আবদুল বাহার গদ্য ‘আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ’

প্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০২০

প্রকৃতি হচ্ছে সেই অবস্থা, সেই বাস্তবতা, যা বাহ্যত জীবন ও মৃত্যুতে বা অন্য কথায়, পদার্থসমূহের সংযোজন ও বিয়োজনে নিহিত। এই প্রকৃতি একটি অপরিবর্তনীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নির্ধারিত নিয়ম, পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলা ও সুসম্পাদিত পরিকল্পনার অধীন, যা থেকে এটা কখনোই স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হতে পারে না। বস্তুত এটা এতই নিয়মাধীন যে, যদি মনোযোগ পূর্বক ও সুদৃষ্টি সহকারে ক্ষুদ্রতম অণু-পরমাণু থেকে আরম্ভ করে সূর্যমণ্ডল বা অপর কোনো বিশাল তারকামণ্ডল ও জ্যোতিমণ্ডল প্রভৃতির অস্তিত্বসহ জগতের বৃহদাকার পিণ্ডগুলো নিরীক্ষণ করা হয়, এমনকি তাদের শৃঙ্খলা সংযোজন, আকার অথবা সঞ্চরণ পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাওয়া যায়, এরা সকলেই সর্বোচ্চ সু-শৃঙ্খলায় সন্নিবিষ্ট এবং একই নিয়মের অধীন, যা থেকে এরা কেউ কখনো স্বাধীন হতে পারে না।

কিন্তু যখন আমরা জড় প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করি, দেখি যে, এর কোনো জ্ঞান নেই, এর কোনো ইচ্ছা শক্তি নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, অগ্নির প্রকৃতি হচ্ছে দহন করা। এটা ইচ্ছা কিংবা জ্ঞান ব্যতীত দহন করে; জলের প্রকৃতি প্রবাহিত হওয়া, এটা ইচ্ছা কিংবা জ্ঞান বিহীন প্রবাহিত হয়; সূর্যের প্রকৃতি উজ্জ্বল হওয়া, এটা ইচ্ছা কিংবা জ্ঞান ব্যতীত উজ্জ্বল কিরণ বিতরণ করে; বাষ্পের প্রকৃতি উপরের দিকে উত্থিত হওয়া, এটা ইচ্ছা কিংবা জ্ঞান ব্যতীতই ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়। তাহলে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, বস্তু জগতের স্বাভাবিকত গতিবিধি বাধ্যতামূলকভাবে হয়ে থাকে। জীব সাধারণ, বিশেষত: মানুষ ছাড়া অপর কোনো বস্তুরই বিচরণে স্বাধীনতা নেই। কেবলমাত্র মানুষই প্রকৃতিকে প্রতিরোধ করতে পারে এবং এর প্রতিকূলতা করতে সক্ষম। কারণ মানুষ সকর বস্তুর গঠন প্রণালি আবিষ্কার করতে পারে, এবং এই আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রকৃতির শক্তিসমূহের উপর আধিপত্য করে। সে যে সমুদয় নতুন আবিষ্কার করেছে, বস্তুত বস্তুসমূহের উপাদান নিয়েই সেটা সম্ভবপর হয়েছে।

এর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, সে টেলিগ্রাম আবিষ্কার করেছে, এটা দ্বারা পূর্ব-পশ্চিম দেশসমূহের মধ্যে সংবাদ বিনিময়ের উপায় হয়েছে। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট হলো যে, মানুষ প্রকৃতির উপর আধিপত্য করে। এখন যখন আপনি সৃষ্ট জগতে এরূপ শৃঙ্খলা, বিধিব্যবস্থা ও নিয়মবিধি অবলোকন করেন, তখন কি আপনি এটা বলতে পারেন যে, এই সকলই প্রকৃতির প্রভাবে রয়েছে? যদিও প্রকৃতির কোনো জ্ঞান বা উপলব্ধি শক্তি নেই। যদি তা না হয়, তাহলে এটা প্রমাণিত হলো যে, এই প্রকৃতি, যার কোনো উপলব্ধি বা বোধশক্তি নেই, এটা সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহরই আজ্ঞাধীন, যিনি প্রকৃতি জগতের শাসনকর্তা; বা তাঁর ইচ্ছা, প্রকৃতি দ্বারাই তিনি তা করিয়ে নেন।

এই অস্তিত্ব জগতে যা কিছুই আবির্ভূত হয়েছে, তার মধ্যে একটির জন্য প্রকৃতির বিশেষ আবশ্যকতা রয়েছে, সেটা হচ্ছে মানব জীবন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা কররে দেখা যায় যে, মানুষ শাখা বিশেষ, আর প্রকৃতি মূল বা শিকড়; তাহলে যে ইচ্ছাশক্তি, বোধশক্তি এবং পূর্ণতা শাখাতে রয়েছে, সেটা কি মূলে বা শিকড়ে না থাকতে পারে?

সুতরাং সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো যে, প্রকৃতি তার স্বীয় স্বভাবে ঐশী মুক্তির আয়ত্বাধীন, যিনি সর্বশক্তিমান সনাতন প্রভু। তিনি প্রকৃতিকে সঠিক বিধি-ব্যবস্থা ও নিয়মের অধীনে ধারণ করে তার উপর আধিপত্য করেন।

মানুষ যে নিজেকে নিজে সৃষ্টি করিনি, শুধু তাই নয়, তার সৃষ্টিকর্তা ও তার পরিকল্পনাকারী সে নিজে ছাড়া আরেকজন, এটাই আল্লাহর অস্তিত্বের একটি প্রমাণ ও নিদর্শন। এটা নিশ্চিত ও অবধারিত যে, মানুষের সৃষ্টিকর্তা মানুষের সদৃশ নয়। কারণ একজন শক্তিহীন সৃষ্ট জীব আর একটি জীবের সৃষ্টি করতে পারে না। সৃষ্টিকারী তথা সৃষ্টিকর্তাকে সকল সর্ম্পণূতার অধিকারী হতে হবে, যাতে সে সৃষ্টি করতে পারে।

এটা কি হতে পারে যে, সৃষ্টি পূর্ণাঙ্গ সম্পন্ন এবং সৃষ্টিকর্তা অপূর্ণাঙ্গ তথা অসম্পূর্ণ? এটা কি সম্ভব হতে পারে যে, একটি চিত্র নৈপুণ্যে সর্বোৎকৃষ্ট এবং চিত্রকর তার শিল্পে অনিপুণ? অধিকন্তু, চিত্র-চিত্রকরের ন্যায় হতে পারে না, কেননা তাহলে চিত্র নিজেকে নিজে সৃষ্টি করতে পারত। একটি চিত্র যতই সম্পূর্ণ হোক না কেন, চিত্রকরের তুলনায় এটা অসম্পূর্ণতার চূড়ান্ত অবশেষ।

কোনো কিছু ঘটবার সম্ভবনা সাপেক্ষ পৃথিবী অসম্পূর্ণতার উৎপত্তি স্থল। আল্লাহ্ সম্পূর্ণতার আদি কারণ। এই জড় জগতের অসম্পূর্ণতাই আল্লাহর পূর্ণতার নিদর্শন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন আপনি মানুষের দিকে লক্ষ্য করেন, তখন আপনি বুঝতে পারেন যে, সে সহায়হীন-দুর্বল। এই অসমর্থ জীবের দুর্বলতাই সর্বশক্তিমান শাশ্বত এক আল্লাহর শক্তি সামর্থের প্রমাণ। কারণ যদি সামর্থ না থাকতো, তাহলে দুর্বলতাই কল্পনা করা যেত না। সুতরাং সৃষ্ট জীবের দুর্বলতা, ঐশী শক্তির এক নিদর্শন। কারণ যদি শক্তি না থাকতো, তাহলে সমর্থহীনতাও থাকতো না। সুতরাং এই শক্তিহীনতা থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, জগতে শক্তি বিরাজ করছে। পুনশ্চ এই পার্থিব জগতে দরিদ্র আছে, সুতরাং অপরিহার্যরূপে সম্পদও রয়েছে; জ্ঞানও অপরিহার্যরূপে বিদ্যমান, যেহেতু অজ্ঞতা দৃষ্ট হয়; কারণ যদি কোনো জ্ঞান না থাকতো, অজ্ঞতাও থাকতো না। জ্ঞানের অনস্তিত্বই অজ্ঞতা এবং যদি অস্তিত্ব না থাকতো, তবে অনস্তিত্বের উপলব্ধি হত না।

এটা নিশ্চিত যে, সমগ্র সাপেক্ষ বিশ্ব জগৎ একই বিধান, একই নিয়মের দ্বারা পরিচালিত, যা এটা কখনো লঙ্ঘণ করতে পারে না; এমনকি মানুষও মৃত্যু, নিদ্রা ও অন্যান্য অবস্থার নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়; অর্থাৎ মানুষও কোন কোন বিশেষ বিষয়ে শাসিত হয় এবং শাসিতের জন্য একজন শাসনকর্তা অপরিহার্য। কারণ অধীনতা সৃষ্ট জীবের একটি বিশেষ লক্ষণ এবং এই অধীনতা এর একটি অপরিহার্য প্রয়োজনীয় শর্ত। সুতরাং এরূপ এক স্বাধীন সত্তা হতে হবে, যার স্বাধীনতাও আবশ্যক। অনুরূপভাবে একজন পীড়িত লোককে দেখে বুঝতে পারা যায় যে, একজন স্বাস্থ্যবান লোক নিশ্চয়ই আছে; কারণ যদি একজন স্বাস্থ্যবান না থাকতো তবে তার পীড়া প্রমাণ করা যেত না।

অতএব এটা অবগত হওয়া গেল যে, এক অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান শাশ্বত পুরুষ বিদ্যমান, যিনি সকল পূর্ণতার অধিকারী। কারণ তিনি যদি পূর্ণতার অধিকারী না হন, তাহলে তাঁকে তাঁর সৃষ্ট জীবের সমতুল্য হতে হবে। অস্তিত্ব জগতের সর্বত্রই এই একই নিয়ম; ক্ষুদ্রতম সৃষ্ট বস্তু প্রমাণ করে যে, এর একজন স্রষ্টা রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এই রুটিখণ্ড প্রমাণ করে যে, এর একজন প্রস্তুতকারী আছে।

প্রশংসা আল্লাহর! ক্ষুদ্রতম বস্তুর অনস্থার সামান্য পরিবর্তনেও এর নির্মাণকারীর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। অতএব এই বিশাল অস্তিত্ব জগৎ, যা অন্তহীন তা কি নিজে নিজেই সৃষ্ট এবং পদার্থ ও পরমাণু ও উপাদাসমূহের কার্যক্রমে, অস্তিত্বে সমাগত হতে পারে? এরূপ অনুমান কতই না ভ্রান্তিপূর্ণ!

এই সমুদয় সুস্পষ্ট বিতর্ক দুর্বল চিত্তের জন্য উপস্থাপিত করা হয়; কিন্তু যদি তার অভ্যন্তরীণ পরমাত্মার উপলব্ধি খুলে যায়, তাহলে শত সহস্র সুস্পষ্ট প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়। এইরূপে যখন মানুষ তার আত্মস্থ পরমাত্মাকে উপলব্ধি করে, তখন পরমাত্মার অস্তিত্বের প্রমাণের কোনো আবশ্যকতা থাকে না। কিন্তু যারা পবিত্র পরমাত্মার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত, বাহ্যিক যুক্তি তর্কের প্রয়োজন হয়ে থাকে।