আবু তাহের সরফরাজের কিস্‌সা ‘দস্যু দরবেশ’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১১, ২০২৩

ধু ধু মরুপ্রান্তর। চচ্চড়ে রোদ ঝলছে দিচ্ছে তেতে ওঠা বালুর বুক। বিরান শূন্যতা ভর করে আছে প্রান্তরে। এই পথে চলেছে এক বণিক কাফেলা। হঠাৎ একদল মরুতস্কর হামলে পড়ল তাদের ওপর। এক বণিক উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে পালাতে লাগল। তার পেছনে ছুটল দুই তস্কর। দৌড়তে দৌড়তে বণিক দেখতে পেল, একটি তাঁবু। আরকিছু ভাবার অবসর সে পেল না, দৌড়ে ঢুকে পড়ল তাঁবুর ভেতর। ঢুকেই থ হয়ে গেল বণিক। জায়নামাজে বসে এক দরবেশ তসবিহ পাঠ করছেন। পরনে চটের পোশাক, মাথায় টুপি। ভরসা পেল বণিক। দরবেশের পায়ের কাছে বসে সে বলল, ডাকাত আমার পিছু নিয়েছে। আপনি আমাকে ঠাঁই দিন। নয়তো আমি সারা জীবনের জন্য ফতুর হয়ে যাব। আমার সব সঞ্চয় এখন আমার কাছে। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল বণিক।

দরবেশ তসবিহ পাঠ থামিয়ে বললেন, ভয় নেই। তুমি নিশ্চিন্তে এখানে বসে থাকো। এরই মধ্যে বাইরে হইচই শোনা গেল। ধড়াস ধড়াস বুক কাঁপতে লাগল বণিকের। এখন কী হবে! ডাকাতদল তো এদিকেও চলে এসেছে! লুটের মাল নিয়ে কয়েক ডাকাত ঢুকল তাঁবুর ভেতর। কেঁপে উঠল বণিক। ফ্যাসফেসে স্বরে বলল, জনাব, ওরা এসে পড়েছে। বণিককে দেখেই এক ডাকাত বলে উঠল, আরে, এই তো আরেকজন। ব্যাটা পালিয়েছিল। দরবেশ বললেন, তোমরা এই বণিককে স্বসম্মানে যেতে দাও। সে আমার ওপর নির্ভর করেছিল। যেরকম আমি সবসময় আল্লাহর ওপর নির্ভর করে থাকি।

ডাকাতদল দরবেশকে কুর্ণিশ করে জানালো, জি ওস্তাদ। আপনার যা নির্দেশ। এই বলে মালামার রেখে তারা বেরিয়ে গেল। বিস্ময়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বণিক। এই দরবেশ লোকটাই তবে ডাকাতদলের সর্দার? ভারি আশ্চর্য তো! বণিক বিনীতভাবে এবার জিগেশ করল, জনাব, আপনাকে আপনাকে দেখে আমি বিস্মিত। একদিনে আল্লাহর ধ্যান, আরদিকে লুণ্ঠন! আমাকে বলুন তো, দরবেশ ছদ্মবেশে আপনি কি ডাকাত? নাকি ডাকাত ছদ্মবেশে দরবেশ? দরবেশ জবাব দিলেন, কোরআনে লেখা আছে, দ্বিতীয় দল নিজেদের পাপ স্বীকার করল, আর পুণ্য তার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল। বণিক বলল, কোরআনে এও লেখা আছে, এখনও কী বিশ্বাসীদের সময় হয়নি, হৃদয়ে আল্লাহকে ধারণ করার? বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দরবেশ উঠে দাঁড়ালেন। কাঁপতে লাগল তার দেহ। ঘেমে উঠলেন তিনি। বণিকের দু’হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, হ্যাঁ, সময় হলো, এইমাত্র। আপনাকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন আমাকে এ ইঙ্গিত দেয়ার জন্যে। এখন চলুন, আমাকে খলিফার কাছে নিয়ে চলুন। আমার ওপর তিনি ভীষণ ক্ষেপে আছেন। পেলেই আমাকে কঠিন শাস্তি দেবেন। আমি তার শাস্তি মাথা পেতে নেব।

বণিক জিগেশ করল, আপনার নাম কি?
দরবেশ জবাব দিলেন, ফাজায়েল ইবনে আয়াজ।
হ্যাঁ, বণিকও এই নাম শুনেছেন। বণিক কাফিলার কাছে এই নাম সাক্ষাৎ বিভীষিকা। আরসব মানুষের মতো সেও এতদিন এই নাম বিভীষিকা হিশেবেই জেনে এসেছে। কিন্তু মানুষটার মুখোমুখি হয়ে তার সে ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। তাঁবুর বাইরে কেউ একজন জোহরের আজান দিতে শুরু করেছে। বণিক জিগেশ করল, আজান দিচ্ছে কে? দরবেশ জবাব দিলেন, মোয়াজ্জিন।
আপনার এখানে মোয়াজ্জিনও ঠিক করা আছে? জবাবে দরবেশ বললেন, যে ডাকাত সে-ই মোয়াজ্জিন। যে মোয়াজ্জিন সে-ই ডাকাত। চলুন, নামাজটা পড়ে নেয়া যাক। বাইরে বেরিয়ে বণিক দেখল, ডাকাতদল নামাজের জন্যে তৈরি হচ্ছে। এ তাঁবুর পেছন দিকে আরও দুটো তাঁবু। এরই মাঝামাঝি প্রশস্ত জায়গায় দুই সারিতে সবাই দাঁড়ালো। বণিকও দাঁড়িয়ে পড়ল পেছনের সারিতে। দরবেশ হলেন ঈমাম। নামাজ শেষ হলো। কিছু সময় চুপচাপ বসে রইলেন দরবেশ। এরপর সঙ্গীদের উদ্দেশে বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আর ডাকাতি করব না। ডাকাতদল আঁতকে উঠল। প্রায় একইসঙ্গে সবাই জিগেশ করল, সে কী, আমরা তবে কি করব? কোথায় যাব? দরবেশ নির্বিকার মুখে বললেন, জগতে কেউ কারও জন্যে অপরিহার্য নয়। এইদিন আমি এই ভারসাম্য রাখতেই তোমাদের শিখিয়েছি। সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছি। এটাই শৃঙ্খলা। জীবনের যেদিকেই যাও, ভারসাম্য তোমাকে রাখতেই হবে। এখন তোমরা যে যার মতো চলে যাও। খোদা হাফেজ। উঠে দাঁড়ালেন দরবেশ। বণিককে বললেন, চলুন, এবার আমরাও রওনা দেই।

পায়ে হেঁটে দুজন পাশাপাশি চললেন। যেতে যেতে এক পল্লীর কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন দরবেশ। বললেন, জনাব, আপনি এখানে একটু দাঁড়ান। আমি ওই পল্লীতে একটু যাব। একজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি। আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে লজ্জিত। বিনয়ের স্বরে বণিক বলল, ছি ছি, তা কেন? কিন্তু আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। খলিফার কাছে আপনি একাই তো যেতে পারেন। আমাকে টানছেন কেন? দরবেশ জবাব দিলেন, জি, তা পারি। কিন্তু সাহসে ঠিক কুলোচ্ছে না। কৃতকর্ম নিয়ে শাসনকর্তার সামনে দাঁড়াতে সব অপরাধীর মেরুদণ্ডই ভেঙে যায়। আপনি সঙ্গে থাকলে আমি একটু ভরসা পাব, এই আরকি!

দরবেশ এগিয়ে গেলেন। পল্লীতে গিয়ে এক ঘরের সামনে তিনি দাঁড়ালেন। কী যেন ভাবলেন। এরপর দরজায় খটখট শব্দ করলেন। ভেতর থেকে এক নারীকণ্ঠ জিগেশ করল, কে? দরবেশ জবাব দিলেন, আমি ফাজায়েল। দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন ফাজায়েল। দাঁড়ালেন নারীর মুখোমুখি। বললেন, জোলেখা, আমি চলে যাচ্ছি। আর আমাদের দ্যাখা হবে না। আঁতকে উঠল জোলেখা। সে কী! কোথায় যাবেন আপনি?
আমি খলিফার কাছে আত্মসমর্পণ করব। তিনি যা শাস্তি দেবেন, মাথা পেতে নেব। ডাকাতি আমি ছেড়ে দিয়েছি। দলের সবাইকে চলে যেতে বলেছি। ওরা চলে গেছে।
জোলেখা পলকহীন চোখে চেয়ে রইল ফাজায়েলের মুখের দিকে। বিস্ময়ে থরো থরো তার দৃষ্টি। বুকের ভেতর ছুটোছুটি করছে হাহাকার। ছলোছলো চোখে সে জিগেশ করল, সত্যিই আপনি চলে যাবেন?
ফাজায়েল বললেন, হ্যাঁ। এতদিন আমার তৃষ্ণা ছিল। সুন্দরের তৃষ্ণা। আমি তৃষ্ণার্ত থাকতাম তোমার জন্যে। আর তাই, ডাকাতি থেকে পাওয়া আমার ভাগের একটা অংশ আমি এতদিন তোমাকে দিয়ে এসেছি। দিয়েছি কারণ, তোমাকে সুখি দেখতে চেয়েছি। তুমি সুখি ছিলে, আমি জানি। কিন্তু আমি সুখি হতে পারিনি।
জোলেখা জিগেশ করল, কেন পারেননি?
ফাজায়েল বললেন, তার আগে বলো, ডাকাতির ভাগ যেমন নিয়েছো, আমার পাপের ভাগও কি তুমি সেরকম নেবে?
কথা নেই জোলেখার মুখে।
জবাব দাও।
জবাব তবু দিতে পারে না জোলেখা। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখ নামিয়ে চেয়ে থাকে নিচের দিকে।
ফাজায়েল বললেন, যতবার তোমার কাছে এসেছি, ততবার তৃষ্ণায় কাতর হয়েই এসেছি। তোমার মুখোমুখি বসে টের পেয়েছি, কত স্থূল তোমার দেহ। কখনোই তাই যেতে পারিনি তোমার দেহের ভেতর।
জোলেখার ফ্যাসফেসে স্বর, স্থূল কেন মনে হতো?
ফাজায়েল জবাব দিলেন, শরীরে নগ্নতা থাকে। আর কাম থাকে হৃদয়ে। আমার দেহে নগ্নতা আছে, তবে হৃদয়ে কাম নেই। আছে তৃষ্ণা। সৌন্দর্যের জন্যে প্রবল তৃষ্ণা।
থরো থরো ঠোঁট কেঁপে ওঠে জোলেখার, কী রকম?
এমনই এক তৃষ্ণা, যৌনকর্ম যা নিবারণ করতে পারে না। যে সৌন্দর্যে হঠাৎ হঠাৎ আমার আত্মা আলোকিত হয়ে ওঠে। যৌনকর্ম তো আর দশটা কর্মের মতোই একটি ঘটনা।
জোলেখার স্বরে এবার দৃঢ়তা ফুটল, যৌনকর্ম মোটেও আরদশটা কর্মের মতো নয়। প্রাণী হিসেবে মানুষ সর্বোচ্চ আনন্দ পায় যৌনকর্মেই।
ফাজায়েল কাঁধ নাচালেন, হ্যাঁ, তা পায়। তবে মানুষ সর্বোচ্চ তৃপ্তি পায় যখন সে পরম আত্মার সঙ্গে লীন হয়ে যায়। আজ জেনেছি, আমি আসলে এই আনন্দের জন্যেই তৃষ্ণার্ত ছিলাম। আমি চলি। পথে আমার এক সাথি দাঁড়িয়ে আছে।
সে কে?
আমার পথ প্রদর্শক। বলেই, দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ফাজায়েল।

খলিফা হারুণ-অর-রশিদের দরবারে উপস্থিত হলেন ফাজায়েল ইবনে আয়াজ ও বণিক। খলিফার সামনে ফাজায়েল দণ্ডবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন। মাথা তার হেট। চোখ তুলে তিনি খলিফার দিকে তাকাতে পারছেন না। যা বলার, বণিক বললেন। খলিফা বললেন, লোকমুখে এতদিন তোমার ডাকাতির নানা গল্প শুনেছি। আর আজ শুনলাম তোমার বিশ্বাসী সত্তার গল্প। তুমি আত্মসমর্পণ করেছো, তাই তুমি মুক্ত।
মুখ তুলে খলিফার দিকে চেয়ে ফাজায়েল বললেন, আমিও এতদিন আপনার মহানুভবতার গল্প শুনে এসেছি। আর আজ চোখের সামনে দেখলাম। এবার তবে যেতে অনুমতি দিন।

খলিফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন ফাজায়েল ও বণিক। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বণিক জিগেশ করল, এখন কোথায় যাবেন আপনি? ফাজায়েল জবাব দিলেন, জানি না। আমি ভেবেছিলাম, খলিফা আমাকে গুরুতর শাস্তি দেবেন। তবে এখন আমি চিন্তিত, বিশ্বজগতের প্রতিপালক যদি আমাকে ক্ষমা না করেন! বণিক বলল, কিন্তু আমাকে তো এবার ফিরতে হবে জনাব। ব্যাকুল হয়ে পড়লেন ফাজায়েল। বণিকের দু’হাত ধরে তিনি বললেন, বন্ধু, আমার হৃদয়ে চিরদিন আপনি ভাস্বর হয়ে থাকবেন। আপনি ফিরে যান আপনার বাড়িঘরে, আমিও চললাম। বিদায়... দুজন দু’পথে চললেন।

রাতের থমথমে অন্ধকার ঢেকে আছে চারদিক। থেকে থেকে দমকা হাওয়া উড়ে যাচ্ছে। নিঃসীম নীরবতা এখন, এই মাঝরাতে। আকাশে আবছায়া মেঘেঢাকা চাঁদ, গ্রহ আর নক্ষত্র। এসব প্রতিটি, দূরতম এক একটি জগতের ইঙ্গিত। স্তব্ধতার সিঁড়ি বেয়ে যা নেমে আসে মানুষের পৃথিবীতে। ফাজায়েল এসে দাঁড়ালেন তার বাড়ির দরজায়। এই তার সংসার। জগতে নির্ভরযোগ্য একটি আশ্রয়। নির্ভরযোগ্য কি? তীরের ফলার মতো এই ভাবনা ছুটে গেল তার মাথার ভেতর। এরপর নিজের অস্তিত্ব তিনি দেহশূন্য অবস্থায় অনুভব করলেন। আর তখন তার ভেতর থেকে যন্ত্রণার স্বর বেরিয়ে এলো, আহ, জীবন এত ক্ষণস্থায়ী! দরজায় করাঘাত করলেন তিনি। বেশ কয়েকবার। ভেতর থেকে ঘুমজড়ানো স্বরে ভেসে এলো নারীকণ্ঠ, কে? আমি ফাজায়েল।

দরজা খুলে গেল। সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী সুরাইয়া। স্বামীর দিকে চেয়ে মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার মুখ। তার স্বরে আতঙ্ক, কী হয়েছে আপনার? ডাকাতি করতে গিয়ে কোথাও কি আঘাত খেয়েছেন? ফাজায়েল শান্ত স্থির স্বরে জবাব দিলেন, হ্যাঁ, আঘাত তো খেয়েছি। তবে তা দেহে নয়, হৃদয়ে। ঘরে ঢুকলেন ফাজায়েল। চারদিকে চেয়ে দেখলেন তার সংসার। পরিপাটি, বেশ গোছানো তার স্ত্রী। ঘরের প্রতিটি জিনিস কী নিপাটভাবে গুছিয়ে রেখেছে। তিনি বিছানায় গিয়ে বসলেন। দেয়াল ঘেঁষে ঘুমোচ্ছে সাত বছরের ছেলেটি। কী নিষ্পাপ মুখ। ঝুঁকে ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন ফাজায়েল। তার পাশে বসতে বসতে সুরাইয়া জিগেশ করলেন, কী হয়েছে আপনার? এ কথার জবাব না দিয়ে ফাজায়েল জিগেশ করলেন, মেয়েরা কোথায়? সুরাইয়া জবাব দিলেন, পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু আপনার কী হয়েছে, দয়া করে আমাকে বলুন। ফাজায়েল স্ত্রীর হাত ধরে বললেন, আমি ডাকাতি ছেড়ে দিয়েছি সুরাইয়া। এবার আমি মক্কায় চলে যাব। সেখানেই থাকব। এখন তোমার মতামত বলো। চমকে উঠলেন সুরাইয়া। স্বামীর মুখের দিকে হতবিহ্বল চোখে চেয়ে জিগেশ করলেন, এসব কী বলছেন আপনি? কী হয়েছে আপনার?

ফাজায়েল খুলে বললেন ঘটনা। চুপচাপ শুনলেন সুরাইয়া। এরপর বললেন, কিন্তু তিন সন্তানকে নিয়ে আমার কী হবে, ভেবেছেন একবারও? আমরা চারটে প্রাণী আপনাকে ছাড়া বাঁচব কীভাবে?

এ বড়ই হাস্যকর কথা সুরাইয়া। আমি কি তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছি?
সে যাই হোক, আমরাও যাব আপনার সঙ্গে। এভাবে আপনাকে একা কিছুতেই আমি ছাড়ব না।

স্ত্রীর হাত ছেড়ে থ হয়ে কিছু সময় বসে রইলেন ফাজায়েল। একসময়ে বললেন, বেশ, তবে চলো। কিন্তু ভেবে দ্যাখো সুরাইয়া, সংসার নির্বাহে তোমার খুবই কষ্ট হবে। আর তাছাড়া, এতদিন ধরে নিজের হাতে যে সংসার তুমি গুছিয়ে রেখেছো, পারবে ছেড়েছুড়ে চলে যেতে?
ড্যাবড্যাব চোখে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে সুরাইয়া জবাব দিলেন, মৃত্যু এলে কি চলে যেতে হতো না? সে যাক, সংসার কীভাবে চলবে, এনিয়ে আপনি ভাববেন না। যার ওপর আপনার এই দৃঢ় আস্থা, তিনিই চালিয়ে নেবেন। আবার দেখুন, ঘড়বাড়ি বেচে তো কিছু টাকা আমরা পেতেই পারি।
ফাজায়েল বললেন, তবে সে ব্যাবস্থাই করো। দু’একদিনের মধ্যেই আমরা মক্কার উদ্দেশে রওনা দেব, নাকি বলো?
সুরাইয়া জবাব দিলেন, হ্যাঁ। কালই বাড়িঘর বেচার ব্যাবস্থা আমি করছি। আপনি এবার হাতমুখ ধুয়ে আসুন। আমি খাবার বাড়ছি। উঠে গেলেন সুরাইয়া।

দুই.
মক্কায় একটি ভাড়াবাড়িতে এসে তারা উঠলেন। আসবাবপত্রের কোনও বালাই নেই। নেহায়েত দরকারি দু’চারটে জিনিস ছাড়া। স্বামীর এই সাধনার পথে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো লেগে রইলেন সুরাইয়া। দৃশ্যমান জগৎ যে ক্ষণস্থায়ী, এই বোধ তার ভেতরও জেগে উঠল। স্বামীর সঙ্গে বসে কোরআন পড়েন। নামাজে একাত্ম হতে চেষ্টা করেন। খুব হিসেব করে তিনি সংসার চালাতে লাগলেন। সন্তানদের নিয়ে খুব বেশি ভাবনা তার নেই। দু’মেয়েই বড় হয়ে গেছে। ছেলেটিও হয়েছে শান্ত স্বভাবের। সারাদিন নিজের মতো চুপচাপ কাটিয়ে দ্যায়।

বাড়িতে সারাদিনে দু’বেলা রান্না হয়। ফাজায়েল অবশ্যি রোজা রাখেন। মাগরিবের নামাজ পড়ে ইফতার খান। এই একবেলাই তিনি আহার করেন। বাকি সময় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকেন। আকণ্ঠ ডুবে থাকেন নির্জনতার ভেতর। যত ডুবছেন, তত অনুভব করতে পারছেন জীবনের সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্যই তিনি এতকাল খুঁজে এসেছেন। কোরআন পড়ছেন। হাদিস পড়ছেন। প্রজ্ঞা দিয়ে মানে বোঝার চেষ্টা করছেন। মাঝে আর মধ্যে জীবন ও জগতের রহস্য নিয়ে কিছু প্রশ্ন তার ভেতর তৈরি হয়। তখন তিনি যান কোনও দরবেশের কাছে। এভাবে অনেক দরবেশের সংস্পর্শে তিনি আসেন। প্রজ্ঞার সিঁড়ি একটার পর আরেকটা পেরিয়ে আসতে থাকেন।

রাতের নিঃসীম নীরবতায় তিনি একাত্ম হয়ে যান কোরআন পাঠে। সুরাইয়ার চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়ে আসে। বেশি রাত তিনি জেগে থাকতে পারেন না। ঘুমোতে চলে যান। এরকম এক রাতে খটখট শব্দ হলো দরজায়। ফাজায়েল জিগেশ করলেন, কে? জবাব এলো, খলিফা হারুন-অর-রশিদ। ফাজায়েল উঠে দরজার খিড়কি খুলে বললেন, আমি অনুমতি দিচ্ছি না। তবে খলিফা যদি একান্তই ভেতরে আসতে ইচ্ছে করেন, তবে দরজা ধাক্কা দিন। খুলে যাবে। দরজা খুলে গেল। দ্রুত পিছু ফিরে ফাজায়েল ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলেন প্রদীপ। এরপর বসলেন জায়নামাজে। জিগেশ করলেন, খলিফার সঙ্গে কে? খলিফা জবাব দিলেন, আমার উজির ফজল বারমাকি। ফাজায়েল বললেন, আপনারা বসুন। দুঃখিত আলো নিভিয়ে দেয়ার জন্যে। এটা এজন্য যে, খলিফার মুখ যেন আমাকে দেখতে না হয়। খলিফা ও ফজল বারমাকি বসলেন। খলিফা তার ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন ফাজায়েলের দিকে। ফাজায়েলও ডান হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল খলিফার হাত। এবং বলে উঠলেন, আহ, কী মোলায়েম হাত! এ হাত এখন জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ থাকলেই ভালো। তা এবার বলুন, আমার কাছে কী উদ্দেশ্যে?

খলিফা বললেন, জনাব, মানুষের ভেতর থেকে মনের নির্জনতা কিছুতেই আর খুঁজে পাচ্ছি না। শাসনব্যবস্থায় ঠিকঠাক মনও দিতে পারছি না। আমাকে কিছু পরামর্শ দিন। আমি বড্ড পেরেশান আছি। ফাজায়েল বললেন, জনাব, আপনার দাদা ছিলেন হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর চাচা। নবিজির কাছে তিনি কোনও এক রাজ্যের নেতৃত্ব চেয়েছিলেন। নবিজি তাকে বলেছিলেন, চাচাজান, আপনাকে আপনার নিজের ওপর আমির নিযুক্ত করলাম। মনে রাখবেন, হাজার বছর প্রজাপালনের চেয়ে নিজের মনের নির্জনতা বেশি জরুরি। আপনি যখন সে যোগ্যতা অর্জন করবেন, তখনই পরম সত্তার প্রতি একনিষ্ঠ মনোসংযোগ দিতে পারবেন। জেনে রাখবেন, কিয়ামত দিবসে নেতারা অপদস্ততার মুখোমুখি হবে।

খলিফা বিমূঢ় হয়ে বসে শুনছেন। আবছায়া ঘরের ভেতর তিনি আকুল চোখে চেয়ে আছেন ফাজায়েলের দিকে। মানুষটাকে আবছা দ্যাখা যাচ্ছে। কে বলবে, এই মানুষটাই একসময়ে ডাকাতি করত! খলিফা আকুল স্বরে বললেন, আরও কিছু বলুন জনাব, আমি স্থিরতা চাই। ফাজায়েল বললেন, প্রজাপালনের সর্বোচ্চ কল্যাণকর একটি নীতি আপনাকে বলি। আপনি কি তা শুনবেন? বিনীত স্বরে খলিফা বললেন, জ্বি জনাব, বলুন। ফাজায়েল বললেন, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খেলাফতে আসীন হয়ে ডেকে পাঠালেন সালাম ইবনে আব্দুল্লাহ, রাওয়াহা ইবনে হাইয়ানসহ কয়েকজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে। খলিফা তাদেরকে বললেন, আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ হয়েছে, কীভাবে তা পালন করব, আপনারা স্থির করে দিন। আমন্ত্রিতদের একজন তাকে পরামর্শ দিলেন, বৃদ্ধ মুসলমানদের পিতার মতো, যুবকদের ভাইয়ের মতো, ছোটদের সন্তানের মতো, আর নারীদের মা ও বোনের মতো জানবেন। এ নীতি যদি একজন নেতা মেনে চলতে পারেন, তবেই তিনি কিয়ামত দিবসে অপদস্ততা থেকে রেহাই পাবেন। হারুন-অর-রশিদ বললেন, দয়া করে আরো কিছু বলুন জনাব। আপনার কথা শুনে মনে আমি শান্তি পাচ্ছি। ফাজায়েল বললেন, রাজ্যকে নিজের পরিবার, আর প্রজাদের তার সদস্য মনে করবেন। এ বড় কঠিন আত্মত্যাগ। আমার আশঙ্কা হয়, আপনার সুন্দর কোমল এ চেহারা জাহান্নামের আগুনে বিভৎস হয়ে যায় কীনা। কর্মফল দিবসে বহু শাসক জাহান্নামের খোরাক হবে।

কান্নায় ভেঙে পড়লেন খলিফা হারুন-অর-রশিদ। মাথা নিচু করে তিনি বসে আছেন। চোখের পানিতে তার দাঁড়ি ভিজে গেছে। বুকের ভেতরে তার কাঁপছে। হায়, কীভাবে তিনি দাঁড়াবেন সেদিন তার আমলনামা নিয়ে? তার কাঁধে হাত রাখলেন ফাজায়েল। বললেন, আল্লাহকে ভয় করুন জনাব। কিয়ামত দিবসে জবাবদিহিতার জন্যে সবসময়েই তৈরি থাকুন। সেদিন প্রতিটি প্রজার খুঁটিনাটি ব্যাপারেও আল্লাহর কাছে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। কোনও রাতে যদি একজন প্রজাও অনাহারে অনিদ্রায় রাতশেষে আপনার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে নালিশ করে, তাহলে আপনার বিপদ আছে। হাউমাউ কেঁদে উঠলেন খলিফা হারুন-অর-রশিদ। তার আত্মার শেকড় ধরে কেউ যেন নাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি থত্থর কাঁপছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ফজল বারমাকি বলে উঠলেন, দরবেশ, আপনি যে খলিফাকে মৃতপ্রায় করে ফেললেন। এবার ক্ষান্ত দিন। মৃদু ধমকের স্বরে ফাজায়েল তাকে বললেন, তুমি চুপ থাকো হামান। তুমি আর তোমার লোকেরাই খলিফার সর্বনাশ করছ। আমি তার সর্বনাশ করছি না। কাঁদতে কাঁদতে খলিফা বললেন, ফজল, তিনি তোমাকে হামান বলার মানে কি জানো? আমাকে তিনি ফেরাউন মনে করেন। একটু থেমে ফাজায়েলকে তিনি বললেন, জনাব, কারও কাছে কি আপনার ঋণ আছে? ফাজায়েল জবাব দিলেন, হ্যাঁ আছে। খলিফা জিগেশ করলেন, কার কাছে? ফাজায়েল জিগেশ করলেন, তার আগে বলুন কেন আপনি একথা জিগেশ করছেন। খলিফা বললেন, আমি আপনার ওই ঋণ পরিশোদ করে দিতে চাই। আপনার প্রতি এটা আমার প্রেম। আরকিছু নয়। ফাজায়েল বললেন, হ্যাঁ, ঋণ আমার আছে, তবে তা কোনও মানুষের কাছে নয়। আল্লাহর কাছে। আরসব মানুষের মতো আমাকেও তিনি তার প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। প্রতি মুহূর্তেই তার নেয়ামত আমি ভোগ করে চলেছি। এই ঋণ কি আপনি পারবেন শোধ করে দিতে? জবাব নেই খলিফার মুখে। হতবিহ্বল হয়ে কিছু সময় বসে থেকে পকেট থেকে কাপড়ের ছোট্ট একটি থলে বের করে রাখলেন ফাজায়েলের পায়ের কাছে। ফাজায়েল জিগেশ করলেন, এতে কি আছে? খলিফা জবাব দিলেন, এক হাজার দিনার। এগুলো সম্পূর্ণ হালাল। আমার মায়ের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে এ দিনারগুলো আমি পেয়েছি। কোনোরকম সংশয় ছাড়াই আপনি এগুলো গ্রহণ করতে পারেন। ফাজায়েল আক্ষেপের স্বরে বললেন, আফসোস, আমার উপদেশ আপনার কোনও কাজেই এলো না। আপনার বোঝা হালকা করতে এতক্ষণ আমি যা যা বললাম, তার কোনও দামই আপনি দিলেন না। উল্টো এখন আমার বোঝা বাড়াতে চাইছেন। উঠে দাঁড়ালেন ফাজায়েল। এগিয়ে গেলেন দরজার কাছে। খলিফা উঠলেন। চলো ফজল, আমাদের এবার উঠতে হবে।

দরজা বন্ধ করে কোরআন পড়তে বসলেন ফাজায়েল ইবনে আয়াজ। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে ঘরটাতে ছড়িয়ে পড়ল সুরেলা ধ্বনি। অপকর্মকারীরা কি মনে করে যে, তাদেরকে আমি পুন্যবান ও ঈমানিদের মধ্যে গণ্য করব? ভোর হলো। জেগে উঠল মহল্লা। কিছু সময় ঘুমোলেন ফাজায়েল। ঘুম থেকে উঠে গোছল শেষে বসলেন বারান্দায়। বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। গাছে গাছে পাখি। এসবই গভীর ধ্যানীর চোখে দেখছিলেন ফাজায়েল।
আব্বা? আব্বা?
ঘাড় ফেরালেন তিনি। দেখলেন তার আদরের ছেলেটি এসে বসল তার পাশে। তিনি ছেলেটির মাথা টেনে নিলেন তার বুকে। আদর করতে লাগলেন। ছেলেটি একসময়ে জিগেশ করল, আব্বা, আপনি কি আমাকে খুব ভালোবাসেন? ফাজায়েল জবাব দিলেন, হ্যাঁ বাবা। খুবই ভালোবাসি। ছেলেটি এবার জিগেশ করল, আব্বা, আল্লাহকেও তো আপনি ভালোবাসেন, তাই না? ফাজায়েল বললেন, হ্যাঁ, তাকেও ভালোবাসি। ছেলেটি বলল, একজন মানুষ হয়ে এতজনকে কীভাবে ভালোবাসা সম্ভব? ছেলের মুখের দিকে কিছু সময় চেয়ে রইলেন ফাজায়েল। এতটুকু বাচ্চা, অথচ কী গভীর দার্শনিক প্রশ্ন তার মুখে! একটু অবাক হলেন ফাজায়েল। বললেন, শোনও বাবা, জন্মের আগে আমি ছিলাম আল্লাহর কাছে। মৃত্যুর পরও তার কাছেই চলে যাব। মাঝখানে পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকি, তুমি আমার ছেলে। তোমার দুই বোন আমার মেয়ে। তোমাদের আম্মা আমার স্ত্রী। এরকম অনেক প্রেমের সম্পর্কে আমি জড়িয়ে আছি। এ সম্পর্ক খুবই ক্ষণস্থায়ী। আর তাই, আমার পরম ভালোবাসা আল্লাহর প্রতি। তোমাদের প্রতি যা, তা ক্ষণস্থায়ী। অবশ্যই তা আল্লাহর চেয়ে বেশি নয়। তুমি কি বুঝতে পেরেছো বাবা আমার কথা? ছেলেটি বলল, জি আব্বা, আমি বুঝতে পেরেছি।

ফাজায়েল দেখলেন, রাস্তা দিয়ে কয়েকটা উট নিয়ে এক বণিক চলেছে। উটের পিঠে সওদা। লোকটি বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। একটু সময় পরে উটগুলো দাঁড় করিয়ে বণিক তার দিকে এগিয়ে এলো। সামনে এসে জিগেশ করল, আপনিই কি সেই লোক যিনি একসময়ে ডাকাতের সর্দার ছিলেন? মুহূর্তে মাথা নত হয়ে গেল ফাজায়েলের। সহসা জবাব তিনি দিতে পারলেন না। পাশে বসে ছেলেটিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়ে আছে তার মুখের দিকে। বেশ কিছু সময় পর মাথা তুলে তিনি বললেন, জি জনাব, আপনি ঠিকই চিনেছেন। আমিই সেই অপকর্মকারী। বণিক বললেন, লোকমুখে শুনেছি, আপনি নাকি এখন দরবেশ হয়ে গেছেন। তা খুশির কথা। একসময়ে ডাকাতি করে আপনি আমাকে প্রায় সর্বশান্ত করে ছেড়েছিলেন। সত্যিই যদি আপনি দরবেশ হয়ে থাকেন, তবে আমার মালামাল এখন ফেরত দিন। শান্ত স্বরে ফাজায়েল জিগেশ করলেন, আমার তো এখন স্মরণে নেই, আপনার কাছ থেকে কী পরিমান মালামাল আমি ছিনিয়ে নিয়েছিলাম। কীভাবে এখন তা আমি পরিশোধ করব? বণিক কী যেন ভাবলেন। এরপর বললেন, ঠিকাছে, আমি তাহলে হিসেবটা মিলিয়ে একটু পরে আবার আসছি। এই বলে বণিক চলে গেল। কিছু সময় পরই ফিরে এলো। তার হাতে একটি থলে। থলেটি ফাজায়েলের হাতে দিয়ে বণিক বলল, আমার টাকার পরিমান এই থলের ওজন সমান। হাতে নিয়ে দেখুন। ফাজায়েল থলেটি হাতে নিয়ে ওজন দেখলেন। এবং গভীর ভাবনায় পড়লেন। মুখে কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়ল তার। এতগুলো টাকা এখন কীভাবে তিনি পরিশোধ করবেন? ফ্যাসফেসে স্বরে তিনি বললেন, ভাই, আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিন। এই ওজনের টাকা এখন তো আপনাকে আমি দিতে পারছি না। তবে আমি কথা দিচ্ছি, কয়েকদিন পরে অবশ্যই আমি এ টাকা আপনাকে পরিশোধ করব।

বণিক বলল, ঠিকাছে, আপনাকে সময় দিচ্ছি। এবার আমার থলে ফেরত দিন। থলে হাতে নিয়ে বাঁধন খুলতেই হা হয়ে গেল বণিকের মুখ। সোনা! চোখ কপালে তুলে সে বলল, জনাব, আপনি প্রকৃতই একজন দরবেশ। আমি শুনেছি, প্রকৃত দরবেশের হাতের ছোঁয়ায় মাটিও সোনা হয়ে যায়। আপনাকে পরীক্ষা করতে তাই আমি থলে ভর্তি মাটি নিয়ে এসেছিলাম। হাতে হাতে ফল পেয়েছি। থলের সব মাটি সোনা হয়ে গেছে। এই দেখুন। ফাজায়েল দেখলেন। এবং অবাক হয়ে গেলেন। দেখল ছেলেটিও। সেও অবাক। বণিক এবার ফাজায়েলের পায়ের কাছে বসে পড়ে দু’হাত জড়ো করে বলল, জনাব, আপনি এখন আমাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করুন। আমি একজন ঈহুদি। ফাজায়েল হাত ধরে তাকে ওঠালেন। বললেন, সকল প্রশংসা আমার পালনকর্তা আল্লাহর। আলোর পথে আপনাকে স্বাগতম। বলুন, লা ইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)। বণিক পাঠ করলেন কালিমা তাইয়িবা। তার অন্তঃকরণে মুহূর্তেই জ্বলে উঠল আলো। অপার্থিব আলো। এই আলো এরআগে কখনও আর বণিক তার ভেতর দেখতে পায়নি। সে চলে যেতে পা বাড়ালো। ফাজায়েল ডাক দিয়ে বললেন, ভাই, তোমার থলের সোনা তো নিয়ে যাও। বণিক মুখ ফিরিয়ে বলল, যে রত্নখনি বুকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি, তার কাছে ওই থলের সোনা কিছুই নয়। হায়, এসত্যি এতদিন কেন বুঝিনি! আর কিছু না বলে বণিক চলে গেল। পেছন ফিরেও তাকালো না।
 
থলের দিকে চেয়ে ছেলেটি বলল, আব্বা, সোনাগুলো এখন কি হবে?
থলেটা হাতে নিয়ে একটু সময় ভাবলেন ফাজায়েল। এরপর উঠে রাস্তার পাশে সোনাগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ফিরে এলেন। ছেলের হাত ধরে দ্রুত ঢুকে গেলেন বাড়ির ভেতর। ছেলেটি ঘরে ঢুকেই আম্মাকে জানিয়ে দিল এই ঘটনা। চোখ সুরাইয়ারও কপালে উঠল। স্বামীকে জিগেশ করলেন, সত্যি নাকি? ফাজায়েল কথা বললেন না। ওপর-নিচে মাথা নাড়লেন। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে সুরাইয়া দেখল, থলে ঘিরে লোকজন জমে গেছে। তারা যে যা পারছে, নিয়ে যাচ্ছে সোনা। সুরাইয়া শুনতে পেলেন স্বামীর কণ্ঠস্বর, জানলা বন্ধ করে দ্যাও সুরাইয়া। আর ওখান থেকে সরে আসো। সাবধান, এ ঘটনা কারও কাছে প্রকাশ করো না। তাহলে আমার এতদিনের সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে।  

জানলা বন্ধ করে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সুরাইয়া জিগেশ করল, কেন? ব্যর্থ হয়ে যাবে কেন? এ ঘটনা তো আপনার ওপর আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানি। ফাজায়েল জবাব দিলেন, হ্যাঁ। কিন্তু সাধারণ মানুষ মূর্খ। তারা মনে করবে, এ বুঝি আমারই কেরামতি। মনে রেখো সুরাইয়া, একজন দরবেশ ততক্ষণ পর্যন্ত দরবেশ থাকে, যতক্ষণ তার অনুসারী তৈরি হয় না। একবার তা হয়ে গেলে দরবেশ মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ফলে সে কোরআনি বিধান ভঙ্গ করে নিজেকেই বড় করে জাহির করে। এ ধরনের আচরণ শিরক। দরবেশের উচিত, সাধারণ মানুষ থেকে তার অলৌকিকত্ব আড়ালে রাখা। থামলেন ফাজায়েল। এরপর বললেন, আমাকে ওজুর পানি দ্যাও। এ ঘটনায় আমিও বিস্মিত। এখন আমি সেজদায় লুটিয়ে পড়ব মহিমান্বিত সেই সত্তার উদ্দেশে।
পানি আনতে ইঁদারার দিকে চলে গেলেন সুরাইয়া।

বিকেল। বাইরে রোদ নরম হয়ে এসেছে। গরমে তবু তেতে আছে বাতাস। জানলার কাছে বসে কোরআন পাঠ করছিলেন ফাজায়েল। দরজায় খটখট শব্দ হলো। আয়াত শেষ করে তিনি জিগেশ করলেন, কে? জবাব এলো, আমি আহমদ ইবনে হাম্বল। ফাজায়েল উঠে দরজা খুলে দিলেন। এবং সালাম দিলেন। সালামের জবাব দিলেন আহমদ। জিগেশ করলেন, আমি কি একটু আপনার সঙ্গে সময় কাটাতে পারি? ফাজায়েল খপ করে একটি হাত ধরলেন আহমদ হাম্বলের। বললেন, ভেতরে আসুন। আপনার মতো বিদ্বান মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের। বসলেন তারা মুখোমুখি। আহমদ জিগেশ করলেন, জনাব, আমায় বলুন তো, আল্লাহর প্রেমের শীর্ষ পর্যায়ে মানুষ কখন পৌঁছতে পারে? ফাজায়েল জবাব দিলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু পাক বা না-পাক, মানুষ যখন আল্লাহর প্রতি একই মনোভাব পোষণ করে, তখনই সে আল্লাহর প্রেমের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। কথা শুনে হাম্বল খুশি হলেন। বললেন, বাহ, চমৎকার বলেছেন তো। আপনার সঙ্গে সময় কাটানোর এই হচ্ছে আনন্দ। এবার আমায় একটা পরামর্শ দিন তো ভাই। ফাজায়েল জিগেশ করলেন, কী ব্যাপারে, বলুন। আহমদ বললেন, আমি হজ্ব করতে চাই। কিন্তু একটি ব্যাপারে আমার অন্তরে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখন আপনার পরামর্শ চাই। ফাজায়েল জিগেশ করলেন, কীসের ভয়?

আহমদ বললেন, ভয় পাচ্ছি যে, যখন আমি উচ্চারণ করব, হে আল্লাহ আমি উপস্থিত হয়েছি (লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক), তখন যদি আল্লাহ আমাকে জবাব দেন, না, তুমি উপস্থিত হওনি। ফাজায়েল বললেন, যার অন্তরে এ ভয় থাকে, সে ব্যক্তিই হজ্বের জন্যে উপযুক্ত। কিন্তু আফসোস, বেশিরভাগ হাজি মুখেই বলে লাব্বায়েক, অন্তরে তা লালন করে না। কিছু সময় কথা জুটল না আহমদের মুখে। ফাজায়েলের মুখের দিকে চেয়ে থেকে তিনি বললেন, ধন্যবাদ ভাই, আপনি আমার অন্তরের পেরেশানি দূর করে দিলেন। ফাজায়েল বললেন, সবকিছুই ঘটে আল্লাহর নির্দেশে। মনে রাখবেন, যে মানুষ আল্লাহর হয়ে যায়, জাগতিক মানুষ তাকে হেয় চোখে দ্যাখে। জাগতিক মানুষের কাছে জগতের আরাম-আয়েশই বড়, আর আল্লাহর কৃপাধন্য মানুষ আল্লাহর প্রেমেই শান্তি পেয়ে থাকে। আহমদ এবার জিগেশ করলেন, কিছু মনে করবেন ভাই, আপনার কোনও অনুসারী নেই? তাদের কাউকে তো এখানে দেখছি না। ফাজায়েল থমথমে মুখে বললেন, ভাই আহমদ, একটা কথা সবসময়ে মনে রাখবেন, কোরআন আর সুন্নাহ ছাড়া কোনও ব্যক্তির অনুসরণ ধ্বংস ডেকে আনে। আমি তাই অনুসরণীয় হই না। আমাকে কেউ অনুসরণ করতে চাইলে তাকে কোরআন-হাদিসের অনুসরণ করতে পরামর্শ দিই।
আহমদ জিগেশ করলেন, আমায় বলুন তো, সুখি হওয়ার উপায় কি? ফাজায়েল জবাব দিলেন, খুবই সহজ। যা আছে, তাতে সন্তুষ্ট থাকা। আহমদ বললেন, ধন্যবাদ ভাই। আমার ভেতর তৈরি হওয়া বেশ কিছু দ্বন্দ্ব আপনি ভেঙে দিলেন। আল্লাহ আপনার ওপর সন্তুষ্ট থাকুন। এবার আমায় অনুমতি দিন, আমি উঠব। উঠে দাঁড়ালেন ফাজায়েল। জি ভাই, আসুন। আল্লাহ হাফেজ।
আল্লাহ হাফেজ। চলে গেলেন আহমদ ইবনে হাম্বল।

তিন.
রাতের নিঃসীম অন্ধকার নেমে এসেছে মক্কা নগরীতে। রাস্তায় লোক চলাচল নেই। মরুভূমির দিক থেকে ছুটে আসছে তপ্ত হাওয়া। আকাশে ঝুলছে একফালি চাঁদ। জ্বলজ্বল করছে তারা। বারান্দায় বসে আছেন ফাজায়েল। চেয়ে আছেন আকাশের অনন্ত সীমায়। তার ভাবনায় তখন বিস্ময়। কত বিপুল এই মহাবিশ্ব। আদি-অন্ত নেই। ওই যে কোটি কোটি নক্ষত্র, এসবেরও নেই সীমা-পরিসীমা। অনন্ত এ মহাবিশ্বে কত ক্ষুদ্র এই পৃথিবী নামের গ্রহ। মহাবৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের দিকে তাকালে বিস্ময়ে থ হয়ে যেতে হয়। কত ক্ষুদ্র মানুষ! জন্ম নিচ্ছে, আবার মরেও যাচ্ছে। মানুষের বেঁচে থাকার সময়কাল চোখের পলকমাত্র।

আত্মমগ্ন হয়ে বসে আছেন ফাজায়েল। দূরে কোথাও ডেকে যাচ্ছে কুকুর। আর কোনও শব্দ নেই। বেশ রাত হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুরাইয়াও এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তার দিক থেকে আবছা অন্ধকারে কেউ যেন তার বাড়ির দিকে হেঁটে আসছে। নড়েচড়ে বসলেন ফাজায়েল। কাছাকাছি এসে লোকটা সালাম জানালো। ফাজায়েল জবাব দিয়ে জিগেশ করলেন, কে? লোকটা বলল, জনাব, আমি সুফিয়ান সাওরি। ফাজায়েল উঠে দাঁড়ালেন। ইনি সম্মানীত একজন দরবেশ। হাত বাড়িয়ে দিয়ে ফাজায়েল বললেন, উঠে আসুন জনাব। কিন্তু আমায় বলুন তো, এত রাতে আমার বাড়িতে আপনার আগমনের হেতু কি? সুফিয়ান বললেন, আজকের রাতটি আমি আপনার সান্নিধ্যে কাটাতে চায়। দয়া করে আমায় নিরাশ করবেন না। একটু সময় ভাবলেন ফাজায়েল। এরপর বললেন, দেখুন জনাব, আল্লাহর প্রেমের রাজ্যে একা থাকাই কার্যত নিরাপদ। একথা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। সুফিয়ান বললেন, জি, তা আমি জানি। তবে আপনার সান্নিধ্যে একটা রাত কাটানো আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে। এ ইচ্ছে পূরণেই আমি অনেক দূর থেকে হেঁটে আপনার কাছে এসেছি। সুফিয়ান সাওরির হাত ধরে ফাজায়েল বললেন, বেশ, তবে ঘরে চলুন।

ঘরে গিয়ে প্রদীপ জ্বাললেন ফাজায়েল। এরপর খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বললেন, বসুন ভাই। সুফিয়ান বসলেন। তিনি দেখলেন, এই পাটি, একটা জায়নামাজ আর কোরআন-হাদিসের বইপত্র ছাড়া ঘরটায় আর কিছু নেই। খোলা জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকে প্রদীপের শিখা তিরতির কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সুফিয়ান সাওরির মুখোমুখি বসলেন ফাজায়েল। বললেন, রাতের সময়টাই আমি আনন্দে থাকি, বুঝলেন ভাই। কেননা, এ সময়ে নীরবে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়া যায়। দিনের আলোয় তা সম্ভব হয় না। তখন লোকজন আসা-যাওয়া করে। মনে রাখবেন, এমন নির্জনবাস ভালো যেখানে আপনি লোকজন দেখতে পাবেন না। নির্জনতাকে যে অপছন্দ করে, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে ভালোবাসে, প্রকৃত শান্তি থেকে সে দূরে সরে যায়। সুফিয়ান জিগেশ করলেন, কিন্তু এমন দ্যাখা যায় যে, বিদ্বান ব্যক্তিদের কাছে মানুষের যাতায়াত ঘটে বেশি। ফাজায়েল বললেন, ঠিকই বলেছেন। তবে ওইসব বিদ্বান ব্যক্তি কেবলমাত্র আমল সম্পর্কিত কথাবার্তাই বলে, নিজেরা তা আমল করে না। বলতে পারেন, সাধারণ মানুষের মুর্খতার সুযোগ নিয়ে তারা মানুষকে প্রতারিত করে। মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, তার কথা বলার শক্তি লোপ পায়। সুফিয়ান বললেন, বাহ, চমৎকার বলেছেন জনাব। কিন্তু এসব ব্যক্তি তো সর্বদা গরিবি অবস্থায় জীবন-যাপন করে। ফাজায়েল বললেন, হ্যাঁ। এর কারণ, আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন তার ওপর নানা রকমের বিপদ তিনি দ্যান। আর আল্লাহর প্রতি যে শত্রুতা পোষণ করে, আল্লাহ তাকে পৃথিবীতে সুখে-শান্তিতে রাখে। বিশ্বাসীদের পুরস্কার তো পৃথিবীতে নয়, আখেরাতে দেয়া হবে। সুফিয়ান জিগেশ করলেন, জনাব, দেখেছি যে, জ্ঞানী ব্যক্তি একা একা থাকেন। মানুষের সঙ্গে খুব একটা তারা মেশেন না। এর কারণ কি? ফাজায়েল বললেন, দেখুন ভাই, আল্লাহর দেয়া সবকিছুরই যাকাত আছে। আত্মার যাকাত হচ্ছে চিন্তা করা। জ্ঞানী মানুষ নির্জনে থেকে এ যাকাতই আদায় করে। লোকজনের ভেতর থেকে সে আত্মার মুখোমুখি হতে পারে না। আত্মার গহীন সমুদ্রে ডুব না দিলে চিন্তার মনিমানিক্য আপনি কীভাবে খুঁজে পাবেন? ঘাড় নাড়লেন সুফিয়ান, একদম খাঁটি কথা। আচ্ছা বলুন তো, মানুষের সবচে বড় অর্জন কি? ফাজায়েল বললেন, পৃথিবীতে সবচে বড় জ্ঞান হচ্ছে আল্লাহকে জানা। যে মানুষ আল্লাহকে জেনেছে তার মুখ দিয়ে অনর্থক কথা বের হতে পারে না। ষড়রিপুকে সে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এটাই মানুষের সবচে বড় অর্জন। মনে রাখবেন, পৃথিবী একটি পাগলাগারদ। এখানে বসবাসকারীরা পাগল। কারাগারে যেরকম কয়েদিদের হাতে-পায়ে শেকল থাকে, তেমনই পৃথিবীবাসী মানুষ পৃথিবীর মায়াজালে বন্দি। অথচ দেখুন, মানুষ কত বড় নির্বোধ। সে ভুলে যায় পৃথিবী হচ্ছে আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। এখানে যা সে উপার্জন করবে, আখেরাতে সে তা-ই পাবে। কমও নয়, বেশিও নয়। আল্লাহ মহান বিচারক। সুফিয়ান জিগেশ করলেন, জনাব, সুফি-দরবেশদের বিষয়ে আপনার কী ধারণা? ফাজায়েল বললেন, কে দরবেশ? শুনুন ভাই, তিনটে জিনিস কখনও খোঁজ করবেন না। কেননা, তা পাবেন না। এক. এমন জ্ঞানী যার জ্ঞান ও আমল সমান। দুই. এমন দরবেশ যিনি কথা ও কাজে সমান। তিন. এমন সঙ্গী যে সম্পূর্ণ আপনার মনের মতো। সুফিয়ান বলে উঠলেন, সে কী কথা! আমি তো জানি দরবেশরা আল্লাহর খুবই আপনজন। ফাজায়েল বললেন, হ্যাঁ, তা বটে। এ ধরনের দরবেশরা আত্মগোপনে থাকেন। আমরা যে দরবেশদের দেখি, তারা সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসে। প্রকৃত দরবেশ কখনোই লোকসম্মুখে কোনও কেরামতি প্রকাশ করবেন না। আর সাধারণ মানুষ এমন যে, কেরামতি না দেখলে দরবেশ হিশেবে তারা কাউকে স্বীকৃতিও দ্যায় না। মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি নিজেকে সম্মানিত মনে করে, সে বিনয়ী নয়। দরবেশ সে, যে বিনয়ী। সুফিয়ান জিগেশ করলেন, কেরামতি বিষয়ে কিছু বলুন। ফাজায়েল বললেন, কোনও মানুষের পক্ষে অলৌকিক কিছু ঘটানো সম্ভব নয়। যা ঘটে তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই ঘটে। এটা আত্মার গূঢ় সাধনা, লোক জানানো কোনও ব্যাপার নয়। সুফিয়ান বললেন, আচ্ছা, আমায় বলুন তো, প্রকৃত বীরের বৈশিষ্ট্য কি? ফাজায়েল জবাব দিলেন, আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীর কারও কাছে সাহায্যের আশা না করাই প্রকৃত বীরের বৈশিষ্ট্য।

কথায় কথায় রাত পেরিয়ে যেতে থাকে। প্রদীপ নিভে গেছে অনেক আগেই। পাতলা অন্ধকারে ঢেকে আছে ঘর। খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের ফিকে আলো এসে ঘরের অন্ধকার একটু আবছা করে তুলেছে। এরই মধ্যে চলতে থাকে দুজনের কথাবার্তা। নিঃসাড় রাত একসময়ে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের সুললিত ধ্বনি। রাস্তার দিক থেকে মানুষের টুকরো-টাকরা কথা শুনতে পাওয়া যায়। উঠলেন দুই দরবেশ। ওজু করে ফজরের নামাজ পড়লেন। এরপর সুফিয়ান বললেন, জনাব, এবার আমায় যেতে অনুমতি দিন। আপনার সান্নিধ্যে রাতটি খুবই কল্যাণকর ও শুভ হলো। আজকের রাতটি আজীবন আমার স্মরণে থাকবে। ফাজায়েল প্রতিবাদের স্বরে বললেন, না জনাব, রাতটি দুজনের কারও জন্যেই শুভ হয়নি। অবাক হলেন সুফিয়ান। জিগেশ করলেন, একি বলছেন! সারারাত আমরা জ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। আপনার কথা থেকেই আমি অনেক কিছুই শিখেছি। এরপরও বলছেন রাতটি আমাদের কারও জন্যে শুভ হয়নি। মানে কি আপনার এ কথার? ফাজায়েল বললেন, দেখুন, দুজন মানুষ যখন একান্তে বসে কথা বলে তখন দুজনের কথাতেই থাকে পরস্পরকে খুশি করার ঝোঁক। এ অবস্থা আত্মার নিজস্বতা নষ্ট করে। এরচে আমরা যদি আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত থাকতাম, তবেই বলতে পারতাম, রাতটি আমাদের জন্যে শুভ হয়েছে।  
ফাজায়েলের একটি হাতে চুমু খেয়ে সুফিয়ান বললেন, সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর। আপনি জনাব প্রকৃতই একজন দরবেশ। আমি এবার চলি। আল্লাহ হাফেজ। হাত তুললেন ফাজায়েল, আল্লাহ হাফেজ জনাব। পরম দয়াময় আপনার কল্যাণ করুন।

চার.
বাড়িতেই কেটে যায় সময়। খুব বেশি দরকার না পড়লে ফাজায়েল ইবনে আয়াজ বাইরে বের হন না। রাস্তাঘাটে হাটে-বাজারে সব জায়গাতেই মানুষের কোলাহল। চলছে জীবনের দর কষাকষি, হইচই, ঠুনকো একটু স্বার্থের সংঘাতে খুনোখুনি। মানুষ ভুলেই গেছে, পৃথিবীতে সে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি। প্রতিনিধির বিশেষ দায়িত্ব থাকে। প্রতিটি মানুষের রয়েছে এ দায়িত্ব। অথচ বেশিরভাগ মানুষ তা ভুলে গেছে। তারা উদাসীন। এই উদাসীনতা যার ভাঙে, ঠিক সে মুহূর্তেই মানুষটি আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্জন করে বিশেষ করুণা। এরপর ধাপে ধাপে আল্লাহ তাকে হেদায়েত দিয়ে থাকেন। হেদায়েতের বিশেষ একটি পর্যায়ে পৌঁছে নির্জনবাসেই ফাজায়েল এখন শান্তি খুঁজে পান। এদিকে হাতের সঞ্চয় ফুরিয়ে গেছে। দরজা থেকে সংসারের ভেতরে হামুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে অভাব। স্বাভাবিক তবু পরিবারটির জীবনযাপন। যা নেই, তা নেই। যা আছে, তা আছে। অভাব, তবু বিষাদের ছায়া নেই পরিবারের কারও মুখে। এমনও রাত যায়, প্রদীপ জ্বালানোর তেলটুকু থাকে না। অন্ধকার তমিস্রার ভেতরও আত্মার আলোয় রাঙানো থাকে পাঁচটি প্রাণী। নির্জনে দু’হাত তুলে ফাজায়েল আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করতেন, হে আল্লাহ, প্রায়ই দিন তুমি আমাকে অনাহারে রাখো। এমনকি, রাতে ঘরে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থাও তুমি রাখো না। এ অবস্থা তো তোমার প্রিয়জনদের বিশেষত্ব। জানি না, আমার কোন কাজের জন্যে আমাকে তুমি এ মর্যাদা দান করেছো। আমি তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।

একদিন বিকেলবেলা। ফাজায়েল হাঁটতে বের হলেন। অনেকদিন ঘরে বসে থাকতে থাকতে কী রকম যেন জড়তা এসে গেছে দেহমনে। হাঁটতে হাঁটতে এরাস্তা-সেরাস্তা ঘুরে বাড়ির পথ ধরলেন। একটি মসজিদের সামনে দিয়ে তিনি হাঁটছিলেন। থমকে দাঁড়ালেন। মসজিদের বারান্দায় বসে একজন কোরআন পাঠ করছে। কী সুরেলা স্বর! কানে যেন কেউ মধু ঢেলে দিচ্ছে। বেশ কিছু সময় তিনি দাঁড়িয়ে মধুর স্বাদ গ্রহণ করলেন। পাঠ শেষ করে লোকটা উঠল। ফাজায়েল এগিয়ে গেলেন। সালাম জানালেন। তাকে দেখতে পেয়ে লোকটি বিনয়ে জবাব দিলেন, ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনি ক্যামন আছেন জনাব? ফাজায়েল বললেন, জি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি ভাই। এতক্ষণ আপনার কোরআন পাঠ শুনলাম। চমৎকার আপনার গলা। আপনি যদি আমার ছেলের শিক্ষক হিসেবে একটু সময় দ্যান তো আমার ছেলেটির বিশেষ উপকার হয়। লোকটি বলল, অবশ্যই জনাব। এ তো আমার সৌভাগ্য। এ সুযোগে আপনার সান্নিধ্যেও কিছু সময় থাকা যাবে। আজ মাগরিব বাদ আমি আপনার বাড়িতে আসছি।
ধন্যবাদ ভাই।
ফাজায়েল বাড়িতে ফিরে এলেন। মাগরিবের নামাজ শেষে হাফেজ এলেন। বসলেন ছেলেকে নিয়ে। ফাজায়েল গিয়ে বসলেন বারান্দায়। অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। রাস্তায় লোক চলচলও কমে গেছে। ঘর থেকে ভেসে আসছে হাফেজের মধুর স্বর। তিনি পাঠ করছেন সুরা কারিয়াহ।

১.    মহাপ্রলয়।
২.    মহাপ্রলয় কি?
৩.    এ প্রলয় বিষয়ে কি তুমি জানো?
৪.    সেদিন মানুষ হবে ছড়ানো-ছেটানো পতঙ্গের মতো।
৫.    পর্বতগুলো হবে ধূনিত রঙিন পশমের মতো।
৬.    যার পাল্লা ভারি হবে,
৭.    এ সময় সে শান্তির জীবনে থাকবে।
৮.    যারা পাল্লা হালকা হবে,
৯.    তার জায়গা হবে হাবিয়াহ।
১০.    এটা কি তুমি জানো?
১১.    এটা খুবই উত্তপ্ত আগুন।

তীব্র একটি আর্তচিৎকারে ভেঙে পড়ল অন্ধকারের নির্জনতা। চারদিক কেঁপে উঠল। কী হলো জানতে ফাজায়েল ঘরে গেলেন। দেখলেন, হাফেজের সামনে মেঝেতে পড়ে আছে তার প্রাণহীন দেহ। মহাপ্রলয়ের বর্ণনা তার ছোট্ট ছেলেটি সইতে পারেনি। ফাজায়েলের সারামুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। বিড়বিড় করে তিনি উচ্চারণ করলেন, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য। এবং তার কাছেই ফিরে যাব। হাফেজ অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন ফাজায়েলের মুখের দিকে। তিনি জিগেশ করলেন, জনাব, কিছু মনে করবেন না। শুনেছি, তিরিশ বছর আপনাকে কেউ হাসতে দ্যাখেনি। কিন্তু আজ আমি আপনার মুখে হাসি দেখলাম। রহস্য কি? ফাজায়েল বললেন, আল্লাহর সন্তুষ্টিতে আমার সন্তুষ্টি। আমি বুঝলাম যে, আমার ছেলের মৃত্যুতে আল্লাহ সন্তুষ্ট। তাই আমিও সন্তুষ্ট। হাসি হচ্ছে আমার আত্মার সন্তুষ্টির প্রকাশ।

সময় চলে যায় মহাকালের রথের চাকায়। তারই ঘূর্ণনে কত কত বদল ঘটে সৃষ্টিজগতে। আজকের চারাগাছ কয়েকদিন পরেই লকলকিয়ে গাছ হয়ে ওঠে। এরকম ঢের বয়েস হয়ে গেল ফাজায়েল ইবনে আয়াজের। কোনও এক মধ্যযামিনীতে তিনি বুঝলেন, মৃত্যুর ফেরেস্তা জিবরাইল (আ.) তার কাছে আগমন করছেন। তার মাথার কাছে বসে আছেন সুরাইয়া। দু’পাশে দুই মেয়ে। প্রায় নিভু নিভু স্বরে ফাজায়েল বললেন, শোনও সুরাইয়া, মৃত্যুকে কখনও ভয় পেয়ো না। মৃত্যু খুবই সহজ একটি বিষয়। যদি নিজে তুমি পৃথিবীতে সহজ জীবন কাটিয়ে আসতে পারো। আমার মৃত্যুর পর মেয়েদের নিয়ে তুমি যাবে আবু কোবায়েস পাহাড়ে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, এতদিন আমরা মেয়ে দুটোকে রক্ষণাবেক্ষণ করেছি। এখন আমি তাদের দায়িত্ব আপনার ওপর সোপর্দ করলাম।... লা ইলাহা ইল্লাল লা হু মুহাম্মাদুর রাসুল্লাহ (স.)। শেষনিঃশ্বাস ছাড়লেন ফাজায়েল। দেহের খুব ভেতর থেকে মুহূর্তে একটা ঝাঁকি খেলেন সুরাইয়া। কেঁপে উঠল মেয়ে দুটোও। বাইরে তখন ঊষার পাপড়ি খুলে উঁকি দিচ্ছে নতুন সূর্য।

মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে সুরাইয়া উঠলেন আবু কোবায়েস পাহাড়ে। দু’হাত তুলে প্রার্থনা করতে লাগলেন, হে আল্লাহ, আমার স্বামীর নির্দেশমতো আমি আপনার দরবারে প্রার্থনা করছি। এতদিন আমরা মেয়ে দুটোর দেখাশুনা করেছি। এখন থেকে তাদের দায়িত্ব আপনার।
কী দৈব! ওই পথ দিয়ে কয়েকজন সৈন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন ইয়েমেন বাদশাহ। দুই কিশোরীসহ এক নারীকে প্রার্থনারত দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হলেন তিনি। জনমানবশূন্য এমন এক জায়গায় এরা কারা?
কাছাকাছি গিয়ে তিনি নামলেন ঘোড়ার পিঠ থেকে। প্রার্থনা শেষ করে সুরাইয়া তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। বাদশা ও সৈন্যদের দেখে সে ও মেয়েরা একটু জড়সড় হয়ে গেল। বাদশাহ জিগেশ করলেন, আপনারা কারা আম্মাজানেরা? এখানে কি করছেন? সুরাইয়া জবাব দিলেন, আমি দরবেশ ফাজায়েল ইবনে আয়াজের স্ত্রী। আর এরা আমাদের দুই মেয়ে। বাদশাহ চমকে উঠলেন। সে কী! শুনেছি যে, তিনি মারা গেছেন। কিন্তু আপনারা এখানে কি করছেন? সুরাইয়া বললেন, ওদের বাবার নির্দেশমতো আল্লাহর হাতে মেয়ে দুটোকে সোপর্দ করতে এখানে এসেছি। আমারও বয়েস হয়ে এসেছে। আমি আর ক’দিন। এদিকে তারাও বিবাহের বয়েসী হয়ে উঠেছে। ৎ
কী যেন খানিক ভাবলেন বাদশাহ। এরপর বললেন, আল্লাহ আপনার প্রার্থনা শুনে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বোন। আমার দুই ছেলে আছে। আপনার আপত্তি না থাকলে তাদের সঙ্গে আপনার মেয়েদের বিয়ে হতে পারে। এখন আপনার কি মত? সুরাইয়া বলে উঠলেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমার কোনও আপত্তি নেই।

বাদশাহ তকখুনি দুই সৈনিককে পাঠিয়ে পালকির ব্যবস্থা করলেন। এরপর তাদেরকে নিয়ে চললেন ইয়েমেনে।