় পেয়েছিলাম! যদি সত্যি সত্যি তেড়ে আসত?
আমি হাসলাম, আসত না। আজ রাত্রে সবকিছু চাঁদে পেয়ে বসেছে। কেউ আর নিজের ভেতর নেই। আমরাও নেই।
চোখ পাকায় লাভলি, যাঃ। এ আবার কী কথা।
এই রকমই হয়। আমি বোঝাতে চেষ্টা করি তাকে, কোনও কোনও রাত্রে চাঁদে এই রকমভাবে গ্রাস করে ফেলে সবকিছু। চাঁদের আলোর ঘূর্ণির ভেতর ঢুকে পড়ে সবকিছুই যার যার স্বভাব হারিয়ে ফেলে। আমরাও হারিয়ে ফেলেছি আমাদের অরিজিন্যালিটি। যে কারণে ছুটে চলেছি।
কপালের ওপর থেকে ঘামে লেপ্টে যাওয়া একগোছা চুল সরিয়ে গভীর আর শীতের শেষরাতের মতো আচ্ছন্নতা ছড়ানো দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালো লাভলি। তারপর বলল, আর কত দূর যেতে হবে আমাদের?
আমিও একই কথা জিগেশ করলাম তাকে, আর কত দূর যেতে হবে আমাদের?
ফিক করে হেসে ফেলল লাভলি। ছেলেবেলায় যে রকম সে হেসে উঠত, যে রকম সারল্য সে লালন করত, আমি বুঝতে পারলাম, সে রকমভাবেই লাভলি এই মুহূর্তে হাসতে পারল। চাঁদে পেয়ে বসলে এই রকম হাসতে পারে মানুষ।
আমি চাঁদ দেখলাম। তারপর দেখলাম লাভলির মুখ। একই রকম দেখতে দুটো। একই রকম সৌন্দর্য, আর একই রকম গোলগাল। সবচেয়ে বেশি কে আমার চেনা? সবচেয়ে বেশি কে আমার কাছাকাছি? কত বছর ধরেই তো দেখে আসছি চাঁদ, চাঁদের শরীর থেকে ঠিকরে পড়া আলোর রহস্যময়তা চোখে নিয়ে এই বয়েস অবধি বেঁচে আছি; তবু বলতে তো পারব না আমাদের নৈকট্য গভীরতর। এই চাঁদ যখন মেলে ধরে তার সৌন্দর্য, আর আমি দেখি, কিন্তু যা দেখি তা কি সত্যিই ওই চাঁদ? নাকী আমার অনুভূতি চাঁদের অবয়ব নিয়ে যতটা আমাকে দেখাতে পারে, ঠিক ততটাই আমার চাঁদ দেখে ওঠা। আর লাভলির এই মুখই বা কতটা সত্যি আমার কাছে! আমার লালসা আর জীবনের চেনাজানা যাপিত জীবনে কোথায় তার এই মুখ রঙের নির্মিতি পেয়েছে? বাইরে থেকে চেনা আর ভেতর থেকে অচেনা, এই দুয়ের মধ্যেকার যে দূরত্ব, লাভলি কি তারই মাইলফলক? চাঁদ আর মুখের এই এক গোলকধাঁধা। চোখ ঝলসে দেয় যা কেবল, সমাধানের কোনও স্বস্তি পেতে দেয় না। রঙ দিয়েও যা নিজস্ব হয়ে উঠতে পারে না। এই বোধ পেয়েই কী শাহ আব্দুল করিম লিখেছিলেন :
রঙের দুনিয়া তোরে চাই না
দিবানিশি ভাবি যারে
তার ছবি পাই না।
আমরা পালাচ্ছি। হ্যাঁ, এই পালিয়ে যাওয়া জীবন থেকে, জীবনের ভেতর যে গভীরতর জীবন রয়েছে তার রক্তমাংসের আস্বাদ অথবা সে জীবনের কাম-ভালোবাসা-পরিচিত কণ্ঠস্বর ঘামের মতো শরীর থেকে ঝরিয়ে দিয়ে আরেক গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটে যাওয়া। যা যা চেনা ছিল, তার বাইরে আরেক জীবনে আমাদের এই যাত্রা।
পরস্পরের এই দৌড়।
দেখলাম লাভলিকে। সে এখনও হাঁপাচ্ছে, আর তাকাচ্ছে আমার দিকে। তাকালাম দুপাশে গাছপালার ওপর। সবুজ পাতার ভিড়ে রাত্রির অন্ধকার নয়, চাঁদের লালচে গোলাপি আলো। সবুজ আর এই গোলাপি মিলেমিশে এই যে আরেক আভা, এ কেবল রঙের আয়োজন নয়; সৌন্দর্যের এক গভীর অনুচ্চারিত ইঙ্গিত যেন।
চলো, লাভলির স্বর শুনে মুখ ফেরালাম। বললাম, চলো।
আমি কিন্তু আর দৌড়োতে পারব না, বাব্বা! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল লাভলি, পা দুটো আর টানতে পারছি না। আচ্ছা, আমরা তো অনেক দূর চলেও এসেছি।
হ্যাঁ, তেপান্তর ছাড়িয়েও।
যাঃ। খালি বানিয়ে বানিয়ে কথা।
দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি এখানে?
জবাব না দিয়ে আমার একটা বাহু সে পেঁচিয়ে ধরে এবং হাঁটতে আরম্ভ করে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়িঘর আর চোখে আমাদের পড়ে না। মাটির রাস্তা ছেড়ে এবার রেললাইনের ওপর উঠে পড়ি। পরিত্যক্ত রেললাইন। কোথাও কোথাও লাইনের পাত নেই। কিছু দূর এগোলেই একটা ব্রিজ পড়ল। লাইনের ওপর কাঠ দিয়ে রাস্তা তৈরি করা। নিচে নদী। হুহু হাওয়া ছুটে আসছে নদীর ওপর দিয়ে। জলো হাওয়া। নদীতে কিছু দূর পরপর ভেসাল পাতা। অথচ সেখানে কোনও লণ্ঠন জ্বলছে না। তারমানে জেলে নেই মাছ পাহারায়। আমার মনে হলো, মানুষের ভূত এসে এই সুযোগে লুটেপুটে খেয়ে যাচ্ছে জেলেদের মাছ। চাঁদের আলোয় আমি যেন দেখতেও পেলাম সেইসব ভূতদের। শুনতে পেলাম ব্রিজের নিচে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। আমি জানি, এই শব্দ ভূতেরা জাগায়। সারা রাত ভরে এইসব শব্দের ঢেউ তারা তুলে যাবে। এইভাবে একদিন এসে যাবে, তখন এইসব শব্দও ভূত হয়ে কেবল শব্দের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলবে শব্দের পৃথিবীতে।
চাঁদ এখন মাথার ওপর।
লাভলির হাত ছেড়ে আমি ঝুঁকে নিচের দিকটা দেখতে চেষ্টা করি। আঁতকে ওঠে লাভলি, কী করছ তুমি? পড়ে যাবে তো?
আমার কী রকম যেন ভয় করে। কত নিচে পানি, মনে হয় একেবারে পাতালে। আমি পৃথিবীর ওপর দাঁড়িয়ে পাতাল দেখছি। লাভলি এসে আমার হাত ধরে টানে, চলো তো।
ঝাঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়েই আমি দুহাতে লাভলির মুখ ধরে ঠোঁট বসিয়ে দিই তার ঠোঁটের ভেতর। নরম মাংসের জলাধার যেন। তিরতির কেঁপে ওঠে। আর কেঁপে ওঠে নদীর ঢেউয়ের মতো লাভলির শরীর। শিরশির হাওয়া ছুটে চলে যায় আমাকে কাঁপিয়ে দিয়ে। নিশ্বাস তোলপাড় করে ওঠে আমার বুকের ভেতর। নরম ঠোঁটের ভেতর আমার ঠোঁট কেবলই তলিয়ে যেতে থাকে। কপট ঝটকায় মুখ সরিয়ে নিয়ে খিলখিল হেসে ওঠে লাভলি।
আমি চেয়ে থাকি তার মুখের দিকে। লালসা নয়, কামনাও নয়; আরেক রকম অনুভূতির উত্তেজনা আমার রক্তের ভেতর ঢেউ তোলে। এই সৌন্দর্য কীভাবে এলো এই নারীর ভেতর! হুহু ঠাণ্ডা হাওয়া ছুটে যাচ্ছে। পেছন দিকে ছড়িয়ে উড়ছে লাভলির চুল। উড়ছে তার ওড়নার প্রান্ত।
মুগ্ধতা নয়, তারও বেশি কিছু চোখে নিয়ে আমি চেয়ে থাকি তার দিকে। আমার লাভলির দিকে। একটি জীবন কেবল এভাবেই চেয়ে থেকে কাটিয়ে দেয়া যায়। হ্যাঁ, যায়ই তো, এ রকম একটি দৃশ্যের জন্ম হবে বলে সব মানুষই তো অপেক্ষা করে বেঁচে থাকে। জীবনের বেঁধে দেয়া সব শক্ত শক্ত বোধের বাইরে এসে এই সৌন্দর্য যখন চোখে পড়ে, অর্থ-কীর্তি কিংবা সচ্ছলতার আর কী মূল্য তখন মানুষকে তাড়িত করে?
এই এক জীবন মানুষের। এই রকম দৃশ্যের মুখোমুখি।
যদিও রহস্য রয়েছে এই দৃশ্যের ভেতর, যদিও সত্যি-মিথ্যের খেলা রয়েছে এই দৃশ্যের ভেতর, তবু তারও যেন আলাদা কোনও মানে নেই এই রকম সৌন্দর্যের কাছে। যে রকম এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। দৃশ্যের ভেতর কেবল দৃশ্যই সত্যি এখন। সৌন্দর্যের ভেতর কেবল সৌন্দর্যই সত্যি এখন।
হাসি থামিয়ে দুপা এগোয় লাভলি, হয়েছে, চলো তো এখন।
হাঁটতে হাঁটতে রেললাইনের পাশেই একটা বাজারে পৌঁছোই আমরা। আর দেখি, বাজারের সব দোকানই খোলা। কোনও বিক্রেতা নেই। ক্রেতাও নেই। কোনও মানুষই আসলে নেই। বৈদ্যুতিক বালব জ্বলছে দোকানে দোকানে। নানা রকমের দোকান। এই মধ্যরাত্রিতে প্রকৃতির ভেতর থেকে উঠে আসা শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই এই বাজারে। কয়েকটি কুকুর শুধূ এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছে আর ডাক ছাড়ছে।
লাভলি বিস্ময় নিয়ে চারদিকে তাকালো। দেখল এক একটি দোকান ঘিরে মৃতের মতো নির্জনতা কীভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। আমার দিকে চেয়ে ভয় খাওয়া গলায় ফিসফিসিয়ে বলল, এ আবার কেমন বাজার, কোনও মানুষজন নাই।
আমি তার কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে দোকানগুলোর দিকে চেয়ে বললাম, বলেছিলাম না সবকিছু আজ চাঁদে পেয়ে বসেছে। এই বাজারের মানুষগুলোও উধাও দোকান খোলা রেখে। বিশ্বাস হলো তো এবার?
না গো তা নয়। কী যেন হয়েছে কোথাও।
হয়েছে তো হয়েছেই। তাতে কার আবার কী। চলো, আমরা বাজারের পেছন দিককার ওই রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়।
এঃ মা, এ কোথায় চলে এলাম আমরা! লাভলি তার কাঁধের ওপর রাখা আমার হাত আঁকড়ে ধরে।
তুমি এমন করছ যেন পৃথিবীতে মহা বিপর্যয় নেমে এসেছে। দাঁড়াও দেখি, বলে আমি একটা দোকানের সাইনবোর্ডে জায়গাটার নাম পড়লাম, জ্ঞানদিয়া বাজার। তারপর বললাম, এ বাজারের নাম জ্ঞানদিয়া বাজার। তোমার যদি জ্ঞানের দরকার থাকে তবে তুমি থাকো, আমি চললাম...
আঁতকে উঠে পেছন থেকে আমার হাত টেনে ধরল লাভলি। তারপর দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে লাগল আমার সঙ্গে। এদিকটায় ঘরবাড়ি আর তেমন পেলাম না। কেবল ফসলি খেত। আরও কিছু দূর এগোলে দেখতে পেলাম নদী। রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর ভেতর। ব্রীজের সেই নদীই কীনা, কে বলবে তা।
তীরে দাঁড়িয়ে বললাম, চলো, এখানে একটু বসি।
আমার কাঁধের ওপর আলগোছে মাথাটা নামিয়ে আনল লাভলি। বলল, কী স্নিগ্ধ এই নদী, না?
হুঁ। চলো, লাভলির হাত ধরে ঢালু জায়গাটা সাবধানে পেরিয়ে পানির কাছাকাছি এসে বসলাম। পাশাপাশি। এই নদীতে ভেসাল নেই কোথাও। তবে মাছ আছে। পানির ভেতর থেকে মাছেদের ঘাই মারার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। চাঁদের প্রতিবিম্ব এসে পড়েছে পানির ওপর। চিকচিক করছে পানি। টলটল করছে। উজ্জ্বলতার রঙ তবে এই রকম? যেন প্রথম দেখলাম আমি। ইচ্ছে হলো, ঝাপিয়ে পড়ি নদীর বুকে। জলজ চাঁদটা যেখানে ভেসে রয়েছে, তার ওপর গিয়ে আমিও ভেসে থাকি। ঘুরেঘুরে সাঁতার কাটি।
লাভলি বলে ওঠে, এই দেখেছো, ছিপ। কারা যেন ফেলে গেছে।
চেয়ে দেখলাম, সত্যিই দুটো ছিপ আমাদের সামনে। কারা যেন মাছ ধরছিল এইখানে। আর এখন উধাও হয়ে গেছে। পাশেই একটা খালুই।
লাভলি বিহ্বল হয়ে পড়ল। একটা ছোট্ট পাখির মতো নরম করে ঘাড় হেলিয়ে বলল, আমরা এখন মাছ ধরব। পারো তো তুমি?
তেমন কখনও ধরিনি তো।
সমস্যা নেই। আমি নজর রাখব। তুমি শুধু ছিপ হাতে বসে থাকবে আমার পাশে। আমি বললেই টান দেবে।
আমি গুণমুগ্ধ শিষ্যের মতো মাথা কাত করি একদিকে। দুজনে তুলে নিলাম দুটো ছিপ। বসে রইলাম। এদিকটায় গাছপালা তেমন নেই। আলোছায়ার মিশেলও তাই প্রকট নয়। ওপরে বিস্তীর্ণ আকাশ। উজ্জ্বল এক একটি ফুলের মতো তারা। আর চাঁদ। চরাচর জুড়ে স্নিগ্ধ এক নরম আলো ছড়ানো। ঝিঁঝি ডেকে যাচ্ছে একটানা। আমরা বসে আছি পাশাপাশি। মাছের কোনও নামনিশানা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। স্থির তবু আমাদের প্রতীক্ষা। যেন এইভাবে বসে থাকতে থাকতে আমরা একসময় শিকারি হয়ে উঠব। শিরশিরে হাওয়া ছুটে আসে নদীর ওপর দিয়ে। আর নদীর ওপার থেকে অন্ধকার ভেঙে ভেঙে ভেসে আসে রাতপাখিদের চুনমুন চুনমুন। ডানা ঝাপটানি।
ডাহুকের কান্না।
পাতাসহ কী একটা ডাল ভেসে যেতে দেখলাম আমাদের সামনে দিয়ে। এক একটি অনুসঙ্গ এইভাবে আমাদের একাত্ম হয়ে উঠতে প্ররোচনা দেয়। আমাদের পিঠে বিগত দিনের শতকোটি সময়ের দাগ। আমাদের কণ্ঠনালি সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরে রয়েছে বিগত সময়ের না-বলা অনেক অনেক কথা। তবু চুপচাপ আমাদের অপেক্ষা। ছিপ ফেলে তবু আমাদের বসে থাকা মাছেদের জন্যে। হঠাৎ দড়িতে টান পড়ে আমার। প্রায় উত্তেজিত হয়ে উঠি আমি। চিৎকার করে বলি, ছিপ টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমার। ছিপ আমার...
লাভলি নিজের ছিপ নামিয়ে রেখে আমার ছিপ ধরে বিশেষ কৌশলে টান দিয়ে ওপরে তুলে আনে। মাঝারি আকৃতির একটা পোনামাছ গেঁথে আছে বঁড়শিতে। আমার উত্তেজনা কে আর দেখে! লাভলি কিন্তু নির্বিকার মুখে মাছটি ছাড়িয়ে খালুইয়ের ভেতর রেখে দেয়। ছিপটি আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তুলে নেয় নিজের ছিপ। আমি বুঝতে পারি, শিকারে কী হাস্যকর রকমের আনাড়ি আমি। ছেলেমানুষ, কিছুই যেন এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। আর এই মেয়েটি আশ্চর্য কৌশলী হয়ে ওঠে আমার অনুভূতির জগতে। বোধের গভীরে কোথায় ধরে যেন নাড়া দেয়।
তাকাই আশ্চর্য মেয়েটির দিকে। পানির দিকে চেয়ে সে বসে আছে স্থির হয়ে। কোত্থেকে চিলতে মেঘ এসে ঢেকে দেয় চাঁদ। ছায়া ছায়া এক রকম আলো নদীর ওপর, চারদিকে। আমরা কথা বলি না। আমাদের সব কথাই যেন বলে দিয়ে যাচ্ছে এই নদী, আর ছায়া ছায়া চাঁদ। মেঘের ভাসমান শাদা-কালো।
বেশ কিছু সময় মুখ নিচু করে বসে থাকে লাভলি। আর তখন ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যেতে থাকে। শেয়াল ডেকে ওঠে দূরে কোথাও। তারপর মুখ না তুলেই লাভলি বলল, এই পৃথিবী আমার কল্পনায় এতদিন ছিল, ভাবতেও পারতাম আমি এ রকম কিছু; তবু ভাবতে পারতাম না কেবল সত্যি সত্যি পেয়ে যাব এই জীবন।
নিজেকেই শুনিয়ে যেন বলি, এই জীবন তুমি চেয়েছিলে বুঝি? এই চাঁদ, নদী আর অন্ধকারের মোহিনী এই জীবন। তারপর লাভলিকে শুনিয়ে বলি, পেয়েছো তাহলে?
মুখ না ফিরিয়েই তার নির্জন গাম্ভীর্য নিয়ে লাভলি বলে, হ্যাঁ, পেয়েছিই তো মনে হচ্ছে।
তবে পেয়েছো। আমার চোখ নদীর ওপারে গাছপালার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে। প্রায় ফিসফিসিয়ে তাকে বলি, তুমি জানো না, তোমাকে এক নদীর তীরে ঘন কুয়াশার ভেতর আমি হারিয়ে এসেছি।
লাভলি মুখ ফেরায় আমার দিকে। মনে হয় আমার, কৌতুক মেশানো স্বরে সে জানতে চায়, এই কী সেই নদী?
জানি না। তবে এ রকমই এক নদী। এ রকম চাঁদ ছিল। অন্ধকার ছিল। নির্জনতা ছিল। তুমি আর আমি ছিলাম। আর কুয়াশা ছিল। এই নদীতে কুয়াশা নেই।
ছলনার মতো হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে লাভলি বলে, তুমি খুঁজে দেখলে না আমাকে? ফেলে চলে এলে? কী পুরুষ তুমি!
আমি খুঁজতাম। খুঁজতে যেতাম হয়তো, কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, আমাদের জীবনে কী কী ঘটবে তার সবটাই আসলে কেউ একজন আড়াল থেকে লিখছে, তখন আর আগ্রহ হয়নি।
ব্যগ্র হয়ে ওঠে লাভলি, তারপর কী হলো?
তারপর কী হলো আমি জানি না। ওই গল্প তারপর থেকে আমি আর লিখিনি।
উটের গ্রীবার মতো কাঁধ নাচিয়ে লাভলি বলে, ও আচ্ছা, তুমি গল্পের কথা বলছ?
হ্যাঁ, তোমার গল্প। আমার গল্প। এক গল্প থেকে আরেক গল্পে জীবন ঢুকে যাবার গল্প। এই যে একটু আগে তুমি বললে, যে জীবন কল্পনায় ছিল তোমার সে জীবন এই মুহূর্তে পেয়ে গেছ তুমি। তারমানে তুমি কিন্তু তোমার আগের জীবন হারিয়ে ফেলেছো।
মহাশূন্যের অনন্ত শূন্যতা নিয়ে লাভলি চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। আর আমি বলতে থাকি, একটি জীবন থেকে এইভাবে অনেক অনেক জীবনে ঢুকে আগের জীবন মানুষ হারিয়ে ফেলে।
ছলাৎ শব্দ হতেই ছিপের দিকে চোখ চলে যায়। টান পড়ছে পানির ভেতর থেকে। শরীরের ভেতর কী এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই মাছ আটকে পড়েছে আমার ফাঁদে। শিকারির ক্রুরতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে আমার চোখমুখে। নিজেই এবার টান দিই ছিপ। পানির ওপরে তুলতে না তুলতেই তলিয়ে যায় আমার শিকার। খিলখিল হেসে ওঠে লাভলি। আমি হতচকিত। বোকার মতো মাথা দোলায় দুদিকে, মাছ ধরার অভ্যেস কখনও নেই তো।
এই কারণে পারো না, তাই তো? বলতে বলতে লাভলি টান দেয় তার ছিপ ধরে। দাঁড়িয়ে পড়ে। আধাকেজি খানেক ওজনের একটা রুই তার বড়শিতে গাঁথা। হাততালি দিয়ে উঠি আমি, ব্রাভো!
মুচকি মুচকি হাসি ছড়িয়ে সে বলে, বসে না থেকে মাছটা ছাড়িয়ে খালুইয়ে রাখো। এটাতে তেমন কৌশল জানতে হয় না।
আমি হাসি। তার দিকে চেয়ে বোকা বোকা হাসি। তারপর আমার সামনে ঝুলে থাকা মাছটি বঁড়শি থেকে তুলে খালুইয়ে রেখে দিই। হাসতে হাসতেই বলি, বেশ বড় শিকার তো।
বসতে বসতে লাভলি বলে, এক জীবন থেকে আরেক জীবনে ঢুকে যেতে হলে এই রকম কৌশলী শিকারি হতে হয়।
আমি কৌশলী নই। আমি সেই লাভলিকে এখনও পেতে চাই, যে কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেছিল।
ঘাড় কাত করে লাভলি জানতে চায়, আর এই আমি? এই লাভলি?
তুমি তো আছোই। এই যে রয়েছ আমার সামনে। তারমানে তুমি এই মুহূর্তে আমার অস্থি-মজ্জায় রয়েছ। কিন্তু কোনও কিছুই আমার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না। মায়া হয়।
চুপচুপ চেয়ে রইলাম লাভলির পায়ের দিকে। পায়ের কাছটায় আবছা অন্ধকার। শাড়ির পাড় দিয়ে আড়াল থাকায় কেবল বোঝা যায় পাতা দুটো। পায়ের তলায় যে ঘাসগুলো গুটিশুটি মেরে রয়েছে, তারা কি টের পাচ্ছে পাতা দুটোর উত্তাপ? সৌন্দর্য যে সর্বভূক, এই সত্যি কি বুঝতে পারছে তারা পিষ্ট হবার যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে?
লাভলি কিছু বলে না। চুপচাপ চেয়ে থাকে আমার দিকে। ছিপ হাতে ধরাই রয়েছে। এক সময় বলে, যন্ত্রণাও যদি তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়, তবে তার জন্যেও কি তোমার মন খারাপ হয়ে যায়?
আমি হাসি। রহস্য ছড়িয়ে দেয়ার জাদুকরি কৌশলে বলি, আমি তো যন্ত্রণার সন্তান। টের পাওনি বুঝি এতদিনে?
ছিপ ফেলে উঠে দাঁড়ায় লাভলি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমরা কি এভাবেই বসে থাকব সারা রাত?
কিন্তু এই মাছগুলো?
হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, এই তো? নিয়ে চলো। কাছাকাছি কোনও বাড়িঘর পেলে রান্নাটান্না করা যাবে।
এত রাতে রান্না, বাড়ির লোকজন যদি জেগে ওঠে?
আসার পথে দেখলে না, বাড়িঘর জনশূন্য। সবাইকে চাঁদে পেয়েছে। কেউ জেগে উঠবে না।
এতক্ষণে খেয়াল হয় আমার। আশ্চর্য, মানুষজন সব কোথায় চলে গেল ভেলকিবাজির মতো। আঁচল ঝেড়ে কাঁধে জড়িয়ে নেয় লাভলি। তারপর ঝুঁকে গলুই হাতে নিয়ে পা বাড়ায়।
আমার কাছে দাও। আমি নিচ্ছি।
একজন নিলেই হয়। চলো।
পাড়ের ওপর দিয়ে চিকন পায়ে হাঁটা রাস্তা। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে ছড়িয়ে থাকা চাঁদের আবছা আলোয় পথ চিনে আমরা হাঁটছি। ঝিঁঝির ডাকে চারদিক কম্পিত। আর গাছের পাতার আড়ালে থেকে থেকে পাখিদের ডানা ঝাপটানি। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক। সেই ডাক মরা কান্নার মতো সুর তুলছে শিরশির হাওয়ায়। একটু যেতেই চোখে পড়ল, গাছপালার আড়ালে টংঘরের মতো কী একটা। লাভলিকে দেখিয়ে বললাম, দেখেছো, কুঁড়েটুরে হবে বোধহয়। চলো, ওখানে যাওয়া যাক।
হ্যাঁ, ওপরে চালা দেয়া আর দুদিকে বেড়া দেয়া একটা একচালা ঘর। সামনে আর পেছনে খোলা। ঘরের মাঝখানে একটা চৌকি। তার ওপর কেউ একজন বসে রয়েছে। তার পাশে জ্বলছে একটা প্রদীপ। লোকটার কাছাকাছি হতেই ধাক্কা খেলাম। বাহু আঁকড়ে ধরলাম লাভলির। চমকে উঠে লাভলি বলল, কী হলো?
আমি লোকটাকে দেখছি। বয়েসের কোনও গাছ-পাথর নেই। খালি গা। এক হাঁটু ভাঁজ করে আরেক হাঁটু তুলে বসে আছে। চুল শনের মতো শাদা। তোবড়ানো গাল। চেয়ে আছে সে আমাদের দিকে। আমার ভেতর তখন ভূমিকম্প। চেনা চেনা লাগছে। চেনা চেনা এই ভঙ্গি... চেনা চেনা মুখ... কোথায়...
চমক ভাঙে আমার। এ তো সেই বুড়ো। যুক্তি তক্কো গপ্পো সিনেমাতে যে বুড়োকে আমি দেখেছিলাম। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার তেষ্টা পায়। মাঠঘাট, পাহাড় আর সমুদ্র ডিঙিয়ে যেন হাহাকার এসে আছড়ে পড়তে থাকে এইখানে। আমার বুকের ভেতর কোনও কথা ভাষা পেল না। কেবল এক রকম ধ্বনি যা হাহাকারের মতো, ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
নড়েচড়ে ওঠে বুড়ো। চৌকির নিচে পা ঝুলিয়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে জিগেশ করে, কারা তোমরা?
আমি বুঝতে পারি না কী জবাব আমাদের দেয়া উচিত।
লাভলি আমার শরীর ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়।
কিছু না ভেবেই বলে উঠি, আমি আপনাকে চিনি।
বিস্ময়ে মনে হলো ভিমড়ি খেল বুড়ো, তোমরা নারী-পুরুষ? বলেই হাঁপাতে লাগল। হাঁপানির টান একটু কমতে বলল, আমি তো ভেবেছিলাম আর কোনও মানুষ বেঁচে নেই। আমিই কেবল একা একজন মানুষ বসেছিলাম ধ্বংসের চূড়ান্ত মুহূর্তটি দেখব বলে। বিশেষ এই শাস্তি তো আমারই পাবার কথা।
আমি জিগেশ করলাম, কেন?
বুড়ো আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, তা ঠিক জানি না। তবে এই রকমই নির্দেশ, আমি জানি।
পায়ের তলার থেকে বালু সরে গেলে যে রকম অনুভূতি হয়, হঠাৎ সে রকম শিহরণ খেলে গেল আমার শরীরে। কেবল অন্ধকার, অনন্ত অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে যেতে যেতে নিজেকে ভয়ংকর একা দেখতে পেলাম। মানুষের পৃথিবীর চূড়ান্ত ভীতিকর মুহূর্ত আবিষ্কার করে ফেললাম। তাহলে আমরা এই তিনজন এই মুহূর্তে পৃথিবীর জীবিত মানুষ। আর মাত্র কিছু সময় পর মহাবিশ্বের অনন্ত অন্ধকারে মিলিয়ে যাব। ভেসে বেড়াবো মহাশূন্যের অসীম শূন্যতায়। ভাসতে ভাসতে আবার হয়তো নিউট্রন-প্রোটনের মধ্যে দিয়ে কোনও জীবকোষ হয়ে জন্ম নেব আরেক কোনও গ্রহে। কত কত গ্রহ এই মহাবিশ্বে?
আমি হিসেব মেলাতে পারি না।
আমার ভেতর অনন্ত অন্ধকার ছেয়ে যেতে থাকে। সূর্যের আলো সেখানে সময়ের কোনও ব্যবধানেই পৌঁছতে পারবে না। এই তবে মানুষের জীবন। এতই ক্ষুদ্র। কত ক্ষুদ্র, তা আমার কল্পনারও বাইরে। এই জীবন নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমার পাশে লাভলি। সে ধরে আছে আমার কাঁধ। টের পাই, কাঁপছে সে। জীবন ফুরিয়ে যাবার অনাস্বাদিত মুহূর্তটির ভয়ে ভীত লাভলি। আঁচলের নিচ দিয়ে আমি তার কোমর পেঁচিয়ে ধরি। তার কোমরের এই মসৃণতা অসীম অন্ধকারেও কী জ্বলতে থাকবে আমাদের এই পৃথিবী থেকে তাকিয়ে দেখা ছোট ছোট তারাদের মতো।
সৌন্দর্যের লাবণ্য কী সৃষ্টি-প্রলয় মানে? সৌন্দর্যও তো অনন্ত মহাবিশ্বের মতো। পৃথিবীর জনক ওই সূর্যের মতো। সূর্য থেকে কোনও গ্রহের আঘাতে যে রকম একসময় সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবী, আবার হারিয়ে যাবে সূর্যের গর্ভেই। আবার জন্ম হবে অন্য আরেক কোনও পৃথিবী। সৌন্দর্যও সে রকম হয়তো অসীম অন্ধকার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। মিলিয়ে যাবে আবার অন্ধকারে। বারবার জন্ম নেবে তারপর।
চৌকি থেকে নেমে এলো বুড়ো। হাসি ফুটল তার মুখে। হাড় জিরজিরে শরীর। বুকের খাঁচা রীতিমতো গোনা যায়। হাঁপাচ্ছে। একটু দম নিয়ে সে এগিয়ে এলো দুপা, আসো তোমরা। একই সাথে নারী ও পুরুষ, ভাবতেই পারিনি। তোমরা কোত্থেকে এলে?
লাভলি কথা বলে, আমরা পালাচ্ছিলাম।
যাচ্ছিলে কোথায়?
তা তো জানি না। তবে পালাচ্ছিলাম।
আর পালাতে হবে না। এইখানে তোমাদের স্থিতি হোক। দুজন মিলে তোমরা পৃথিবীকে ধ্বংস থেকে বাঁচাও। পৃথিবীতে আবার মানুষের প্রাণ দাও।
আমরা দাঁড়িয়ে থাকি।
বুড়ো এগোতে থাকে আমাদের দিকে। বলতে থাকে, সময় আর নেই... তাড়াতাড়ি করো... উঠে এসো এইখানে...
আমি তাকালাম লাভলির মুখের দিকে। লাভলি তাকালো আমার মুখের দিকে। ভাষা নয়, যেন কোনও অতলান্তিক মৌনতা আমাদের চোখে। জলজ পাথরের মতো সজীব লাভলির চোখের মনি। শিশিরধোয়া যেন তার নরম দুটো ঠোঁট, তিরতির কাঁপছে। আমার পাঁচ আঙুল সে তার পাঁচ আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরে। বলে, ভালোবাসা তীব্র হলাহল। এসো, আমার ভেতর তীব্র বিষ ঢেলে দাও। আমি প্রাণবতী হই।
ধীরে ধীরে সে আমাকে নিয়ে চৌকির ওপর বসে। তারপর ঢলে পড়ে আমার কোলের ওপর। আমি চেয়ে থাকি তার মুখের দিকে। ঠোঁট কাঁপছে তার। নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কী আলগোছে, যেন চূড়ান্ত আলস্য নিয়ে সে চোখের পাতা ফেলছে। তার চোখের পাতা বন্ধ হবার ওই মুহূর্তটি আমার মনে হলো, সৃষ্টি আর ধ্বংসের মধ্যেকার নীরবতা। নীরবতার গহ্বর থেকে আমি কথা বলে উঠি, তোমার পুরো নামের মানে কী জানো তুমি?
লাভলি মানে তো সুন্দরী। আর শারমিন মানে কি?
শারমিন মানে হচ্ছে কাঁটা। তাহলে কী দাঁড়ায় জানো? সুন্দরী কাঁটা।
লাভলি বলল, অথবা ভালোবাসার কাঁটা। জীবনকে তীব্রভাবে পেতে চাওয়ার কাঁটা।
আমি ঝুঁকে পড়ে জিব দিয়ে চেটে নিই তার নাকের ঘাম। নোনতা, আর কী এক অনাস্বাদিত শিহরণ যেন, বয়ে যায় আমার শরীরে, রক্তে। এই স্বাদের কোনও নাম মানুষ কখনও দিতে পারেনি। ফিসফিসিয়ে লাভলি বলল, আমার নিশ্বাস শুঁকে দেখো, তোমার গন্ধ পাবে।
আমি তার নাকের ছিদ্রের কাছে আমার নাক নিয়ে প্রাণভরে শ্বাস টেনে নিই। কোত্থেকে যে এলো এই হাওয়া, আমার মাথার ভেতর ঝড় তুলল। শোঁ শোঁ নয়, শিরশির শিরশির। সে আমার নিচের ঠোঁট পুরে নেয় তার ঠোঁটের ভেতর। আমি দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরি তার মুখ। খেয়াল হয় বুড়োর কথা। চেয়ে দেখি, বুড়ো একটা গাছের নিচে অন্ধকারের প্রেতাত্মার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো চেয়ে আছে এদিকে। বুড়ো তার শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। তাকে পরিত্রাণ দিতে পারি কেবল আমরা।
আমার মুখ সরিয়ে দিয়ে লাভলি তার শাড়ি খুলতে থাকে। কালো ব্রাউজের ভেতর মাংসের দুই ঢিবি। কালো অহংকারে ফুলে রয়েছে। অহংকার ভেঙে জোছনার নরম গন্ধ উঠে আসছে তার বুকের স্ফিত মাংসের ভেতর থেকে। আমি অনাঘ্রাত মানুষের মতো এই প্রথম যেন অমৃতের গন্ধ পেলাম। ঝিরঝির হাওয়া আমার মাথার মধ্যে। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। চুল এলোমেলো ছড়িয়ে পড়েছে বুকের কাছে, আর পিঠের ওপর। ধবল জোছনার মতো দুই বাহু এঁটে রয়েছে ব্লাউজের হাতা। অপরূপ এই মোহনীয় রঙ। নাভির কাছ থেকে শাড়ি খুলে ফেলে লাভলি। তারপর ছুড়ে দেয় গাছপালার ভেতর, অন্ধকারে। শুয়ে পড়ে সে। চিৎ হয়ে দুই হাত মেলে দেয় দুদিকে। শায়া উঠে গেছে তার হাঁটুর ওপরে। প্রদীপের আলোয় সমুদ্র তীরের বালুভূমির মতো ধবধবে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয় তার হাঁটুর নগ্নতা। চোখ সরিয়ে নিয়ে আমি তাকাই লাভলির মুখের দিকে। আমার মনে হলো, দুলছে তার মাথা। তিরতির কাঁপছে প্রদিপের আলো। আমি ঝুঁকে পড়ি তার বুকের ওপর। পিঠের দুদিকে দুহাত দিয়ে তার নারী শরীর তুলে নিই আমার বুকের সঙ্গে। পিঠের দিকে ব্লাউজের বোতাম খুলে ফেলি। তারপর ব্রার হুক। আমার গলার কাছে তার তপ্ত নিশ্বাস এসে লাগে। দুই বাহু গলিয়ে খুলে ফেলি ব্লাউজ আর ব্রা। শুয়ে পড়ে ফের লাভলি। নেচে ওঠে তার বুকের ভরাট দুই মাংসপিণ্ড।
আমার মনে হয়, দুটো নরম মাংসের চাঁদ। এত আলো! এ রকম আলোর মুখোমুখি বসে থেকে আমার বুকের ভেতর শুকিয়ে যেতে থাকে। যেন মরুভূমি। কোনও তৃণলতা নেই। এইবার আমি একটা হাত তার ডান দিকের ধবল মাংসের ওপর রাখি। চাপ দিই একটু একটু। আর তখন মরুভূমির ভেতর আমার অনুভূতি সবুজ হয়ে ওঠে। আমি ঝুঁকে পড়ি তার বুকের ওপর। স্তনচুড়োয় ঠোঁট ছোঁয়ায়। কেঁপে ওঠে লাভলি। জিভ ঘোরাতে থাকি চুড়োয়। তার দুই বগলের নিচে আমার দুই হাত। বগলের চুলগুলো আদর করতে থাকি। কিছু সময় পর একটা হাত চলে যায় শায়ার নিচে, পাছায়। তার পাছার নরম মাংসে ডুবে যায় আমার আঙুল। হাতের তালুতে রেখে তার পাছা একবার ওপরে তুলি, আবার নামায়।
ফিসফিসিয়ে ওঠে লাভলি, এই শোনও।
স্তনচুড়ো থেকে মুখ তুলে আমি তাকাই তার মুখের দিকে। তারপর চোখ চলে যায় তার বুকের ওপর। নারকেলের উপুড় করে রাখা খোলার মতো নরম মাংসের স্তন। এই নগ্নতার কী যে এক রঙ, আমার অনুভূতি নির্জন রঙের এক সরোবরে স্নান করতে লাগল। আমি আশ্চর্য রকমের রঙের জগৎ থেকে দুহাত বাড়াই উপুড় করে রাখা দুটো মাংসের দিকে। আর তখন লাভলি আগের চেয়েও আরও ফিসফিসিয়ে বলল, আমার চোখের দিকে তাকাও।
আমি তাকাই তার মুখের দিকে। তার ঠোঁট দেখি। তার নাক দেখি। চোখ দেখি, ভুরুর অপরূপ বিন্যাস দেখি। মুগ্ধতা নয়, আনন্দবোধ নয়, নয় নানা ছন্দ আয়োজনে জীবনের উল্লাস; এ এক আলাদা অনুভূতি। শৃঙ্খলিত জীবন যার কারণে ভেঙে যায়। তারপর গড়ে উঠে অনন্ত সৌন্দর্য সত্তার জীবন।
আগের মতোই স্বরে, কেবল চোখদুটো একটু নাচিয়ে লাভলি বলল, দেখতে পাচ্ছ?
কী?
কিছুই দেখতে পাচ্ছ না?
ফিসফিসিয়ে আমি বললাম, সবুজ বনভূমি।
খিলখিল হেসে ওঠে লাভলি, আগুনের শিখা দেখতে পাচ্ছ না? সবুজ বনভূমির মধ্যে আগুন। মহাপ্রলয়ের আগুন।
বোকার মতো আমি বলি, না।
ভালো করে চেয়ে দ্যাখো। সৃষ্টি আর ধ্বংসের আগুন কী রকম দাউদাউ জ্বলছে। দ্যাখো... চোখের সবুজে চোখ রাখো...
চোখ রাখলাম আমি তার চোখের নির্জন সবুজে। এবার দেখলাম, তার চোখের নরম সবুজ পুড়িয়ে দিচ্ছে আগুনের লেলিহান শিখা। চোখ সরিয়ে নিতে আমি পারি না। আগুন এত পবিত্র, আগে তো কখনও বুঝতে পারিনি। ঝিমঝিম অনুভূতি আমার মাথার ভেতর। ঠিক সেই মুহূর্তে শুনতে পেলাম মহাশূন্য থেকে ভেসে আসছে উদাত্ত স্বর :
আছাতু মা সাদগামাইয়া
তামাছু মা জ্যোতির্গামাইয়া
রুদ্দিউর মা আরমুতাগামাইয়া
ওঁ শান্তি হি শান্তি হি শান্তি হি...
উঠে বসলাম আমি। তাকালাম বুড়ো যে গাছটার নিচে রয়েছে, সেই অন্ধকারে। শুনতে পেলাম লাভলি বলছে, কী হলো, আগুনে বিলীন হয়ে যেতে চাও না?
তার কথার কোনও জবাব আমি দিলাম না। বুড়োর হাঁপানির টান শুনতে পেলাম। আর শুনতে পাচ্ছি অনন্ত অন্ধকার থেকে ভেসে আসা শান্তি আহ্বান। ওঁ শান্তি হি... শান্তি হি... শান্তি হি...
আহত যেন লাভলির স্বর, পবিত্র আগুনে আত্মাহুতি দিতে ভয় পেয়ে গেলে?
তার দিকে তাকাতে আর আমি পারি না। অন্ধকারে বুড়োর আবছা অবয়ব দেখতে দেখতে আমি জবাব দিই, আত্মাহুতি নয়, এ ভয় অন্যরকম।
কী রকম তা বলবে তো।
তোমার সৌন্দর্যের প্রতি আমার যে টান, মানে যাকে ভালোবাসা বলে, যদি তা নিঃশেষ হয়ে যায়। একটু থেমে ফের বলি, অথবা মনে করো, সৌন্দর্যের চূড়ান্ত আশ্রয় যে শরীর এই অনুভূতিকে আমি অস্বীকার করি।
লাভলি কোনও জবাব দেয় না। আবছা অন্ধকার ছেড়ে এগিয়ে এলো বুড়ো। দেখলাম, শ্বাসকষ্টের চেয়েও তীব্র রকমের এক কষ্ট বুকের ভেতর চেপে রাখতে রাখতে বুড়ো চেয়ে আছে আমার দিকে, সেই সঙ্গে বিস্ময়। জিগেশ করল, সময় নেই আর... মিলিত হও... মিলিত হও...
ভয়ে ভয়ে আমি মুখ ফেরালাম লাভলির দিকে। বিমূঢ়, আর তরঙ্গায়িত পাহাড়ি ঝরনার মতো চিত্রকল্প মুখের ওপর ফুটিয়ে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে লাভলি। তরঙ্গ ভেঙে একসময় লাভলি হেসে ওঠে। তারপর আবৃত্তি করতে থাকে :
নিঃশেষ হইনি কোথাও
উপাসনায় দণ্ডিত হয়ে গিয়ে কিনে ফেলি
ভূত-ভবিষ্য চাবুকের ভাষা।