আবু তাহের সরফরাজের গদ্য ‘কথাচ্ছলে কথা’

প্রকাশিত : মার্চ ০৭, ২০২২

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজের শিশুশিক্ষার বই ‘ছোটদের পদার্থবিজ্ঞান’। বইটি মূলত ছোটদের উপযোগী পদার্থবিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ। স্কুল-পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য। বইটি প্রকাশ করেছে বিদ্যাপ্রকাশ। দাম রাখা হয়েছে ৩৩৫ টাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। বইমেলার প্রথম দিন থেকেই বইটি পাওয়া যাচ্ছে বিদ্যাপ্রকাশের ৫৭-৫৮-৫৯-৬০ নম্বর স্টলে। বইটি থেকে ভূমিকা অংশটি তুলে দেয়া হলো:


পৃথিবীতে যা-কিছুই দেখি না কেন, সবই পদার্থ। আবার এমন অনেক কিছুই আছে, যা দেখা না গেলেও অনুভব করা যায়। এসব কিছুও পদার্থ। মৌলিক পদার্থ ১১৮টি। এগুলো দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে এই বিশ্বজগৎ। এক বা তারচেয়ে বেশি মৌলিক পদার্থ একসঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি করে যৌগিক পদার্থ। আবার, মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ একসঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি করে মিশ্র পদার্থ। পদার্থের সর্বশেষ অবস্থা পরমাণু। পরমাণুর জগৎ খুবই বিস্ময়কর। সেখানে ঘটে যাচ্ছে কত কত রদবদল, মানুষ তা টেরও পাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা কিন্তু এই রদবদল টের পান। তারা গবেষণাগারে বিভিন্ন পদার্থের পরমাণু নিয়ে গবেষণা করেন। শুধু পদার্থই নয়, প্রাকৃতিক নিয়মকে জানতে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। প্রকৃতির গহিন রাজ্যে কীযে সব অবাককরা ব্যাপার-স্যাপার ঘটে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ সেসবের খোঁজই রাখে না। বিজ্ঞান লেখকের কাজ হচ্ছে, প্রকৃতির বিস্ময়কর জগৎকে সাধারণ মানুষের চোখের সামনে তুলে আনা।

আমি বিজ্ঞান লেখক নই, সাহিত্যিক। বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক কখনো ছিল না। সাহিত্যচর্চা করেই এতদিন আনন্দ পেয়েছি। জীবন অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, সাহিত্য আসলে মানুষের রুচি তৈরি করে। এর বাইরে সাহিত্যের তেমন আর কাজ নেই। জগতে যে যত রুচিমান, সে তত উন্নত চরিত্রের মানুষ। মানুষ যখন রুচিমান হয়ে ওঠে, এরপর তার দরকার হয় জ্ঞান। জীবন ও জগৎ বিষয়ক জ্ঞান। বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব হচ্ছে জ্ঞানের উৎস। জীবন ও জগৎ জিজ্ঞাসার তৃষ্ণা নিয়ে আমি বিজ্ঞানপাঠ আরম্ভ করি। পাশাপাশি দর্শন ও ধর্মতত্ত¡। এই পাঠ আর শেষ হওয়ার নয়। যত পড়ছি, জ্ঞানের দরজাগুলো ততবেশি খুলে যাচ্ছে।

‘ছোটদের পদার্থবিজ্ঞান’ লেখার অনুপ্রেরণা পাই কন্যা ছায়াবীথি শ্যামলিমাকে চতুর্থ শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি পড়াতে গিয়ে। দেখি যে, লেখাগুলো সাবলীল নয়। ছায়াবীথি সহজভাবে ও আনন্দের সঙ্গে পাঠ বুঝতে পারছে না। ঝামেলায় পড়ে যাই। তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞান বইগুলো কয়েকদিন পড়লাম। প্রতিটি শ্রেণিতে পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ একটু একটু করে দেয়া। আমার ভাবনায় এলো, পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ প্রতিটি শ্রেণির বইতে না দিয়ে একটাই বই যদি হতো! বইটার নাম হতে পারত, ছোটদের পদার্থবিজ্ঞান। আবার, প্রতিটি শ্রেণিতে জীববিষয়ক পাঠ না দিয়ে ছোটদের জীববিজ্ঞান নামে বই যদি করা যেত! এইভাবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান বইতে বিজ্ঞানের যত শাখা পড়ানো হয়, সেই শাখাগুলোর আলাদা আলাদা বই যদি করা হয়, কেমন হতো? তাহলে, বিজ্ঞান বইটাই আর থাকতো না। বদলে এক একটি বিজ্ঞান বিষয়ের এক একটি বই।

জানি যে, রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থায় এরকমটা কখনো হবে না। না হলেও ক্ষতি নেই। পদার্থবিজ্ঞানের তথ্যগুলো একসঙ্গে করে সহজ ও সাবলীল ভাষায় ছোটদের উপযোগী পদার্থজ্ঞিানের একটা বই তো লেখাই যায়। এতে খুদে শিক্ষার্থীদের সুবিধেই হবে। খারাপ লাগে যখন দেখি, অভিভাবকরা শিশুকে ইংরেজি শেখাতে যেভাবে কসরত করেন, বিজ্ঞান শেখাতে অতটা করেন না। ইংরেজি শেখাটা যেন নিয়ম, বাধ্যতামূলক। এই ইংরেজি ভাষাটা দশ বছর ধরে শিখতে শিখতে শিক্ষার্থীও নিশ্চিত হয় যে, তাহলে ইংরেজিটা আসলেই জরুরি। অথচ ইংরেজির চেয়ে বিজ্ঞান শেখাটা বেশি জরুরি। সেই বিজ্ঞান শেখায় অতটা মনোযোগ অনেক শিক্ষার্থীর থাকে না। ছোটবেলায় আমি বিজ্ঞান বইটাকে ভয় পেতাম। আর গণিত। বিজ্ঞানে কীসব খটোমটো কথা! সেসব সহজভাবে বুঝিয়ে দেয়ার মতো শিক্ষকও তখন তেমন পাওয়া যেত না। এখনও যে যায়, তাও নয়।

বইতে ১১৮টি মৌলিক পদার্থের বৈশিষ্ট্য, জৈবিক ভূমিকা, উৎস, ব্যবহার ও আইসোটোপ বর্ণনা করা হয়েছে। আমার ধারণা, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ছোটদের পদার্থবিজ্ঞান খুদে শিক্ষার্থীর জানার পরিধি আরও বাড়াবে। এই জানাটা হবে আনন্দের ভেতর দিয়ে। খুদেগুলো পড়তে পড়তে দেখবে, সহজ ভাষায় সহজে পদার্থের খুঁটিনাটি রহস্য তাদের সামনে খুলে যাচ্ছে। খটোমটো শব্দ নেই, বক্তব্যেও নেই জড়তা।

বইটি পড়তে পড়তে কয়েকটি শব্দ খুদে শিক্ষার্থীরা পাবে, যেগুলোর মানে তাদের জানার কথা নয়। শব্দগুলো হচ্ছে: কিলোগ্রাম বা গ্রাম, সেন্টিমিটার বা মিটার, মিলিলিটার বা লিটার, তাপমাত্রা, অক্সাইড, দ্রবণ, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বিদ্যুৎ চার্জ বা আধান, রসায়ন, রাসায়নিক বা ভৌতধর্ম, রাসায়নিক বিক্রিয়া, ফসিল, নিঃসরণ, জারক ও বিজারক এবং খনি। এইসব শব্দ দিয়ে কী বোঝানো হয়, শব্দের পরপরই তা লিখতে গেলে বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয়। এজন্য শব্দগুলোর মানে শব্দার্থ অধ্যায়ে দেয়া হয়েছে। পড়তে পড়তে কোনো শব্দ না বুঝলে শব্দার্থ অধ্যায়ে গিয়ে শব্দটির মানে খুদে শিক্ষার্থীরা জেনে নিতে পারবে। তবে মৌলিক পদার্থের পরিচিতি পড়তে পড়তে কিছু শব্দ খুদে পাঠক হয়তো বুঝতে পারবে না। বুঝতে না পারলেও ওই শব্দ দিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে, সে ধারণা তারা করতে পারবে। জ্ঞানের জগতে ‘ধারণা’ও গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। ছোটরা চারপাশের সবকিছুই যে ঠিকঠাক বুঝতে পারে, তা তো নয়। তারা ধারণা করে নেয়। বড়দের বেলাতেও এই ‘ধারণা’র মূল্য কম নয়।

কথাচ্ছলে আরও একটি কথা বলে নিই। এই বইটির পাঠশেষে খুদে শিক্ষার্থী পদার্থের জগৎ বিষয়ে মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা পাবে। তবে এ ধারণা পদার্থবিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা। এরপর আরও কী কী সব রহস্য ছড়িয়ে আছে পদার্থে, তা জানতে কোনো কোনো খুদে পাঠকের কৌতূহল থেকেই যাবে। কৌতূহল মেটাতে তাদের জন্য পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বইয়ের নাম পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকটি বই অধ্যায়ে দেয়া হয়েছে। বইগুলো খুদে শিক্ষার্থীদের জানার তৃষ্ণাকে ভালোভাবেই মেটাতে পারবে। দেশজুড়ে বই বিপণনের অনলাইন প্রতিষ্ঠান রকমারি.কমে অর্ডার করলে বইগুলো বাড়িতে বসেই পাওয়া যাবে।

লিখতে সঙ্কোচ নেই, প্রকাশক না পাওয়ায় কয়েকটি পাণ্ডুলিপির সাথে এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি বছরখানেক পড়ে ছিল। লেখকবন্ধু স্বকৃত নোমানকে একদিন কথাচ্ছলে পাণ্ডুলিপিটা দেখালাম। পড়ে সে খুবই উচ্ছ্বসিত হলো। এরপর প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিল। তার কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।

একুশে বইমেলা ২০১৮